অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৫৩



অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, ব্রহ্ম সর্বদা অভিন্ন—ঈশ্বর ও জীবের ভেদ, মায়া ও অবিদ্যার বিভাজন, কেবল প্রতিফলনের সীমায় ঘটে। উপাধি বিলীন হলে, যা প্রকাশিত হয়, সেটিই চিরন্তন সত্য—এক, অবিভাজ্য, স্বয়ং-আলোকিত চেতনা, যা কখনও মায়ার অন্তর্গত ছিল না, কেবল তার আলোয় মায়া ভাসত।

অবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে অদ্বৈত বেদান্তের অন্তর্দীপ্ত বিতর্ক অদ্বৈত দর্শনের সূক্ষ্মতম যুক্তিবোধের নিদর্শন। শঙ্কর-পরবর্তী এই আলোচনায় প্রশ্নটি কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে—অবিদ্যা কোথায় অবস্থিত? কার উপর এটি নির্ভরশীল? এই প্রশ্নের জবাবে দুটি প্রধান মতবাদের উদ্‌ভব ঘটে, যা অদ্বৈতের একই মূল তত্ত্ব—’চেতনার অদ্বিতীয়তা’ অক্ষুণ্ণ রেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়।

বাচস্পতি মিশ্র প্রবর্তিত ভামতী সম্প্রদায় অবিদ্যার মনস্তাত্ত্বিক দিকটির উপর জোর দিয়ে বলেন যে, অবিদ্যা জীবের মধ্যে অবস্থান করে (জীব-আশ্রয়বাদ); কারণ অজ্ঞতা অনুভূত হয় কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়—আমার অজ্ঞান, আমার বিভ্রম, আমার সীমাবদ্ধতা। তাই এটি ব্যক্তিগত অন্তঃকরণে প্রকাশিত এক মনো-অবস্থা, ব্রহ্মে নয়। এতে ব্রহ্মের বিশুদ্ধতা রক্ষিত থাকে—শুদ্ধ চেতনা কোনো বিভ্রমের অধীন হতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি চেতনার পরম প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রাখে এবং অবিদ্যাকে অভিজ্ঞতার মানসিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করে।

অন্যদিকে প্রকাশাত্মন দ্বারা বিকশিত বিবরণ সম্প্রদায় বলে যে, অবিদ্যা ব্রহ্মের মধ্যে অবস্থান করে (ব্রহ্ম-আশ্রয়বাদ)। কারণ যদি সত্যিই একমাত্র ব্রহ্মই সর্বত্র বিদ্যমান, তবে অজ্ঞানতারও অন্য কোনো আধার থাকতে পারে না—অস্তিত্বের বাইরে কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই, যেখানে অজ্ঞতা থাকতে পারে। অতএব, অবিদ্যা ব্রহ্মের সাথেই সম্পর্কিত হতে হবে, যদিও এটি কখনও ব্রহ্মকে স্পর্শ করে না। এটি ঠিক তেমনি, যেমন নিখুঁত স্ফটিক একটি নীল ফুলের সংস্পর্শে এসে নীলাভ দেখায়, অথচ স্ফটিকের নিজস্ব রং অপরিবর্তিত থাকে। অবিদ্যা ব্রহ্মের উপর অধ্যস্ত—আরোপিত—অর্থাৎ, এটি ব্রহ্মের অন্তর্গত নয়, আবার সম্পূর্ণ পৃথকও নয়।

এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরের বিপরীতে নয়, বরং একই বাস্তবতার দুই স্তরের ব্যাখ্যা। ভামতী যখন বলে অবিদ্যা জীবের মধ্যে, তখন সে অভিজ্ঞতার ব্যাবহারিক স্তর বোঝায়; বিবরণ যখন বলে এটি ব্রহ্মের মধ্যে, তখন সে পারমার্থিক স্তর বোঝায়। চূড়ান্ত উপলব্ধিতে এই দুই অবস্থান পরস্পরবিরোধী নয় বরং পরিপূরক—দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যমাত্র।

এখানে একটি গভীর যৌক্তিক চ্যালেঞ্জ উত্থাপিত হয়—আশ্রয়-অনুপপত্তি, অর্থাৎ, “অবিদ্যা কোথায় অবস্থিত”, এই প্রশ্নের নিজস্ব অসুবিধা। যদি জীবের মধ্যে অবিদ্যা থাকে, তবে জীব নিজেই তো অবিদ্যা থেকে উদ্‌ভূত; তখন জীব ও অবিদ্যা পরস্পরকে নির্ভর করে—যা একটি চক্রাকার যুক্তি (অন্যোন্যাশ্রয়-দোষ)। আবার যদি বলা হয়, ব্রহ্ম অবিদ্যার আশ্রয়, তবে সমস্যা দাঁড়ায়: শুদ্ধ, সর্বজ্ঞানময়, সর্ববোধস্বরূপ ব্রহ্ম কীভাবে অজ্ঞতার আশ্রয় হতে পারে? এই দোদুল্যমানতার সমাধান পাওয়া যায় একমাত্র তখনই, যখন অবিদ্যাকে অনির্বচনীয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়—এটি না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব, বরং “সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”।

অবিদ্যা তাই অধ্যস্ত—ব্রহ্মের উপর আরোপিত, কিন্তু ব্রহ্মের অংশ নয়। এটি ঠিক যেমন দড়ির উপর সাপ দেখা যায়: সাপ দড়ির মধ্যে সত্যিই নেই, আবার দড়ি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও নয়। জ্ঞান উদিত হলেই, অবিদ্যা—এই আরোপণ—অদৃশ্য হয়ে যায়, যেমন আলোর আগমনে অন্ধকার বিলীন হয়।

যে-মুহূর্তে এই উপলব্ধি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে ওঠে, অবিদ্যা-ভঙ্গ ঘটে। আবরণ ভেঙে যায়, বিক্ষেপ স্তব্ধ হয়। প্রতিফলিত চেতনা, চিদ্‌ভাস, তখন নিজের উৎসকে চিনে ফেলে—বিম্বকেই নিজের স্বরূপ হিসাবে স্বীকার করে। এটি কেবল বৌদ্ধিক উপলব্ধি নয়, বরং এক প্রত্যক্ষ আত্ম-জাগরণ—যেখানে জীব নিজের প্রকৃত সত্তা ব্রহ্ম হিসেবেই জেগে ওঠে। এই মুহূর্তে পৃথকত্বের দীর্ঘ স্বপ্ন ভেঙে যায়, আর আত্মা স্থির হয় তুরীয় চেতনার উজ্জ্বল বাস্তবতায়।

তখন আত্মা-অনাত্মা-বিবেক কেবল একটি ধারণা নয়, বরং জীবন্ত অনুভব—“আমি ব্রহ্ম”, এই স্বয়ং-উদ্‌ভাসিত সত্য। আবরণ-দোষ ও বিক্ষেপ-দোষ, বিপর্যয় ও ভ্রান্তি—সব অজ্ঞানজাত বিভ্রান্তি তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়। অন্তঃকরণ, যা এতদিন মেঘে আচ্ছন্ন ছিল—শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের পরিশুদ্ধতায় এক নির্মল দর্পণে পরিণত হয়। সেখানে সত্য প্রতিফলিত হয় বিকৃতি ছাড়াই, বাসনা ও সংস্কারের ছায়া আর থাকে না।

এই অবস্থায় আত্মা আর কোনো সত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমস্ত সত্তার ভিত্তি হয়ে ওঠে। সে কর্ম করে না, আবার তার উপর কোনো কর্মের ছাপও পড়ে না। আত্মা এখানে সাক্ষী—অচল, নীরব, অজর—যিনি কেবল সব কিছুর উপস্থিতি উপলব্ধি করেন, কিন্তু কোনো কিছুতেই আবদ্ধ নন।

এই উপলব্ধির পর, অদ্বৈত দর্শনের সমস্ত তাত্ত্বিক মতবাদ—মূল-অবিদ্যা, কারণ-শরীর, উপাধি, বিবর্তবাদ, প্রতিবিম্ববাদ, অবচ্ছেদবাদ—সবই তাদের স্থান হারায়। এগুলি তখন কেবল শিক্ষাগত সহায়ক উপায় (অধ্যারোপ-অপবাদ-পদ্ধতি), পথ দেখানোর উপকরণ, সত্য নয়। যেমন আঙুল চাঁদকে নির্দেশ করে, কিন্তু চাঁদ আঙুল নয়—তেমনি এই মতবাদগুলি ব্রহ্মের দিকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু ব্রহ্মকে ধারণ করতে পারে না।

যখন জ্ঞান-প্রকাশ আত্মাকে আলোকিত করে, তখন অদ্বৈততা নিজের পরিপূর্ণ বাস্তবতায় উদ্‌ভাসিত হয়, যেখানে দ্বৈত ও অদ্বৈত উভয় ধারণাই বিলীন হয়। সেই অবস্থায় এমনকি “অদ্বৈত-বাদ” ধারণাটিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, কারণ, যা প্রকাশিত হয়েছে তা আর কোনো তত্ত্ব নয়—তা স্বয়ং-প্রকাশিত সত্য, চিরস্থায়ী, অব্যক্ত, অপরিবর্তনীয় ব্রহ্ম।

মিথ্যাত্ব অদ্বৈত বেদান্তের দার্শনিক হৃদস্পন্দন—এটি কেবল বিভ্রমের ব্যাখ্যা নয়, বরং বাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রকৃতির উপলব্ধি। অদ্বৈত দর্শন অনুযায়ী, জগৎ মিথ্যা—কিন্তু এই “মিথ্যা” শব্দের অর্থ “অস্তিত্বহীন” নয়। বরং মিথ্যা অর্থ সেই অনির্বচনীয় মধ্যাবস্থা, যা একদিকে অভিজ্ঞতাযোগ্য, অন্যদিকে চূড়ান্ত সত্য নয়।

এই মিথ্যাত্বের সংজ্ঞা—সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্—অর্থাৎ, “যা না সৎ, না অসৎ”—এক গভীর দ্বন্দ্বময় সত্য প্রকাশ করে। দড়ির উপর সাপ দেখা (রজ্জু-সর্প), ঝিনুকে রুপা প্রতিভাত হওয়া (শুক্তি-রজত), বা স্বপ্নে জগৎ দেখা—এগুলি এমন অভিজ্ঞতা, যা অনুভবের সময় সম্পূর্ণ বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু পরবর্তী উচ্চতর জ্ঞান উদিত হলে বিলোপিত হয়। এই বিলোপন বা বাধ প্রক্রিয়া মিথ্যা ও সত্যের স্তরবিন্যাস বোঝার মূল উপায়।

অদ্বৈত বেদান্ত এই প্রেক্ষিতে বাস্তবতার তিনটি স্তর নির্ধারণ করে, যাদেরকে একসাথে বলা হয় সত্তা-ত্রয়:

প্রথমত, পারমার্থিক-সত্তা, যা একমাত্র ব্রহ্ম-এর। এটি চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, স্বয়ং-আলোকিত ও স্বাধীন সত্তা—যার জ্ঞানই সব কিছুর ভিত্তি।

দ্বিতীয়ত, ব্যাবহারিক-সত্তা, যা অভিজ্ঞতার জগৎ—কারণ ও কার্য, কর্ম ও ফল, নৈতিকতা ও সম্পর্কের জগৎ—যা মায়া ও অবিদ্যা দ্বারা টিকিয়ে রাখা হয়।

তৃতীয়ত, প্রাতিভাসিক-সত্তা, যা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিভ্রমের স্তর—স্বপ্ন, কল্পনা, হ্যালুসিনেশন—যা একান্তই মানসিক প্রক্ষেপণ।

এই তিন স্তরের পারস্পরিক সম্পর্ক বাধ-নিয়মে প্রকাশিত হয়—প্রতিটি নিম্নতর স্তর উচ্চতর স্তরের দ্বারা বিলোপিত হয়। স্বপ্নকে জাগ্রত অবস্থা বিলোপিত করে, জাগ্রত অবস্থাকে আত্ম-জ্ঞান বিলোপিত করে এবং আত্ম-জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা নিজেই বিলীন হয়।

কিন্তু বাধ ধ্বংস নয়; এটি রূপান্তর। এটি অভিজ্ঞতাকে মুছে দেয় না, বরং তার প্রকৃত অবস্থান প্রকাশ করে। দড়িকে সাপ মনে করা এক ত্রুটি, কিন্তু দড়ি চিনে নেওয়ার পর সাপ অদৃশ্য হয় না—তার “বাস্তবতার দাবি” হারায়। একইভাবে, ব্রহ্ম-জ্ঞান উদিত হলে জগৎও বিলোপিত হয় না; বরং জানা যায় যে, এটি কেবল আপাত, ব্রহ্মের উপর প্রক্ষেপিত নাম-রূপের নৃত্য।

এই সম্পর্কই বাধ-সম্বন্ধ—যেখানে বাধক-জ্ঞান (বিলোপকারী জ্ঞান) বাধিত-অজ্ঞান (বিলুপ্ত অজ্ঞতা)-কে অপসারিত করে। আলো যেমন অন্ধকারকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু অন্ধকারের কোনো ছায়া রেখে যায় না, তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞান অজ্ঞতাকে দূর করে, তবুও জগৎকে বিলোপ না করে তাকে সঠিক স্বরূপে—ব্রহ্মের আভাস হিসেবে—উন্মোচিত করে।

এভাবে মিথ্যাত্বের ধারণা অদ্বৈত দর্শনে নেতিবাচক নয়, বরং গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি। এটি শেখায় যে, “মিথ্যা” অর্থ অনুপস্থিত নয়, বরং “নির্ভরশীল”—যা নিজে টিকে থাকতে পারে না, কিন্তু পরম সত্যের আলোয় স্বীকৃত। স্বপ্ন যেমন জাগরণের দ্বারা সংশোধিত হয়, তেমনি জগৎও ব্রহ্ম-জ্ঞান দ্বারা সংশোধিত হয়। এই সংশোধনই মুক্তি—দেখার পরিবর্তন, বস্তুর নয়।

অদ্বৈত বেদান্তে “মিথ্যাত্ব” বা “অবাস্তবতা” নির্ণয় করার দুটি মূল মানদণ্ড আছে।

প্রথমত, সত্তা-অনুসন্ধান-অভাব—কোনো কিছু যদি সব অবস্থায় সমানভাবে টিকে না থাকে, অর্থাৎ কখনো থাকে, কখনও থাকে না, তবে সেটি সত্য নয়। যেমন স্বপ্নে-দেখা বস্তু জাগরণের পর মিলিয়ে যায়, তাই সেটি টিকে থাকা সত্য নয়।

দ্বিতীয়ত, বাধ-যোগ্যতা—কোনো অভিজ্ঞতা যদি উচ্চতর জ্ঞান বা প্রমাণের দ্বারা নিবারিত হয়, তবে সেটিও মিথ্যা। যেমন, দূর থেকে মরীচিকায় জল মনে হলেও কাছে গেলে বোঝা যায়, সেখানে জল নেই; জ্ঞান উদয় হওয়ায় ভ্রম নষ্ট হয়।

এই দুটি পরীক্ষায় যদি কোনো বস্তু বা ধারণা উত্তীর্ণ হয়, তবে সেটি “মিথ্যা” অর্থাৎ আপাত ও নির্ভরশীল—নিজস্ব স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।

অবিদ্যা এই দুই মানদণ্ডেই মিথ্যা। কারণ, এটি কেবল যতক্ষণ সত্য জ্ঞান উদিত হয়নি, ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে; আর একবার ব্রহ্ম-জ্ঞান উদয় হলে অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়—তার কোনো চিহ্নও থাকে না। তাই অবিদ্যা নিজেই আপাত-অস্তিত্বশীল; এর স্থায়িত্ব কেবল অজ্ঞানের সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

অর্থাৎ, জ্ঞানের আলো জ্বলে উঠলে অবিদ্যা-রূপ অন্ধকার যেমন নিজে থেকেই বিলীন হয়, তেমনি আত্মস্বরূপের উপলব্ধি ঘটলে অবিদ্যা আর কোথাও থাকে না—কারণ অন্ধকার কখনো আলোকে সহাবস্থান করতে পারে না।

এই মিথ্যা-সত্তা-র ব্যাখ্যার জন্য অদ্বৈত বেদান্ত প্রয়োগ করে বিবর্ত-বাদ—যে-মত বলে, জগৎ ব্রহ্মের কোনো বাস্তব পরিণাম নয়, বরং এক আপাত-রূপান্তর। যেমন আগুনে তাপ থাকা সত্ত্বেও আগুন তার স্বরূপ পরিবর্তন করে না, তেমনি প্রকাশ ব্রহ্মকে পরিবর্তিত করে না। ঘট-আকাশ ও মহাকাশ-ন্যায় এই সত্যটিই দেখায়—স্থান কলসের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়, অথচ প্রকৃতপক্ষে কোথাও বিভাজন ঘটে না। কলস ভাঙলে “ঘট-আকাশ” মহাকাশে মিশে যায়, কিন্তু এটি নতুন কোনো মিলন নয়, কেবল এক বিভ্রমের অপসারণ। এভাবে, উপাধি-সম্বন্ধ এক অবিভক্ত চেতনার উপর বহুত্বের আভাস সৃষ্টি করে, অথচ চেতনা নিজে চিরস্থির, অপরিবর্তনীয় থাকে।

অবিদ্যা-উপাধি-কার্য-ভেদ এখানে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। মূল-অবিদ্যা, যা কারণ-শরীর নামে পরিচিত, ব্যক্তিগত অস্তিত্বের বীজরূপ। এর মধ্য থেকেই সূক্ষ্ম-শরীর জন্ম নেয়—মন, বুদ্ধি, অহং ও প্রাণশক্তির জটিল কাঠামো, যা অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম অবলম্বন। পরে স্থূল-শরীর, অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়সমৃদ্ধ শারীরিক গঠন, এই সূক্ষ্ম কাঠামো থেকেই উদ্‌ভূত হয়। এই তিনটি—কারণ, সূক্ষ্ম ও স্থূল দেহ—জীবকে জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি-র অভিজ্ঞতা দেয়। তারা পৃথক সত্তা নয়; বরং অবিদ্যার ধারাবাহিক প্রকাশমাত্র, যেমন সূর্যের চারপাশে সমকেন্দ্রিক মেঘের স্তর আত্মার আলোকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

যখন আত্মা-অনাত্মা-বিবেক পরিপক্ব হয়, তখন এই আবরণগুলি স্পষ্টভাবে “অনাত্মা”—অর্থাৎ, “আমি নই”—হিসেবে স্বীকৃত হয়। তখন আত্মা-সাক্ষী সমস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে অপরিবর্তনীয়ভাবে জ্বলে ওঠে, চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে আলোকিত করে, কিন্তু কখনও তাদের দ্বারা স্পর্শিত হয় না। এই চেতনা হচ্ছে সেই নিঃশব্দ আলোক, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও ঘুমের মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান।

যে-মুহূর্তে বুদ্ধি এই আলোককে সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে প্রতিফলিত করে, তখন ঘটে অপরোক্ষ-অনুভূতি—সরাসরি উপলব্ধি—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”। এটি কোনো নতুন জ্ঞান নয়, বরং অজ্ঞান-বৃত্তির সমাপ্তি, মনের অন্ধকার সরে যাওয়া। সেই মুহূর্তে জীব আর জ্ঞাতা বা অভিজ্ঞ নয়—সে নিজেই অভিজ্ঞতার উৎস, চেতনার একক ভিত্তি। তখন সমস্ত স্তরের মিথ্যা-সত্তা বিলীন হয় এবং যা অবশিষ্ট থাকে, তা একমাত্র সত্য—চিরন্তন, নিরুপাধি, স্বয়ং-আলোকিত ব্রহ্ম।