আমি অহক। ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ছোটোবেলা থেকেই ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখেছি। এইচএসসি পরীক্ষার পরেই কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গেছি, রেজাল্টের জন্যও অপেক্ষা করিনি। আমি খুবই চুপচাপ আর লাজুক স্বভাবের ছেলে। সোশাল মিডিয়াতেও আমার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। ভেবেছি, মেডিকেলে চান্স পাবার পরেই নাহয় হবে ওসব। কোচিং শুরু করবার পর, অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। ক্লাসে অনেক মেয়েও আছে, তবে আমি মেয়েদের কারও সাথেই কথা বলি না। কোচিংয়ে প্রতিদিনই আমাদের পরীক্ষা হয়। ছেলেদের উত্তরপত্র মেয়েদের আর মেয়েদের উত্তরপত্র ছেলেদেরকে দেখতে দেওয়া হয়। একদিন আমি রুহি নামের এক মেয়ের উত্তরপত্র পেলাম। দেখলাম, অপর পৃষ্ঠার সাদা অংশে, মানে ডানদিকে একটা পুতুল আর কিছু হাঁড়িপাতিলের ছবি আঁকা। আমি দেখেই হেসে ফেললাম। আনসার মেলানোর পর দেখলাম সে মাত্র দুই পেয়েছে। সবার সামনে যখন নাম ডেকে ডেকে নম্বর বলা হবে, তখন মেয়েটা লজ্জা পাবে অনেক। এই ভেবে, আমি দুইয়ের পাশে এক বসিয়ে বারো করে দিলাম। রুহি নামটা বলে যখন ডাকা হলো, আমি মাথা নিচু করে রইলাম, তাকাতেই পারলাম না। এরকম আরও দুইদিন পরে, আবারও ওর খাতাটাই পেলাম। এবার দেখলাম, সে এঁকেছে একটা জেলে মাছ ধরছে, আর তার ছোট্ট ছেলেটা পুকুরের পাশে বসে আছে। কী এক সাধারণ, অথচ অপূর্ব দৃশ্য! সেদিন সে পরীক্ষায় পেয়েছিল ছয়, কিন্তু নেগেটিভ মারকিংয়ের কারণে নম্বর গিয়ে দাঁড়াল এক দশমিক দুই পাঁচে! হায়! এরকম একটা নম্বর কি কাউকে দেওয়া যায়? তার চেয়ে বরং শূন্য দিলেও ভালো দেখাবে। শূন্য দিতে গিয়েও দিতে পারলাম না। আবারও বারোই দিয়ে রাখলাম। সেদিনও ওর নাম ডাকার পর আমি ওর দিকে তাকাতে পারিনি, অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর অনেক দিন ওর উত্তরপত্র আর পাইনি। আমার কেন জানি না মন খারাপ লাগল। কী হলো মেয়েটার? যেহেতু ওর চেহারা চিনি না, সেহেতু ওর খোঁজও করতে পারলাম না। কয়েক দিন পরে ওর খাতা পেলাম আবার। পেছনে আঁকা ছবিটা ছিল আগেরটার চেয়েও দারুণ! এক পাশে এক ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, আর সামনে দুটো মেয়ে নাচছে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। মেয়েগুলোর আশেপাশে অনেকগুলো কৃষ্ণচূড়া ফুল ছড়ানো। সত্যিই ভীষণ মনোমুগ্ধকর একটা ছবি! মানুষ এমন করেও আঁকতে পারে! আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। একসময় দেখলাম, উত্তরপত্রের এক কোনায় খুব ছোটো ছোটো করে লেখা: ‘এই যে, দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীন, আমি কি আপনার বোন মন্নুজান? আমাকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে কে বলেছে?’ এটা পড়ে আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। কিন্তু মেয়েটা বুঝল কী করে যে আমিই সেই ছেলে, যে নম্বর বাড়িয়ে দেয়? আজকে মেয়েটা পেয়েছে শূন্য। একেবারেই শূন্য! কিছু প্রশ্নের আনসারই করেনি, আর কিছু প্রশ্নের ডবল আনসার করেছে। এই মেয়ে কি ইচ্ছে করেই নম্বর কম পেতে চায় নাকি? আমি আজকে শূন্যই দিলাম ওকে। স্যার যখন রুহি বলে ডাকলেন, মেয়েটা এগিয়ে এল। বলল, সে অসুস্থ, তাই কয়েক দিন আসতে পারেনি, আর কিছু পড়তেও পারেনি। এই প্রথম আমি সাহস করে ওর মুখের দিলে তাকালাম। আমার মনে হলো, আহা, কী মায়াবী মুখটা, একদম ওর আঁকা ছবিরই মতন! যেন এক কৃষ্ণকলি! যাবার সময় আমার দিকে কেমন করে যেন একটু তাকাল! আমি বলে বোঝাতে পারব না ওর সেদিনের চাহনির কথা। তবে তারপর থেকে আমার মনটা কেমন যেন ছটফট করত। কখনও ক্লাস মিস দিতাম না। লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখার চেষ্টাও করতাম। ওদিকে বন্ধুরা মিলে আমাকে জোরাজুরি করে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। নতুন আমি ফেইসবুকের নিয়মকানুন জানতাম না। ফ্রেন্ড-সাজেশনসে একদিন দেখলাম ‘রাবেয়া রুহি’ নামের একটা মেয়েকে। ছবিটা একপাশ থেকে তোলা, তাই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না চেহারাটা। কিন্তু প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম, এই মেয়ে ছবি আঁকে। আঁকার ধরন দেখে নিশ্চিত হলাম, এটাই সেই মেয়ে। সাথে সাথে বেহায়ার মতন ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই মেসেজ এল। - কে আপনি? - হাজী মুহম্মদ মুহসীন। - হা হা হা! - কী খবর? - ভালো। - দারুণ ছবি আঁকার হাত আপনার! - আপনার হাতও ভালো, নম্বর বাড়িয়ে দেবার। - হা হা হা…। আপনি খাতায় ভুল করেন কেন অত? ওরকম নম্বর কি কাউকে দেওয়া যায়? - আমার নম্বর পাওয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই! - মেডিকেলে চান্স পাবেন কী করে তাহলে? - পাবো না। পেতে চাইও না। দাদিমার ইচ্ছেতে কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। - আমার রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করছেন না যে? - করলাম। এভাবে টুকটাক কথা হতো আমাদের ফেইসবুকে। আস্তে আস্তে প্রেম হয়ে গেল দুজনের। যা হয় আরকি! এর কিছুদিন পর আমরা দেখাও করলাম, ঘুরে বেড়ালাম শহরজুড়ে। দেখতে দেখতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দিন এগিয়ে এল। পরীক্ষা দিলাম দুজনে। মেধাতালিকায় দুজনের কারুরই নাম এল না। রুহি তো শুধু নামেমাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু আমি যে অনেক পড়াশোনা করেছিলাম! আমার স্বপ্নই তো ওই একটা। রেজাল্টের পর আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। রুহি অনেক বুঝিয়েছে আমাকে, অনেক সাপোর্ট দিয়েছে সে সময়। এরপর রুহি একটা সরকারি কলেজে জুওলজিতে ভর্তি হয়ে গেল, আর আমাকে জোর করে দ্বিতীয়বার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিল। ওর একটা কথা আমার শক্তিকে নতুন করে জাগ্রত করে তুলল। সেটা হচ্ছে: ডাক্তার তুমি হবেই হবে! আমি গভীররাতে এই একটাই প্রার্থনা করি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। জানোই তো, গভীররাতের প্রার্থনা কখনও বৃথা যায় না! আমি আবার শুরু করলাম পড়াশোনা, আরও বেশি মনোযোগী হয়ে, আরও বেশি পরিশ্রম করে পড়তে লাগলাম। অবশেষে আবারও পরীক্ষা দিলাম। এবার নিশ্চিত ছিলাম যে চান্স আমি পাবোই পাবো। রেজাল্ট বের হলো। আমি চান্সও পেলাম। তবে মেধাতালিকায় একটু পেছনের দিকে থাকায় আমার চান্স হলো কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে। সেটা নিয়ে আবারও মন খারাপ হলো। কিন্তু এটা ভেবে খুব শান্তি পেলাম যে সত্যি সত্যিই আমার স্বপ্নটা এবার পূরণ হলো। আজ থেকে আমি আসলেই একজন মেডিকেল-স্টুডেন্ট! একটা সাদা অ্যাপ্রোন, একটা স্টেথোস্কোপ! আমার নামের সামনে ডাক্তার লেখা থাকবে, আর মাত্র পাঁচ বছর পরেই! কত কত মানুষের ভরসার একটা কাঁধ হবো এই আমি অহক! আমার সমস্ত শরীরে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। জলদি রুহিকে ফোন করলাম। - হ্যাঁ, বলো। - আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, রুহি। - হুঁ, জানি। কনগ্রাচুলেশনস! - সন্ধ্যায় বের হবে আজকে? - কেন? - ওমা, সেলিব্রেট করব না? - আচ্ছা, আসব। - রুহি, উপরওয়ালার পরে তুমিই ছিলে আমার সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা। আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। তোমার জন্যই তো আজকের সব কিছু! তোমাকে আমি ভালোবাসি। আমি ভেবেছি… - আচ্ছা, শোনো, আমার খালাত ভাই ঢাকা মেডিকেলে পঞ্চান্নতম হয়েছে। ওই যে আমার বান্ধবী ছিল না, যূথী? ও সলিমুল্লাহতে সেকেন্ড পজিশনে আছে। আমরা নিশ্চিত যে ও ঢাকা মেডিকেলে আসতে পারবে। কারণ যারা চান্স পায়, সবাই-ই তো আর মেডিকেলে পড়ে না, অনেকেই অন্য জায়গায় চলে যায়। আর আমার প্রতিবেশী যে মেয়েটা, সীমা, ওরও বুয়েটে হয়েছে, যদিও শেষের দিকে থাকার কারণে কেমিক্যাল বা ওই ধরনের কিছু একটা পাবে। তবুও চান্স পেয়েছে, এটাই বড়ো কথা। আমি বুঝতে পারছিলাম না, রুহি এসব অবান্তর কথা কেন আমাকে বলছে! এসব আমাকে বলার মানেটা কী! - এই দেখো, তোমার ডাক্তার প্রেমিক তোমার সামনেই বসে আছে! - হুঁ, দেখছি। - এবার বাসায় বলে দাও না সব কিছু, রুহি! দুটো খুশির খবর একসাথেই শুনুক সবাই! - তুমি ডাক্তার হবে, আমরা সবাই-ই এতে খুব খুশি। কিন্তু আসলে অহক, আমি ভেবেছিলাম, তুমি ঢাকা মেডিকেলেই চান্স পাবে। আর ওটা ভেবেই আমি এতদিন… - ডাক্তার তো ডাক্তারই, রুহি! - তবুও ঢাকা মেডিকেল তো আলাদা একটা কিছু, তাই না? আসলে অহক… রুহিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বাড়ি ফিরে আসে অহক। ফিরেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে ও। ও কখনও ভাবেইনি যে জীবনের এত বড়ো সুখ আর এত বড়ো দুঃখ ও একই দিনে পাবে। প্রচণ্ড কষ্ট হয় ওর রুহিকে ছাড়া থাকতে। ও রুহির আঁকা ছবিগুলো দেখে, আর চোখের জল মোছে সারাক্ষণ। ওর বন্ধু রিফাত ওর আর রুহির ব্যাপারটা জানত। রিফাত ওর বাসায় এল ওকে অভিনন্দন জানাতে। - দোস্ত, আমি ভাবতেই পারছি না, তুই ডাক্তার হয়ে গেছিস! অনেক অনেক শুভকামনা রে তোর জন্য। বাই দ্য ওয়ে, রুহির কী খবর? - জানি না রে। আমরা আলাদা হয়ে গেছি। - কী বলিস? - আমি ওকে ভুলে যেতে চাই। - কী করে পারবি? - ওর ভোররাতের প্রার্থনা যদি আমাকে ডাক্তার বানাতে পারে, তবে আমার ভোররাতের প্রার্থনাও ওকে আমার মন থেকে ঠিকই মুছে ফেলতে পারবে। কিছু কিছু দুঃখ থাকে, যা পেলেই বরং মানুষ সুখী হবার পথে এগিয়ে যায়! কিছু কিছু সুখ থাকে, যা পেলেই বরং মানুষ অসুখী হবার পথে এগিয়ে যায়! হয়তোবা, এসব মেনে নিয়ে বাঁচার নামই জীবন!