একইভাবে Advaita-Vision.org-এর বিশ্লেষণে একে বলা হয়েছে “দ্বিস্তরীয় বাস্তবতার তত্ত্ব” (Two-tiered Reality Doctrine), যেখানে অভিজ্ঞতার সত্য (empirical truth) ও অস্তিত্বের সত্য (ultimate reality) স্পষ্টভাবে পৃথক।
অব্যাবহারিক-সৃষ্টি-বাদ শেখায়—পরমার্থে: ব্রহ্ম অচল, অনাদি, অভিন্ন; কোনো সৃষ্টি হয়নি। ব্যাবহারিক স্তরে: কর্ম, ধর্ম, অভিজ্ঞতা ও প্রপঞ্চ সত্য বলে প্রতীয়মান।
অতএব, “সৃষ্টি” কেবল চেতনার ব্যাবহারিক প্রক্ষেপ, ontological অর্থে নয়। যেমন কাঠের স্বরূপ অপরিবর্তিত থেকেও নানা রূপ ধারণ করে, তেমনি ব্রহ্ম অপরিবর্তিত থেকেও মায়ার প্রেক্ষিতে জগৎরূপে “ব্যাবহারিকভাবে” প্রতীয়মান—সৃষ্টির ছায়া আছে, কিন্তু জন্ম নেই।
২১. নিবর্তিত-বিকল-মনবাদ (Nivṛta-vikala-manavāda) অদ্বৈত বেদান্তের এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাধারা, যা মুক্তির (জ্ঞানলাভের) পর মনের অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে। এই মতে, জ্ঞানপ্রাপ্তির পর মন ধ্বংস হয় না, বরং “বিকল” অর্থাৎ কর্মক্ষমতাহীন বা কার্যহীন হয়ে পড়ে। মন তখন আর “বিভ্রম”, “প্রক্ষেপ”, বা “বিক্ষেপ”-এর কারণ হয় না; চৈতন্যে স্থিত থেকে এক নিস্ক্রিয় ছায়ারূপে থেকে যায়—ন লীয়তে (ঈশাবাস্য উপনিষদের প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত)—"তিনি লিপ্ত হন না" বা "তিনি কর্মফলে আবদ্ধ হন না"।
এই ধারণাটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে ভামতী-প্রবাহে (Vāchaspati Miśra’s Bhāmatī) ও যোগবাশিষ্ঠ-এর মুক্তিপ্রসঙ্গ অধ্যায়ে। ভামতী-ধারায় বলা হয়েছে—মুক্তিপ্রাপ্ত জ্ঞানীর মন ধ্বংস হয় না, কারণ মনই ব্রহ্মানুভূতির মাধ্যম; তবে জ্ঞানোত্তর অবস্থায় তা “নিবৃত্ত”, “বিকল” বা “নিষ্ক্রিয়” হয়ে পড়ে—যেমন একটি দগ্ধ দড়ি নিজের রূপ বজায় রাখলেও আর কিছু বাঁধতে পারে না।
যোগবাশিষ্ঠ (উত্তরসর্গ, নির্বাণপ্রকরণ) এ বলা হয়েছে—“চিত্তমপ্যুন্মীলনহীনং নির্বৃত্তম্ ইব দগ্ধরজ্জুসদৃশম্।”—“জ্ঞানীর চিত্ত দগ্ধ দড়ির মতো, যা আছে, কিন্তু কিছু বাঁধে না।” অর্থাৎ, মন তখন রূপে আছে, কিন্তু ক্রিয়ায় নিস্ক্রিয়।
অদ্বৈত বেদান্তে মন (antaḥkaraṇa) জ্ঞানের “উপাধি” বা “অবয়ব”—চৈতন্য তার মধ্য দিয়েই আত্ম-স্বরূপে প্রতিফলিত হয়। জ্ঞানপ্রাপ্তির আগে এই মনই কর্ম, বিকার ও অজ্ঞান-প্রক্ষেপের কারণ; কিন্তু জ্ঞানোত্তর অবস্থায়, যখন চৈতন্য নিজের স্বরূপে স্থিত, তখন মন আর কোনো বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে না।
এখানে “নিবর্তন” (nivṛtti) মানে ধ্বংস নয়, বরং কার্যহীনতা বা নিষ্ক্রিয়তা। মন থাকে, কিন্তু তার কর্মশক্তি নিঃশেষ। যেমন আগুনে দগ্ধ দড়ি বাহ্যরূপে অবিকৃত মনে হলেও আর বাঁধার সক্ষমতা রাখে না, তেমনি মুক্ত অবস্থায় মন নিজের ভ্রমজনক গতি হারায়—চৈতন্যে লীন হয়ে এক শুদ্ধ “প্রতিবিম্বরূপ অবস্থা”-য় থাকে। উদাহরণস্বরূপ—
১. দগ্ধ দড়ি দৃষ্টান্ত: আগুনে-পোড়া দড়ি বাহ্যরূপে দড়ির মতো দেখায়, কিন্তু সেটি আর কিছু বাঁধতে পারে না। মুক্ত জ্ঞানীর মনও তেমনি রূপে অবশিষ্ট থাকে, কিন্তু আর অজ্ঞান বা বিকার সৃষ্টিতে সক্ষম নয়।
২. নির্বাপিত প্রদীপ দৃষ্টান্ত: প্রদীপ নিভে গেলে কিছুক্ষণ সলতে জ্বলন্ত ছাইয়ের মতো থাকে, যা আলো দেয় না—মনও তেমনি দেহে অবস্থান করলেও আর জগৎ-প্রক্ষেপে সক্রিয় নয়।
এই মতের তাৎপর্য হলো—“মন লয় পায়” বলা অদ্বৈতের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক; কারণ মন লয় পেলে মুক্তজীবনের অভিজ্ঞতা বা “জীবন্মুক্তি” অসম্ভব হত। নিবর্তিত-বিকল-মনবাদ তাই জীবন্মুক্তির অবস্থাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করে—জ্ঞানী ব্যক্তি দেহধারণ করেও জগৎ-প্রক্ষেপে আর অংশ নেন না।
ভামতী-পরম্পরার বিশ্লেষণে (দ্রষ্টব্য: ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ভামতী টীকা, ৪.১.১৫) বলা হয়েছে—“মনো নিবর্তিতং ন লীণম্; দগ্ধরজ্জুসদৃশম্।” অর্থাৎ, “মন ধ্বংস হয়নি, কিন্তু পোড়া দড়ির মতো কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।”
আধুনিক বিশ্লেষণে, Wisdom Library ও Advaita Vision-এর আলোচনায় এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে—“জ্ঞানলাভের পর মন থাকে, কিন্তু দগ্ধ দড়ির মতো—রূপ আছে, শক্তি নেই। জ্ঞানী মন সব দেখে, কিন্তু আর কোনো প্রক্ষেপণ সৃষ্টি করে না।”
নিবর্তিত-বিকল-মনবাদ শেখায়—জ্ঞানপ্রাপ্তির পর মন থাকে, কিন্তু নিষ্ক্রিয়। তার সমস্ত “কর্মশক্তি” লুপ্ত হয়ে যায়, আর চৈতন্য থাকে পরিপূর্ণ স্বরূপে উদ্ভাসিত। মন তখন কেবল এক নিঃসংশ্লিষ্ট প্রতিবিম্ব, যেখানে চিন্তা নেই, বিকার নেই, কেবল ব্রহ্মস্বরূপের নিস্তরঙ্গ শান্তি।
যেমন আগুনে দগ্ধ দড়ি আর কোনো বস্তুকে বাঁধতে পারে না, তেমনি জ্ঞানীর মনও আর কোনো “আমি ও আমার” সম্পর্ক গঠন করতে পারে না—এটাই তার নিঃশেষ নিবৃত্তি ও পরম মুক্তি।
এই ধারাগুলি যদিও ভিন্ন ভাষায় ও রূপে কথা বলে—কোথাও বলা হয়েছে “একটিও সৃষ্টি হয়নি”, কোথাও “ব্রহ্ম নিজেই স্বতঃসিদ্ধ”, আবার কোথাও “ব্রহ্মের প্রকাশ স্তরবিন্যস্ত”, “ব্যাবহারিক সৃষ্টি স্বীকারযোগ্য”, কিংবা “জ্ঞানলাভে মনের কার্যকারিতা শেষ হয়”—তবুও তাদের মূল সিদ্ধান্ত একত্রে একই সত্যে এসে মেলে: চৈতন্যই একমাত্র পরমার্থসত্তা এবং জগৎ বা সৃষ্টি তারই অভিজ্ঞতা-খেলা ও স্বপ্রকাশের আভাসমাত্র। এই দর্শনধারার ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি রচিত হয়েছে প্রাচীন গ্রন্থসমূহে—বিশেষত গৌড়পাদাচার্যের মাণ্ডূক্যকারিকা-র “অজাত”-বোধ, এবং তার পরবর্তী শঙ্করোত্তর উপভাষ্য ও টীকাসমূহের বিশ্লেষণে, যেখানে এই চিন্তাধারাগুলি একে অপরের পরিপূরক রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে।
যদি আমরা “সৃষ্টি নয়”, “ব্রহ্মই চির-সিদ্ধ”, “ ব্যাবহারিক এবং সত্তাগত ভাগ” ইত্যাদি বিষয়গুলো গভীরে অনুধাবন করি, তাহলে যত সাধন-চিন্তা, মুক্তি-আগ্রহ, জীব-উৎপত্তি-ভ্রম—সবই নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়। উদাহরণস্বরূপ—স্বপ্নবিশ্ব, দড়ি-সাপ ভ্রম, আয়নায় মুখ প্রতিফলন—সবই এই তত্ত্বগুলোর জীবন্ত নিদর্শন।
এই ব্যাখ্যাগুলি যাচাই-সংবেদশীল পাঠ ও মনন-প্রক্রিয়ায় সহায়ক। আলাদা করে প্রতিটি গ্রন্থ-উৎসে ডুব দেওয়া গেলে, নিমিত্ত-উপাদান-কারণ-নিমিত্ত-বিশ্লেষণ, মন-বৃত্তি-চৈতন্য-উপবিতর্ক ইত্যাদি আরও স্পষ্ট হবে।
সব ধারার মর্ম একটাই—চৈতন্যই একমাত্র সত্য, অচল, অভিন্ন ও স্বয়ংপ্রকাশমান। জগৎ সেই চৈতন্যেরই প্রতিফলন, প্রতিভাস বা আভাসমাত্র; সৃষ্টির ভেদাভেদ কেবল মন ও মায়ার প্রক্ষেপণ।
অদ্বৈত বেদান্তে এই সত্যকে ব্যাখ্যা করতে যে-সকল প্রধান ধারা (ভামতী থেকে বিবর্ত-বিস্তারবাদ পর্যন্ত) বিকশিত হয়েছে, তার সঙ্গে আরও কয়েকটি উপধারা—যেমন অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান কারণবাদ, প্রতিবিম্ববাদ, সংকর-আভাসবাদ, দ্বিস্তর-বাস্তবতা ও নিবর্তিত-মনবাদ—যোগ করলে মোট প্রায় একুশটি সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা গঠিত হয়।
এই একুশটি দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা দর্শন নয়; এগুলি একই অদ্বৈত সত্যকে নানা দিক থেকে উন্মোচনের প্রচেষ্টা। শেষপর্যন্ত সব মতেই এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়—ব্রহ্ম এক, চৈতন্য এক; জগৎ তারই চেতনা-উদ্ভাস, আর মুক্তি মানে কোনো অর্জন নয়—এই প্রক্ষেপণের অন্তরেই নিজের ব্রহ্মস্বরূপে জেগে ওঠা। “অহং ব্রহ্মাস্মি”—এই অনন্ত চেতনা-স্মৃতিই সব দর্শনের পরিণতি।
অবিদ্যার তত্ত্ব এক গভীর অনুসন্ধানের আকারে শুরু হয়—“বাস্তবতাকে কী আচ্ছন্ন করে?”—কিন্তু তার সমাপ্তি ঘটে এই উপলব্ধিতে যে, বাস্তবতা কখনও আচ্ছন্নই ছিল না। এই শুরু ও শেষের মধ্যবর্তী পরিসরেই অদ্বৈত বেদান্তের সমগ্র দ্বান্দ্বিক নৃত্য সম্পন্ন হয়: অধ্যারোপ ও অপবাদ—অর্থাৎ, আরোপণ ও পরিত্যাগ।
প্রথমে অবাস্তবকে স্বীকার করতে হয় আপাত-প্রকাশের কারণ বোঝাতে, তারপর পার্থক্য-জ্ঞান (বিবেক) উদ্ভাসিত হলে সেই স্বীকৃতি প্রত্যাহৃত হয়। যেমন দড়ির উপর সাপ দেখা বিভ্রম বিলোপিত হয় কেবল তখনই, যখন দেখা যায়, “এটি দড়ি”, তেমনি অবিদ্যা-র পর্দা সরিয়ে দিলে বোঝা যায়, কোনো পর্দাই কখনও ছিল না। অদ্বৈত ব্যাখ্যার এই সহানুভূতিশীল কৌশল—যা বিভ্রমকে স্বীকার করেও তাকে অবশেষে নাকচ করে—অধ্যারোপ-অপবাদ-পদ্ধতিরই রূপ।
এই দ্বান্দ্বিকতাকে এক মন্ত্রে সংক্ষেপ করা হয়েছে: ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ। ব্রহ্ম একমাত্র পারমার্থিক বাস্তবতা, জগৎ অভিজ্ঞতামূলক স্তরে বাস্তব বলে মনে হলেও চূড়ান্তভাবে মিথ্যা, আর জীব ও ব্রহ্মের পৃথকতা কেবল অবিদ্যার বিভ্রমমাত্র। মানুষ ভুল করে প্রতিফলনকে মূল বলে ধরে, বিম্বকে ভুলে প্রতিবিম্বে নিজের পরিচয় খোঁজে—এটাই জীবত্বের মূল। চেতনার জ্যোতি (চিদ্ভাস) মনের আয়নায় পড়ে, আর সেই প্রতিফলনেই অহং ঘোষণা করে, “আমিই এই শরীর, আমিই মন”।
এই বিভ্রম থেকেই জন্ম নেয় বন্ধন—যেখানে অসীম নিজেকে সসীম বলে মনে করে, চৈতন্য নিজেকে জড়ের সাথে অভিন্ন ভাবতে থাকে। সেই মিথ্যা পরিচয়ের জাল গাঁথা হয় বাসনা, সংস্কার ও কর্মের অগণিত সুতায়—অতীত অভিজ্ঞতার ক্ষীণ কিন্তু প্রভাবশালী প্রতিধ্বনিগুলিতে। মনের দর্পণে এরা জমে-থাকা ধূলির মতো, যা চেতনার আয়নাকে মলিন করে রাখে। সাধনার প্রক্রিয়া, চিত্ত-শুদ্ধি, এই ধূলি ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়; মন পরিষ্কার হয়, কিন্তু কেবল জ্ঞানই—সেই প্রত্যক্ষ বাধক-জ্ঞান—অবিদ্যার শেষ সুতোটি ছিন্ন করতে পারে। কারণ অবিদ্যা কোনো আংশিক পরিশোধন দ্বারা নয়, কেবল সত্য-জ্ঞান-প্রকাশ দ্বারা শেষ হয়।
মুক্তি তাই কোনো সৃষ্ট অবস্থা নয়, বরং ভ্রান্তির বিলুপ্তি। যখন জ্ঞান উদয় হয়, তখন দেখা যায়, ব্রহ্ম কখনও আচ্ছন্ন ছিলেন না, জীব কখনও আবদ্ধ ছিল না, আর জগৎ কখনও সত্য ছিল না—শুধু চেতনার পরম স্বচ্ছতায় এক ক্ষণিক তরঙ্গ উঠেছিল, যে নিজেকে বাস্তব বলে ভুল করেছিল। জ্ঞানের আলোয় সেই তরঙ্গ ব্রহ্মের অসীম সাগরে মিলিয়ে যায়, আর, যা অবশিষ্ট থাকে, তা কেবল চিরস্থায়ী পূর্ণতা।
কার্যকারণতার যে-আপাত-ধারাবাহিকতা আমরা দেখি—যা সৃষ্টি বলে মনে হয়—তা মায়া-শক্তির কার্যকলাপের ফল। এই শক্তি একযোগে দুই ভূমিকা পালন করে: আবরণ ও বিক্ষেপ। প্রথমে এটি সত্য-ব্রহ্মকে আড়াল করে, তারপর সেই আচ্ছন্ন ভিত্তির উপর বহুত্ব প্রক্ষেপণ করে। যেন এক আয়না নিজেই ধুলোয় ঢেকে গিয়ে তার প্রতিবিম্বকে বিকৃত করে, তেমনি মায়া চেতনার স্বচ্ছতাকে গোপন করে এবং সেই গোপনতার উপর একটি কল্পিত বহুবিশ্ব নির্মাণ করে।
মায়া ও অবিদ্যার পার্থক্য সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর। মায়া সমষ্টিগত, মহাজাগতিক মাত্রায় কার্যকর—ঈশ্বরের (ঈশ্বর-অধিষ্ঠিত) শক্তি, যিনি তার নিয়ন্ত্রক; অবিদ্যা ব্যক্তিগত, ব্যষ্টি-স্তরে সক্রিয়—জীবের চেতনায় সীমাবদ্ধতার অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। এই দুইয়ের যোগেই ঈশ্বর ও জীবের আপাত-ভেদ জন্ম নেয়। তাই বলা হয়, ঈশ্বর-জীব-ভেদ অবিদ্যা-কৃত—অজ্ঞতারই সৃষ্টি; যখন অজ্ঞান বিলীন হয়, তখন ভেদও বিলীন হয়, আর, যা অবশিষ্ট থাকে তা একমাত্র ব্রহ্ম।
যতক্ষণ উপাধি—দেহ, মন, ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধ আচ্ছাদন—অবশিষ্ট থাকে, জীব নিজেকে সসীম জ্ঞাতা বলে অনুভব করে। সে তখন প্রমাণত্রয়—প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ (সাক্ষ্য)—এর মাধ্যমে জগৎকে জানার চেষ্টা করে। কিন্তু এই প্রমাণগুলি ব্যাবহারিক জগতের সীমার মধ্যে আবদ্ধ; তারা পারমার্থিক সত্যে প্রবেশ করতে পারে না। কারণ তারা, যা জানায়, তা উপাধি দ্বারা শর্তিত। প্রকৃত জ্ঞান, যা মুক্তির কারণ, উদ্ভূত হয় কোনো পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণ থেকে নয়, বরং এক তাৎক্ষণিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে—অপরোক্ষ অনুভূতি, যেখানে দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন একীভূত হয়।
এই জাগরণের মুহূর্তে, যে-শক্তি এতকাল সত্যকে আড়াল করেছিল—আবরণদোষ—তা গলে যায়; আর যে শক্তি বহুত্ব প্রক্ষেপণ করেছিল—বিক্ষেপদোষ—তা থেমে যায়। মন এখন ব্রহ্ম-জ্ঞান দ্বারা আলোকিত, তাই আর বিষয়-বস্তুর মধ্যে দোল খায় না। আত্মা তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলে ওঠে সাক্ষীচৈতন্য হিসাবে—যে-চেতনা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থাকেই পরিব্যাপ্ত করে, তবুও তাদের দ্বারা কখনও স্পর্শিত হয় না। যখন এই সাক্ষী চেতনা অবস্থার ত্রয়ীকেও অতিক্রম করে, তখন উদিত হয় তুরীয়—কালহীন, বিষয়বস্তুহীন, অপরিবর্তনীয় চৈতন্য, যা না জানে, না জানায়—কেবল আছে।