অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৪৮



শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ বলেন—ঈশ্বর ও জীব উভয়ই চৈতন্যস্বরূপ; পার্থক্য কেবল মায়ার প্রভাবে। ঈশ্বর সেই চেতনা, যিনি মায়াকে নিয়ন্ত্রণ করেন (মায়াধীশ), আর জীব সেই চেতনা যিনি মায়ার আচ্ছাদনে আবদ্ধ (মায়াবৃত)। উদাহরণ হিসেবে শঙ্কর বলেন—একই সূর্য মেঘের ওপরে উজ্জ্বল, কিন্তু নিচে মেঘে ঢাকা পড়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন মনে হয়; অথচ সূর্য একটিই। তেমনি চেতনা এক হলেও, মায়ার অবস্থানের ভেদে সে ঈশ্বর ও জীব—এই দুই রূপে প্রতীয়মান।

ভগবদ্‌গীতায় (১৫.৭) শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ”—“এই জীবেরা আমারই অনন্ত অংশ।” অর্থাৎ, ঈশ্বরই জীবরূপে প্রকাশিত, জীব ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়। পার্থক্য কেবল দৃষ্টিভঙ্গির; যেমন পূর্ণ চাঁদের আলো জলাধারে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে দেখা দেয়, অথচ চাঁদ একটিই।

সমুদ্র ও তরঙ্গ। তরঙ্গ সমুদ্রেরই রূপ, আলাদা কোনো পদার্থ নয়। তরঙ্গ উঠলে জলেই ওঠে, পড়লে জলে মিশে যায়—তবু তরঙ্গের মধ্যে জল ছাড়া অন্য কিছু নেই। তেমনি জীব, ঈশ্বর ও জগৎ—তিনটিই চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ। জীব হলো সীমিত চেতনার প্রতিফলন, ঈশ্বর হলো অসীম চেতনার অভিব্যক্তি, আর জগৎ সেই চেতনার নাম-রূপময় তরঙ্গাবলি।

অদ্বৈত বেদান্তে ঈশ্বর-জীব-বিভক্তি কোনো চিরস্থায়ী ভেদ নয়; এটি অবিদ্যা বা মায়া-র প্রভাবে দেখা এক আপাত পার্থক্য। যতক্ষণ জ্ঞান উদিত হয়নি, ততক্ষণ এই তিনের ভেদ সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে সেই ভেদ ঘুচে যায়, এবং প্রকাশ পায় সেই এক, অভিন্ন, অচল চৈতন্য—যার মধ্যেই সমস্ত ভেদ ও ভ্রম বিলীন হয়ে যায়।

ঈশ্বর-জীব-বিভক্তি শেখায়—ঈশ্বর, জীব ও জগৎ আলাদা নয়; তারা একই পরমসত্তার তিনটি প্রকাশমাত্র। জ্ঞানপ্রাপ্তির মুহূর্তে এই বিভক্তি বিলুপ্ত হয়, আর যা থাকে, তা হলো নিঃসঙ্গ, অবিভাজ্য, সর্বব্যাপী চৈতন্য—যেমন তরঙ্গ শান্ত হলে কেবল সমুদ্রই থেকে যায়।

১৫. বহুজীববাদ (Nānā-jīva-vāda) অদ্বৈত বেদান্তে এমন এক ব্যাখ্যা-ধারা, যা একজীববাদ (Eka-jīva-vāda)-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বহুত্বের আপাত বাস্তবতাকে যুক্তিসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করে। এই মতে, ব্রহ্ম বা চৈতন্য এক ও অভিন্ন, কিন্তু সেই এক চৈতন্য প্রত্যেক জীবের অন্তঃকরণে পৃথক প্রতিফলন বা আভাসরূপে প্রকাশিত হয়। ফলে জীবের বহুত্ব বাস্তবে ব্রহ্মের বহুত্ব নয়; বরং উপাধিভেদে এক চৈতন্যের বহুবিধ প্রতিচ্ছবি।

এই মতের মূলসূত্র পাওয়া যায় শঙ্করোত্তর অদ্বৈত ব্যাখ্যা-ধারায়—বিশেষত ভামতী-বাদ (বাচস্পতি মিশ্র) ও বিবরণ-বাদ (প্রকাশাত্মা)-এর মধ্যবর্তী ব্যাখ্যাগুলিতে। সেখানে বলা হয়েছে, চৈতন্য সর্বব্যাপী হলেও অন্তঃকরণ (মন-বুদ্ধি)-এর স্বচ্ছতা, গঠন ও গুণভেদে তার প্রতিফলন ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। চিৎসুখাচার্য তাঁর তত্ত্বপ্রকাশিকা-য় বলেন—“ব্রহ্মচৈতন্যং সর্বগমপ্যন্তঃকরণবৃত্তিভেদাত্‌ নানা জীবতয়া বিভাতি”—অর্থাৎ, এক ব্রহ্মচৈতন্যই অন্তঃকরণের ভেদে বহু জীবচৈতন্য বলে প্রতীয়মান হয়।

এই ধারণাকে শঙ্করীয় ভাষ্যে “উপাধি-ভেদ” (upādhi-bheda) তত্ত্বের মধ্যেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (২.৫.১৯)-এর বিখ্যাত বাক্য—“নেহ নানাস্তি কিঞ্চন”—পরমার্থে বহুত্ব নেই; কিন্তু ব্যাবহারিক স্তরে জীবের সীমাবদ্ধতা বা অজ্ঞানের ফলে বহুত্ব প্রতীয়মান হয়। তাই ব্রহ্ম এক, তবু অসংখ্য জীব হিসেবে প্রকাশিত—যেন এক সূর্য নানা জলে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিফলিত।

বহুজীববাদ মতে, প্রতিটি জীব হলো চৈতন্যের পৃথক আয়না-স্বরূপ প্রতিবিম্বক্ষেত্র। সূর্যের প্রতিফলনের দৃষ্টান্ত এখানে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়—একই সূর্যের আলো শতাধিক পাত্রে প্রতিফলিত হয়; কোনো পাত্র ঘোলা হলে প্রতিফলন মলিন, কোনো পাত্র নির্মল হলে আলো উজ্জ্বল; কিন্তু সূর্য নিজে অপরিবর্তিত। তেমনি প্রতিটি জীবের অন্তঃকরণ এক-একটি পাত্র—যার নির্মলতা (সত্ত্বগুণ) অনুযায়ী চৈতন্যপ্রকাশের পরিমাণ ভিন্ন।

এই ভাবটি ভগবদ্‌গীতায়ও (১৩.৩১) স্পষ্ট—“অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মায়মব্যয়ঃ। শরীরস্থোহপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে।।” এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা-র ত্রয়োদশ অধ্যায়ের (ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ আত্মা বা পরমাত্মার প্রকৃতি, অবস্থান ও কর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে মূল শিক্ষা হলো—পরমাত্মা চিরন্তন, নির্বিকার, এবং কর্মে নিলিপ্ত।

এখানে প্রতিটি শব্দের মধ্যে আত্মার তত্ত্ব লুকিয়ে আছে।

অনাদিত্ব্বান্‌—অর্থাৎ আত্মার কোনো শুরু বা জন্ম নেই। তিনি কাল, কারণ বা কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফল নন; তাই তাঁর জন্ম বা সৃষ্টি নেই।

নির্গুণত্বাত্‌—আত্মা প্রকৃতির তিনটি গুণ—”সত্ত্ব, রজ, তম”-এর ঊর্ধ্বে। এই গুণগুলো দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও জগৎ পরিচালনা করে, কিন্তু আত্মা সেই গুণত্রয়ের বাইরে অবস্থান করেন।

পরমাত্মায়মব্যয়ঃ—এই পরমাত্মা কখনও নষ্ট হন না, তাঁর কোনো ক্ষয় বা পরিবর্তন নেই। তিনি চিরন্তন, অবিকৃত ও সর্বব্যাপী।

শ্রীকৃষ্ণ এরপর বলেন—“শরীরস্থোহপি কৌন্তেয় ন করোতি ন লিপ্যতে”, অর্থাৎ—হে কৌন্তেয় (অর্জুন), যদিও আত্মা শরীরের মধ্যে অবস্থান করছে, তবু সে কোনো কর্ম করে না, এবং কর্মের ফলে আবদ্ধও হয় না। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়—সবই প্রকৃতির উপাদান; তারা কাজ করে, অনুভব করে, পরিবর্তিত হয়, কিন্তু আত্মা তাদের মধ্যে কেবল সাক্ষীস্বরূপ। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, কর্তা নন; ফলে কর্মফল বা পাপ–পুণ্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় না।

একটি সহজ উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়—যেমন সূর্য পৃথিবীর সমস্ত কর্ম ও পরিবর্তনের সাক্ষী; আলো দেয়, কিন্তু কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। ভালো বা খারাপ, দিন বা রাত—সব ঘটছে তার আলোয়, কিন্তু সূর্য নিজে নিস্পৃহ। তেমনি আত্মা শরীরের মধ্যে থেকে সমস্ত অনুভূতি ও কর্মের সাক্ষী, কিন্তু নিজে কখনও তাতে লিপ্ত হন না।

এই শ্লোকের দার্শনিক অর্থ গভীর—এটি আমাদের শেখায় যে, প্রকৃত আত্মা কর্মের দ্বারা না সৃষ্টি হয়, না ধ্বংস হয়। সে নিঃস্পৃহ, চিরন্তন, অচল ও অব্যয়। জীবের যে-সমস্ত দুঃখ, আনন্দ, আসক্তি ও ভয়—সবই মায়াজাত দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের স্তরে ঘটে। কিন্তু আত্মা সেই সবের ঊর্ধ্বে, এক নিঃশব্দ, শুদ্ধ, চিরপ্রকাশমান সত্তা—যিনি শুধু “দেখেন”, কখনও “করেন” না।

এই উপলব্ধিই মুক্তির মর্ম—যে-ব্যক্তি বুঝতে পারে, “আমি শরীর নই, আমি সেই শুদ্ধ চেতনা”—সে তখনই কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চিরশান্ত অবস্থায় পৌঁছায়।

যেখানে একজীববাদ বলে—সব জীব ও জগৎ এক জীব-চেতনার স্বপ্ন বা প্রক্ষেপ, সেখানে বহুজীববাদ বলে—এক চৈতন্য বিভিন্ন অন্তঃকরণে প্রতিফলিত হয়ে বহু জীব-রূপে প্রতীয়মান। অর্থাৎ, বহুত্ব এখানে স্বপ্নের মতো মায়াজাত নয়; বরং প্রতিফলনের স্তরে বাস্তব, যদিও পরমার্থে অভিন্ন।

এই কারণেই আপ্পাইয় দীক্ষিত তাঁর সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ-এ বলেন, একজীববাদ ও বহুজীববাদ উভয়ই আপাততঃ-সিদ্ধ (provisionally valid) দৃষ্টিকোণ—প্রথমটি জগতের মায়ামূলক স্বরূপকে নির্দেশ করে, দ্বিতীয়টি অভিজ্ঞতার বহুত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে বোঝায়।

একই সূর্য নানা পাত্রে প্রতিফলিত হলে প্রতিটি পাত্রে ভিন্ন আলো প্রতীয়মান হয়; কোনোটি নীল, কোনোটি সবুজ, কোনোটি মলিন, কোনোটি নির্মল। কিন্তু সূর্য কখনও বিভক্ত হয় না। তেমনি চৈতন্যও বিভক্ত হয় না; জীবপ্রতীতি কেবল প্রতিফলনজনিত ভেদ। আবার, এক জলাশয়ে সূর্যের প্রতিবিম্ব কাঁপলে সূর্য কাঁপছে বলে মনে হয়—তেমনি মন-বুদ্ধির চঞ্চলতায় চেতনা “কর্তা” বা “ভোক্তা” বলে প্রতীয়মান হয়, অথচ চৈতন্য সর্বদা অচল।

বহুজীববাদ অভিজ্ঞতাগত বাস্তবতাকে মান্যতা দেয়—প্রতিটি ব্যক্তির চেতনা-অভিজ্ঞতা আলাদা, কিন্তু তাদের মূল উৎস একই চৈতন্য। এটি একদিকে অদ্বৈতের ঐক্যবোধ রক্ষা করে, অন্যদিকে বহুত্বের প্রাত্যহিক অনুভূতিকে অবৈধ করে না।

আধুনিক আলোচনায়, যেমন Wisdom Library, Advaita-vision.org এবং JSTOR-এর “Multiplicity in Post-Śaṅkara Advaita” প্রবন্ধসমূহে—এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, “নানাজীববাদ (Nānā-jīva-vāda) অভিজ্ঞতার স্তরে বহু জীবসত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে, তবে সেই বহুত্ব চেতনার মূল ঐক্যকে বিনষ্ট করে না; বরং প্রত্যেক জীবকেই এক ব্রহ্মচেতনার প্রতিবিম্ব হিসেবে গণ্য করে।” অর্থাৎ বহুত্ব বাস্তব নয়, আপাত—সব জীবই একই চৈতন্যসাগরের তরঙ্গমাত্র।

বহুজীববাদ শেখায়—ব্রহ্ম এক, কিন্তু তার প্রতিফলন বহু। প্রতিটি জীব ব্রহ্মেরই দীপ্তির পৃথক আয়না, যেখানে মায়া সেই প্রতিফলনের মাধ্যম। তাই জগৎ ও জীবের বহুত্ব পরমার্থে নয়, অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য—এক চৈতন্য, নানা প্রতিফলন।

১৬. বোধবোধ্যাভেদবাদ (Bodha-bodhyā-bheda-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এক গভীর কিন্তু সূক্ষ্ম দার্শনিক ধারা, যেখানে বলা হয়েছে—“বোধ” (চেতনা বা জ্ঞান) এবং “বোধ্য” (যা জানা যায়, অর্থাৎ জগৎ বা অভিজ্ঞতার বিষয়) প্রকৃত অর্থে অভিন্ন সত্তা, তবে অভিজ্ঞতার স্তরে তারা ভিন্ন বলে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ চেতনা ও জগৎ অস্তিত্বগত (অন্তঃসত্তাগত বা ontological) স্তরে এক হলেও, অভিজ্ঞতাগত (phenomenological) স্তরে তাদের মধ্যে এক প্রকার ভেদ-প্রতীতি দেখা যায়।

এই তত্ত্বের মূল তাৎপর্য হলো—জ্ঞান ও জ্ঞেয় কোনো দ্বৈত বাস্তবতা নয়, বরং একই চৈতন্যের দুটি দিক—একটি আত্মপ্রকাশ (জ্ঞান), অন্যটি সেই আত্মপ্রকাশের প্রতিফলন (জ্ঞেয়)। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিচ্ছবি মুখ থেকে আলাদা নয়, কিন্তু দেখা-প্রক্রিয়ায় আলাদা বলে মনে হয়; তেমনি চৈতন্য ও তার প্রতীত জগৎ—উভয়ই এক চৈতন্যসত্তার দুই আভাসমাত্র।

কেন উপনিষদে বলা হয়েছে—“ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগচ্ছতি নো মনঃ। ন বিল্লো ন-বিজ্ঞানীমো যথৈতদনুশিষ্যাৎ।। (১.৩)

অন্বয়: তত্র (সেখানে [অর্থাৎ যেখানে ব্রহ্ম আছেন]); চক্ষুঃ ন গচ্ছতি (চোখ যেতে পারে না); ন বাক্ গচ্ছতি নো মনঃ (যা বাক্য এবং মনের অতীত); ন বিঘ্নঃ (আমরা জানি না [এই ব্রহ্মের স্বরূপ কী]); যথা (কীভাবে); এতৎ (এই [ব্রহ্ম]); অনুশিষ্যাৎ (গুরু শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন); ন বিজানীমঃ ([তা-ও] আমাদের কাছে দুর্বোধ্য [অর্থাৎ আমরা জানি না])।

সরলার্থ: ব্রহ্ম যেখানে, সেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছতে পারে না। তা আমাদের বাক্য এবং মনেরও অতীত। আচার্য এ দুরূহ তত্ত্ব কীভাবে শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন, তা আমরা জানি না।

ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। তাঁর সম্পর্কে তাই আমরা কিছুই বলতে পারি না। তিনি অসীম—এতই বিশাল যে, আমাদের মন তাঁর ধারণা করতে পারে না। তাই আচার্য বলছেন, 'ন বিঘ্নঃ ন বিজানীমঃ'—আমরা জানি না, আমরা জানি না।

কেন আমরা জানি না? কারণ, ব্রহ্ম জ্ঞানের বিষয় নন। আমাদের থেকে আলাদা একটা বস্তুকে আমরা জানতে পারি, কিন্তু ব্রহ্মকে পারি না। কারণ আমরাই ব্রহ্ম। আমাদের থেকে যা পৃথক, তাকেই আমরা জানতে পারি, কিন্তু নিজের আত্মাকে আমরা কখনোই দেখতে পাই না।

ব্রহ্ম সর্বদাই জ্ঞাতা, বিষয়ী। তিনি কখনও জ্ঞেয় বা জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। বস্তুত যা-কিছু আছে, সব ব্রহ্ম। জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর পার্থক্য অথবা বিষয়ী এবং বিষয়ের মধ্যে যে-পার্থক্য, তা আমাদের কল্পনা।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জ্ঞান আর কোনো পৃথক শক্তি নয়, বরং চৈতন্যের স্ব-দীপ্ত স্বরূপ। চেতনা জগৎকে জানে না বলে আলাদা কোনো বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না, বরং নিজের আলোয় নিজেকে জানে, এবং সেই জানাই জগৎ-প্রকাশ।

ফলত, বোধবোধ্যাভেদবাদ শেখায়—জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের ভেদ অভিজ্ঞতার মাত্রায়, কিন্তু সত্যের স্তরে নয়। প্রকাশ ও প্রতিফলনের এই দ্বৈত-খেলা, যা একই সঙ্গে দর্শন ও দৃষ্টি, বিভ্রম ও সত্য, সেটিই এই তত্ত্বের কেন্দ্রীয় সারমর্ম—যেখানে শেষপর্যন্ত জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় তিনটি মিলে এক চৈতন্যসত্তায় বিলীন হয়।

এই তত্ত্বের সূত্র পাওয়া যায় শঙ্করোত্তর অদ্বৈতচিন্তাধারায়, বিশেষত চিৎসুখাচার্য ও সচ্চিদানন্দ যতি-র রচনায়, যেখানে তাঁরা চেতনা ও অভিজ্ঞতাজগতের সম্পর্ককে নিখাদ অভিন্নতা (abheda) ও আপাত ভেদ (bheda)-এর সহাবস্থান হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। শঙ্কর নিজেও ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪) ও বৃহদারণ্যক ভাষ্য (২.৫.১৯)-এ ইঙ্গিত দেন—“যথা মৃৎপিণ্ডাৎ ঘটাদয়ঃ”—মাটি ও ঘট আলাদা বলে মনে হলেও, মাটি ব্যতীত ঘটের অস্তিত্ব নেই; সুতরাং ভেদপ্রতীতি থাকলেও অস্তিত্বগতভাবে অভিন্ন।