(আমার এই ফেসবুক স্ট্যাটাসটিকে নোট করে রেখে দেয়ার আসলে কিছু নেই। তবুও পোস্টটিতে লাইকের সংখ্যা আর কমেন্টের ধরন দেখে মনে হল, লেখাটি বোধ হয় ভালই হয়েছে, এটিও হারিয়ে না যাক। আমি কী লোভী, না? লোভীই তো! কেউ আমার পোস্টে লাইক না দিলে কিংবা লেখা ভাল হয়েছে, এমনটা না বললে, লিখতাম কি কখনওই? বন্ধুরা ভাল বলে, ভালোবেসে হোক কিংবা না বেসে হোক—লাইকটাইক দেয়, শেয়ার করে, আমার লেখা নিয়ে কথা বলে, শুধু সেইজন্যই লিখি। যদি কোনওদিন এমন হয়, কেউ চাচ্ছে না, আমি লিখি, সেদিন থেকে আর লিখব না। আরও অনেকের মতই, আমিও কমেন্ট, লাইক আর শেয়ারের লোভে লিখি।)
গত দুইদিনে একটা ব্যাপার খুব গভীরভাবে মনে গেঁথে গেছে। আমি খুব সম্ভবত খুব হাসিমুখে মারা যাব। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যতই যন্ত্রণা হোক না কেন, একটুও কাঁদব না, এমনকি মনখারাপও করব না। আমি এতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি, এটা কবে শেষবার মনে হয়েছিল, তা মনে নেই।
আমি অবশ্য বরাবরই অসুস্থ শরীরে হাসতে অভ্যস্ত। চারপাশের মানুষকে যন্ত্রণায় রাখার ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আমার সব কষ্টের জন্য একমাত্র আমিই দায়ী। খুব জ্বর, এই যেমন ১০৩, ফেসবুকে হাসিখুশি টাইপ লেখা দিচ্ছি, এরকমটা অনেকবারই হয়েছে। ফেসবুকে, ভাল নেই, বলে কী হয়? কিচ্ছু হয় না। কমেন্টবক্সের প্রার্থনা কমেন্টবক্সেই মিলিয়ে যায়।
বেশিদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা কখনওই আমার মধ্যে ছিল না, এখনও নেই। আসলে বেশিদিন বেঁচে কী হয়? তার চাইতে বরং হাসিমুখে সবার সাথে মিলেমিশে ছোট্ট একটা জীবন কাটিয়ে চলে যাব। বেঁচে থাকার সময়টাতে খুব করে বাঁচব, আফসোসটাফসোস থাকবে না কিংবা কম থাকবে। তবে মরে যাওয়ার সময় কিছু আফসোস থেকেই যাবে। এই যেমন, আরও কিছু বেশি বই পড়তে না পারার, আরও কিছু ভাল মুভি দেখতে না পারার, আরও কিছু ভাল সুরে ভাসতে না পারার, আরও কিছু সুন্দর জায়গায় ঘুরতে না পারার, কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসার কিছুটা হলেও প্রতিদান দিতে না পারার, আরও একটুখানি নিজের মত করে না বাঁচার, আরও কিছু কম মানুষের মনে কষ্ট দিতে না পারার, সত্যিই ভালকিছু লিখে যেতে না পারার, ভাললাগার মানুষগুলোকে ‘ভাল লাগে’ বলতে না পারার, চাকরিটা আরও একটু কম করে না করার, এরকমকিছু। হয়তোবা মৃত্যুর আগের খাবারটা খাওয়ার সময়েও কিছু ঠাট্টা করে যাব। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না। ঘুমের মধ্যে মরে গেলে বেশ হয়। আমিও কষ্ট পাব না, অন্যরাও পাবে না। সবাই ঘুম ভেঙে দেখবে, আমি নেই। মজার না? আমি বেঁচে থাকার সময়ে আমাকে নিয়ে অন্যদের কষ্ট দেখতে রাজি নই।
গত পরশু মাঝরাতে ঘাড় থেকে পিঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথায় ঘুমুতে পারিনি। ব্যাকপেইন যে কী জিনিস, সেটা, যার ওটা কখনও হয়নি, সে কিছুতেই বুঝবে না। আমার পেইনটা এর আগেও হয়েছে দুএকবার, তবে পরশুরটার মত তীব্র কোনওটাই ছিল না। আমি কায়িক শ্রম করি না অত। আমার পেইন হয়েছে স্নায়বিক কারণে। গত বৃহস্পতিবার অনেকবেশি লেখালেখি করতে গিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসেছিলাম অন্তত ১২-১৪ ঘণ্টা। কী কষ্ট কী কষ্ট! চোখের কষ্ট, স্নায়ুর কষ্ট, মনের কষ্ট, শরীরের কষ্ট! তবুও লিখতে শুরু করলে, একবার লেখার ভূত ঘাড়ে চেপে বসলে, উঠে যাওয়াটা লেখালেখির শারীরিক ও মানসিক কষ্টের চাইতেও বেশি কষ্টকর। লেখালেখি কী এক নিষ্ঠুর যাদুকর যা লেখকদের এক আশ্চর্য পৃথিবীর খোঁজ দিয়ে দেয়, যে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়ানোর নেশাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব, অথচ কীকরে সে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে হয়, তার কোনও নিয়ম সে যাদুকর কখনওই বলে দেয় না। যারা লিখে না, শুধু পড়ে কিংবা চুরি করে, ওরা এটা কোনওভাবেই বুঝবে না। লিখতে যে সে কী ভীষণ কষ্ট, সেটার কিছুমাত্র খোঁজও ওরা জানে না। সেদিন বারবারই মনে হচ্ছিল, পুরো শরীরমন অবশ হয়ে যাচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, এই বুঝি মাথাঘুরে পড়েটড়ে যাব; তবুও লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মনের খেয়ালে শরীরের দাবি মেনে না নিলে শরীর কখনও-কখনও এতটা ভীষণভাবে বিদ্রোহ করে বসে, এটা এর আগে এতটা তীব্রভাবে শেষবার কবে বুঝেছি, ঠিক মনে পড়ে না।
মজার ব্যাপার হল, পরশু রাতে ঘাড় আর পিঠের ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি, চোখের জলে বালিশ ভিজছে, অথচ আমি নিজের মনে হাসছিলাম আর শুধুই হাসছিলাম। মা-বাবা কিংবা আমার ছোটভাই কাউকেই ডাকতে ইচ্ছে করছিল না, অবশ্য আমি ওরকম ডাকিও না; মনে হচ্ছিল, কষ্টটা কেমন, দাঁতে দাঁত চেপে একটু দেখি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। খাট থেকে নেমে অ্যাটাচড বাথরুমে যেতে সময় লেগেছিল অন্তত ১৫ মিনিট। তবুও মনে হচ্ছিল, এটাও তো জীবনের একটা অংশ! জানালাটা খুলে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর ব্যথায় কাঁদছিলাম। আমার হাসিমাখা মুখ দেখে রাগেক্ষোভে কি না জানি না, শরীরটায় বিদ্রোহ একেবারে জেঁকে বসেছিল সে রাতে। এভাবে করে আর ঘুমাতে পারিনি। সকালে মা রুমে এলে হাসিমুখেই বললাম যন্ত্রণার কথা। ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। কিছু ওষুধ দিলেন, সাথে ঘাড় আর পিঠে গরম রসুন-সরিষার তেল দিয়ে ম্যাসাজ, এবং শুকনো গরম টাওয়েলের সেঁক। আমার ছোটভাইই ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল, মায়ের গায়ে এখন আর অত শক্তি নেই। ছোটভাই ম্যাসাজ করে দিচ্ছে, মা পাশে বসে আমার কপালে-চোখেমুখে চুমু খাচ্ছে, আর আমি কী এক সংকোচে অনবরত হাসছিই তো হাসছি, এরকমটা হচ্ছিল। আমার ব্যথার চাইতেও ওদের ব্যথাটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছিল আমাকে। বাবা বারবার বলছিলেন, বাবা, তুই খুলনাতে মঙ্গলবারে জয়েন করিস না, দুদিন পর কর। মা বলছিলেন, খবর্দার, ফেসবুকে বসবি না! তোকে আর কখনও কিছু লিখতে হবে না। আমার মহাফাজিল ছোটভাই বলল, আহা মা, ওকে কিছু বলো না। ও না লিখলে লোকে চুরি করবে কীভাবে? আর ও লোকজনকে গালাগালি করে মাথাটা খারাপ করবে কীভাবে? আমি শুধুই হাসছিলাম আর হাসছিলাম; মাঝেমাঝে ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে আমার ছোটভাইকে বলছিলাম, পাপ্পু, পরেরবার টাওয়েলটা ওভেনে ৩০ সেকেন্ড কম রাখবি, কেমন? চামড়া পুড়ে যাচ্ছে তো! ও বলল, চুপ থাক! তোকে এরকম খ্যাঁকখ্যাঁক করে গাধার মত হাসতে কে বলসে? (গাধা কি খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে? আমি শিওর না। একটা গাধাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জেনে নেয়া গেলে ভাল হতো।)
জীবনটা আসলেই এতটা খারাপ লাগত না যদি পরিবারকে আরও একটু বেশি সময় দেয়া যেত! খুব অসুস্থ হয়ে গেলে আর কে-ই বা পাশে থাকে? জ্বরে প্রলাপ বকতে থাকলে, পরিবার ছাড়া আর কে-ই বা কাঁদে? আর যারা আমার মত আত্মসংবৃত মানুষ, তারা তো কাউকে বলতেই পারবেন না, আপনি অসুস্থবোধ করছেন। একমাত্র আপনার পরিবারই বুঝতে পারবে, আপনি ভাল নেই। বাকিরা জানতে পারলে বরং বিরক্ত হবে, কেউ-কেউ সহানুভূতি দেখাবে অবশ্য। কেউ আমার জন্য ঝামেলায় পড়ে গেছে আর মমত্ব দেখাচ্ছে, এটা মেনে নেয়াটাও খুব কঠিন। এই যে দুদিন ফেসবুকে তেমনকিছু লিখিনি, কই তেমন কেউ তো জিজ্ঞেস করল না, আমি কেমন আছি! আসলে জীবনটা এরকমই। সবাই তো ব্যস্ত, কে কার খোঁজ রাখে? আমি নিজেও তো রাখি না অত। তবে কেউ আমার খোঁজ কেনই বা রাখবে? উল্টো সুযোগ পেলেই তো লোকজনের সাথে দুর্ব্যবহার করি। ওরা কষ্ট পায় না? ওদের কিছু-কিছু বদপ্রার্থনাও তো কবুল হয় কখনও-কখনও, নাকি? মানুষের প্রার্থনা কবুল হোক আর না হোক, বদপ্রার্থনা প্রায়ই কবুল হয়ে যায়! হায়! অসহায় হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ ভালোবাসতে শেখে না। মানুষ অসহায় হয়ে গেলে বোঝে, কাছের মানুষ কী। ভালোবাসা না পেলে কেমনটা লাগে!
এখন একটু ভাল আছি। ফেসবুকে আসতে না পারার, লিখতে না পারার, বই পড়তে না পারার কষ্ট অনেক। এমনিতে খুব ভাল আছি। পাপ্পু আমার সব কাজ করে দিচ্ছে, এমনকি আমি বারণ করা সত্ত্বেও জোর করে পরনের কাপড়টাও ধুয়ে দিচ্ছে! মা পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবা বারবার জিজ্ঞেস করছে, এখন তোর কেমন লাগছে? কেউ-কেউ জানতে পেরে ফোনে খবর নিচ্ছে। সত্যি বলছি, এসবের কষ্টও কম নয়! কার জন্য আমি কবে কী করেছি? কিছুই না! তবু কেন কেউ আমায় এমন করে ভালোবাসবে? ভালোবাসা বড় কষ্ট দেয়! ঘৃণাও এর তিল পরিমাণও দিতে পারে না। কষ্টে থেকেও কোনও অভিযোগ-অনুযোগ ছাড়া হাসতে কী যে ভাল লাগে! আমি চলে গেলে কারওর কিচ্ছু এসে যাবে না, অসুস্থতার সময় এ ভাবনা বড় আরাম দেয়। আমরা কী অদ্ভুত! যখন সুস্থ থাকি, তখন বিশ্বাস করে নিই, আমি কখনওই অসুস্থ হব না। যখন অসুস্থ থাকি, তখন মনে করতে ভাল লাগে, বুঝি আর সুস্থ হব না। মনে আছে, একবার গলা ভেঙে গিয়েছিল। এমনভাবেই যে, প্রায় দুসপ্তাহ কারওর সাথে কথা বলতে পারিনি। তখন এমবিএ চলছিল, থাকতাম আইবিএ হোস্টেলে। কথা বলতে না-পারার সে কী কষ্ট! খুব বেশি করে মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর কোনদিনও কথা বলতে পারব না। সেসময় শুধু মা ছাড়া আর কেউই আমার কথা বুঝত না। ক্যান্টিনে খেতে গেলে কাগজে লিখে দিতাম, আমি কী কী খাব। যখন কথা বলতে পারতাম, তখন কত আজেবাজে কথা বলে কথা বলতে পারার সুযোগটাকে নষ্ট করেছি, সেকথা ভেবে মনখারাপ হত। কথা বলতে পারাটাকে মনে হত, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কিছু। আসলে অসুস্থ হলে অনুভব করা যায়, এই শরীরটা কতটা দামি! যে হাঁটতে পারে না, তাকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন না, পা দুটো আমাদের শরীরের কত সুন্দর অঙ্গ!
গতকালকের সমস্ত ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেরে উঠছি আস্তে-আস্তে। এর পুরো কৃতিত্ব ডাক্তারের, আমাকে ভালোবাসে, এমনকিছু মানুষের শুভকামনার, মায়ের, বাবার, আর অবশ্যই পাপ্পুর। অসুস্থ হয়ে গেলে দুটো ভাবনা বড় বেশি পীড়া দেয়। এক। আমার জন্য আমার কাছের মানুষগুলো কষ্ট পাচ্ছে। এর চাইতে দূরের কোনও দ্বীপে চুপচাপ মরে যাওয়াও অনেক ভাল। দুই। এমন কেউ নেই, যে ফোন করে বলবে, তোমাকে যদি মেসেঞ্জারে আর একবারও অ্যাক্টিভ দেখি, একেবারে খুন করে ফেলব। কেউ যে একেবারেই বলেনি, এমনও নয়। সেটা কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। যে ভালোবাসাকে আশ্রয় দিতে পারব না, সেটাকে প্রশ্রয় দেয়াটা কি আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? ভালোবাসা বড় বেশি অপরাধী করে দেয়। ভালোবাসা এমনকিছু, যেটা না পেলে বিপদ, আর পেলে তো মহাবিপদ! মানুষ ভালোবাসার খোঁজে কাঙাল হয়ে ঘোরে, আর পেয়ে গেলে পালিয়ে বেড়ায়। যতদিন ভালোবাসা অনুভব করতে না শেখে, ততদিন মানুষ ভালোবাসা নিয়ে স্বস্তিতে থাকে। একবার ভালোবাসা দিতে আর নিতে শিখে গেলে পৃথিবীর সমস্ত অপরাধবোধ এসে সবকিছু একেবারে এলোমেলো করে দেয়!