যখন এই বোঝাপড়া কেবল ধারণা হয়ে না থেকে জীবন্ত উপলব্ধি তথা অপরোক্ষ-অনুভূতি হিসেবে জেগে ওঠে, তখন “বন্ধন” এবং “মুক্তি”র দ্বিমুখীতা নিজের ভরেই ভেঙে পড়ে। মোক্ষ তখন অর্জনের বস্তু নয়, স্বীকৃতির দ্যুতি—যা ছিল, আছে, থাকবে—তারই অনাবৃত উপস্থিতি। জীবন্মুক্ত এই স্বীকৃতির সরলতায় থাকেন—সাক্ষী হিসেবে, অক্লান্ত নয়, অচঞ্চল নয়, বরং চিত্ত-শুদ্ধি দ্বারা স্বচ্ছ; বাসনা নিভে গিয়ে দগ্ধ-রজ্জুর মতো হয়ে আছে—রূপ আছে, বাঁধন নেই; কর্ম ঘটে, কিন্তু লোকসংগ্রহ মাত্র—স্বতঃস্ফূর্ত, ফলত্যাগী, অহম্-মমতা-বর্জিত।
প্রারব্ধ-কর্ম দেহের গতি টিকিয়ে রাখলেও ভেতরে তিনি অকর্তা—কর্তৃত্বের কোনো মোহ নেই, ভোক্তৃত্বের কোনো দাবি নেই। কার্য তার শরীর-মন-যন্ত্রে প্রকাশ পায়, কিন্তু আত্মা অপ্রভাবিত—আশ্রিত নয়, সংযুক্তও নয়। চলার এই বাকি শ্বাস ফুরোলে কিছু ঘটে না—কোনো রূপান্তর নেই, কোনো যাত্রাপথ নেই, কোনো আগমন বা প্রস্থান নেই—শুধু বিদেহমুক্তি: উপাধির শেষ তরঙ্গ থেমে যাওয়া, সীমাবদ্ধতার শেষ ছায়ার শান্ত নিবিড় অবসান।
এখানে তত্ত্বগুলো নিজেরাই তাদের কাজ শেষ করে নামতে থাকা মই—বিবর্ত-বাদ পথ দেখিয়েছিল, পরিবর্তন আপাত; বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদ শিখিয়েছিল, প্রতিফলন মূলকে স্পর্শ করে না; অবচ্ছেদ-বাদ জানিয়েছিল, সীমা কেবল উপাধির ছায়া; এখন ওরা সবাই নীরবে সরে দাঁড়ায়। অবিদ্যা, মায়া, উপাধি—এই তিন নামে চলা একই ছায়া—সূর্যোদয়ে আঁধার যেমন মিলায়, তেমনি বিলীন। অবশিষ্ট থাকে একমাত্র অসীম, চিদানন্দ-রূপ—স্বয়ং-আলোকিত, সর্বব্যাপী, অবিভাজ্য।
এই উপস্থিতিকে জানার জন্য দ্বিতীয় কোনো জ্ঞাতা নেই, বোঝার জন্য কোনো ভাবনা নেই, বলার জন্য কোনো শব্দ নেই। শ্রুতি যাঁকে পারমার্থিক-সত্তা বলে—তাঁকেই দেখা যায় একমাত্র বাস্তবতা হিসেবে; এর তুলনায় ব্যাবহারিক এবং প্রাতিভাসিক কেবল খেলা—উঠে এসে নীরবে মিলিয়ে যাওয়া ঢেউ—যা অবশেষে সত্তার অবিচ্ছিন্ন নীরবতায় নিজে নিজে থেমে যায়: ব্রহ্মৈব সত্যম্, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।
ব্রহ্মৈব সত্যম্ (ব্রহ্ম + এব + সত্যম্)
ব্রহ্ম: পরম সত্তা, চূড়ান্ত বাস্তবতা, অপরিবর্তনীয়, অসীম, এবং সর্বব্যাপী চেতনা।
এব: কেবল/নিশ্চিতভাবে।
সত্যম্: সত্য/বাস্তব।
অর্থাৎ, ব্রহ্মই কেবল সত্য (বা চূড়ান্ত বাস্তবতা)।
জগন্মিথ্যা (জগৎ + মিথ্যা)
জগৎ: দৃশ্যমান বিশ্ব/জাগতিক অস্তিত্ব।
মিথ্যা: মিথ্যা/অবাস্তব/মায়া (আপেক্ষিক বাস্তবতা)।
অর্থাৎ, এই জগৎ মিথ্যা (বা আপেক্ষিকভাবে সত্য)।
জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ (জীবঃ + ব্রহ্ম + এব + ন + অপরঃ)
জীবঃ: স্বতন্ত্র আত্মা/ব্যক্তিগত চেতনা।
ন অপরঃ: ভিন্ন নয়।
অর্থাৎ, জীব (ব্যক্তিগত আত্মা) ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছু নয় (অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্ম একই), যা মূলত অষ্টম শতাব্দীর মহান দার্শনিক আদি শঙ্করাচার্যের শিক্ষাকে ধারণ করে, যিনি অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান প্রচারক।
এই স্তরে এসে আর কোনো তর্ক বা খণ্ডনের প্রয়োজন থাকে না, কারণ সত্য এখানে নিজেই জেগে ওঠে। যেমন ঘুম থেকে জেগে উঠলেই স্বপ্নের সব দৃশ্য আপনাআপনি মুছে যায়, তেমনি আত্মজ্ঞান উদয় হলে জগৎ, দেহ, মন—সব দাবিই নিঃশব্দে বিলীন হয়। তখন “আমি জানি”, “আমি করি”, “আমি ভোগ করি”—এইসব ধারণা ভেঙে পড়ে। জ্ঞাতা আর জ্ঞেয়, প্রমাতা আর প্রমেয়—সব মিলেমিশে যায় একটিমাত্র চেতনার মধ্যে। আর সেই চেতনা চিরকালই যেমন ছিল, তেমনি থাকে—অবিকল, অনাবদ্ধ, অজন্মা। সে কখনও জন্ম নেয়নি, তাই কখনও বন্ধনেও পড়ে না, মুক্তিও তার কোনো নতুন অবস্থা নয়; সে সর্বদা মুক্ত।
এই জ্ঞানের মুহূর্তে “আমি কর্তা”-র জায়গা নেয় “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি-ই ব্রহ্ম। অহংকারের গিঁট খুলে যায়, অন্তরের আয়না থেকে কুয়াশা সরে যায়, আর চিদাভাস—যে ছিল প্রতিফলন—নিজের উৎসকে চিনে ফেলে, বুঝতে পারে সে-ই আসল আলোক। জগৎ তখনও আছে, নাম-রূপের খেলাও চলছে, কিন্তু দেখা বদলে যায়। এখন সব কিছু দেখা যায় এক নতুন দৃষ্টিতে—যেখানে প্রতিটি রূপ, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি কর্ম ব্রহ্মেরই এক প্রকাশ, এক লীলা। যেমন তরঙ্গকে তরঙ্গ বলেও সমুদ্র হারায় না, তেমনি জগৎকে জগৎ বলেও ব্রহ্ম অপরিবর্তিত থাকে।
এই নীরব জাগরণে প্রমাণ, প্রমাতা আর প্রমেয়—তিনটি সীমানা গলে এক হয়ে যায়। তখন মহাবাক্যগুলো—“তৎ ত্বম্ অসি”, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”, “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম”, “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”—আর শুধু উচ্চারণ নয়, হয়ে ওঠে নিঃশ্বাসের মতো স্বাভাবিক সত্য, অস্তিত্বের ছন্দ। তখন বোঝা যায়, মোক্ষ কোনো ভবিষ্যতের লক্ষ্য নয়, কোনো সাফল্যও নয়—এ তো কেবল সেই পর্দা সরে যাওয়া, যার নিচে চিরকাল এই মুক্ত আকাশই জ্বলজ্বল করছিল, নিঃশব্দে, অবিচল, অনন্ত।
শঙ্করোত্তর আচার্যগণ—যেমন প্রকাশাত্মা, বাচস্পতি মিশ্র, চিৎসুখাচার্য, বিদ্যারণ্য প্রমুখ—অবিদ্যা বা অজ্ঞানতত্ত্বকে আগের তুলনায় অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
শঙ্করের মতে, অবিদ্যা একপ্রকার অন্ধকার, যা আত্মার স্বপ্রকাশকে আড়াল করে রাখে; কিন্তু পরবর্তী ব্যাখ্যাকারগণ দেখান—এই অবিদ্যা একমাত্র নয়, এর দুটি স্তর আছে। একটিকে বলা হয় মূল-অবিদ্যা (Mūlāvidyā)—এটি সর্বজনীন, সর্বব্যাপী এবং মহাজাগতিক স্তরে কার্যকর। এটি সেই শক্তি, যা প্রত্যেক জীবের মধ্যে একইভাবে আত্মপ্রকাশকে ঢেকে রাখে। এর কাজ হলো আবরণ—যেমন আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক মেঘের ছায়া পুরো পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়। তাই আকাশ, সূর্য ও মাটি—সবই আসলে আছে, কিন্তু মেঘের আবরণে তারা অদৃশ্য বলে মনে হয়।
অন্যদিকে তূলা-অবিদ্যা (Tūlāvidyā) বা ব্যক্তিগত অবিদ্যা কাজ করে একেবারে ব্যক্তির স্তরে। তূলা অবিদ্যা হলো সেই অসংখ্য অজ্ঞান, যা প্রতিটি স্বতন্ত্র জীবকে আবদ্ধ করে রাখে এবং তাদের ব্যক্তিগত বন্ধন, সুখ-দুঃখ এবং পুনর্জন্মের কারণ। এটি ব্যক্তিগত মন, বাসনা, সংস্কার ও পূর্ব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে প্রতিটি জীবের জন্য আলাদা আলাদা বাস্তবতার রূপ তৈরি করে। যেমন, একই সূর্যের আলো প্রতিটি জানালার রঙিন কাচে পড়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙে প্রতিফলিত হয়—কোথাও তা লাল, কোথাও নীল, কোথাও সবুজ। সূর্য এক, আলো এক, কিন্তু প্রতিফলন ভিন্ন। তেমনি চৈতন্য এক, কিন্তু প্রতিটি জীবের মন বা অন্তঃকরণের গঠন অনুযায়ী সেই চৈতন্যের প্রতিফলনও ভিন্ন। ফলে একই ব্রহ্মচেতনা বিভিন্ন জীবের মধ্যে বিভিন্ন জগত, অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা ও অনুভূতির রূপে প্রকাশিত হয়।
প্রকাশাত্মা আচার্যের বক্তব্য হলো—আবরণ এক, কিন্তু বিক্ষেপ বহু। অর্থাৎ আত্মাকে ঢেকে রাখা অজ্ঞানতার মূল একটাই, কিন্তু সেই আচ্ছাদনের ফলে যে বিভ্রান্তি বা প্রক্ষেপণ তৈরি হয়, তা প্রত্যেক জীবের ক্ষেত্রে আলাদা। অন্যদিকে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেন—অবিদ্যা আসলে জীবেরই আশ্রিত, কারণ “আবৃত” বলেই যে অভিজ্ঞতা হয়, সেই অভিজ্ঞতাকারীই অবিদ্যার কেন্দ্র। যদি জীব না থাকে, তবে “অবিদ্যা” বলারও অর্থ থাকে না।
এইসব আলোচনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক সিদ্ধান্ত গড়ে ওঠে—অবিদ্যা “অনাদি” হলেও “অনন্ত” নয়। অর্থাৎ, এর কোনো শুরু নেই, কিন্তু এর শেষ আছে। শুরু নেই, কারণ অবিদ্যা মানেই সময় ও কারণের ধারণা; আর সময় নিজেই অবিদ্যা-নির্মিত। কিন্তু এটি চিরস্থায়ী নয়, কারণ জ্ঞান উদিত হলেই এটি লুপ্ত হয়। যেমন অন্ধকারের নিজের কোনো ইতিহাস নেই—প্রদীপ জ্বালানো মানেই অন্ধকারের বিলোপ। তেমনি আত্মজ্ঞান জন্ম নিলেই অবিদ্যা স্বয়ং বিলীন হয়।
এইজন্যই অবিদ্যাকে বলা হয় “অনির্বচনীয়” (Anirvacanīya)—অর্থাৎ তাকে “সত্য” বা “মিথ্যা”—কোনোটিই বলা যায় না। সত্য নয়, কারণ এটি চিরস্থায়ী নয়; মিথ্যা নয়, কারণ জ্ঞানের আগ পর্যন্ত এটি অভিজ্ঞতায় উপস্থিত। কিন্তু এটি “বাধযোগ্য” (Bādhyā)—অর্থাৎ জ্ঞান উদিত হলেই এটি বাধিত বা পরাজিত হয়, যেমন সূর্য উঠলে রাতের আঁধার সরে যায়।
এভাবে অদ্বৈত বেদান্ত অবিদ্যাকে এক অনন্য দার্শনিক অবস্থান দেয়—এটি বাস্তবও নয়, অবাস্তবও নয়; বরং এমন এক মধ্যবর্তী সত্তা, যা যতক্ষণ জ্ঞান-আলো অনুপস্থিত, ততক্ষণ টিকে থাকে, আর জ্ঞান জেগে উঠলেই নিঃশব্দে নিজে থেকেই লুপ্ত হয়।
অবিদ্যা কেবল এক নিষ্ক্রিয় অন্ধকার নয়, বরং এর একটি নির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতি আছে—এটি “অবিদ্যা-বৃত্তি-ভাব” নামে পরিচিত। এখানে “বৃত্তি” শব্দটি মন বা চিন্তার সাধারণ স্পন্দন (যেমন আনন্দ-বৃত্তি, রাগ-বৃত্তি ইত্যাদি) অর্থে নয়; বরং এটি বোঝায় অবিদ্যার কার্যকরী অবস্থা, অর্থাৎ অবিদ্যা কীভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করে, সেই প্রক্রিয়া।
অবিদ্যার কাজ দুইটি প্রধান শক্তি দ্বারা চালিত—আবরণ-শক্তি ও বিক্ষেপ-শক্তি।
আবরণ-শক্তির কাজ হলো আত্মার স্বরূপকে আড়াল করে রাখা, যেন এক সর্বব্যাপী পর্দা, যা সর্বত্র টানানো আছে। এই পর্দা না থাকলে, আত্মার জ্যোতি সরাসরি প্রতীয়মান হতো, এবং জগৎ বলে কোনো বিভ্রম থাকত না।
অন্যদিকে, বিক্ষেপ-শক্তি হলো সেই শক্তি, যা নাম, রূপ ও কর্মের বহুরূপ জগৎকে প্রক্ষেপণ করে—যেন সেই পর্দার ওপর আলো ফেলে নানা নকশা আঁকা হচ্ছে। আবরণ সর্বজনীন, এক, অথচ বিক্ষেপ বহু—প্রত্যেক জীবের চিত্ত, বাসনা, সংস্কার, অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিক্ষেপের আকার আলাদা। তাই আকাশ এক হলেও, প্রতিটি মনের পর্দায় প্রপঞ্চ-জগতের চিত্র ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতীয়মান হয়। প্রকাশাত্মা আচার্যের উদাহরণে, এটি যেন একটি বিশাল সাদা পর্দায় অসংখ্য প্রজেক্টর একসঙ্গে কাজ করছে—পর্দা এক, কিন্তু প্রতিটি প্রজেক্টর আলাদা আলাদা দৃশ্য দেখাচ্ছে।
এরপর ভাষ্যকারেরা ব্যাখ্যা করেন, জ্ঞান কীভাবে এই পর্দা ছিঁড়ে দেয়। এখানে আসে “বৃত্তি-ব্যাপ্তি” ও “ফল-ব্যাপ্তি”-র ধারণা।
সাধারণ জ্ঞানে (যেমন কোনো বস্তু দেখা বা চিনতে পারা) দুটি ধাপ কাজ করে—প্রথমে মনো-বৃত্তি সেই বস্তুর রূপ ধারণ করে, যাকে বলে বৃত্তি-ব্যাপ্তি; তারপর সেই বৃত্তিকে আত্মা-প্রকাশ আলোকিত করে, যাকে বলে ফল-ব্যাপ্তি। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি “ঘট” (পাত্র) দেখেন, তখন আপনার মনে ঘটরূপ একটি মানসিক প্রতিচ্ছবি গঠিত হয়—এটাই বৃত্তি-ব্যাপ্তি। পরে আত্মার আলো সেই প্রতিচ্ছবিকে আলোকিত করে, ফলে “আমি ঘটকে জানি”—এই অভিজ্ঞতা হয়—এটাই ফল-ব্যাপ্তি।
ব্রহ্মজ্ঞান সাধারণ জানার মতো কাজ করে না, কারণ এটি কোনো বস্তুকে জানার প্রক্রিয়া নয়, বরং ভুল জানা দূর করার এক অন্তর্দীপ।
সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মন প্রথমে কোনো বস্তুর রূপ ধারণ করে—এটিই বৃত্তি-ব্যাপ্তি। যেমন, আপনি দূরে একটি পাত্র দেখলেন, আপনার মনে তার একটি মানসিক ছবি তৈরি হলো। এরপর আত্মার আলো সেই মানসিক ছবিটিকে আলোকিত করে, তখন আপনি অনুভব করেন, “আমি পাত্রটিকে জানি”—এটিই ফল-ব্যাপ্তি। এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞাতা, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান তিনটি আলাদা থেকে যায়; জানার জন্য একটিকে জানা জিনিস হিসেবে ধরা হয়, আর অন্যটি থাকে জ্ঞানের আলো হিসেবে।
কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান এইভাবে ঘটে না, কারণ ব্রহ্ম কোনো সীমাবদ্ধ বস্তু নয়, যাকে মন কোনো রূপে ধরতে পারে। রূপ মানেই সীমা, আর ব্রহ্ম অসীম। তাই ব্রহ্মকে “ধরে” জানার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। আধো-আলোয় দড়িকে সাপ ভেবে ভুল করা যেমন একধরনের বস্তুর জ্ঞান হলেও তা ভ্রান্ত, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান বস্তুসুলভ জানা নয়—এটি ভুলটাকেই মুছে দেওয়া, সেই “সাপ”-ধারণাকে উজাড় করে দেওয়া।
যখন মহাবাক্য “তৎ ত্বম্ অসি”, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি” গভীরে প্রবেশ করে, তখন মনে এক বিশেষ জ্ঞানরূপ স্পন্দন জাগে, যাকে বলে অখণ্ড-আকার-বৃত্তি। এই বৃত্তির কোনো ছাঁচ বা সীমা নেই; তাই একে “অখণ্ড-আকার” বলা হয়। এটি কোনো আলাদা বস্তুর রূপ গ্রহণ করে না, বরং অবিদ্যার পর্দা ছিঁড়ে দেয়, যেন ঘরে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে—ঘরের জিনিসগুলো আলাদা করে “ধরা” লাগে না, অন্ধকারটাই মিলিয়ে যায়। যেমন অনেকক্ষণ ধরে একটি সমস্যার সমাধান খুঁজে হঠাৎ এক “আহা!”-বোধ জাগে, তখন নতুন কিছু ধরা পড়ে না, বরং ভুল ধারণা ভেঙে যায় এবং আসল সত্যটি নিজে থেকেই স্পষ্ট হয়—অখণ্ড-আকার-বৃত্তি ঠিক তেমনই; ব্রহ্মকে বস্তু করে ধরা নয়, ভুলটাকে গলিয়ে দেওয়া।