অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৫০



এখানে “স্বতঃসিদ্ধতা” মানে—চৈতন্যের কোনো “বাইরের” প্রমাণের প্রয়োজন নেই। যেমন নিজের অস্তিত্ব জানতে আর কোনো সাক্ষ্য লাগে না—“আমি আছি”—এই বোধ নিজেই নিজের প্রমাণ। তাই শঙ্করীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—“স্বরূপসিদ্ধত্বাৎ ব্রহ্মণঃ, তন্মূলকপ্রমাণানামপেক্ষা নাস্তি।” অর্থাৎ, ব্রহ্ম নিজের স্বরূপেই সিদ্ধ, তাই তাকে বোঝাতে অন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

যেমন আপনি নিজেকে উপলব্ধি করছেন—“আমি ভাবছি”, “আমি জানছি”—এই উপলব্ধি নিজেই সেই চেতনার প্রতিফলন। আপনি চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন, কিন্তু সেই পর্যবেক্ষক-চেতনা নিজে কখনও পর্যবেক্ষণের বিষয় হয় না; কারণ সে-ই সব অভিজ্ঞতার আলো। এই চেতনা-সত্তাই ব্রহ্ম। সে কোনো “বাহ্য” কারণের দ্বারা উদ্‌ভূত নয়, বরং সমস্ত কারণ ও ফল তার মধ্যেই ঘটে।

আরও একটি উদাহরণ—সূর্য নিজের আলোয় নিজেকে ও অন্য সব কিছু আলোকিত করে; কিন্তু সূর্যকে আলোকিত করার জন্য অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন নেই। তেমনি ব্রহ্মচৈতন্যই সর্বজ্ঞান, সর্বঅস্তিত্ব ও সর্বপ্রকাশের উৎস।

স্বতঃসিদ্ধ-ব্রহ্মবাদ অদ্বৈতের চূড়ান্ত স্বরূপে নিয়ে যায়। এখানে ব্রহ্ম কোনো “অস্তিত্বসিদ্ধ ফল” নয়, বরং অস্তিত্বের উৎস। সৃষ্টি, বিকাশ, পরিবর্তন—সবই আপাত বা মায়াজাত, কারণ পরিবর্তনের জন্য “পূর্ব” ও “পরবর্তী” ধারণা থাকতে হয়, যা চির-অচল ব্রহ্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই মুক্তিও কোনো “অর্জন” নয়, বরং নিজের স্বতঃসিদ্ধ চৈতন্যকে চিনে নেওয়া।

যদিও এই তত্ত্বটি শঙ্কর বা গৌড়পাদের মূল রচনায় কোনো নির্দিষ্ট নামে সুসংহতভাবে উল্লেখ নেই, পরবর্তী ভাষ্যকারেরা—যেমন চিৎসুখাচার্য, বিদ্যারণ্য, এবং সচ্চিদানন্দ যতি—এই ধারণাটিকে “স্বতঃসিদ্ধ ব্রহ্মতত্ত্ব (svataḥ-siddha-brahma-tattva)” নামে বিশ্লেষণ করেছেন।

আধুনিক গবেষণাতেও (যেমন Advaita-vision.org, Wisdom Library, এবং JSTOR-এর “Self-luminosity and Self-evidence in Advaita Vedānta” প্রবন্ধসমূহে) এই মতকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “self-evident consciousness doctrine” বা “স্বপ্রমাণ ব্রহ্মতত্ত্ব” হিসেবে—যেখানে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের অস্তিত্ব অন্য কোনো প্রমাণের অপেক্ষায় নয়; সে নিজেই নিজের প্রমাণ, নিজের আলোয় নিজেকে ও সব কিছুকে আলোকিত করে।

স্বতঃসিদ্ধ-ব্রহ্মবাদ শেখায়—ব্রহ্মের অস্তিত্ব কোনো প্রমাণের বিষয় নয়; বরং সব প্রমাণ, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের উৎস সেই ব্রহ্মচৈতন্য। সে আগে ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সৃষ্টি বা মুক্তি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ ব্রহ্ম চিরসিদ্ধ, স্বপ্রকাশ ও অনন্ত—নিজেই নিজের প্রমাণ, নিজেই সমস্ত অস্তিত্বের আলো।

১৯. বিবর্ত-বিস্তারবাদ (Pariṇāma-Vistāra-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যাধারা, যেখানে “সৃষ্টি”কে কোনো বাস্তব রূপান্তর বা পরিবর্তন হিসেবে নয়, বরং চৈতন্যের স্ব-উদ্‌ভাস বা বিস্তার হিসেবে বোঝানো হয়েছে। এখানে ব্রহ্ম এক, অচল ও অভিন্ন—কিন্তু সেই এক চৈতন্যই নিজের মধ্য থেকে মায়া, প্রকৃতি, মন, ইন্দ্রিয় ও জগৎ—এই ক্রমে স্তরবিন্যস্ত প্রকাশরূপে উদ্‌ভাসিত হয়েছে।

এখানে “বিবর্ত” (pariṇāma) শব্দটি পরিবর্তন বা রূপান্তর অর্থে নয়, বরং “বিস্তার” (vistāra)—অর্থাৎ চৈতন্যের নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে বিকাশ, প্রসারণ ও প্রকাশ—এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সৃষ্টি তাই কোনো নতুন কিছু “ঘটে যাওয়া” নয়; বরং এক চিরন্তন ব্রহ্মচৈতন্যের নিজের দীপ্তির ভেতরেই অসংখ্য নাম-রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠা।

এই ধারার মূল সূত্র ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪) ও শাঙ্করভাষ্য-এ নিহিত, যেখানে বলা হয়েছে—“মৃৎঘটন্যমন্যত্র নৈব, মৃৎ ঘট ইতি।” অর্থাৎ, যেমন মাটি থেকে তৈরি পাত্রে নতুন কিছু জন্মায় না—পাত্ররূপে যা দেখা যায়, তা কেবল মাটিরই রূপভেদ; মাটি নিজে পরিবর্তিত হয়নি—তেমনি ব্রহ্মও অচল, অথচ নাম-রূপের বহুতায় নিজেকে প্রকাশ করে।

শঙ্কর এখানে “পরিণাম” (রূপান্তর)-এর ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন—ব্রহ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি মানে কোনো “বদল” নয়; এটি কেবল এক “আভাস”, এক “বিস্তার”—যেমন সূর্য নিজের অবস্থান না বদলিয়েও চারদিকে আলো ছড়ায়। এই আলোই “বিস্তার”, কিন্তু সূর্য অপরিবর্তিত।

পরবর্তী শঙ্করোত্তর আচার্যগণ, বিশেষত চিৎসুখাচার্য তাঁর তত্ত্বপ্রকাশিকা গ্রন্থে এবং বিদ্যারণ্য স্বামী পঞ্চদশী-তে এই ধারার বিশ্লেষণে বলেন, ব্রহ্মচৈতন্য নিজস্ব শক্তির দ্বারা ধীরে ধীরে মায়া, প্রকৃতি, মন ও ইন্দ্রিয় ইত্যাদি স্তরে নিজেকে প্রকাশ করেছে। তবে এই প্রকাশ কোনো বাহ্যিক বা কালগত সৃষ্টি নয়; এটি চৈতন্যের অভ্যন্তরীণ উদ্ঘাটন, নিজের মধ্যেই নিজের শক্তির প্রসারণ।

পঞ্চদশী (১.৫৫-৫৮)-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—“ব্রহ্মণো বিস্তৃতিঃ শক্ত্যা নামরূপবিভাগতঃ।” অর্থাৎ, ব্রহ্মের বিস্তার তার শক্তির মাধ্যমে ঘটে—যেখানে নাম ও রূপের বিভিন্নতা আসলে সেই এক চৈতন্যশক্তিরই বহুরূপ প্রকাশ।

“সোনার অলঙ্কার” দৃষ্টান্ত—সোনা থেকে নেকলেস, আংটি, কঙ্কণ, মুকুট ইত্যাদি নানা রূপ গঠিত হলেও সোনার স্বরূপ অপরিবর্তিত থাকে। একইভাবে ব্রহ্মচৈতন্যই সব কিছুর মূল “ধাতু”; নাম-রূপে বহুরূপী হলেও সত্তায় এক ও অভিন্ন।

আরেকটি উপমা হলো “দীপ” ও তার আলো—দীপ অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু তার আলো বিভিন্ন পাত্র, প্রাচীর ও রঙে নানা রূপে প্রতিফলিত হয়। এই আলো-প্রসারণই “বিস্তার”, কিন্তু দীপ নিজে অপরিবর্তিত। তেমনি ব্রহ্ম নিজের মধ্যেই মায়ার প্রতিচ্ছায়ায় নাম-রূপের খেলা রচনা করেছে।

বিবর্ত-বিস্তারবাদ ভামতী ও বিবরণ-ধারার মতো “মনবৃত্তি”-কেন্দ্রিক নয়। এটি মনের সীমা ছাড়িয়ে চেতনার মহাজাগতিক স্তরবিন্যাস দেখায়—ব্রহ্ম থেকে মায়া, মায়া থেকে প্রকৃতি, প্রকৃতি থেকে সূক্ষ্ম ও স্থূল উপাদান এবং শেষপর্যন্ত জগৎ—এই অনাদি ধারায় এক অবিচ্ছিন্ন চৈতন্যপ্রবাহ। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা কেবল আভাসরূপ; ব্রহ্মের মূল স্বরূপ সর্বদা অচল, অবিকৃত, স্বপ্রকাশ।

এই ভাবটি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬.৮)-এর উক্তি দ্বারা সমর্থিত। “ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে ন তৎসমশ্চাভ্যধিকশ্চ দৃশ্যতে। পরাস্য শক্তিবিবিধৈব শ্রুয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া।।” অর্থাৎ, ঈশ্বরের দেহ নেই, কোনো ইন্দ্রিয় নেই। তাঁর সমকক্ষ বা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই। বহু অসাধারণ গুণের অধিকারী তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রভৃত জ্ঞান ও কর্মশক্তির অধিকারী। শাস্ত্র এই কথাই বলেন।”

আমরা কেমন করে ব্রহ্মের স্বরূপ জানব? জানার একমাত্র উপায় উপলব্ধিমান আচার্যের মুখ থেকে তত্ত্বকথা শোনা। বস্তুত শাস্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, সে তো তাঁদেরই উপলব্ধির কথা। তাঁরা যে-সত্য নিজেরা অনুভব করেছেন, সেগুলিই নানান ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

'শ্রয়তে' অর্থ 'শ্রুতি' বা বেদ মতে। এর আর-এক অর্থ যা শোনা হয়। শুধু যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে ব্রহ্মকে জানা যায় না। তার জন্য চাই উপযুক্ত পথপ্রদর্শক, যিনি আমাদের পথ বলে দেবেন এবং যাঁর কথা প্রামাণ্য এবং অকাট্য। কে সেই পথপ্রদর্শক? বেদ। বেদ কিন্তু কতগুলি বই নয়। বেদ হলো যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সিদ্ধপুরুষদের উপলব্ধ সত্য, যা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আমাদের হাতে এসেছে।

এ নয় যে, দশহাজার বছর আগে কোনো একজন একবার এই সত্যকে অনুভব করেছিলেন এবং আজ আমরা বইয়ে সেকথা পড়ছি। যুগে যুগে বিভিন্ন আচার্য এই সত্য অনুভব করেছেন এবং বার বার উপলব্ধির কষ্টিপাথরে সেই সত্য যাচাই হয়েছে।

আপনি হয়তো বলবেন, যে কেউ এসেই তো দাবি করতে পারেন যে, তাঁর ব্রহ্মানুভূতি হয়েছে। তিনি যে আমাদের বোকা বানাচ্ছেন না, তার প্রমাণ কী?

প্রমাণ তাঁর জীবন, তাঁর জীবনচর্যা, অন্যের প্রতি তাঁর ব্যবহার। তিনি শুদ্ধ এবং নির্লিপ্ত, তাঁর কোনো বাসনা নেই, তিনি অহংশূন্য। তিনি নিঃস্বার্থ, সকলের প্রতি তাঁর সমান ভালোবাসা। এমন মানুষকে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, তিনি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, উচ্চকোটির মানুষ। বুঝবেন, তাঁর বিশেষ অনুভূতি হয়েছে।

'স্বাভাবিকী' বলতে স্বাভাবিক বা স্বভাবগত বোঝায়। জ্ঞান, শক্তি (বল) এবং সৃজনশীলতা (ক্রিয়া)-এ সবই ব্রহ্মে নিহিত। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে সকলেই অবাক হয়ে ভাবত, বইপত্র না পড়েও কী করে ইনি এত বড়ো জ্ঞানী হলেন! শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বলতেন, 'আমার যখন যা দরকার, সব মা জুগিয়ে দেন। মা-ই রাশ ঠেলে দেন।' এই জ্ঞানই 'স্বাভাবিকী'। অর্জিত জ্ঞান নয়, পুঁথিগত বিদ্যা নয়। ব্রহ্ম নিজেই জ্ঞানস্বরূপ আর সেই জ্ঞান আমাদের ভেতরেই আছে। এটাই বলা হয়েছে—ব্রহ্ম কোনো ক্রিয়ার দ্বারা পরিবর্তিত হন না; তবু সমস্ত ক্রিয়া তাঁর মধ্যেই ঘটে।

Wisdom Library ও Advaita-vision.org-এ এই ধারাটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “রূপান্তরহীন বিস্তারের তত্ত্ব” (doctrine of expansion without transformation) হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে—“পরিণাম-বিস্তারবাদ (Pariṇāma-vistāra-vāda) সৃষ্টি-প্রক্রিয়াকে কোনো রূপান্তর নয়, বরং চৈতন্যের স্ব-প্রসারণ বা আত্মবিস্তার হিসেবে দেখে; এক ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয় স্বরূপে থেকেই অসংখ্য রূপে নিজেকে প্রকাশ করে।”

বিবর্ত-বিস্তারবাদ শেখায়—ব্রহ্ম এক, কিন্তু তার প্রকাশ স্তরবিন্যস্ত। নাম-রূপের বহুত্ব হলো তার চৈতন্যপ্রকাশের ধাপে ধাপে বিস্তার—কোনো রূপান্তর নয়, কেবল আভাস। ব্রহ্ম তাই একইসঙ্গে অচল ও প্রসারিত, এক ও বহুর উৎস—যেমন সোনা থেকে অলঙ্কার, কিন্তু সোনা অপরিবর্তিত; তেমনি ব্রহ্ম থেকেই জগৎ, কিন্তু ব্রহ্ম অবিকৃত।

২০. অব্যাবহারিক-সৃষ্টি-বাদ (Abvyavahārika-sṛṣṭi-vāda, অর্থাৎ the theory of non-actual creation) অদ্বৈত বেদান্তের একটি সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, যা বলে—পরমার্থে (pāramārthika) কোনো বাস্তব সৃষ্টি নেই, কিন্তু ব্যাবহারিক (vyāvahārika) স্তরে সৃষ্টির ধারণা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, “সৃষ্টি” ও “বিনাশ” নামের যে-প্রক্রিয়াটি আমরা দেখি, তা অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য হলেও পরমার্থে মায়ামূলক ও অনির্বচনীয়।

এই মতটির শেকড় শঙ্করাচার্যের দ্বিস্তর-বাস্তবতা-তত্ত্বে—যেখানে জগৎকে দুটি স্তরে দেখা হয়:

১. ব্যাবহারিক সত্য (vyāvahārika-satya): অভিজ্ঞতা, ধর্ম, কর্ম, নৈতিকতা ও জাগতিক ক্রিয়াকর্মের স্তর।

২. পারমার্থিক সত্য (pāramārthika-satya): ব্রহ্মচৈতন্যের স্তর, যেখানে কোনো সৃষ্টি বা পরিবর্তন নেই।

শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ বলেন—“সৃষ্টির কথা কেবল উপাচার বা উপাধিভেদে”—অর্থাৎ সৃষ্টি-কথনটি কেবল ব্যাবহারিক সুবিধার জন্য। সত্য অর্থে ব্রহ্ম অচল, অবিকার, স্বপ্রকাশ; তার থেকে কিছু উৎপন্ন হয়নি।

এই ধারণাটি মাণ্ডূক্য উপনিষদ-এর গৌড়পাদীয় “অজাতবাদ”-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত—“নৈতদুৎপদ্যতে কিঞ্চিত্‌”—কিছুই জন্মায়নি। কিন্তু এখানে গৌড়পাদের চরম অজাতবাদকে ব্যাবহারিক স্তরে নরমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে—অজাত, তবু আপাত সৃষ্টি।

ধরা যাক, একজন কারিগর কাঠের খণ্ড থেকে আসবাব তৈরি করছে। ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে আমরা বলি—“নতুন বস্তু সৃষ্টি হলো”—কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে কাঠের অস্তিত্ব অপরিবর্তিত; যা ছিল কাঠ, সেটিই অন্য আকারে প্রকাশ পেল। একইভাবে, ব্রহ্মচৈতন্য কখনও পরিবর্তিত হয় না; কেবল নাম-রূপের স্তরে জগৎ দেখা দেয়।

আরেকটি উপমা—স্বপ্নে আপনি নগর, মানুষ, নদী দেখছেন; স্বপ্নের ভেতরে সেগুলো সম্পূর্ণ বাস্তব মনে হয়। কিন্তু জাগরণের পরে বোঝা যায়—সবই মানসিক অভিজ্ঞতা ছিল। তেমনি জাগতিক সৃষ্টিও ব্যাবহারিক স্তরে বাস্তব, কিন্তু পরমার্থে চৈতন্যের আভাসমাত্র।

এই মতে, “সৃষ্টি” এক অব্যাবহারিক ধারণা—অর্থাৎ তা মায়ার অবলম্বন, যা “অভিজ্ঞতার প্রয়োজন” মেটাতে কাজ করে, কিন্তু সত্য-অস্তিত্ব নয়। ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয়; তাই তার কোনো “পরিণাম” হতে পারে না। তবুও জগৎ-অভিজ্ঞতা ও কর্মজগতের কার্যকারিতা অস্বীকার করা যায় না—তাই বলা হয়, সৃষ্টি ব্যাবহারিক সত্য, কিন্তু অস্তিত্বগত সত্য নয়।

এভাবে এই তত্ত্ব অজাতবাদ ও বিবর্ত-বিস্তারবাদ-এর মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে—একদিকে স্বীকার করে যে, পরমার্থে সৃষ্টি হয়নি, আবার অন্যদিকে স্বীকার করে যে, যতক্ষণ মায়াজাত অভিজ্ঞতা থাকে, ততক্ষণ “সৃষ্টি-ভাবনা” প্রযোজ্য।

Wisdom Library-এ “ব্যাবহারিক সৃষ্টি” (Vyāvahārika Sṛṣṭi) ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে—“সৃষ্টিজগৎকে কেবল ব্যাবহারিক স্তরে (vyavahāra) স্বীকার করা হয়, ব্যাখ্যা ও নৈতিক আচরণের সুবিধার জন্য; পারমার্থিক সত্যে কোনো সৃষ্টি কখনও ঘটেনি।”