পরবর্তীতে অভিনবগুপ্ত তাঁর ‘ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিবৃতি’-তে এই ভাবনাকে আরও গভীর করেন। তিনি দেখান, চেতনার মধ্যে প্রতিটি “আভাস” আসলে সেই ঈশ্বরীয় চৈতন্যেরই এক ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনি। চেতনা একই সঙ্গে “প্রকাশ” (আলো) এবং “বিমর্শ” (স্ব-সচেতনতা)—এই দুইয়ের মিলনেই জগৎ জন্ম নেয়। অর্থাৎ, ঈশ্বর কেবল বিশ্বকে আলোকিত করেন না, বরং নিজেকেও চেনেন নিজের মধ্য দিয়ে। তাই জগৎ হলো তাঁরই স্বপ্রকাশের অনন্ত রূপ।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আভাসবাদ কোনো নৈর্ব্যক্তিক মায়াতত্ত্ব নয়, বরং এক অন্তরঙ্গ প্রকাশতত্ত্ব। যেখানে অদ্বৈতের মায়া ধারণা নেতিবাচক—“অবিদ্যা” বা “অসত্য”; সেখানে আভাসবাদে মায়া ইতিবাচক—“প্রকাশের শক্তি।” অভিনবগুপ্তের ভাষায়, “মায়া ন তু বিভ্রান্তি, প্রকাশস্বভাবা”—অর্থাৎ, মায়া কোনো বিভ্রম নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরীণ প্রকাশের ছায়া।
সহজভাবে বললে, আভাসবাদ শেখায়—চেতনা নিজের আলোকেই বিশ্বকে সৃষ্টি করে, কিন্তু কখনও নিজ থেকে আলাদা হয় না। জগৎ তাই ব্রহ্মচৈতন্যেরই এক জীবন্ত প্রতিফলন—এক অবিরাম, আত্মদীপ্ত প্রকাশ।
সূর্য ও তার রশ্মির সম্পর্ক এই তত্ত্বে একটি প্রধান উপমা। সূর্য যেমন নিজের আলোকের বিকিরণে বহুরূপ প্রকাশ করে—আয়না, জলে, ধুলোয়—তবু সূর্যের অখণ্ডতা নষ্ট হয় না, তেমনি চিদ্চৈতন্যও নিজের আভাসে (নাম-রূপে) সর্বত্র প্রসারিত, অথচ নিজে অপরিবর্তনীয়। তাই জগৎ বিভ্রম নয়, চৈতন্যের আভাস।
সমসাময়িক গবেষকরা (যেমন জিয়ানফ্রাঙ্কো বের্তান্যি তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন) বলেছেন যে, “আভাস” ধারণা কাশ্মীর শৈব প্রত্যভিজ্ঞা ও উত্তর-শঙ্করীয় অদ্বৈত দর্শনের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগরেখা। আধুনিক সম্পাদিত অনুবাদ ও গবেষণাগ্রন্থসমূহে—যেমন তোড়েল্লা-র ‘উৎপলদেবের ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা-সহ বৃত্তি’ (Utpaladeva’s Īśvarapratyabhijñā Kārikā with Vṛtti), রতিয়ে-র হার্মেনিউটিকস অব দ্য সেল্ফ (Hermeneutics of the Self) এবং স্যান্ডারসনের বিভিন্ন প্রবন্ধে—আভাসতত্ত্ব-কে এক স্বতন্ত্র প্রকাশতত্ত্ব হিসেবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আভাসবাদ আমাদের শেখায়—বিশ্ব বিভ্রম নয়, বরং চেতনার দীপ্তির অন্তহীন রূপবিকাশ। জগৎ যেমন প্রতিফলিত আলো, তেমনি প্রতিটি অভিজ্ঞতা চৈতন্যালোকেরই অভ্যন্তরীণ প্রতিধ্বনি। তাই মুক্তি মানে জগতের নিবারণ নয়, বরং সেই দীপ্ত চৈতন্যকে তার নিজস্ব আভাস-রূপে চিনে নেওয়া—যেখানে প্রকাশ ও প্রকাশিত, দ্রষ্টা ও দৃশ্য, আলোক ও প্রতিচ্ছবি—সব এক অখণ্ড সত্যে মিলিত হয়ে থাকে, যা শৈব ও অদ্বৈত উভয় ধারায় একক নামেই পরিচিত—প্রকাশ-বিমর্শাত্মক পরমচেতনা।
আভাসবাদ নিয়ে আরও কিছু বলা যাক। ‘আভাসবাদ’ শব্দটি এসেছে “আভাস” থেকে, যার অর্থ হলো “আপাত প্রকাশ”, “প্রতিফলন”, “আলো”, “রূপের অনুরূপতা” বা “উদ্দেশ্যের আভাস।” ভারতীয় দর্শনে এই শব্দটি বোঝায় “প্রকাশতত্ত্ব” বা “প্রতিভাসতত্ত্ব”—যা মূলত কাশ্মীর শৈব ও অদ্বৈত বেদান্ত উভয় ধারাতেই ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও তাদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে “আভাসবাদ” এমন একটি তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে, কীভাবে শিব বা পরমচেতনা নিজের ইচ্ছাশক্তি থেকেই এই জগতের প্রকাশ ঘটান। এখানে শিবকে কেবল কোনো দূরবর্তী ঈশ্বর হিসেবে দেখা হয় না; তিনি একই সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং সংহারক—অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির চেতনা, শক্তি ও কার্য একত্রে তাঁরই মধ্যে নিহিত। তাঁর এই স্বয়ংক্রিয় প্রকাশশক্তিকেই বলা হয় মহেশ্বরায়া বা স্বাতন্ত্র্যশক্তি, অর্থাৎ সেই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, যার দ্বারা জগৎ চেতনার অন্তর্গত প্রকাশরূপে উদ্ভূত হয়।
কাশ্মীর শৈবদের মতে, এই প্রকাশপ্রক্রিয়াকে বোঝার জন্য দুটি প্রধান তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে—স্বাতন্ত্র্যবাদ (Svātantryavāda) এবং আভাসবাদ (Ābhāsavāda)। স্বাতন্ত্র্যবাদ বলে—বিশ্বসৃষ্টির পেছনে কোনো বহিরাগত কারণ নেই; সব কিছুই ঈশ্বরের স্বাধীন ইচ্ছার ফল। শিব নিজের ইচ্ছাশক্তিতেই এই বিশ্বপ্রবাহকে সচল রাখেন, ঠিক যেমন এক শিল্পী নিজের সৃজনশক্তি থেকে রূপ দেয় অসংখ্য ভাবনাকে।
অন্যদিকে, আভাসবাদ এই স্বাতন্ত্র্যবাদকেই আরও সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করে বলে—জগৎ কোনো বাস্তব রূপান্তর নয়, বরং শিবচেতনারই এক আভাস বা প্রতিফলন। অর্থাৎ, সৃষ্টি মানে শিবের মধ্যেই এক অন্তর্লীন প্রকাশ, যেখানে তিনি নিজেকে বহুরূপে উপলব্ধ করেন। এই ধারণার মাধ্যমে কাশ্মীর শৈবরা দেখাতে চেয়েছেন—শিব ও জগৎ আলাদা নয়; জগৎ তাঁরই চৈতন্যের উজ্জ্বল প্রতিফলন।
এই সৃষ্টিশক্তির কার্যপদ্ধতি তিনটি মূল নিয়মে নির্ভর করে—ভেদাভেদ (যেখানে একতা ও ভিন্নতা উভয়ই আপাত সত্য), প্রত্যক্ষ বা অভিজ্ঞতার নিয়ম (যেখানে দর্শন ও জ্ঞান একত্রে প্রকাশ ঘটে) এবং কার্য-কারণ সম্পর্কের নিয়ম (যা জগতের গতিশীলতার মূল ভিত্তি)।
উৎপলাচার্য প্রথম এই আভাসবাদকে সুসংহতভাবে রূপ দেন ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা-য়, আর পরে অভিনবগুপ্ত তার বিশদ ব্যাখ্যায় ‘ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিবৃতি’-তে বলেন—“বিশ্ব আসলে শিবেরই আভাস।” অর্থাৎ শিব নিজের চেতনার দীপ্তিতে নিজেকেই অসংখ্য রূপে উদ্ভাসিত করেন—তবু কখনও নিজের স্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। এইভাবে আভাসবাদ আমাদের শেখায়—সৃষ্টি কোনো বাইরের ঘটনা নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত এক চিরন্তন স্বপ্রকাশ।
আভাসবাদ এই সত্যটিকে মেনে নেয় যে, “দেখা” বা “প্রকাশ” নিজেই বাস্তব; এটি শিবের উপর আরোপিত কোনো বিভ্রম নয়। বরং শিবই স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিক্রিয়ায় চিরনিমগ্ন। প্রকৃতি (prakṛti) বা বিশ্ব তাই শিবের স্বাধীন ইচ্ছারই বহিঃপ্রক্ষেপ, শিবচৈতন্যের ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন।
অন্যদিকে অদ্বৈত বেদান্তে আভাসবাদ কিছুটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত। সুরেশ্বরাচার্যের ব্যাখ্যায় এটি “আভাসতত্ত্ব” নামে পরিচিত, যার মূল বক্তব্য—ব্যক্তি-আত্মা বা জীব আসলে ব্রহ্মচৈতন্যেরই এক আভাস বা প্রতিফলন। জীবের পৃথক কোনো সত্তা নেই; এটি ব্রহ্মেরই প্রতিচ্ছবি। শঙ্করাচার্যের মতে, চেতনার স্তরে জীব (jīva) ও ঈশ্বর (īśvara) উভয়ই এক অবিভাজ্য ব্রহ্মের অভিন্ন প্রতিফলন; তারা স্বতন্ত্র সত্তা নয়। সুরেশ্বর বলেন—জীবেরা ব্রহ্মের মতোই বাস্তব, কারণ তারা অবিদ্যার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক আভাসরূপে প্রকাশিত; কিন্তু জগৎ বা বস্তুসমূহ দ্বিতীয় আভাস—অর্থাৎ এই প্রাথমিক আভাসের প্রতিফলনমাত্র। এইভাবে অবিদ্যার মধ্যে যে-বাস্তবতা আভাসিত হয়, সেখান থেকেই বহির্জগৎ ও অভিজ্ঞতার সমস্ত রূপ উদ্ভূত হয়।
শঙ্করাচার্যের মতে, অবিদ্যা বা মায়া হলো আত্মা ও অনাত্মার পারস্পরিক আরোপ—বাস্তব ও অবাস্তবের সীমারেখা মিশে যায়। সৃষ্টি আসলে কোনো নতুন রূপান্তর নয়, বরং ব্রহ্মের নিজের মধ্যেই এক আত্ম-প্রকাশ। ব্রহ্মসূত্র (১.৪.২৬)-এ বলা হয়েছে, “সৃষ্টিই ব্রহ্মের আত্মসৃষ্টি”—ব্রহ্ম নিজের থেকেই সব কিছু প্রকাশ করে, কিন্তু নিজেকে কখনও বদলায় না।
এইভাবে আভাসবাদ দুটি ঐতিহ্যকে সংযুক্ত করে—কাশ্মীর শৈবের প্রকাশতত্ত্ব ও অদ্বৈত বেদান্তের আত্মপ্রকাশ-তত্ত্ব। উভয়ের মধ্যেই এক গভীর ঐক্য: জগৎ কোনো পরাধীন বিভ্রম নয়; এটি চেতনার নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসিত এক পরম প্রকাশ, যেখানে ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নিজেরই বহুরূপ আভাসে প্রতিফলিত।
বিশেষত কাশ্মীর শৈব দর্শনের পরিসরে আভাসবাদ (Abhāsavāda) এক গভীর ও সুনির্দিষ্ট প্রকাশতত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—চৈতন্য নিজেকেই আভাসিত করে, অর্থাৎ পরম চেতনা নিজের স্বরূপকেই নিজ আলোয় উদ্ভাসিত করে। এখানে জগৎ কোনো বহির্মুখ প্রকল্পন নয়, কোনো বিভ্রম বা মায়াজাত প্রতিচ্ছবি নয়; বরং চেতনার স্ব-অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক উদয়—চৈতন্যের নিজেরই অন্তর্লীন স্ব-দর্শন বা আত্মবিমর্শের প্রকাশ।
এই ধারণা কাশ্মীর শৈব প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন-এর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। উৎপলদেব তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা (১.৫.৮)-এ বলেন—“চিদেব আহং স্বপ্রকাশঃ স্ববিমর্শনাত্মা”—অর্থাৎ “আমি সেই চেতনা, যা নিজের আলোয় নিজেকে প্রকাশ করে এবং স্ববিমর্শ (self-reflexivity)-এর দ্বারা নিজেরই অভিজ্ঞতা লাভ করে।” এখানে “আভাস” মানে কেবল আলোকস্ফুরণ নয়, বরং প্রকাশ ও আত্মবিমর্শের যুগল একতা। চেতনা নিজেকে “দেখে,” এবং সেই দেখা থেকেই বিশ্বরূপের উদ্ভব।
অভিনবগুপ্ত, উৎপলদেবের ব্যাখ্যাকার হিসেবে, এই ভাবনাকে ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিবৃতি ও তন্ত্রালোক (১.৮৭-৯১)-এ সুসংহত করেন। তিনি বলেন—“আলো (প্রকাশ)” যদি চেতনার দিক, তবে “বিমর্শ (reflexive awareness)” তার আত্মানুভব। বিশ্ব এই দুইয়ের অবিচ্ছিন্ন খেলায় প্রকাশিত—যেখানে শিব নিজে নিজেরই অন্তর্মুখ দর্শনে বহুরূপে প্রকাশিত হন। অতএব, সৃষ্টির প্রক্রিয়া কোনো “বাহ্য প্রকল্পন” নয়, বরং চেতনার অন্তর্মুখী আন্দোলন—এক আত্ম-আভাস, যা কেবল প্রকাশ নয়, প্রত্যভিজ্ঞা (self-recognition)।
এই অর্থে, আভাসবাদ কাশ্মীর শৈব দর্শনে একটি স্বতন্ত্র ও সুসংহত তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যেমন Wikipedia ও Encyclopedia of Indian Philosophies (সম্পাদক: কার্ল পটার)-এর আলোচনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—“কাশ্মীর শৈব দর্শনে আভাসবাদ এই মত প্রকাশ করে যে, সমগ্র বিশ্বই চেতনার স্ব-প্রকাশ (স্বাভাসা); শিব নিজেকে বহুরূপ জগৎ হিসেবে প্রকাশ করেন, কিন্তু তবুও নিজের মৌল ঐক্য হারান না।” অর্থাৎ, শিবচেতনা কখনও বিভক্ত বা পরিবর্তিত হয় না—তিনি নিজেরই অন্তর্লীন দীপ্তিতে অসংখ্য রূপে প্রতিফলিত হন, আর সেই প্রতিফলনই এই জগৎ।
অদ্বৈত বেদান্তে আয়না ও মুখ পৃথক—চৈতন্যে প্রতিফলিত জগৎকে ভ্রান্ত প্রতিচ্ছবি ধরা হয়। কিন্তু কাশ্মীর শৈব আভাসবাদের দৃষ্টিতে আয়না ও মুখ এক, আলাদা নয়। চেতনা নিজেই আয়না, নিজেই মুখ, নিজেই প্রতিফলন। মুখের দেখা মানে নিজের দেখা—এখানেই “আভাস”-এর প্রকৃত অর্থ। শিব বা পরমচেতনা নিজেরই অনন্ত রূপাবয়বে প্রতিফলিত হচ্ছেন—যেমন এক দীপ্ত সূর্য অসংখ্য জলে প্রতিফলিত হয়ে নিজেকেই হাজারো বর্ণে দেখায়, অথচ সূর্য কখনও নিজের ঐক্য হারায় না।
কাশ্মীর শৈবদের মতে, চৈতন্য বা শিবের দুই প্রধান শক্তি—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শা (Vimarśa)। প্রকাশ মানে আলোকসত্তা, আর বিমর্শা মানে আত্মসচেতন প্রতিফলন। এই দুই একত্রে “আভাস”-এর জননী—যেখান থেকে বিশ্ব উদয় হয়। শিব কোনো সৃষ্টিকর্তা দেবতা নন, বরং চেতনার অন্তর্মুখ প্রতিফলনশক্তি; তাই বলা হয়—“বিশ্বং শিবাব্বাসম্”—জগৎ শিবেরই আভাস।
যেমন আমরা চিন্তা করলে মন নিজেই ভাব-রূপ ধারণ করে—কোনো বাহ্য উপকরণের প্রয়োজন হয় না। “আমি জানি” বা “আমি ভাবছি”—এই বোধ নিজেই আত্মবিমর্শ। তেমনি শিবচেতনা নিজে নিজের ভাব-রূপে (ভাবনাশক্তি, কল্পনাশক্তি, ইচ্ছাশক্তি) প্রকাশিত হয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করে।
আভাসবাদ আমাদের শেখায়—জগৎ কোনো বাহ্য জগৎ নয়; এটি চেতনার নিজের প্রতিফলিত বোধ। শিব বা চৈতন্য যখন নিজের মধ্যে নিজেকে প্রত্যক্ষ করে, তখনই “বিশ্ব” নামে তার সেই আত্ম-আভাস প্রতীয়মান হয়। অতএব, বিশ্ব শিবের ভিন্ন কিছু নয়—এটি শিবের স্ববিমর্শমান দীপ্তি, তাঁরই অন্তহীন প্রতিচ্ছবি, যেখানে দ্রষ্টা ও দৃশ্য, জ্ঞান ও জ্ঞানী, প্রকাশ ও প্রতিফলন—সব একক চৈতন্যের অনন্ত খেলায় মিশে যায়।
৯। অনির্বচনীয়-খ্যাতিবাদ (Anirvacanīya-khyātivāda) অদ্বৈত বেদান্তের “প্রতিভাস-তত্ত্ব”-এর পরিণত রূপ—এক দার্শনিক প্রয়াস, যা বোঝাতে চায়, জগৎ না সম্পূর্ণ বাস্তব (সত্য), না সম্পূর্ণ অবাস্তব (মিথ্যা), বরং “অনির্বচনীয়”, অর্থাৎ অজ্ঞাত বা বর্ণনাতীত। এটি না ব্রহ্মের মতো চিরসত্য, না সম্পূর্ণ শূন্য; জগৎ যতক্ষণ অভিজ্ঞতার স্তরে বিদ্যমান, ততক্ষণ কার্যকর (vyāvahārika satya), কিন্তু জ্ঞান-নির্ণয়ের (ব্রহ্মজ্ঞান) স্তরে তা বিলীন।
এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি শঙ্করাচার্যের “অধ্যাসভাষ্য”—ব্রহ্মসূত্রভাষ্যের সূচনাভাগে, যেখানে তিনি বলেন, “স্মৃতিরূপোঽয়মধ্যাসঃ”—অর্থাৎ, "এই অধ্যাস (আরোপ) হলো স্মৃতির রূপ।" অজ্ঞানের কারণে এক বস্তুর গুণ অন্য বস্তুর উপরে আরোপিত হয়। দড়ি-সাপ, শুক্তি-রুপা, বা মরীচিকা-জলের উদাহরণগুলি এখান থেকেই এসেছে।