“না নিরোধো ন চোত্পত্তিঃ, ন বদ্ধো ন চ সাধকঃ। ন মুমুক্ষুর ন বৈ মুক্ত ইত্যেষা পরমার্থতা।।” (মাণ্ডূক্যকারিকা ২.৩২) অর্থাৎ—“না কোনো নিবৃত্তি আছে, না কোনো উৎপত্তি; না কেউ আবদ্ধ, না কেউ সাধক; না কেউ মুক্তিকামী, না কেউ মুক্ত। এ-ই পরমার্থ।”
এটি অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম গভীরতম ঘোষণা, যেখানে জগতের সমস্ত পরিবর্তন, সৃষ্টি ও বিনাশের ধারণাই ভ্রান্ত প্রতীতি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই শ্লোকটি মাণ্ডূক্য উপনিষদ কারিকার দ্বিতীয় অধ্যায়, বৈতথ্য প্রকরণ-এর ৩২তম শ্লোক, যা আচার্য গৌড়পাদ রচনা করেছিলেন—তিনি আদি শংকরাচার্যের পরমগুরু, এবং তাঁর অজাতবাদ (Ajātavāda) তত্ত্ব অদ্বৈত দর্শনের এক চূড়ান্ত রূপ।
“অজাত” শব্দের অর্থই হলো—যা কখনও জন্মায়নি, যার কোনো উৎপত্তি নেই। গৌড়পাদাচার্যের মতে, সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—এই তিনটি ধাপ কেবল মনোজাত প্রতীতি, মানসিক আরোপমাত্র। পরমার্থতত্ত্বে, অর্থাৎ চূড়ান্ত সত্যে, কোনো সৃষ্টি কখনও ঘটেইনি; যা জন্মের মতো মনে হয়, তা কেবল অজ্ঞানের আচ্ছাদনে দেখা ভ্রমমাত্র। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি বলেন—না কোনো সৃষ্টি আছে, না কোনো বিনাশ; না কেউ আবদ্ধ, না কেউ সাধক; না কেউ মুক্তিকামী, না কেউ মুক্ত—এই অবস্থাই পরমার্থ।
এই ভাবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল—ব্রহ্ম, অর্থাৎ চৈতন্য চিরন্তন, অচল ও অভিন্ন। জগৎ, জীব, ঈশ্বর—সবই সেই এক চৈতন্যের বিভিন্ন মানসিক প্রতিচ্ছবি। যেভাবে স্বপ্নের মধ্যে আমরা নানা দৃশ্য দেখি, কর্ম করি, সুখদুঃখ ভোগ করি, অথচ জাগরণের পর বুঝি, সবই মনোজাত প্রতীতি ছিল—তেমনি জাগতিক সমস্ত অভিজ্ঞতা, সৃষ্টি ও সাধনা চেতনার পরম স্তরে পৌঁছলে স্বপ্নের মতোই বিলীন হয়।
এই শ্লোকেই গৌড়পাদ স্থির করেন অজাতবাদের সারমর্ম—যেখানে মুক্তি কোনো ভবিষ্যৎ অর্জন নয়, বরং চিরন্তন স্বরূপের প্রত্যাবর্তন। জীব, যিনি নিজেকে আবদ্ধ ও সীমিত বলে ভাবেন, প্রকৃতপক্ষে কখনও আবদ্ধ ছিলেন না। জ্ঞানের উদয়ে তাঁর উপলব্ধি হয়—আমি সর্বদা মুক্ত, আমি ব্রহ্ম। এখানে বন্ধন ও মুক্তি উভয়ই মানসিক প্রক্ষেপণ, আর ব্রহ্ম একমাত্র অপরিবর্তনীয় সত্য।
এই শ্লোকটি শুধু এক দার্শনিক বক্তব্য নয়, বরং এক অনন্ত দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন—যেখানে সমস্ত দ্বৈততা ও পরিবর্তনের ধারণা মায়ার পর্দা সরিয়ে এক অবিকৃত, অচল, চিরপ্রকাশ চৈতন্যে লীন হয়ে যায়। গৌড়পাদ এই অবস্থাকেই বলেছেন “পরমার্থতা”—অর্থাৎ সেই চূড়ান্ত সত্য, যেখানে কিছুই আর শুরু বা শেষ পায় না, কারণ সবই অনাদি, অব্যয় ও অভিন্ন ব্রহ্মের অবিরল নীরব দীপ্তি। সব সৃষ্টি, সাধনা, মুক্তি ও বন্ধনের ধারণাই মানসিক আরোপমাত্র। পরমার্থে, চৈতন্য এক ও অচল; তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা প্রক্রিয়া ঘটেই না।
অর্থাৎ, “কোনো সৃষ্টি নেই, কোনো বিলুপ্তি নেই; কেউ আবদ্ধ নয়, কেউ সাধনা করছে না, কেউ মুক্তও নয়—এটাই পরম সত্য”। এই বাণীই অজাত-বাদ-এর মূল হৃদয়—যে-মত বলে, কিছুই কখনও উৎপন্ন হয়নি। অবিদ্যা জন্ম নেয় না, ধ্বংসও হয় না; সেটি কেবল কল্পনার ফসল এবং সেই কল্পনার মাধ্যমেই দেখা হয়। সমস্ত জ্ঞানের, সমস্ত দ্বন্দ্বের, সমস্ত ধারণার পরিণতি এই স্বীকৃতিতে এসে মিশে যায়—কখনও কিছুই ঘটেনি।
বৃত্তটি সেই জায়গাতেই ফিরে আসে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল—অধ্যারোপ-অপবাদে। দ্বৈততার আরোপণ প্রথমে প্রয়োজন, যাতে পরে তার অস্বীকৃতি সম্ভব হয়। যেমন এক মই ব্যবহার করে উপরে ওঠা হয়, তারপর তা সরিয়ে ফেলে দেওয়া হয়, তেমনি অবিদ্যা ও জ্ঞান উভয়ই অতিক্রমিত হয়। শেষে, যা অবশিষ্ট থাকে, তা কোনো ভাব নয়, কোনো দর্শন নয়—সেই নীরব, সীমাহীন উপস্থিতি, যা সমস্ত চিন্তা ও ভাষার ঊর্ধ্বে। সেখানে ব্রহ্ম অবশিষ্ট থাকেন—অবিদ্যারও ঊর্ধ্বে, জ্ঞানেরও ঊর্ধ্বে, এমনকি “অদ্বৈত” ধারণারও ঊর্ধ্বে। সকল খেলা শেষ হয়, চৈতন্য জেগে ওঠেন এবং, যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো একটিই সত্য—অখণ্ড, দীপ্তিমান, স্ব-জ্ঞানী চেতনা—যা সব কিছুর ভিত্তি, সব কিছুর অন্ত এবং সব কিছুরও পর।
অদ্বৈত জ্ঞানতত্ত্বে প্রমাণ কোনো স্থায়ী আশ্রয় নয়; এটি এমন একটি মই, যার কাজ সমাপ্ত হলেই তা নিজে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। জ্ঞানার্জনের ক্রম প্রথমে ‘ব্যাবহারিক সত্তা’-র পরিসরে চলমান অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান দিয়ে সূচিত হয় এবং ‘অপরোক্ষ অনুভূতি’-তে পরিণত হয়—সেই মুহূর্তে জ্ঞাতা (প্রমাতৃ), জ্ঞান (প্রমা) এবং জ্ঞেয় (প্রমেয়) একক, অবিভাজ্য উজ্জ্বলতায় মিলেমিশে যায়। এই একত্রীকরণ কোনো কৌশলগত সংযোজন নয়, বরং দ্বৈততার প্রকৃত সীমাবদ্ধতাকে ভেদ করে ওঠা আত্ম-দ্যুতির স্বয়ং-প্রকাশ—যেখানে জানা, জানার উপায় এবং জানবার বস্তু—তিনটিই চেতনার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে থাকে।
অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞান বা সত্য উপলব্ধির পথকে বলা হয় প্রমাণ। “প্রমাণ” শব্দের মানে—যে-উপায়ে বা যন্ত্রে (means) আমরা কোনো বস্তুর বা সত্যের বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু এই প্রমাণগুলো—প্রত্যক্ষ (direct perception), অনুমান (inference) এবং শব্দ (verbal testimony or scriptural revelation)—সবই এমন এক স্তরে কাজ করে, যেখানে এখনও অবিদ্যা বা অজ্ঞতা টিকে আছে, অর্থাৎ যেখানে আমরা এখনও বিষয় (object) ও দর্শক (subject)-এর ভেদে আবদ্ধ।
১. প্রত্যক্ষ-প্রমাণ (Direct Perception): যখন আমরা বলি—“এই ফুলটি লাল”, তখন আমাদের চোখ, মন ও আলোকসংযোগের মাধ্যমে আমরা সেই ফুলকে দেখি। এটি সরাসরি ইন্দ্রিয়-যোগে প্রাপ্ত জ্ঞান, একে বলে প্রত্যক্ষ-জ্ঞান। এখানে দেখা হচ্ছে বস্তুর রূপ বা গুণ; কিন্তু চৈতন্য বা সত্যস্বরূপকে এখানে দেখা যায় না। যেমন আয়নায় মুখ দেখা যায়, কিন্তু আয়না মুখ নয়—তেমনি প্রত্যক্ষও কেবল প্রতিচ্ছবি দেয়, স্বরূপ নয়।
২. অনুমান-প্রমাণ (Inference or Logical Reasoning): এই প্রমাণ বুদ্ধির কাজ। যেমন আমরা বলি—“ধোঁয়া আছে, তাই আগুনও আছে।” এখানে আগুনকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ধোঁয়ার উপস্থিতি দেখে আমরা যুক্তির দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছি যে, আগুন অবশ্যই আছে। এটিকে বলে ব্যাপ্তি-জ্ঞান—যেখানে আমরা একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক (যেমন ধোঁয়া ও আগুনের অনিবার্য যোগ) ধরে যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান পাই। কিন্তু অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, এটি এখনও মনের একটি কার্য—যা কারণ, ফল, সময় ও স্থানবোধের ভিতরে সীমাবদ্ধ।
৩. শব্দ-প্রমাণ (Śabda-Pramāṇa or Verbal Revelation): এটি সবচেয়ে সূক্ষ্ম প্রমাণ, কারণ এটি ইন্দ্রিয় বা যুক্তি নয়, বরং আধ্যাত্মিক শ্রুতি বা শাস্ত্রের বাক্য—যেমন উপনিষদ বলে “তৎ ত্বম্ অসি” (তুমি সেই ব্রহ্ম)। এখানে শব্দ বা বাক্য সরাসরি কোনো বস্তু বোঝায় না, বরং একটি লক্ষণা-বৃত্তি বা “ইঙ্গিতমূলক অর্থ” ব্যবহার করে—যাতে মনের ধারণাগুলিকে ভেদ করে আমাদের চেতনার গভীরে থাকা ব্রহ্ম-সত্তাকে জাগ্রত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, “তুমি” (individual self) ও “সেই” (Supreme Self) শব্দদুটি আপাতদৃষ্টিতে আলাদা হলেও, তাদের অন্তর্নিহিত চৈতন্য একই। শব্দ-প্রমাণের উদ্দেশ্যই হলো এই অন্তর্গত ঐক্য উপলব্ধি করানো।
এখন, এই তিন প্রমাণই প্রমা, অর্থাৎ বৈধ জ্ঞানের উৎস, কিন্তু এগুলো সবই এক দ্বৈত কাঠামোর ভিতরে কাজ করে। প্রত্যক্ষ মানে দর্শক ও দৃশ্যমান বস্তু আছে, অনুমান মানে যুক্তি ও তার ফল আছে, আর শব্দ মানে বলা ও শোনা এই দুইয়ের পার্থক্য আছে। অর্থাৎ, এগুলো সবই দ্বৈত অভিজ্ঞতা—যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় দুইটি পৃথক বলে ধরা হয়।
অদ্বৈত বেদান্ত বলছে—এই প্রমাণগুলোর উদ্দেশ্য দ্বৈততাকে চিরস্থায়ী করা নয়, বরং মনের স্বচ্ছতা ও বোধশক্তি বৃদ্ধি করে দ্বৈততার সীমা অতিক্রমের প্রস্তুতি তৈরি করা।
যখন সত্য জ্ঞান, অর্থাৎ ব্রহ্ম-জ্ঞানের উদয় ঘটে, তখন এই সব প্রমাণের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। কারণ তখন আর “জানার” কিছু থাকে না—জ্ঞানী, জ্ঞেয় ও জ্ঞান এই তিনের ভেদ মুছে যায়। যেমন কেউ আলো খোঁজে অন্ধকারে, কিন্তু আলো জ্বলে উঠলে প্রদীপ আর খোঁজার প্রয়োজন থাকে না; তেমনি প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ প্রমাণগুলোও কেবল প্রদীপস্বরূপ পথপ্রদর্শক—যখন আত্মপ্রকাশ চৈতন্য জেগে ওঠে, তখন প্রমাণ নিজেই অনাবশ্যক হয়ে যায়।
সেই অবস্থাতেই বলা হয়—“প্রমাণ, প্রমাতা ও প্রমেয়—এই তিনই ব্রহ্মরূপে লীন।” তখন চেতনা নিজের মধ্যেই বিশ্রাম নেয়, কারণ জানা ও জানার উপায়—উভয়ই তারই খেলা।
‘শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন’ হলো জ্ঞানের তিন ধাপ—শোনা, ভাবা, ও গভীরভাবে ধ্যান করা। যখন এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে উপনিষদের বাক্যগুলি—“অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”, “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম”, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—হৃদয়ে সত্য রূপে অনুভূত হয়, তখন সেই শব্দ আর বাইরের কোনো শাস্ত্রবাণী থাকে না; হয়ে ওঠে জীবন্ত উপলব্ধি। শব্দ তখন আর কেবল সাক্ষ্য নয়, বরং আত্ম-প্রকাশের মাধ্যম—যেমন আয়নায় মুখ প্রতিফলিত হয়ে নিজেকে চিনে ফেলে, তেমনি শ্রুতিও আত্মাকে তার নিজের প্রতিচ্ছবিতে ফিরিয়ে দেয়।
এই অবস্থায় জ্ঞানলাভের তিনটি উপাদান—প্রমাণ (জানার উপায়), প্রমাতা (যিনি জানেন) এবং প্রমেয় (যা জানা হচ্ছে)—ধীরে ধীরে তাদের ভেদ হারাতে শুরু করে। মন, যা একসময় অস্থির জলের মতো সব কিছুর প্রতিফলনকে দোলাচলিত ও বিকৃত করত, চিত্তশুদ্ধির ফলে শান্ত, স্থির ও স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন মন আর প্রতিবন্ধক নয়; বরং হয়ে ওঠে এমন এক নিখাদ আয়না, যার মধ্যে আত্মা নিজের দীপ্তিতে নিজেকে চিনে নিতে পারে।
এই অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনকে অদ্বৈত দর্শনে বলা হয় বাধ বা বিলোপন—অর্থাৎ মিথ্যা জ্ঞানের অপসারণ। কিন্তু “বিলোপ” মানে ধ্বংস নয়, বরং সত্যের উদ্ভাস। যেমন স্বপ্নের অভিজ্ঞতা জাগরণের পরে মিলিয়ে যায়, কিন্তু সেই মিলিয়ে যাওয়াটা কোনো বিনাশ নয়—এটা জাগ্রত আলোর প্রভাবে স্বপ্নের অসত্যতা প্রকাশ পাওয়া। তেমনি আত্মজ্ঞান জেগে উঠলে, জগৎ ও দ্বৈত অভিজ্ঞতার সত্যতা নিজে থেকেই নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে রজ্জু-সর্পের ন্যায় ধরা যায়—অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে মনে হয়, কিন্তু আলো জ্বাললে সাপটি “মরে” না, বরং বোঝা যায়, সাপ বলে কিছুই ছিল না। এইভাবেই আত্মজ্ঞান (বাধ-জ্ঞান) অজ্ঞানকে (বাধিত অজ্ঞান) পরাজিত করে; কারণ অজ্ঞান কখনোই সত্যের সমপর্যায়ে ছিল না, সেটি কেবল এক অনির্বচনীয় ভ্রম—আলো আসলেই সে সরে যায়।
অদ্বৈত এখানে খুব সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রাখে—ব্যাবহারিক প্রমাণ (যা জগতের লেনদেন, নৈতিকতা ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং তাত্ত্বিক প্রমাণ (যা আত্মস্বরূপ উন্মোচনে সহায়ক)। ব্যাবহারিক স্তরে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ ও মনের অনুমান প্রয়োজনীয়—এগুলি সমাজ, কর্ম ও সম্পর্কের সত্য বজায় রাখে। কিন্তু পরমার্থিক সত্য বা ব্রহ্ম-চৈতন্যকে জানার জন্য এসব প্রমাণ অকার্যকর, কারণ আত্মা অবস্তুভূত—তাকে না চোখে দেখা যায়, না যুক্তিতে ধরা যায়। তাই একমাত্র শ্রুতি, অর্থাৎ উপনিষদীয় বাক্য, তাত্ত্বিক প্রমাণের আসল রূপ; কারণ সেটিই চেতনার অন্তর্গত দর্পণ, যা আমাদের নিজস্ব স্বরূপকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
যখন এই শ্রুতির বাণী হৃদয়ে সম্পূর্ণভাবে অবতীর্ণ হয়, তখন শব্দের কাজ শেষ হয়। শব্দ তখন নীরব হয়ে যায়, কারণ তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে। “তৎ ত্বম্ অসি”—এই বাক্য তখন আর উচ্চারিত শব্দ নয়, বরং এক গভীর অন্তর্গত অনুরণন, যেখানে ‘তৎ’ (ব্রহ্ম) ও ‘ত্বম্’ (আত্মা) মিলেমিশে যায় এক ঐক্যবোধে। তখন শ্রুতি আর ভাষা নয়, হয়ে ওঠে অভিজ্ঞতার স্পন্দন; আর “তুমি সেই”—এই উপলব্ধিই হয় আত্মার নিঃশব্দ জাগরণ।
যখন জ্ঞান-উৎপত্তি ঘটে, অবিদ্যা-নিবৃত্তি অনিবার্যভাবে তার পথ অনুসরণ করে। প্রথমে আবরণ-শক্তি ভেঙে পড়ে—যে-আচ্ছাদন সত্যকে আড়াল করত; তারপর বিক্ষেপ-শক্তি—যে-শক্তি বহুত্বকে প্রক্ষেপণ করত—তার অবস্থান হারায়। মনো-নাশ এখানে অঙ্গহানি নয়; এটি মনের মিথ্যা স্বাতন্ত্র্যের অবসান—দগ্ধ-রজ্জু-র মতো মন রূপ আছে, বাঁধনশক্তি নেই। যা অবশিষ্ট থাকে, তা শুদ্ধ সাক্ষী-চৈতন্য—দ্বিতীয় রহিত, নিজালোকে নিজেই উজ্জ্বল—যেখানে পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষ্য আর মুখোমুখি নয়, বরং একক উপস্থিতিতে অন্তর্ভুক্ত।