যেমন—রাত্রির অন্ধকারে কেউ দড়িকে দেখে এবং ভুল করে “সাপ” মনে করে। এখানে “দেখা” বাস্তব; ভয় ও প্রতিক্রিয়াও কার্যকর; কিন্তু পরবর্তীকালে আলো জ্বেলে বোঝা যায়, প্রকৃত সাপ কখনও ছিল না। অতএব, সেই “সাপ” না পুরো বাস্তব (যেমন সত্যিকারের সাপ), না পুরো অবাস্তব (যেমন আকাশে পদ্ম); এটি অনির্বচনীয়—অর্থাৎ এমন এক আভাস, যাকে “আছে” বা “নেই”—এই দুইয়ের কোনোটিই নিরপেক্ষভাবে বলা যায় না।
এই ধারণা অনুযায়ী “অনির্বচনীয়তা” এমন এক সূক্ষ্ম স্তর, যা সম্পূর্ণ বাস্তবও নয়, আবার সম্পূর্ণ অবাস্তবও নয়—এ যেন সত্য ও মায়ার মাঝামাঝি এক অস্তিত্ব-অবস্থা। এখানে বস্তু ও অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা ও প্রতিভাস, জ্ঞান ও ভ্রম—সব কিছু এক জটিল পারস্পরিক নির্ভরতার বন্ধনে গাঁথা। অর্থাৎ, যা আমরা দেখি বা অনুভব করি, তা একদিক থেকে সত্য বলে প্রতীয়মান, আবার অন্যদিক থেকে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, যখন উচ্চতর জ্ঞানে পৌঁছানো যায়।
শঙ্করাচার্যের শিষ্য সুরেশ্বরাচার্য তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বৃহদারণ্যক-ভাষ্য-বৃত্তিকর্য’-এ এই অনির্বচনীয়তার ধারণাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন—জগৎ আসলে এক “মায়ামূলক প্রতীতি”; অর্থাৎ, এটি মায়া বা অজ্ঞতার দ্বারা উদ্ভূত নাম ও রূপের জাল, যা দেখতে বাস্তব মনে হলেও পরম জ্ঞানে তা বিলীন হয়ে যায়। তাঁর কথায়—“মায়াসংভূতং নামরূপাত্মকং বিশ্বমিদং অনির্বচনীয়ম্”, অর্থাৎ এই নাম-রূপময় বিশ্ব মায়াজাত, তাই একে নির্দিষ্টভাবে “বাস্তব” বা “অবাস্তব” বলা যায় না—এ অনির্বচনীয়।
এইভাবেই অনির্বচনীয়তা জগতের প্রকৃতি সম্পর্কে অদ্বৈত বেদান্তের এক গভীর দৃষ্টিভঙ্গি দেয়—যেখানে জগৎকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয় না, আবার তাকে পরমার্থসত্যও বলা যায় না; সে এক স্বপ্নের মতো—যা দেখা যায়, অনুভূত হয়, কিন্তু জাগরণের পর আর থাকে না।
পরবর্তী শঙ্করোত্তর ভাষ্যকারগণ—বিশেষত বাচস্পতি মিশ্র (ভামতী), প্রকাশাত্মা (বিবরণ) এবং চিৎসুখাচার্য (তত্ত্বপ্রকাশিকা)—এই অনির্বচনীয়তত্ত্বকে সূক্ষ্মভাবে শৃঙ্খলিত করেছেন। তাঁদের মতে, মায়া-জাত প্রতীতি তিনস্তরবিশিষ্ট—প্রাতিভাসিক সত্য (স্বপ্ন বা ভ্রমের মতো)—অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য, কিন্তু উর্দ্ধতর জ্ঞানে মিথ্যা; ব্যাবহারিক সত্য—জাগতিক জগৎ, যা অভিজ্ঞতায় কার্যকর; পারমার্থিক সত্য—ব্রহ্মচৈতন্য, যা সর্বোচ্চ ও অবিকার।
এই তিন স্তরের মধ্যবর্তী সংযোগই অনির্বচনীয়তার প্রকৃত ভূমি। উদাহরণস্বরূপ, যেমন মরীচিকায় জল দেখা যায়—তৃষ্ণার্ত মানুষ জল খুঁজতে দৌড়ায়; অভিজ্ঞতায় তা বাস্তব; কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায়, বালি ছাড়া কিছুই নেই। তাই জল “অবাস্তব” নয়, কারণ দেখা গিয়েছিল; আবার “বাস্তব”ও নয়, কারণ সত্যিকারের জল নয়। এই অদ্বৈত তত্ত্বে এই দ্বন্দ্বকেই বলা হয় “অনির্বচনীয়”—যা না একান্তে সত্য, না একান্তে মিথ্যা, বরং “সত্যাভাস।”
এই ধারণাটি আধুনিক গবেষণাতেও বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। যেমন পুনে বিশ্ববিদ্যালয় (unipune.ac.in)-এর দর্শন বিভাগে প্রকাশিত গবেষণাপত্রসমূহে বলা হয়েছে—“অনির্বচনীয়তা অদ্বৈত দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্য; এটি ইন্দ্রিয়গোচর জগতের যৌক্তিকভাবে নির্ধারণঅযোগ্য (অবাচ্যতা) অবস্থাকে নির্দেশ করে, যা উচ্চতর জ্ঞানে লুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে।” অর্থাৎ, জগৎকে না পুরো বাস্তব, না পুরো অবাস্তব বলা যায়—সে এক অন্তর্বর্তী সত্য, যা চেতনার সীমিত অবস্থায় সত্য মনে হয়, কিন্তু পরম জ্ঞানের আলোয় বিলীন হয়ে যায়। অনির্বচনীয়-খ্যাতিবাদ অদ্বৈতের সেই মৌলিক দ্বন্দ্ব-নিরসন করে—যেখানে জগৎকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলা যায় না, আবার পরমার্থে সত্যও নয়। দেখা, জানা এবং জ্ঞান-নির্ণয়—এই তিন পর্যায়ের ভেদে এর সত্যতার মান পরিবর্তিত হয়।
অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করা—দেখা হওয়ার ব্যাপারটা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু জ্ঞানের আলোয় তার নিবারণও অনিবার্য। তাই “সাপ” ছিল আভাসিক সত্য, কিন্তু পরমার্থে অসত্য—এই “অব্যক্ত মধ্যাবস্থা”-ই অনির্বচনীয়তা।
ফলে এই তত্ত্বের দর্শনীয় তাৎপর্য হলো—সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই চেতনার প্রতিফলিত খেলা; সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তবের মধ্যবর্তী এই অনির্বচনীয়তাই জগতের প্রকৃত দার্শনিক অবস্থান।
১০। স্বপ্নবাদ (Svapna-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক দার্শনিক রূপক, যা জাগতিক অভিজ্ঞতার আপাত বাস্তবতাকে বোঝাতে “স্বপ্ন”-এর উদাহরণ ব্যবহার করে। এর মূল বক্তব্য—যেমন স্বপ্নের নগর, মানুষ, সম্পর্ক ও ঘটনা সবই জেগে ওঠার সঙ্গে লুপ্ত হয়, তেমনি জাগ্রত-জগতও চৈতন্য-প্রক্ষেপের মধ্যে যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণই সত্য বলে প্রতীয়মান; জ্ঞান-প্রতিভাস নিবারিত হলে তা মিলিয়ে যায়।
এই মতের উৎস বৃহদারণ্যক উপনিষদের (৪.৩.৯) উক্তিতে স্পষ্ট—“স্বপনে রাজা রাজান্যো ভবতি...”—অর্থাৎ, স্বপ্নাবস্থায় চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে একটি পূর্ণ জগত সৃষ্টি করে এবং সেই জগতের অভিজ্ঞতাও নিজেই গ্রহণ করে। এখানে “রাজা” বা “প্রজাপতি” কেবল প্রতীক—যা বোঝায়, চেতনা নিজেই সৃষ্টিকর্তা, অভিজ্ঞতা-গ্রহণকারী এবং সেই সৃষ্টির উপাদান—সব কিছুই এক।
এই ধারণাকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মাণ্ডূক্য উপনিষদ ও গৌড়পাদাচার্য তাঁর কারিকা-য় (৩.২৯-৩১)। সেখানে তিনি বলেন—“যথা স্বপ্নে তথা জাগ্রতে”—অর্থাৎ, যেমন স্বপ্নে-দেখা নগর, মানুষ, অভিজ্ঞতা—সবই মনের প্রক্ষেপ, তেমনি জাগ্রত অবস্থায় দেখা জগৎও চেতনারই এক প্রক্ষেপমাত্র। পার্থক্য কেবল এই যে, জাগ্রতের অভিজ্ঞতা তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী, তাই তা আমাদের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উভয়ই চেতনার অভ্যন্তরে ঘটে-যাওয়া প্রকাশমাত্র।
স্বপ্নবাদ বা স্বপ্নোপম জগতের ধারণা অদ্বৈত বেদান্তে প্রতিভাসতত্ত্বেরই এক সম্প্রসারণ—যেখানে বলা হয়, জগৎ কোনো বাহ্য বাস্তবতা নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত এক স্ব-প্রতিফলন, যা জ্ঞানের আলোকেই দেখা যায় এবং জ্ঞানের উদয়ে মিলিয়েও যায়।
শাস্ত্র ও ভাষ্যকারেরা স্বপ্নকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—
১. মানসিক নির্মাণ (manas-nirmitatva): স্বপ্নের বস্তু ও ঘটনাগুলি মনই সৃষ্টি করে; বাহ্য জগৎ নেই।
২. স্মৃতি-ভিত্তিক সংযোজন (smṛti-saṅkalita): পূর্বে দেখা বা অনুভূত ঘটনার স্মৃতি মিলিয়ে স্বপ্নরূপ দৃশ্য গঠিত হয়।
এই দ্বৈত ব্যাখ্যা থেকেই অদ্বৈত বলে—জাগতিক জগৎও এক “সমষ্টিগত স্বপ্ন”—মানসিক প্রক্ষেপ ও স্মৃতি-রূপ অভিজ্ঞতার সমন্বয়।
স্বপ্নের বাস্তবতা যতক্ষণ স্বপ্নে আছি, ততক্ষণ নিঃসন্দেহ; জেগে উঠলেই জানা যায়, তা মিথ্যা। ঠিক তেমনি জাগ্রত জগৎও প্রাতিভাসিক স্তরে সত্য (vyāvahārika satya), কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানপ্রাপ্ত অবস্থায় (pāramārthika dṛṣṭi) নিবার্য—অর্থাৎ অবলুপ্তিযোগ্য প্রতিভাস। এই কারণে শঙ্কর ও গৌড়পাদ উভয়েই স্বপ্নকে জগতের প্রকৃতি বোঝানোর শ্রেষ্ঠ উপমা মনে করেছেন।
স্বপ্নে কেউ রাজা হয়, সেনা পরিচালনা করে, বিপদে পড়ে—সবই তৎক্ষণিক বাস্তব। কিন্তু জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই “রাজ্য” ও “সেনা” বিলীন। কেউ জাগরণের পরে বলে না, “আমার স্বপ্নরাজ্য কোথায় গেল?”—কারণ জ্ঞান-নির্ণয়ে তা নিবারিত। একইভাবে জাগতিক প্রপঞ্চও ব্রহ্মজ্ঞান-জাগরণে লুপ্ত হয়; থাকে কেবল স্বপ্রকাশ চৈতন্য।
আধুনিক গবেষণা-প্রবন্ধে (বিশেষত JSTOR-এ প্রকাশিত “The Dream Analogy in Advaita Vedānta” প্রভৃতি) এই স্বপ্ন-উপমাকে দুই স্তরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে—
জ্ঞাতাত্ত্বিক (Epistemic): স্বপ্নের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়—উপলব্ধি সবসময় সত্যতার নিশ্চয়তা দেয় না; জ্ঞান নির্ভর করে চেতনার অবস্থার উপর এবং সেই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে।
অস্তিত্বতাত্ত্বিক (Ontological): স্বপ্নের উদাহরণ বোঝায় যে, “সত্তা” ও “প্রতীতি” আলাদা নয়—চেতনা নিজেই বিশ্বরূপ ধারণ করে, অর্থাৎ জগৎ আসলে চেতনারই এক স্বপ্রকাশ।
অদ্বৈত স্বপ্নবাদ শেখায়—জাগতিক জগৎ এক “দীর্ঘ স্বপ্ন”; যতক্ষণ চৈতন্যের প্রতিভাস রয়েছে, ততক্ষণ তা বাস্তব বলে প্রতীয়মান। কিন্তু চেতনার স্বরূপে জাগরণ ঘটলে, জগতের সব নাম-রূপ মিলিয়ে যায়—যেমন জাগরণের আলোয় স্বপ্নের নগর। অতএব জগৎ প্রাতিভাসিক সত্য, আর ব্রহ্ম—পারমার্থিক সত্য।
প্রতিভাসবাদ শেখায়—জগৎ আসলে সেই প্রতিচ্ছবি, যা দেখা-হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নেয়; অর্থাৎ দেখা মানেই সৃষ্টি। আভাসবাদ বলে—এই বিশ্ব চৈতন্যের বহির্মুখ আলোয় প্রকাশিত, যেন চেতনার দীপ্তি বাইরে ছড়িয়ে পড়ে নাম-রূপের জগৎ রচনা করে। অপরদিকে, আভাসবাদ দেখায়—এই বিশ্ব কোনো বাহ্য প্রকল্পন নয়, বরং চেতনার অন্তর্মুখ স্ব-অভিজ্ঞতা, যেখানে চেতনা নিজেকেই অসংখ্য রূপে অনুভব করে। অনির্বচনীয়-খ্যাতিবাদ ব্যাখ্যা করে, কেন জগৎকে এককথায় “সত্য” বা “মিথ্যা” বলা যায় না—এটি এমন এক মধ্যবর্তী স্তর, যা দেখা যায় ও অনুভূত হয়, কিন্তু পরম জ্ঞানে লুপ্ত হয়ে যায়। স্বপ্নবাদ সেই শিক্ষাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে—যা-কিছু চেতনার প্রক্ষেপণ, তা শেষপর্যন্ত উচ্চতর জ্ঞানের আলোয় মিলিয়ে যায়, ঠিক যেমন জেগে উঠলে স্বপ্ন বিলীন হয়।
শেষপর্যন্ত সব দর্শনের মূল সুর এক—চৈতন্যই একমাত্র বাস্তবতা, আর জগৎ তারই প্রতিফলন, প্রতিভাস বা আভাসমাত্র। মুক্তি কোনো নতুন কিছু লাভ করা নয়; বরং এই প্রতিফলনময় জগৎ থেকেই নিজের সেই স্বয়ং-আলোকিত চৈতন্যসত্তাকে প্রত্যক্ষ করা—যেখানে প্রাতিভাসিক ও ব্যাবহারিক সব স্তর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় পরমার্থের নিঃশব্দ দীপ্তিতে।
নিচে চেতনার প্রতিফলন ও অভিজ্ঞতা-নির্ভর পাঁচটি দর্শনধারার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছি—প্রামাণিক উৎস, প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ও দর্শনগত প্রসঙ্গ-সহ।
১১. প্রতিবিম্ববাদ (Pratibimba-vāda) অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়েছে—জগৎ ও জীব উভয়ই এক ও অভিন্ন ব্রহ্মচৈতন্যের প্রতিফলনমাত্র। যেমন এক সূর্যের প্রতিচ্ছবি হাজারো জলাশয়ে দেখা যায়, কিন্তু সূর্য একটাই—তেমনি এক পরম চেতনা অগণিত জীব ও জগতে প্রতিফলিত হয়ে বহুরূপে প্রতীয়মান হয়, অথচ বাস্তবতায় সে চেতনা এক ও অবিভক্ত।
এই তত্ত্বের মূল শব্দদ্বয়—বিম্ব (bimba) অর্থাৎ মূল চেতনা বা ব্রহ্ম এবং প্রতিবিম্ব (pratibimba) অর্থাৎ সেই চেতনার প্রতিফলন। জীবাত্মাকে বলা হয় প্রতিবিম্বিত চেতনা, কারণ তার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; সে মূল ব্রহ্মচৈতন্যেরই আভাস। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিফলন দেখলে মনে হয়, মুখটি আয়নার ভেতর আছে, অথচ মুখ ও প্রতিফলন ভিন্ন নয়—আয়না ও মুখের অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে এই ভেদপ্রতীতি সৃষ্টি হয়।
শঙ্করোত্তর অদ্বৈতাচার্যগণ—বিশেষত পদ্মপাদাচার্য (পঞ্চপাদিকা) ও প্রকাশাত্মা (পঞ্চপাদিকা-বিবরণ)—এই ধারণাকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, জীবচৈতন্য (cidābhāsa) হলো ব্রহ্মচৈতন্যের প্রতিবিম্ব, যা অন্তঃকরণ (মন-বুদ্ধি)-রূপ আয়নায় প্রতিফলিত হয়। মন স্বচ্ছ হলে প্রতিফলনও স্পষ্ট হয়, যেমন নির্মল জলে সূর্য স্পষ্ট দেখা যায়; কিন্তু মন মলিন হলে প্রতিফলন বিকৃত হয়। ফলে মুক্তি বা জ্ঞানপ্রাপ্তি মানে প্রতিফলনের স্বচ্ছতা—যেখানে প্রতিফলন ও বিম্ব একাকার হয়ে যায়।
এই দৃষ্টান্তই ব্রহ্মসূত্র (২.৩.৫০)-এর ব্যাখ্যায় প্রয়োগ হয়েছে—“প্রতিবিম্বিতোপি প্রায়োহভিন্ন ইতি”—যদিও প্রতিবিম্ব দেখা যায়, আসলে তা বিম্ব থেকে ভিন্ন নয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (২.৫.১৯) বলা আছে—“নেহ নানাস্তি কিঞ্চন”—এখানে কোনো বহুত্ব নেই; যা-কিছু দেখা যায়, তা এক ব্রহ্মেরই প্রতিফলিত আভাস।
যখন একটি সূর্য হাজারো পুকুরে প্রতিফলিত হয়, তখন প্রতিটি জলে আলাদা সূর্য দেখা যায়। কিন্তু সূর্য একটিই; পার্থক্য কেবল প্রতিফলনের মাধ্যম (জল)-এর গুণে। কোনো জল পরিষ্কার, কোনোটি ঘোলা; তেমনি জীবপ্রত্যেকের অন্তঃকরণ ভিন্ন ভিন্ন—কেউ অজ্ঞানে আচ্ছন্ন, কেউ জ্ঞানপ্রাপ্ত। তবু যিনি প্রতিফলিত হচ্ছেন, সেই চৈতন্য সর্বত্র একই।
এই কারণে প্রতিবিম্ববাদে জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক হলো অভেদে ভেদপ্রতীতি—অর্থাৎ মূলত অভিন্ন, কিন্তু প্রতিফলনজনিত ভেদ দেখা যায়। জীবের ‘আমি’-বোধ এই প্রতিফলনেই জন্মায়; এবং যখন এই প্রতিবিম্বিত চেতনা নিজের বিম্বরূপকে চিনতে পারে, তখনই জ্ঞান বা মুক্তি ঘটে।