আধুনিক বিশ্লেষণে Wisdom Library এই তত্ত্বকে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেছে এভাবে—“প্রতিবিম্ববাদ বলে যে, সমগ্র বিশ্ব ও সকল জীব আসলে এক পরম চৈতন্য (ব্রহ্ম)-এরই প্রতিফলন; বহুত্ব বিদ্যমান প্রতিফলনগুলির মধ্যে, মূল আলোকসত্তায় নয়।” অর্থাৎ, জগৎ ও জীব পৃথক বলে মনে হলেও, তারা আসলে এক চৈতন্যেরই বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি—যেমন বহু আয়নায় প্রতিফলিত একটিমাত্র সূর্যের আলো, যা প্রতি বার আলাদা রূপে দেখা দিলেও উৎস সর্বদা এক।
প্রতিবিম্ববাদ আমাদের শেখায়—বহুতা একক চেতনার প্রতিবিম্ব মাত্র। জগৎ ও জীব কোনো পৃথক বাস্তব নয়, বরং ব্রহ্মচৈতন্যের নিজস্ব দীপ্তির ছায়া, যেমন এক সূর্যের আলোয় অগণিত প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে—কিন্তু সূর্য সর্বদা এক, অবিভক্ত ও স্বপ্রকাশ।
১২. আভাস-প্রতিবিম্ব-সংকরবাদ হলো শঙ্করোত্তর অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক সমন্বয়ধারা, যেখানে ভামতী-বাদ (বাচস্পতি মিশ্র)-এর প্রতিবিম্ব-তত্ত্ব এবং বিবরণ-বাদ (প্রকাশাত্মা)-এর আভাস-তত্ত্ব উভয়ের অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে এক সংশ্লেষ গঠিত হয়েছে। এই সংকর-ধারার মূল বক্তব্য—চৈতন্য নিজেই কখনও প্রতিফলিত হয়ে (প্রতিবিম্বরূপে) অভিজ্ঞতার জগৎ গঠন করে, আবার কখনও নিজের দীপ্তিতেই (আভাসরূপে) জগৎকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ, জগতের সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই চৈতন্যের বিকিরণপ্রবাহ—কখনও প্রতিফলনাত্মক (reflective), কখনও উদ্ভাসাত্মক (radiant)।
অদ্বৈত বেদান্তে বিম্ব-প্রতিবিম্ব ও আভাস—এই দুটি শব্দ যুগল বহু ভাষ্য ও টীকায় পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে। ভামতী-ধারায় বলা হয়, চৈতন্য মন-বুদ্ধি-রূপ অন্তঃকরণে প্রতিফলিত হয়ে জীবচৈতন্য বা চিদাভাস (cidābhāsa) সৃষ্টি করে; যেমন সূর্যের আলো জলে প্রতিফলিত হয়। অন্যদিকে বিবরণ-ধারায় বলা হয়, মন কেবল উপলক্ষ্য—চৈতন্য নিজেই স্ব-প্রকাশশক্তিতে জগতকে উদ্ভাসিত করে, যেমন দীপ নিজের আলোয় সব কিছু আলোকিত করে। সংকরবাদ এই দুইয়ের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ করে বলে—চৈতন্যের উদ্ভাস (আভাস) ও চৈতন্যের প্রতিফলন (প্রতিবিম্ব)—দুটিই সত্য অভিজ্ঞতার অপরিহার্য দিক।
এই দৃষ্টিভঙ্গিটি পরবর্তী বহু বেদান্ত-টীকা ও ভাষ্যগ্রন্থে প্রতিধ্বনিত হয়েছে—বিশেষত চিৎসুখাচার্যের তত্ত্বপ্রকাশিকা, প্রকাশানন্দ সরস্বতীর বেদান্তসিদ্ধান্তমুক্তাবলী এবং আপ্পাইয় দীক্ষিতের সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ-এ। এই গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়, আভাসবাদ ও প্রতিবিম্ববাদকে আলাদা দুটি মত হিসেবে নয়, বরং ভিন্ন প্রেক্ষিতে পরস্পর-পরিপূরক তত্ত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আপ্পাইয় দীক্ষিত স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, শঙ্করোত্তর ভাষ্যকারেরা এই দুই ধারণাকে বিরোধী ভাবেননি। তাঁর ব্যাখ্যায়—আভাসতত্ত্ব বোঝায় জগতের প্রকাশ বা উদ্ভবের প্রকৃতি, অর্থাৎ ব্রহ্মচৈতন্য কীভাবে বহুরূপে নিজেকে উদ্ভাসিত করে; আর প্রতিবিম্বতত্ত্ব বোঝায় সেই প্রকাশের অভিজ্ঞতামূলক প্রতিফলন—চেতনা কীভাবে নিজের প্রতিচ্ছবিতে জগৎ ও জীবকে উপলব্ধ করে।
এইভাবে দুই তত্ত্ব একে অপরকে সম্পূর্ণ করে—আভাসতত্ত্ব জগতের “উদ্ভব”-এর দিকটি ব্যাখ্যা করে, আর প্রতিবিম্বতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে সেই উদ্ভবের “অভিজ্ঞতা”-র দিকটি। ফলে ব্রহ্ম, জগৎ ও জীবের সম্পর্ক ব্যাখ্যায় এই দুই তত্ত্ব একসঙ্গে মিলে অদ্বৈত দর্শনের অন্তর্নিহিত ঐক্য ও গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
এই মতে, চৈতন্যের দুটি দিক আছে—
১. আভাসরূপ প্রকাশ (Ābhāsa): চৈতন্য নিজের দীপ্তিতে নাম-রূপের সম্ভাবনা প্রকাশ করে—এটি বহির্মুখ উন্মেষ।
২. প্রতিবিম্বরূপ অভিজ্ঞতা (Pratibimba): চৈতন্য সেই প্রকাশকে নিজের প্রতিফলনে জেনে নেয়—এটি অন্তর্মুখ আত্ম-অভিজ্ঞতা।
অর্থাৎ, জগৎ কেবল চেতনার আলোতে প্রকাশিত নয়, চেতনারই প্রতিফলিত স্ব-অভিজ্ঞতা হিসেবেও বিদ্যমান। এই দ্বিমুখী প্রকাশ-প্রতিফলনেই মায়ার ভূমিকা ধরা পড়ে—মায়া এখানে বিভ্রম নয়, বরং “প্রকাশ-প্রতিবিম্ব-বিকিরণ”-এর মাধ্যম।
যেমন আয়নায় মুখ দেখা যায়—মুখ আলাদা নয়, কিন্তু আয়নার প্রতিফলন ছাড়া দেখা যায় না। আবার, সেই মুখের দীপ্তিই আয়নাকে আলোকিত করছে। একইভাবে, চেতনা নিজের আলোয় নাম-রূপের জগৎকে উদ্ভাসিত করে (আভাস) এবং সেই উদ্ভাস চেতনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জ্ঞানের রূপে অভিজ্ঞ হয় (প্রতিবিম্ব)। ফলে দেখা ও দেখা-হওয়া, প্রকাশ ও প্রতিফলন—দুটিই এক অপরের পরিপূরক।
এই সংকর দৃষ্টিভঙ্গি অদ্বৈত বেদান্তকে আরও অভিজ্ঞতামূলক ও গতিশীল করে তোলে। একদিকে এটি স্বীকার করে যে, ব্রহ্মচৈতন্যই সব কিছুর উৎস, অন্যদিকে মেনে নেয় যে, অভিজ্ঞতা-জগৎ এক বাস্তব প্রতিফলন, যা ব্রহ্মচৈতন্যে নিহিত।
ফলে, জগৎ না নিখাদ বিভ্রম, না সম্পূর্ণ বাস্তব—এটি ব্রহ্মচৈতন্যের আভাস-প্রতিবিম্বরূপ অভিব্যক্তি। যেমন এক সূর্যের আলো নানা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দীপ্তি সৃষ্টি করে, তেমনি এক চৈতন্যের দীপ্তিই মায়ার আয়নায় নানা অভিজ্ঞতার রূপে প্রতিফলিত হয়। আভাস-প্রতিবিম্ব-সংকরবাদ সেই সমন্বয়ধারা, যা বলে—চৈতন্যের আলোই জগতের আয়না, আর সেই আয়নায় প্রতিফলিত হয় চেতনারই মুখ।
১৩. একজীববাদ (Eka-jīva-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এক চূড়ান্ত ও মননাত্মক তত্ত্ব, যা বলে—এই সমগ্র জগৎ ও সমস্ত জীব একমাত্র এক চৈতন্য বা এক “জীব”-এরই স্বপ্ন-সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। বহুত্ব কেবল প্রতীয়মান; বাস্তবে জীব এক, চেতনা এক, দ্রষ্টা এক। অন্য সমস্ত জীব ও জগৎ সেই এক জীব-চেতনার অভ্যন্তরীণ প্রক্ষেপ, তার নিজের স্বপ্ন-সদৃশ প্রতিভাস।
এই তত্ত্বের শেকড় পাওয়া যায় মাণ্ডূক্য উপনিষদ ও গৌড়পাদ কারিকা-তে। গৌড়পাদাচার্য তাঁর কারিকাতে (৩.১৮-১৯) বলেন—“এক আত্মা সর্বভূতেষু”—সকল জীবের অন্তরে এক আত্মাই বিরাজমান। পরবর্তী কারিকায় তিনি বলেন—“সপনদর্শনবৎ সর্বং”—সমস্ত জগৎ স্বপ্নদর্শনের মতো; বহির্জগত বা অন্য জীব কোনো স্বাধীন সত্তা নয়। গৌড়পাদ তাঁর অজাত-বাদে (৩.৪৮) আরও স্পষ্টভাবে বলেন—“নৈকো জীবো ন চা অন্যো”—একাধিক জীব কল্পনা, কারণ বহুত্ব মায়াজাত।
এই একজীববাদকে পরবর্তী শঙ্করোত্তর বেদান্তাচার্যরা (বিশেষত বিদ্যারণ্য তাঁর পঞ্চদশী গ্রন্থে) আরও সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে বলা হয়—যেমন স্বপ্নে একজন ব্যক্তি অসংখ্য মানুষ, প্রাণী, নগর, পাহাড় দেখতে পায়, অথচ জাগরণের পরে বুঝতে পারে—সবই তার নিজের মন থেকেই উদ্ভূত; তেমনি জাগতিক বহুত্বও সেই এক জীব-চেতনার স্বপ্ন-সৃষ্টি।
এই মতে—“জীব” মানে দ্রষ্টা চেতনা, যে জগতকে অভিজ্ঞতা করে। বহুজীব বা জগৎ মানে সেই এক জীবের চিন্তাজাত প্রক্ষেপ (projection)। বহুত্ব কেবল প্রাতিভাসিক সত্য—অভিজ্ঞতায় সত্য, কিন্তু জ্ঞান-নির্ণয়ে অনস্তিত্ব (পরমার্থে অসৎ, paramārthato asat)। অর্থাৎ, এক জীব চেতনা নিজেরই বৃত্তি, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাকে বহির্জগৎ রূপে প্রতিফলিত করে, যেন এক বিশাল স্বপ্ন। অন্য সব জীব সেই এক জীবের চিন্তার ভিন্ন দিক বা “চৈতন্য-আভাস”।
স্বপ্নের উপমা এই তত্ত্বের মূল প্রতীক। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে হাজার মানুষ, প্রাণী ও ঘটনা দেখে—কেউ তার বন্ধু, কেউ শত্রু, কেউ অপরিচিত। কিন্তু জেগে ওঠার পর সে জানে—সবই তার নিজের মানসিক রূপান্তর; স্বপ্নের মধ্যে অন্য কেউ সত্যি সত্যি ছিল না। তেমনি জাগ্রত অবস্থায়ও “আমি”, “তুমি”, “সে”—এই ভেদ কেবল দৃষ্টির স্তরে; জ্ঞানের স্তরে একমাত্র চৈতন্যই বাস্তব।
বিদ্যারণ্য স্বামী তাঁর পঞ্চদশী গ্রন্থে (৭.৩-৫) এই একজীববাদী দৃষ্টিভঙ্গিটিকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন—“স্বপনে যদ্বদেকোহপি নানাজনবিভাসতে, তদ্বৎ জাগ্রতদর্শনং।” অর্থাৎ, যেমন স্বপ্নে একমাত্র স্বপ্নদ্রষ্টাই নিজের মন থেকে অসংখ্য মানুষ, শহর, বস্তু ও ঘটনাকে দেখতে পায়—তেমনি জাগ্রত অবস্থায়ও যে-জগৎ আমরা দেখি, তা আসলে এক চেতনারই প্রক্ষেপ বা মানসিক প্রকাশ।
এই উপমা দিয়ে বিদ্যারণ্য বোঝাতে চেয়েছেন—জগৎ যেমন স্বপ্নে বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে স্বপ্নদ্রষ্টার মনেই গঠিত, তেমনি জাগতিক জগৎও সেই এক চেতনার মধ্যেই সৃষ্ট ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে। এখানে “একোহপি নানাজনবিভাসতে” কথাটি ইঙ্গিত করে—চেতনা এক হলেও তা নিজেকে নানা রূপে প্রকাশ করে; আর “জাগ্রতদর্শনং” বলে বোঝানো হয়েছে যে, জাগ্রত জগৎও সেই একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি।
ফলত, পঞ্চদশী এই শ্লোকে এক গভীর তত্ত্ব প্রকাশ করে—জগৎ বহু বলে মনে হলেও, তা আসলে এক চেতনারই বহুরূপ প্রতিফলন; পার্থক্য কেবল দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতার স্থায়িত্বে। স্বপ্নে যেমন সব মিলিয়ে যায় জেগে ওঠার পর, তেমনি পরম জ্ঞান লাভের পর জাগতিক জগতেরও পৃথকতা লুপ্ত হয়, চৈতন্যই থেকে যায় এক ও অভিন্ন রূপে।
একজীববাদকে “অদ্বৈতের চরম সংহত রূপ” বলা হয়, কারণ এটি বহুত্ব ও পরস্পর-স্বতন্ত্র জীবসত্তার ধারণাকে সম্পূর্ণ নাকচ করে। এই দৃষ্টিতে “অন্য” বলে কিছু নেই—যে-“তুমি”-কে আমি দেখি, সে-ও আমারই অভিজ্ঞতা-রূপ। ফলে সমগ্র জগৎ এক জীবের চেতনার পরিধিতে অবস্থিত।
সমালোচকেরা এই তত্ত্ব নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন—যদি সত্যিই কেবল “এক” জীব থাকে এবং বাকিরা তারই চেতনার অভিব্যক্তি হয়, তাহলে দৈনন্দিন জীবনের নৈতিকতা, সম্পর্ক, দায়িত্ববোধ—এসবের ভিত্তি কোথায়? কারণ, এই ধারণা সাধারণভাবে গ্রহণ করলে মনে হতে পারে—যেহেতু সবই আমার মনেই চলছে, তাই অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের কষ্ট বোঝা বা নৈতিক নিয়ম মানার কোনো বাধ্যবাধকতাই নেই। ফলত, ব্যাবহারিক সত্যের (ব্যাবহারিক জগৎ) স্তরে এই মতকে ধরে রাখা কঠিন।
এই কারণে বহু অদ্বৈতাচার্য বলেছেন—একজীববাদ মূলত উচ্চতর ধ্যান-দৃষ্টি বা দার্শনিক উপলব্ধি। এটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দান করে—“সবই চেতনায়”—কিন্তু দৈনন্দিন সাধনা, নৈতিকতা, সমাজজীবন বা ভক্তিপথে এটি সরাসরি প্রয়োগ করা হয় না।
ব্যাবহারিক জীবনে তাই অধিকাংশ আচার্য বহুজীববাদ-কে গ্রহণ করেন, অর্থাৎ প্রতিটি জীব স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান, এবং ঈশ্বর, জগৎ ও জীবের পার্থক্যকে মান্য রেখেই সাধনা, সেবা ও নৈতিকতার চর্চা হয়।
সহজ ভাষায়—একজীববাদ হচ্ছে, ধ্যান ও জ্ঞান-দৃষ্টির শীর্ষতত্ত্ব (আত্মানুভূতির স্তর)। বহুজীববাদ হচ্ছে, জীবনচর্চা ও সাধনার বাস্তব পন্থা (করুণা-নৈতিকতার স্তর)। অর্থাৎ, “সবই আমি” জ্ঞানে মুক্তি, আর “সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি” অনুভবে ভক্তি ও নৈতিকতা টিকে থাকে।
advaita-vision.org, Wisdom Library ও JSTOR-এর বিভিন্ন প্রবন্ধে এই মতকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “idealistic solipsism”-এর ভারতীয় প্রতিরূপ হিসেবে। সেখানে বলা হয়েছে—“একজীববাদ (Eka-jīva-vāda) এই মত প্রকাশ করে যে, বহু জীব ও জগতের ধারণা আসলে একমাত্র চেতনারই কল্পনা; যেমন স্বপ্নে এক মনেই অসংখ্য ঘটনা ও চরিত্র উদ্ভূত হয়।”
একজীববাদ শেখায়—জগৎ সেই এক চেতনারই স্বপ্ন, জীব সেই এক চেতনারই প্রতিফলন, আর বহুত্ব সেই একতার খেলা। যেমন এক স্বপ্নদ্রষ্টা নিজের মধ্যে স্বপ্নের সব চরিত্র ও ঘটনা ধারণ করে, তেমনি চৈতন্যও নিজের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব ও জীবজগৎ ধারণ করে—একই চেতনা, ভিন্ন ভিন্ন আভাসে উদ্ভাসিত।
১৪. ঈশ্বর-জীব-বিভক্তি অদ্বৈত বেদান্তের একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, যা আমাদের শেখায়, যে তিনটি সত্তা আমরা আলাদা বলে মনে করি—ঈশ্বর (পরমচেতনা), জীব (ব্যক্তিচেতনা) এবং জগৎ (নাম-রূপময় প্রকাশ)—তাদের মধ্যে কোনো পরমার্থিক ভেদ নেই; তারা একই চেতনার তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি, তিনটি অভিব্যক্তি মাত্র। পার্থক্যটি কেবল উপলব্ধির স্তরে, কিন্তু সত্তাগত বা অস্তিত্বতাত্ত্বিক দিক থেকে তারা এক ও অভিন্ন।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে (১.৪.১০) ঘোষিত হয়েছে—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”, অর্থাৎ “আমি-ই ব্রহ্ম।” এই উক্তি মানুষের আত্মাকে (জীবাত্মা) ব্রহ্ম বা পরমচেতনার সঙ্গে অভিন্ন ঘোষণা করে। আবার মুণ্ডক উপনিষদে (২.২.৫) মাকড়সার উপমা দিয়ে বলা হয়েছে—“যথোর্ননাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ”—যেমন মাকড়সা নিজের থেকেই জাল বিস্তার করে এবং তা নিজের মধ্যেই প্রত্যাহার করে নেয়, তেমনি ব্রহ্মও নিজের থেকেই জগৎকে প্রকাশ করেন এবং শেষে নিজের মধ্যেই তা লীন করে নেন। এই দৃষ্টান্তে বোঝানো হয়েছে—জগৎ ব্রহ্মের বাইরের কিছু নয়; তাঁরই অন্তর্গত প্রকাশ।