অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৫৮



সাধারণ জ্ঞানে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় আলাদা থাকে, তাই বৃত্তি-ব্যাপ্তির পরে ফল-ব্যাপ্তি লাগে; কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানে যে-চেতনা জানে, সে-ই ব্রহ্ম, আর যা জানা হচ্ছে, সে-ও ব্রহ্ম। ফলে আলোর বাইরে আলাদা কোনো জানার ছবি নেই—আলো নিজের মধ্যেই মিশে যায়, আলোর সঙ্গে আলোর মিলন ঘটে। যেমন আয়না ময়লা থাকলে মুখ বিকৃত দেখা যায়, কিন্তু আয়না পরিষ্কার হলে “মুখ দেখা” শেখাতে হয় না—পরিষ্কার হলেই দেখা হয়ে যায়। ব্রহ্মজ্ঞানও তেমনই; কোনো অতিরিক্ত ধাপ লাগে না।

সুরেশ্বর আচার্য বলেন, ব্রহ্মজ্ঞান স্বপ্রকাশ; এটি বাহ্য আলো ধার নেয় না। “অখণ্ড-আকার-বৃত্তি” উঠলেই অবিদ্যার পর্দা নিজে থেকেই ছিঁড়ে যায়; আর কোনো প্রমাণ, যুক্তি বা নতুন ধাপ প্রয়োজন হয় না। যেমন সূর্য উঠলেই “দিন হয়েছে” এই সত্য প্রমাণ করার প্রয়োজন পড়ে না—আলোর উপস্থিতিই প্রমাণ। ব্রহ্মজ্ঞানও তেমনই; জেগে উঠলেই জেগে ওঠা নিজেই প্রমাণ।

এইভাবে সাধারণ জ্ঞানে পাত্র ধরতে গেলে ছাঁচ লাগে (বৃত্তি-ব্যাপ্তি) এবং তারপর লাগে আলো (ফল-ব্যাপ্তি); কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান-এ কোনো ছাঁচ নেই, কারণ ব্রহ্ম সীমাবদ্ধ নয়। এখানে আলোই সব—আলো উঠলে অন্ধকার নেই। সেটিই অখণ্ড-আকার-বৃত্তি—নিজেই আলো হওয়া।

যেমন রাতে মনে হলো ঘরে সাপ আছে, পরে টর্চ জ্বালিয়ে দেখলেন দড়ি—এখানে টর্চ-আলো কোনো নতুন বস্তু আনল না, শুধু ভুল ধারণা সরিয়ে দিল। ব্রহ্মজ্ঞানও তাই; এটি নতুন কিছু পাওয়া নয়, বরং যা আছেই, সেটিকে আড়াল থেকে উন্মোচিত করা।

অখণ্ড-আকার-বৃত্তি হলো সেই অন্তর্দীপ, যা অবিদ্যার পর্দা ছিঁড়ে দেয়। এখানে জ্ঞাতা-জ্ঞেয়ের ফারাক গলে যায়; জ্ঞান নিজেই জ্যোতি, আর সেই জ্যোতিই ব্রহ্ম। একবার এই আলো জ্বলে উঠলে বিভ্রম টেকে না, কারণ আলোর সামনে অন্ধকারের নিজস্ব কোনো জোরই কখনও ছিল না।

“তৎ ত্বম্‌ অসি”—এই উপনিষদীয় মহাবাক্যের গভীরতা বুঝতে গেলে জানতে হয়, অদ্বৈত বেদান্ত ভাষার মধ্যে কীভাবে দর্শনকে স্থাপন করেছে। এখানে শব্দ কেবল বাহ্য জগতের কোনো বস্তুকে নির্দেশ করছে না; বরং সেই চেতনা-অভিজ্ঞতার দিকে ইঙ্গিত করছে, যেখানে “তুমি” ও “সেই” (জীব ও ব্রহ্ম) এক অভিন্ন সত্যে মিশে যায়।

এখানে ব্যবহৃত মূল ধারণাটি হলো “লক্ষণা”—অর্থাৎ, কোনো শব্দ যখন তার সরাসরি অর্থে (বাচ্য অর্থে) প্রয়োগ করা যায় না, তখন ইঙ্গিত বা গৌণার্থের মাধ্যমে তার গভীরতর সত্য প্রকাশ করা। যেমন, কেউ যদি বলে, “গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে,” আর আমরা নদীর ধারায় দাঁড়িয়ে জল দেখছি, সেখানে শব্দ “গঙ্গা” মূলত নদীস্রোত বোঝাচ্ছে, কিন্তু যখন কেউ বলে “গঙ্গায় স্নান করো,” তখন “গঙ্গা” শব্দটি সরাসরি স্রোত নয়, বরং নদীর জলে স্নান করার স্থানের ইঙ্গিত। এটাই লক্ষণার কাজ—শব্দকে তার প্রত্যক্ষ অর্থ ছেড়ে গভীরতর কোনো অর্থে ব্যবহার করা।

মীমাংসা ও ন্যায়-দর্শন তিন প্রকার লক্ষণার কথা বলে—জহৎ, অজহৎ, এবং জহদ্-অজহৎ।

“জহৎ লক্ষণা” হলো সেই পদ্ধতি, যেখানে শব্দের মূল অর্থ সম্পূর্ণ ত্যাগ করে নতুন অর্থ গ্রহণ করা হয়। যেমন, “গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে” থেকে “গঙ্গায় বসবাস” বললে, “গঙ্গা” আর নদী নয়, নদীতীর বোঝায়—এখানে মূল অর্থ (নদী) পরিত্যক্ত।

“অজহৎ লক্ষণা”-র ক্ষেত্রে শব্দের মূল অর্থও থাকে, আবার নতুন অর্থও যোগ হয়—যেমন, “গুরুগৃহে পড়াশোনা করছি”—এখানে “গুরুগৃহ” বলতে শুধুমাত্র গুরু নয়, তাঁর পরিবার বা আশ্রমও বোঝানো হয়েছে।

আর “জহদ্-অজহৎ লক্ষণা”—যা আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণ—এটি দুই প্রান্তের মধ্যে এক সেতুবন্ধন; শব্দের বাহ্য অর্থের কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়, কিন্তু মূল সত্তা রাখা হয়, যাতে গভীর অভিন্নতা প্রকাশ পায়।

“জহদ্-অজহৎ লক্ষণা” বোঝার সহজ উদাহরণ হলো—“গঙ্গা কূলো গৃহম্‌” (গঙ্গা নদীর ঘর)। এখানে “গঙ্গা” শব্দটি নদীর প্রবাহ বোঝাচ্ছে না, আবার পুরো নদীও বাদ যায়নি; বরং নদীর তীর বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ “গঙ্গা”-র একটি অংশ—জলপ্রবাহ—ত্যাগ করা হয়েছে (এটাই জহৎ), কিন্তু নদীর অবস্থান ও প্রসঙ্গ—রাখা হয়েছে (এটাই অজহৎ)। ফলে অর্থ দাঁড়ায়—“নদীর তীরে ঘর”, যেখানে শব্দের মূল সত্তা আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণের মাধ্যমে নতুন অর্থে উদ্‌ভাসিত।

অদ্বৈত বেদান্তে “তৎ ত্বম্‌ অসি” ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও এই একই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। “তৎ” শব্দে ঈশ্বরের মায়া-উপাধি (সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান প্রভু) অংশটি ত্যাগ করা হয়, কিন্তু তাঁর চৈতন্যস্বরূপ অংশটি রাখা হয়। আবার “ত্বম্‌” শব্দে জীবের অবিদ্যা-উপাধি (দেহ-মন-ইন্দ্রিয়-সীমাবদ্ধ সত্তা) ত্যাগ করা হয়, কিন্তু তার চৈতন্যরূপ অংশটি রাখা হয়। এই আংশিক ত্যাগ ও আংশিক গ্রহণের ফলে দুই দিকের উপাধি ঝরে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে অভিন্ন শুদ্ধ চেতনা—যা কোনো ঈশ্বর বা জীব নয়, বরং উভয়ের অন্তরস্থ চৈতন্য।

এভাবে “জহদ্-অজহৎ লক্ষণা” ভাষার মধ্য দিয়ে দ্বৈততার আবরণ ছিন্ন করে অভিন্ন সত্যের দিকে নির্দেশ করে। শব্দের কাজ এখানে তথ্য দেওয়া নয়, বরং বিভাজন মোচন; ভাষা নিজের সীমা ভেঙে নীরবতায় প্রবেশ করে, যেখানে “তুমি” ও “সেই”—এই দুই শব্দ এক সত্তার প্রতিধ্বনি মাত্র হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তে “তৎ ত্বম্‌ অসি” (তুমি সেই) মহাবাক্যের ব্যাখ্যা মূলত ভাগত্যাগ-লক্ষণা নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত—এটি ভাষা, যুক্তি ও চেতনার সীমা ভেঙে মুক্তির অভিজ্ঞতায় পৌঁছানোর এক সূক্ষ্ম দার্শনিক উপায়। এখানে “তৎ” শব্দে বোঝানো হয়েছে ঈশ্বর বা পরমাত্মা, আর “ত্বম্‌” শব্দে বোঝানো হয়েছে জীব বা ব্যক্তিচেতনা। আপাতভাবে এরা এক নয়—ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, নির্ভয়, সর্বব্যাপী; জীব সীমাবদ্ধ, অজ্ঞ, দেহ ও মনের পরিধিতে আবদ্ধ। এই পার্থক্যটাই “উপাধি” বা সীমাবদ্ধতাজনিত ভেদ, যা আসলে মায়া ও অবিদ্যার কার্যফল।

বেদান্ত বলে—এই পার্থক্য বাস্তব নয়, বরং কেবল আপাত অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান। ঈশ্বর ও জীব—উভয়ের ভিতরকার সারসত্তা একটাই: চিদ্‌রূপ ব্রহ্ম, যা নিজেই স্বপ্রকাশ, স্বসিদ্ধ, অবিকার ও চিরন্তন। এই ঐক্য উপলব্ধির জন্যই “ভাগত্যাগ-লক্ষণা” ব্যবহৃত হয়—যেখানে উভয় শব্দের বাহ্য বা আক্ষরিক অর্থের উপাধিগুলি “ত্যাগ” করা হয় (ভাগ), আর অভ্যন্তরস্থ চৈতন্যস্বরূপ অংশ “রাখা” হয় (অত্যাগ)।

অর্থাৎ “তৎ” শব্দে ঈশ্বরের মায়া-উপাধি (সৃষ্টির কারণ, সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তি) ত্যাগ করা হয়, কারণ এগুলি আপাত রূপ; “ত্বম্‌” শব্দে জীবের অবিদ্যা-উপাধি (দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, অহংকার) ত্যাগ করা হয়, কারণ এগুলিও অনিত্য। উভয়ের আচ্ছাদন ঝরে গেলে যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো এক ও অভিন্ন চেতনা—যা কখনও জন্মায়নি, কখনও পরিবর্তিত হয় না, কেবল প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত অবস্থায় থাকে।

এই ব্যাখ্যার মূল উদ্দেশ্য তথ্য দেওয়া নয়, বরং “ভুল চিহ্নন” (misidentification) দূর করা। মানুষ যখন “আমি দেহ,” “আমি মন,” “আমি কর্তা,” “আমি ভোগী” এই ভ্রান্ত ধারণায় আচ্ছন্ন থাকে, তখন নিজেকে আত্মা নয়, উপাধি বলে মনে করে। “তৎ ত্বম্‌ অসি” বাক্যটি সেই ভুলটিকে চিরে দেয়—এটি বলে না “তুমি ঈশ্বর হয়ে যাবে,” বরং জানায় “তুমি সর্বদাই সেই ছিলে।”

এই পর্যায়ে ভাষা তার সাধারণ অর্থবোধক ভূমিকা হারায়—এখানে শব্দ কেবল মুক্তির সূচনা নয়, মুক্তির পথও বটে। কারণ শ্রুতি বা উপনিষদের বাক্যই একমাত্র শব্দ-প্রমাণ, যা আত্মতত্ত্বকে জাগাতে পারে। এই জ্ঞান আর কোনো প্রমাণের দ্বারা সম্পূরক নয়—এটি স্বয়ং-প্রমাণিত (svataḥ-siddha)।

সেইজন্যই শংকরাচার্য তাঁর ছান্দোগ্য উপনিষদ ভাষ্য-তে বলেন—“তৎ ত্বম্‌ অসি” বাক্যের কাজ জ্ঞান উৎপাদন নয়, বরং অবিদ্যা-নিবৃত্তি। যেমন অন্ধকার দূর হলে আলোর জন্য আর কোনো প্রমাণ লাগে না, তেমনি “তুমি সেই” উপলব্ধি একবার জেগে উঠলে পৃথক কর্তা, ভোক্তা বা ঈশ্বরের ধারণা নিজে থেকেই বিলীন হয়।

এই দৃষ্টিতে ভাষা আর যুক্তির বিষয়বস্তু নয়, বরং চেতনার দিকে নির্দেশ করা এক উপায়—যা অবশেষে নিজের কাজ শেষ হলে নিজেই লুপ্ত হয়। শব্দ নিজ সীমা ছাড়িয়ে যায়, জ্ঞানের আলোয় নিঃশব্দ হয়ে মিশে যায়। “তৎ ত্বম্‌ অসি” তখন আর কোনো বাক্য থাকে না—এটি প্রত্যভিজ্ঞা, আত্মস্মরণ, এক গভীর অন্তর্জাগরণ, যেখানে শোনা, বোঝা ও হওয়া—এই তিন ক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়।

এই অবস্থায় “তুমি” আর “তিনি” কোনো পৃথক রয়ে যায় না। যেমন তরঙ্গ বলে কিছু আলাদা থাকে না, যখন তা বুঝে ফেলা যায় যে তরঙ্গই সমুদ্র, তেমনি জীব ও ঈশ্বরও পৃথক থাকে না, যখন বোঝা যায় উভয়ই চেতনার এক অনন্ত প্রকাশ। “তৎ ত্বম্‌ অসি” সেই বোঝার মুহূর্ত, যেখানে বাক্য পরিণত হয় অভিজ্ঞতায়, অভিজ্ঞতা পরিণত হয় নীরবতায়, আর নীরবতা নিজেই সত্যের উচ্চারণ হয়ে ওঠে।

“তৎ” শব্দে ঈশ্বরের যে-মায়া-উপাধি (মায়াশক্তির দ্বারা সীমিত সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান চৈতন্য), এবং “ত্বম্” শব্দে জীবের যে-অবিদ্যা-উপাধি (অবিদ্যার দ্বারা সীমিত ব্যক্তিগত চেতনা)—এই দুই উপাধি পরিত্যাগ করলে যে সাধারণ সারটি অবশিষ্ট থাকে, সেটিই হলো শুদ্ধ চিত্‌, বা অপরিমেয় চেতনা। এই চৈতন্যে ঈশ্বর ও জীবের কোনো ভেদ থাকে না।

তাই “তৎ ত্বম্‌ অসি” কোনো প্রস্তাবনা বা বর্ণনা নয়; এটি এক “উপাধি-বোধ-ছেদন”—যেখানে শব্দের কাজ তথ্য দেওয়া নয়, বরং মিথ্যা বিভাজন সরিয়ে দেওয়া। ঠিক এই ছেদন-মুহূর্তেই জন্ম নেয় “অখণ্ড-আকার-বৃত্তি”—এক অনন্য অন্তর্জ্যোতি, যেখানে জ্ঞান আর জ্ঞেয় পৃথক থাকে না।

এই ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতর স্তরে এসে “অবিদ্যা”র আশ্রয় নিয়ে শাস্ত্রীয় বিতর্কে নতুন সূক্ষ্মতা দেখা যায়। প্রশ্ন ওঠে—এই অবিদ্যা আসলে কোথায় অধিষ্ঠিত? কে তার আশ্রয়, আর কাকে সে আচ্ছন্ন করছে? একে বলা হয় “আশ্রয়-অনুপপত্তি”—অর্থাৎ অবিদ্যা কোথায় অবস্থান করে, তা নির্ধারণের জটিলতা।

ভামতী আচার্যের মতে, অবিদ্যার আশ্রয় হলো জীব, কারণ জীবই অভিজ্ঞতার ধারক; মায়ার প্রভাব অনুভব করে ব্যক্তিই, তাই আশ্রয়ও ব্যক্তিসত্তাই। কিন্তু বিবরণ আচার্যের যুক্তি ভিন্ন—তিনি বলেন, অবিদ্যা তো ব্রহ্মকেই আচ্ছন্ন করে, তাই আশ্রয়ও ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না; যদি জীব ও ব্রহ্মকে আলাদা ধরা হয়, তাহলে তো দ্বিত্ব স্বীকার করতে হয়, যা অদ্বৈতের মূল নীতি নষ্ট করে।

ফলে উভয় মত এক সংযত সংশ্লেষে এসে মিলে—বিষয় (যাকে অবিদ্যা ঢেকে রাখছে) হলো ব্রহ্ম, আর আশ্রয় (যার অন্তরে অবিদ্যা অবস্থান করছে) হলো জীব। তবে অবিদ্যা যেহেতু অনির্বচনীয়—অর্থাৎ তা না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব—তাই এই ভাষাও আপাত। জ্ঞান উদিত হলে, অর্থাৎ যখন “অখণ্ড-আকার-বৃত্তি” প্রজ্জ্বলিত হয়, তখন এই দুই দিকের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যায়।

জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে যে কথনভিত্তিক পার্থক্য, তা কেবল অবিদ্যা-স্থিত চেতনার দৃষ্টিতে সত্য; জ্ঞান-দৃষ্টিতে তা বিলীন। তখন বোঝা যায়—“তৎ ত্বম্‌ অসি” কোনো শিক্ষণ নয়, বরং এক অনির্বচনীয় প্রত্যভিজ্ঞা—তুমি-ই সেই, যাকে জানার চেষ্টা করছিলে; জানার চেষ্টাই যখন থেমে যায়, জানা সম্পূর্ণ হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে জীব ও ঈশ্বরের আপাত-ভেদ ব্যাখ্যা করার জন্য দুইটি প্রধান তাত্ত্বিক রীতি গড়ে উঠেছে—অবচ্ছেদবাদ (Avaccheda-vāda) এবং প্রতিবিম্ববাদ (Pratibimba-vāda)। এই দুই ধারাই মূলত একই সমস্যার সমাধান খুঁজছে: যদি ব্রহ্ম এক, অভিন্ন ও অচল হয়, তবে “জীব” ও “ঈশ্বর” এই দুইয়ের ভেদ আমরা কেন অনুভব করি? এই ভেদের মায়িক উৎস বোঝানোর জন্যই দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে।