অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৪৯



এই মত অনুযায়ী, বোধ (চেতনা) সর্বত্র বর্তমান, আর অবোধ (অচেতনা) বলে কিছু নেই; জগৎও চৈতন্যেরই প্রকাশ। কিন্তু মায়ার কারণে চৈতন্য ও তার প্রকাশিত বিষয়ের মধ্যে একটি আপাত ভেদ অনুভূত হয়। বোধবোধাভেদ মানে—চৈতন্য ও চৈতন্যপ্রকাশ, জ্ঞান ও জানা, আলো ও তার দীপ্তি—এক ও অভিন্ন হলেও অভিজ্ঞতায় তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য মনে হয়।

যেমন বাতাসকে দেখা যায় না, কিন্তু তার গতি অনুভূত হয়—এখানে বাতাস ও তার গতি আলাদা নয়, তবুও অনুভবে ভিন্ন মনে হয়। তেমনি চৈতন্যই জগৎরূপে প্রকাশিত হচ্ছে; কিন্তু চৈতন্য (জ্ঞাতা) ও জগৎ (জ্ঞেয়) অভিজ্ঞতায় দ্বিত্বময় প্রতীয়মান হয়। আবার যেমন তরঙ্গ ও সমুদ্র—তরঙ্গ সমুদ্রেরই অংশ, কিন্তু তরঙ্গকে দেখলে মনে হয় যেন পৃথক কিছু; বাস্তবে তা নয়।

এই তত্ত্বে মায়া-কে বলা হয়েছে “অভেদে ভেদপ্রতীতি”-র কারণ। মায়া চৈতন্যে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, কিন্তু চৈতন্যের উপর ভেদরূপ প্রতিচ্ছায়া সৃষ্টি করে। মায়া তাই বিভ্রান্তি নয় কেবল, বরং অভিজ্ঞতামূলক “বিভেদ-ধারণা”-র শক্তি। শঙ্করের মতে, “নির্ভিন্নেহপি ব্রহ্মণি বিভেদপ্রতীতি মায়ায়ামাত্রম্‌”—অভিন্ন ব্রহ্মেও ভেদ প্রতীয়মান হয়, কিন্তু তা মায়ার কল্পনা।

এই তত্ত্ব আভাসবাদ ও জ্ঞানবাদ-এর মধ্যবর্তী অবস্থান তৈরি করে। আভাসবাদ যেখানে চৈতন্যকে বহির্মুখ প্রকাশরূপে দেখে, আর জ্ঞানবাদ যেখানে সমস্ত অস্তিত্বকে জ্ঞানস্বরূপ বলে মেনে নেয়, বোধবোধ্যাভেদবাদ সেখানে বলে—জ্ঞানই জ্ঞেয়ের ভিতরে নিজের প্রকাশের সীমা নির্ধারণ করে; তারা পরস্পরের মধ্যে লীন, পৃথক নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতায় আলাদা বলে মনে হয়।

এখানে “ভেদ” কেবল প্রতীতি-মাত্র (apparent distinction), বাস্তব নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অদ্বৈত-বেদান্তের স্বপ্রকাশ-চৈতন্যবাদ (svayam-prakāśa-vāda)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। চৈতন্য নিজেই নিজের মাধ্যমে জগৎকে প্রকাশ করে—তাই “জগৎ” আসলে “চৈতন্যের নিজের অভিজ্ঞতা।”

Wisdom Library ও JSTOR-এর প্রবন্ধসমূহে এই দর্শনকে “phenomenological Advaita” নামে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—অর্থাৎ এমন এক অদ্বৈত ধারণা, যেখানে অস্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা পরমার্থে অবিচ্ছিন্ন হলেও, মায়ার প্রক্ষেপশক্তির ফলে তারা অভিজ্ঞতায় পৃথক বলে প্রতীয়মান হয়।

Wisdom Library-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে—“বোধ-বোধ্য-অভেদবাদ (Bodha-bodhya-bheda-vāda) এই মত স্থাপন করে যে, চেতনা (bodha) ও তার জ্ঞেয়-বস্তু (bodhya) স্বরূপত অভিন্ন, কিন্তু মায়ার প্রক্ষেপশক্তির কারণে তারা ভিন্ন বলে দেখা যায়। এই তত্ত্বই ‘প্রকাশ’ ও ‘বাস্তবতা’-র মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে।” অর্থাৎ, এই দর্শন শেখায়—যা দেখা যায়, তা আলাদা মনে হলেও, যা আছে, তা একমাত্র চেতনা। জগতের বহুরূপতা আসলে চৈতন্যেরই স্ব-প্রতিফলন, আর মায়া কেবল সেই প্রতিফলনের অন্তর্গত বিভ্রমমাত্র।

বোধবোধ্যাভেদবাদ আমাদের বলে—চেতনা ও জগৎ দুই নয়; চেতনা নিজেই নিজের রূপে জগৎ হয়ে উঠছে। তবে মায়ার পর্দায় সেই এক চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে দ্রষ্টা ও দৃশ্য, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়, বোধ ও অবোধ—এই দ্বিত্বের নাটক রচনা করে। বাস্তবে কোনো বিভেদ নেই—বোধই বোধের প্রতিফলনে বোধ হয়, এ-ই এই তত্ত্বের কেন্দ্রীয় আলোকবিন্দু।

এই ধারাসমূহ মূলত চৈতন্য, জগৎ ও মন—এই তিনের পারস্পরিক সম্পর্ককে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্‌ঘাটন করেছে। প্রতিটি মতেই চৈতন্য একমাত্র পরমসত্য, কিন্তু অভিজ্ঞতার স্তরে তার প্রকাশ, পার্থক্য ও মায়ার অভিনয় ভিন্নভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। কোথাও এই সম্পর্ক আয়নায় প্রতিফলনের মতো (প্রতিবিম্ববাদ), কোথাও একক চেতনার স্বপ্নবিশ্বের মতো (একজীববাদ), কোথাও অসংখ্য প্রতিফলনের মাধ্যমে (নানাজীববাদ), আবার কোথাও জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সূক্ষ্ম ভেদপ্রতীতির (বোধবোধ্যাভেদবাদ) রূপে প্রকাশিত। আধুনিক গবেষণায়ও এই ধারাবিচার দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে—যেমন Wisdom Library-র “Pratibimba-Vāda”-র বিশ্লেষণ ও Advaita-Vision-এর “Eka-Jīva-Vāda” আলোচনা এই মতগুলির পারস্পরিক সংগতি ও পার্থক্য উভয়কেই সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

এই ব্যাখ্যাধারাগুলির মূল উদ্দেশ্য এক—চৈতন্যকে একমাত্র পরম সত্য স্বরূপ ঘোষণা করা এবং দেখা-অভিজ্ঞতার জগৎকে সেই চৈতন্যেরই প্রতিফলন, আভাস বা নাম-রূপ মাত্র হিসেবে আবিষ্কার করা। এই উপলব্ধিই অদ্বৈত বেদান্তের মুক্তির সোপান: কোনো বহির্গামী সাধনা বা বহুবিধ জীবের অর্জন নয়, বরং একান্ত নিজের-চৈতন্য-সত্তা অনুধাবন।

নিচে “অজাত ও পারমার্থিক ধারা”-র অন্তর্গত প্রধান ধারাগুলির ব্যাখ্যা সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:

১৭. অজাতবাদ (Ajāta-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের দার্শনিক বিকাশে এক পরম ও অনিবার্য চূড়ান্ত বিন্দু—যেখানে “সৃষ্টি” ধারণাটিই বাতিল হয়ে যায়। এই মতের প্রবর্তক আচার্য গৌড়পাদ (Gauḍapāda), যিনি শ্রীশঙ্করাচার্যের পরমগুরু এবং মাণ্ডূক্যকারিকা (Māṇḍūkya Kārikā)-র রচয়িতা। এই গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়, “অজাতপ্রকরণ (Ajāta-Prakaraṇa)” এবং আংশিকভাবে দ্বিতীয় অধ্যায় “বৈতথ্যপ্রকরণ (Vaitathya-Prakaraṇa)”-এ তিনি এই তত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রতিপাদন করেন।

গৌড়পাদ বলেন—“নৈতদুৎপদ্যতে কিঞ্চিদ্যদস্তি ন বিদ্যতে।” (মাণ্ডূক্যকারিকা ৩.৪৮)—“যা বাস্তব নয়, তা কখনও জন্মেও না।” আবার বলেন—“অজাতমজমব্যয়ং কিঞ্চিন্ন জন্মতি ক্বচিৎ।” (৪.২২)—“যা অজাত, অজ, অব্যয়, তা কোথাও কখনও জন্মায় না।” এই দুটি উক্তিই তাঁর দর্শনের মূলস্তম্ভ।

“অজাত” শব্দের অর্থই হলো—যা কখনও জন্ম নেয়নি, যা আদিতে অনুৎপন্ন। এই এক শব্দের মধ্যেই গৌড়পাদাচার্য স্থাপন করেন এক বিপ্লবাত্মক সত্য—সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের সমগ্র ধারণা আসলে চেতনার মনোজাত প্রতীতি, এক মানসিক আরোপমাত্র। পরমার্থের দৃষ্টিতে কোনো “সৃষ্টি” আদৌ ঘটে না; জগৎ, কাল ও পরিবর্তনের সমগ্র অভিজ্ঞতা কেবল চৈতন্যের স্বপ্নসদৃশ প্রতিফলন, যা জ্ঞানের প্রভাতে নিজেই লুপ্ত হয়ে যায়, যেমন জাগরণের আলোয় স্বপ্ন মিলিয়ে যায়।

তিনি বলেন—“নির্বিকারে চ ব্রহ্মণি কস্মাদ্বিকারা দৃষ্টান্তে”—অচল, অবিকৃত ব্রহ্মে পরিবর্তনের স্থানই নেই। যেমন মায়ার প্রভাবে আকাশে নীলিমা দেখা যায়, অথচ আকাশ কখনও নীল হয় না; তেমনি চৈতন্যে জগৎ প্রকাশিত মনে হয়, অথচ ব্রহ্ম নিজে অপরিবর্তিত থাকে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, গৌড়পাদাচার্যের “অজাতবাদ” আসলে দুই ধারার মধ্যে এক সেতুবন্ধন। একদিকে বৌদ্ধ দর্শনের অদ্বয়বাদ (Advayavāda)—যেখানে বলা হয়, সব কিছু শেষপর্যন্ত দ্বৈততাহীন এবং কোনো চূড়ান্ত সত্তা আলাদা করে নেই; অন্যদিকে উপনিষদীয় অভেদব্রহ্মতত্ত্ব, যা ঘোষণা করে—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ তারই প্রকাশ।

গৌড়পাদ এই দুইয়ের মিল ঘটালেও বৌদ্ধদের “শূন্যতা” মতকে তিনি গ্রহণ করেননি। বৌদ্ধ দর্শনে “শূন্যতা” মানে সবকিছুই আপেক্ষিক ও নিঃসত্তা—কোনো স্থায়ী বাস্তব নেই। কিন্তু গৌড়পাদ বলেন, চেতনা বা আত্মা কখনও “শূন্য” নয়; বরং সেটিই একমাত্র চিরন্তন ও স্বয়ংস্থিত বাস্তব।

তিনি এই ধারণার নাম দিয়েছিলেন “অশূন্য-শূন্যতা”। অর্থাৎ, জগৎ বা নাম-রূপের প্রকাশ শূন্য—তার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; কিন্তু সেই চেতনা, যার মধ্যে এই প্রতিভাস ঘটে, সেটি অশূন্য—অবিনশ্বর ও পরিপূর্ণ।

সহজভাবে বলা যায়, গৌড়পাদ বলেন—“জগৎ শূন্য, কিন্তু চেতনা শূন্য নয়।” দৃশ্য ও দর্শকের পার্থক্য এখানে আপাত; বাস্তবে কেবল এক অদ্বৈত চৈতন্যই সর্বত্র বিদ্যমান, যা কখনও জন্মায়নি, বদলায় না, আর কখনও বিনষ্টও হয় না।

অদ্বৈত বেদান্তে তাই অজাতবাদ হলো সৃষ্টির মায়াবাদ নয়, বরং সৃষ্টিরই অবসানবোধ। এটি এক নিখাদ পরমার্থতত্ত্ব—যেখানে ব্রহ্ম অনাদি, অবিকৃত, অভিন্ন, এবং সমস্ত পরিবর্তন, ক্রিয়া ও বহুত্ব কেবল মনস্তাত্ত্বিক ছায়া। যেমন স্বপ্নে-দেখা নগর জাগরণের পরে মিথ্যা হয়ে যায়, তেমনি জ্ঞানোদয়ের পরে সমগ্র জগৎ প্রতিভাসরূপে লীন হয় সেই এক, চির-অজাত ব্রহ্মচৈতন্যে।

গৌড়পাদ স্বপ্নের দৃষ্টান্ত দিয়ে এই মতটি ব্যাখ্যা করেন। স্বপ্নে একজন ব্যক্তি যদি যুদ্ধ, নগর বা নানারকম কর্ম-ঘটনা দেখে, জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বিলীন হয়—কারণ স্বপ্নের জগৎ কখনও বাস্তবে সৃষ্টি হয়নি। তেমনি জাগতিক জগৎও চৈতন্যের প্রক্ষেপমাত্র; তাই সেটি জন্মগ্রহণ করেনি। এই কারণে তিনি বলেন—“যা শুরুতে নেই, শেষে নেই, মধ্যেও নেই, সেটিই মিথ্যা।” (মাণ্ডূক্যকারিকা ২.৩১) অতএব, স্বপ্ন ও জাগরণ উভয়ই চেতনার আভাসমাত্র—কোনোটিরই স্বাধীন উৎপত্তি নেই।

অজাতবাদ অদ্বৈত দর্শনের সর্বোচ্চ পারমার্থিক স্তর, যা শঙ্করাচার্যের বিবর্তবাদ (Vivarta-vāda) ও পরিণামবাদ (Pariṇāma-vāda)-এরও অতীত। এখানে “অস্তিত্ব” (sat) ও “চৈতন্য” (cit) অভিন্ন, অচল ও অনাদি। যদি সৃষ্টি বাস্তবে ঘটত, তবে ব্রহ্মের চিরনিত্যতা নষ্ট হতো—অর্থাৎ “ব্রহ্ম পরিণত হয়েছে জগতে”—এটি ব্রহ্মের অপরিবর্তনীয় স্বরূপের পরিপন্থী। তাই গৌড়পাদ বলেন—সৃষ্টি ও লয় কেবল চেতনার দৃষ্টিকোণভেদে প্রতীয়মান; পরম সত্যে কোনো “ঘটনাক্রম” নেই।

গৌড়পাদ মায়াকে মানসিক আরোপ বা বোধ-আভাস হিসেবে দেখেছেন। মায়া সৃষ্টি করে না, কেবল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, যেমন আয়নায় প্রতিফলন বাস্তব নয়, কিন্তু দেখা যায়। সৃষ্টির ধারণা মানসিক অভ্যাস—চৈতন্য নিজে অপরিবর্তনীয়, অজাত।

এই মতের প্রভাব বৌদ্ধ অদ্বয়বাদ (Advaya-vāda) ও নাগার্জুনের শূন্যতা-তত্ত্ব (Śūnyavāda)-এর সঙ্গে তুলনীয়। উভয় ক্ষেত্রেই জন্ম ও বিনাশকে কল্পনা বলা হয়েছে। তবে গৌড়পাদ ব্রহ্মচৈতন্যকে শূন্যতার ঊর্ধ্বে—এক ইতিবাচক, স্বপ্রকাশ চেতনা হিসেবে স্থাপন করেন।

উইকিপিডিয়া, উইজডম লাইব্রেরি এবং জেএসটিওআর-এর প্রবন্ধসমূহে অজাতবাদ (Ajātavāda)-কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “সম্পূর্ণ অসৃষ্টিতত্ত্ব (the doctrine of absolute non-origination)” হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে—“সৃষ্টি, বন্ধন ও মুক্তি—সবই অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মের উপর মানসিক আরোপমাত্র; প্রকৃত অর্থে কিছুই কখনও জন্মায় না।”

অজাতবাদের মূল অন্তর্দৃষ্টি হলো—“জগৎ কখনও উৎপন্ন হয়নি।” তাই মুক্তি কোনো পরিবর্তন বা অর্জন নয়; মুক্তিই আমাদের চিরস্থায়ী স্বরূপ। যেমন গৌড়পাদ বলেছেন—“নির্বিকারে হি শান্তে চেৎ নান্যদস্তি কদাচন।” (মাণ্ডূক্য কারিকা ৪.৪৫) অর্থাৎ, “যা নির্বিকার ও শান্ত, সেটিই একমাত্র সত্য; অন্য কিছু কখনও ছিল না।” অজাতবাদ আমাদের শেখায়—বন্ধন, মুক্তি, সৃষ্টি, লয়—সবই মানসিক প্রক্ষেপ; একমাত্র ব্রহ্মই চিরন্তন অজাত, অচল, অভিন্ন।

১৮. স্বতঃসিদ্ধ-ব্রহ্মবাদ (Svataḥ-siddha-Brahmavāda) অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক মৌল তত্ত্ব, যা ঘোষণা করে—ব্রহ্ম নিজেই স্বতঃসিদ্ধ, অর্থাৎ তার অস্তিত্বের জন্য কোনো প্রমাণ, কারণ, বা উৎপত্তির প্রয়োজন নেই। ব্রহ্ম কোনো কিছুর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং সব কিছুই ব্রহ্মের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। চেতনা (বোধ) স্বতঃপ্রকাশ, নিজের মধ্যেই নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করে; তাই ব্রহ্মের অস্তিত্ব প্রমাণনির্ভর নয়, প্রমাণপ্রদ।

এই মতের মূল ধারণা নিহিত বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৪.১)-এর উক্তিতে—“ন তত্র অন্যোহস্তি দ্রষ্টা, ন শ্রোতা, ন মন্তা, ন বিজ্ঞাতা।” অর্থাৎ, ব্রহ্মের বাইরে কোনো দ্রষ্টা, শ্রোতা, মন বা জ্ঞাতা নেই; সে-ই সকল জ্ঞানের, সমস্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট।

শঙ্করাচার্য এই উপনিষদীয় ভাবনা ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (১.১.৪)-এ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—“ব্রহ্ম স্বতঃসিদ্ধঃ”—ব্রহ্ম নিজের দ্বারা প্রমাণিত। কোনো বহির্জগৎ, ইন্দ্রিয় বা মন তাকে প্রকাশ করে না; বরং তারা সকলেই তার দ্বারা প্রকাশিত। যেমন আলো নিজের দীপ্তির দ্বারা সমস্ত কিছু আলোকিত করে, তেমনি ব্রহ্মচৈতন্যই সমস্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তি এবং নিজেও আত্মপ্রকাশমান।

স্বতঃসিদ্ধ-ব্রহ্মবাদ বলে—ব্রহ্ম-চৈতন্য চির-সিদ্ধ; তাই সৃষ্টি, বিকাশ বা পরিবর্তনের ধারণাগুলো কেবল আপাত। এই জগৎ, এই দেহ, মন, ইন্দ্রিয়—সবই সেই স্বতঃসিদ্ধ চৈতন্যের মধ্যে প্রকাশিত ঘটনাবলি। যেমন আকাশে মেঘ জমে, কিন্তু আকাশ মেঘে আবৃত হয় না, তেমনি চৈতন্য মায়ায় আবৃত নয়—বরং মায়া চৈতন্যের মধ্যেই প্রতীয়মান।