অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৫৬



অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে, একজন অদ্বৈতী সাধক যখন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন, তখন তিনি জীবন্মুক্তি অবস্থা প্রাপ্ত হন। তবে অদ্বৈতী জানেন, এই জ্ঞান-প্রকাশে মূল অবিদ্যা (অজ্ঞানতা) লুপ্ত হলেও, সংস্কার ও বাসনা যা জন্ম-জন্মান্তরের গাঢ় ছাপ এবং কারণ শরীরে (Causal Body) সূক্ষ্ম প্রবণতা রূপে সুপ্ত থাকে, সেগুলির জড়তা সহজে দূর হয় না। এই অবশিষ্ট সূক্ষ্ম প্রবণতাগুলিই 'জীবন্মুক্তি' অবস্থায় টিকে থাকা প্রারব্ধ কর্মের কারণ।

এই অবশিষ্ট সূক্ষ্ম প্রবণতাগুলির জড়তা দূর করার জন্য নিদিধ্যাসনের অগ্নি (গভীর ধ্রুব-স্মরণ বা নিরন্তর ধ্যান) প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় সংস্কারগুলি ধীরে ধীরে দগ্ধ হয়। অন্তরের এই অন্তঃশুদ্ধি বা ভেতরের সংস্কারমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকেই চিত্তশুদ্ধি বলা হয়। এই চিত্তশুদ্ধি মুক্তি থেকে আলাদা কোনো দ্বিতীয় বস্তু নয়; এটি হলো সময়ের পরতে পরতে মুক্তিরই উন্মোচন।

এই স্তরে সাধনা (নিদিধ্যাসন) কোনো নতুন ফল উৎপাদন করে না, কারণ মুক্তি যেহেতু আত্মার স্বরূপ, তাই তা আগে থেকেই ছিল। সাধনার ফল হলো: স্বয়ং-আলোক (আত্মার স্বয়ংপ্রকাশ)। অর্থাৎ, সাধনা কেবল নিজেকে প্রত্যক্ষ করার জন্য থাকা বাধা (সংস্কার) সরিয়ে দেয় মাত্র।

বাংলা ও ভারতীয় তর্কশাস্ত্রের প্রেক্ষাপটে “সিলোগিস্টিক শৃঙ্খল” (Syllogistic Chain) বলতে বোঝানো হয় ন্যায় দর্শনে বর্ণিত পঞ্চাবয়বী বাক্য—অর্থাৎ অনুমান (Inference) প্রক্রিয়ার সেই সুসংগঠিত যুক্তি-পদ্ধতি, যার উদ্দেশ্য হলো কোনো অজানা সত্য (সাধ্য) প্রমাণ করা।

ন্যায়দর্শনের প্রবর্তক মহর্ষি গৌতম এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন দুই ক্ষেত্রেই—একদিকে পরামাণু (অন্যকে সিদ্ধান্ত বোঝানো) এবং অন্যদিকে স্বার্থানুমান (নিজের মধ্যে সিদ্ধান্ত যাচাই করা)।

এই যুক্তিপদ্ধতির মূল কথা হলো—একটি সত্যকে প্রমাণ করতে শুধু মতপ্রকাশ যথেষ্ট নয়; বরং কারণ, উদাহরণ, প্রয়োগ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—এই পাঁচটি ধাপ সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করতে হয়। এই পাঁচ ধাপেই গঠিত হয় পঞ্চাবয়বী বাক্য, যা ভারতীয় যুক্তিতত্ত্বের ভিত্তি।

প্রথম ধাপ প্রতিজ্ঞা (Pratijñā)—ঘোষণা বা অভিপ্রায়। এখানে সাধ্য (যা প্রমাণ করতে হবে) ও পক্ষ (যার ওপর প্রমাণ আরোপিত হবে)-এর সম্পর্ক নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন, “পর্বতে আগুন আছে”—এটি সেই বক্তব্য, যা প্রমাণের অপেক্ষায়।

দ্বিতীয় ধাপ হেতু (Hetu)—কারণ বা যুক্তি। যেমন, “কারণ, সেখানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।” অর্থাৎ ধোঁয়ার উপস্থিতি আগুনের সম্ভাবনাকে নির্দেশ করছে। এই হেতু অবশ্যই সৎ হেতু হতে হবে—যা সাধ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, এবং যা পক্ষকে সাধ্যের দিকে পরিচালিত করে।

তৃতীয় ধাপ উদাহরণ (Udāharaṇa) বা ব্যাপ্তি-জ্ঞান—হেতু ও সাধ্যের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক (ব্যাপ্তি) স্থাপন করে। যেমন, “যেখানেই ধোঁয়া থাকে, সেখানেই আগুন থাকে—যেমন রান্নাঘরে।” এই উদাহরণই প্রমাণ করে যে, ধোঁয়া ও আগুনের মধ্যে এক স্থায়ী কার্য-কারণ সম্পর্ক রয়েছে।

চতুর্থ ধাপ উপনয় (Upanaya)—সাধারণ নিয়মকে বর্তমান ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। যেমন, “এই পর্বতেও ধোঁয়া রয়েছে, তাই এখানেও আগুন থাকা উচিত।” এখানে সাধারণ নিয়মটি বর্তমান উদাহরণের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।

পঞ্চম ধাপ নিগমন (Nigamana)—চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। যেমন, “অতএব, পর্বতে সত্যিই আগুন আছে।” এই ধাপে পূর্ববর্তী চারটির যৌক্তিক সমর্থনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এইভাবেই গঠিত পঞ্চাবয়বী বাক্য ভারতীয় তর্কশাস্ত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ ও যুক্তিনিষ্ঠ “সিলোগিস্টিক শৃঙ্খল”।

ভারতীয় পঞ্চাবয়বী যুক্তি-পদ্ধতি অ্যারিস্টটলীয় সিলোগিজম থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত ও বিশদ। পাশ্চাত্য সিলোগিজমে তিনটি অবয়ব থাকে—বৃহৎ প্রতিজ্ঞা, ক্ষুদ্র প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত; যার মূল উদ্দেশ্য যৌক্তিক বৈধতা রক্ষা।

অন্যদিকে, ভারতীয় পদ্ধতিতে পাঁচটি অবয়ব থাকে এবং এর কেন্দ্রে থাকে দৃষ্টান্ত (উদাহরণ), যা হেতু ও সাধ্যের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক (ব্যাপ্তি)কে নিশ্চিত করে।

ন্যায় দর্শনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যুক্তিকে বৈধ করা নয়; বরং যুক্তির মাধ্যমে সত্যের প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যকেও তা বোঝানো।

এই কারণেই ন্যায়দর্শন যুক্তিকে কেবল মানসিক অনুশীলন নয়, বরং সত্য-প্রতিষ্ঠার এক বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক উপায় হিসেবে দেখেছে—যেখানে যুক্তি হয়ে ওঠে জ্ঞানের সহায়, আর জ্ঞান হয়ে ওঠে মুক্তির পথ।

এই সমগ্র প্রক্রিয়া শেষপর্যন্ত প্রমাণ-অতিক্রান্তি-তে এসে থামে। যে-শ্রুতি একদিন শিক্ষা দিয়েছিল “তুমিই সেই”—“তৎ ত্বম্ অসি”—সেটিই এখন সচেতনতার মূলে নীরব স্পন্দন হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ—সব পথ আপনাতেই নিস্তব্ধ; যে-আলোকে জানতাম, যে-জানাকে আলো বলতাম, যে-জানাকে জানার বস্তু বলতাম—তিনটিই এখন একীভূত। আত্মা আর সন্ধানযোগ্য নয়; সে-ই একমাত্র জ্ঞাতা, সে-ই একমাত্র জ্ঞেয়, সে-ই একমাত্র জ্ঞান। তাই শেষ বাক্যটি নিজেই জ্বলে ওঠে—“জ্ঞানম্ এব জ্ঞেয়ম” (গীতার ১৩.১৮ শ্লোকের সঙ্গে সম্পর্কিত)—একা, অব্যর্থ, মধ্যস্থতাহীন—"সেই জ্ঞেয় বস্তু (ব্রহ্ম), যা জ্ঞানস্বরূপ (জ্ঞানম্) এবং জানার যোগ্য (জ্ঞেয়ম্), তা থেকেই জ্ঞান উদ্ভূত হয়।"

ব্রহ্ম-জ্ঞানের দীপ্ত স্বচ্ছতায় জাগতিক পার্থক্য বা দ্বৈততা নিজেই নিজের ভিত্তি হারাতে শুরু করে। অবিদ্যা, মায়া, অধ্যাস, উপাধি, জ্ঞান, মোক্ষ—এই দার্শনিক শব্দগুলি আর কোনো চূড়ান্ত বিশ্বতত্ত্ব বা বাস্তব সত্তা নয়, বরং মনকে বহুত্বের গিরিখাত পেরিয়ে তার আদি ঐক্যে পৌঁছানোর জন্য স্থাপিত এক শিক্ষাবহ মই মাত্র। মূল বিভ্রান্তির বীজ ছিল অবিদ্যা (অজ্ঞান); তার মহাজাগতিক স্থাপত্য বা সৃষ্টিশক্তি ছিল মায়া; তার মনস্তাত্ত্বিক রূপ ছিল অধ্যাস (এক বস্তুর ওপর অন্য বস্তুর মিথ্যা আরোপ); আর তার সত্তাতাত্ত্বিক যন্ত্র বা সীমাবদ্ধতা ছিল উপাধি (যেমন দেহ, মন)। এই চারদিকে অদৃশ্য বয়নেই অসীম (অনন্ত) সত্তা সসীম বলে ধরা দিয়েছিল, অপরিবর্তনীয় আত্মা গতির ছদ্মবেশ নিয়েছিল, এবং নিরাকার ব্রহ্ম অগণন নাম-রূপ ধারণ করেছিল। তবুও, প্রতিটি আবরণ বা বিভ্রম আসলে সেই দ্যুতিকেই ইঙ্গিত করছিল, যাকে সে ঢাকছিল—কারণ ব্রহ্মের আলো না থাকলে কোনো বিভ্রমই ঝলমল করতে পারে না; মিথ্যার ঋণ সবসময় সত্যের কাছেই।

এই মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনের জন্য অধ্যারোপ-অপবাদ-এর করুণাময় পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিকে "করুণাময়" বলা হয়, কারণ এটি সরাসরি চরম সত্য নির্গুণ ব্রহ্ম-কে বোঝার মতো কঠিন কাজটি না দিয়ে, মানুষের সীমাবদ্ধ বুদ্ধির স্তরে নেমে এসে ধীরে ধীরে তাকে সত্যের দিকে নিয়ে যায়।

প্রথমে শ্রুতি পরম সত্তার ওপর গুণ আরোপ (অধ্যারোপ) করে—তাঁকে সৃষ্টিকর্তা, ধারক, সংহারক হিসাবে সগুণ ব্রহ্ম, এবং সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসাবে বর্ণনা করে। এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষের বুদ্ধি যেন ধারণার দণ্ড ধরে অদেখাকে (নির্গুণ ব্রহ্মকে) প্রাথমিকভাবে স্পর্শ করতে পারে। এরপর শুরু হয় প্রত্যাহারের পালা। একে একে সেই পোশাকগুলি খুলে নেওয়া হয়; অপবাদ ঘটে—অর্থাৎ, সেই আরোপিত গুণাবলী খণ্ডন করা হয় "নেতি, নেতি" (এটা নয়, এটা নয়) নীতির মাধ্যমে—আর অবশিষ্ট থাকে নগ্ন সত্য: নির্গুণ ব্রহ্ম, যিনি কারণ-কার্য, গুণ-দোষ, নাম-রূপের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে।

এই অপসরণের সাথে সাথেই অবিদ্যা-ভঙ্গ ঘটে—মায়ার দুটি প্রধান শক্তি নিভে যায়। আবরণ-শক্তি (যা সত্যকে ঢেকে রেখেছিল) নিভে যায়; এবং বিক্ষেপ-শক্তি (যা বহুত্ব প্রক্ষেপণ করত) অবসন্ন হয়। তখন প্রকাশিত থাকে কেবল সাক্ষী-চৈতন্য—যে কখনও আবদ্ধ ছিল না, তাই কখনও মুক্তিও হতে হয় না, কারণ সে-ই আদি থেকে স্বয়ং-প্রকাশ এবং স্বয়ং-স্থিত। এটিই অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত উপলব্ধি।

যে-রূপকগুলি এতদিন দর্শনের পথে আলোকরেখা এঁকে পথ দেখিয়েছিল—রজ্জু-সর্পের বিভ্রম, শুক্তিতে রুপার মায়া, ঘটাকাশে মহাকাশের নিঃশব্দ মিশ্রণ, দর্পণে প্রতিবিম্বের স্বচ্ছ নৃত্য—তারা একটা সময় পর এসে স্তব্ধ হয়ে যায়; যেন নিঃশেষে তাদের ভূমিকা শেষ। কারণ সত্য যখন নিজের দীপ্তিতে উদ্‌ভাসিত হয়, তখন প্রতীক আর সেতু নয়—তারা কেবল একদা অচিন আলোর দিকে নির্দেশ-করা ছায়া।

জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অভিজ্ঞতাগত তরঙ্গ তখন তুরীয়ের অসীম নিস্তব্ধ পটে নিছক এক ঝলক আলোড়নমাত্র। সেখানে সময় নিস্তব্ধ, চিন্তা লুপ্ত এবং চৈতন্য একা, অবিকল, অপরিবর্তনীয়। যেন সমুদ্র সমস্ত তরঙ্গকে নিজের গর্ভে ফিরিয়ে নিয়েছে, শুধু দীপ্ত নীল স্থিরতা জেগে আছে।

এই স্থিতির অন্তর্গত প্রভায় পঞ্চকোষ—অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়—আত্মার দীপ্ত আলোয় ভেসে থাকা সূক্ষ্ম পরতগুলির মতো প্রতীয়মান হয়; তাদের সত্তা তখন আর আবরণ নয়, বরং আলোক-ধূলির মতো এক স্বচ্ছ বিস্তার। অন্তর্মুখ চেতনা অনুভব করে—এরা আত্মার উপাদান নয়, আত্মার ওপর ভাসমান জ্যোতির ছায়া, যেন সূর্যের চারপাশে পরাগিত আভা, যা সূর্যেরই প্রতিধ্বনি।

এই অন্তরালেই মহাবাক্যগুলি—“তৎ ত্বম্ অসি”, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”, “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম”, “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”—আর শাস্ত্রের বাক্য থাকে না; তারা হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার সুর, অন্তরের অনন্ত কম্পন। “তৎ ত্বম্ অসি”—এখানে ‘তুমি’ আর ‘সেই’ পৃথক সত্তা নয়, পরস্পরের পরিসমাপ্তি; একটি অন্যের প্রতিফলিত রূপ, যেন দু-দিকের আয়না একই আলো বহন করছে। “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—এ আর চিন্তা নয়, বরং সেই মৌন উদ্ঘোষ যে, ‘আমি’ দেহ-মন-নাম-রূপের সকল সীমার পূর্বে, মধ্যে এবং পরে জেগে থাকে—অপরিমেয়, অবিকল, অবিচ্ছিন্ন। “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম”—এখানে জ্ঞান আর কোনো বৌদ্ধিক অনুধ্যান নয়; এটি সেই আত্ম-দীপ্তির প্রত্যয়, যেখানে জানা, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—সব মিশে গেছে এক অভিন্ন স্বচ্ছতায়। আর “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”—এ আর কোনো ইঙ্গিত নয়, এটি তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি—এই এখানেই, এই নিঃশব্দ চেতনার গভীরে, ব্রহ্ম নিজের আলোয় আত্মপ্রকাশ করছে।

এখানে বাক্য নিঃশেষ, চিন্তা নিঃস্তব্ধ, বুদ্ধি বিনত। বাকি থাকে কেবল এক অবিচ্ছেদ্য অনুভব—চৈতন্য নিজেরই দীপ্তিতে নিজেকে চিনে নিচ্ছে; এক অনন্ত, নিরাকুল, অনবদ্য স্থিতি, যেখানে জানা ও থাকা এক হয়ে যায়, এবং নীরবতারই মধ্যে উচ্চারিত হয় চূড়ান্ত বাণী—“অহম্ ব্ৰহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)—আমিই (সেই) ব্রহ্ম।

শঙ্করের সংকেত—“ব্রহ্ম সত্যম্, জগন মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—”ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। জগৎ মিথ্যা। জীব (জীবাত্মা) ব্রহ্মই, অন্য কিছু নয়।” এটি পরম অভিজ্ঞতাকে ভাষার মধ্যে বেঁধে দেবার শেষচেষ্টা।

সত্য এখানে কেবল অস্তিত্ব নয়; “ত্রিকাল-অবাধিত-সত্তা”—কাল, দেশ, অবস্থা-ত্রয় অতিক্রমী অপরিবর্তনীয়তা। “মিথ্যা” কোনো কল্পকাহিনির মতো অসত্য নয়; এটি নির্ভরশীল সত্তা (অধিষ্ঠান-নির্ভর), ধার-করা আলোয় দৃশ্যমান—জলে চাঁদের প্রতিফলনের মতো, স্বপ্নে-দেখা গন্ধর্ব-নগরের মতো। জগৎ অনুভবযোগ্য থাকে, কিন্তু তার দাবিকৃত স্বায়ত্তশাসন বিলোপিত হয়—বাধ-ব্যবহার পূর্ণতা পায়। জীব, যে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করত, দেখা যায়, সে ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কিছু নয়; ভেদটি ছিল কেবল উপাধি-ভেদ—দর্পণের গুণে প্রতিফলনের ভাঁজ, মুখের নয়।

এই স্বীকৃতিতে নীতিশাস্ত্র কিংবা করুণা ক্ষুদ্র হয় না; বরং কর্তৃত্বের অভাবেই সৎকর্ম স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে—লোকসংগ্রহ তখন লীলার মতো প্রবাহিত হয়—ফলের দাবি ছাড়া, অহংয়ের ছায়া ছাড়া। জ্ঞান কোনো অনুভূতি দমন নয়; এটি এমন অবস্থা, যেখানে অনুভূতি তার অগ্রসরতা হারায়, কারণ “অন্য” বলে আর কিছু দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। ভাষা সেখানে পৌঁছে থেমে যায়—শব্দের উপদেশ নীরব উপদেশে (মৌন-উপদেশ) রূপ নেয়; ধারণার সিঁড়ি সরিয়ে ফেলা হয়; দেখা যায়, কোনোদিন অন্য তীরে যাওয়া লাগেনি—নদীই ছিল জলের একখানি নৃত্য।

সবশেষে, যা থাকে, তা কোনো তত্ত্ব নয়, কোনো প্রমাণ নয়—একটিই অখণ্ড দ্যুতি, সৎ-চিৎ-আনন্দের অবিভাজ্য স্বরূপ। সেখানে মায়া-অবিদ্যা-অধ্যাস-উপাধি এই সব শব্দ নিজে থেকেই ঝরে পড়ে—অধ্যারোপের দান অপবাদে সমর্পিত হয়। জানা, জানার যন্ত্র ও জানার বস্তু—এই ত্রয়ী নীরবে ভাঁজ হয়ে যায় একটিমাত্র উপস্থিতিতে। সেই উপস্থিতিই ব্রহ্ম; এবং এই স্বীকৃতিই মোক্ষ—সময়ের মধ্যে নতুন কোনো ঘটনাও নয়, বরং সব ঘটনার অন্তরে সর্বদা জেগে থাকা নিঃশব্দ সত্য, যে সব খেলাকে আলোকিত করে, কিন্তু কোনো খেলাতেই কখনও জড়ায় না।