আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণাতেও এই ভাবনার সঙ্গে আশ্চর্য মিল দেখা যায়। কোয়ান্টাম অবজারভার ইফেক্ট-এ বলা হয়—কোনো কণার অবস্থা পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত তা নির্দিষ্ট বা স্থির থাকে না; বরং দেখার ক্রিয়াই তাকে এক নির্দিষ্ট অবস্থায় রূপ দেয়। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণই সৃষ্টি ঘটায়, আর দর্শকই বাস্তবতার নির্মাতা।
আচার্য প্রকাশানন্দের দৃষ্টি-সৃষ্টি-তত্ত্বেও একই ভাব প্রকাশ পেয়েছে—চৈতন্যই একমাত্র সত্য দর্শক, আর সেই চেতনার দেখা বা দর্শন-ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সমস্ত জগতের রূপ, অবস্থান ও অর্থ গঠিত হয়। দেখা মানেই সৃষ্টি, আর চেতনা সেই সৃষ্টির মূলে থাকা চিরজাগ্রত দৃষ্টি।
এইভাবে দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ একদিকে উপনিষদীয় “অদ্বৈত” ভাবনাকে গভীর করে তোলে—যেখানে চেতনা ও জগৎ এক অখণ্ড সত্তা—অন্যদিকে এটি মন, অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের সম্পর্ককেও নতুনভাবে বোঝায়। এখানে কোনো “বাইরের জগৎ” নেই; যা আছে, তা কেবল চৈতন্যের দেখা। আর সেই দেখাতেই চিরকাল নতুনভাবে জন্ম নেয় বিশ্ব—প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি দর্শনে।
শেষপর্যন্ত, দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ আমাদের শেখায় যে, জগৎ কোনো স্থির বস্তু নয়; এটি সচল চেতনার অন্তর্মুখী ক্রিয়া, এক স্বপ্ন-সদৃশ প্রকাশ। যেমন যোগবাশিষ্ঠ-এ বলা হয়েছে—“দৃষ্টিমাত্রমিদং বিশ্বম্”—সমস্ত জগৎ কেবল দৃষ্টি-মাত্র। তাই, মুক্তি এখানে মানে জগতের বিলোপ নয়, বরং সেই দৃষ্টির উৎস ‘চৈতন্য’-কে নিজের স্বরূপে চেনা; তখন দৃষ্টি-সৃষ্টি’র খেলা নিজে নিজেরই অন্তর্লীন হয়ে যায়, এবং থেকে যায় কেবল সেই নিঃসঙ্গ জাগ্রত চৈতন্য, যে সব দৃষ্টিরও দ্রষ্টা।
৫। বিবর্তবাদ, যাকে শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যায় প্রায়ই “বিবর্ত-পরিণামবাদ” বলা হয়, অদ্বৈত বেদান্তে সৃষ্টিতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এই মতের মূল কথা হলো—সৃষ্টি কোনো বাস্তব রূপান্তর নয়, বরং এক অভাসমূলক বিবর্ত বা আপাত প্রকাশ।
ব্রহ্ম চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও অচল; কিন্তু সেই ব্রহ্মের মধ্যেই নানা নাম-রূপ, জগৎ ও জীবের বহুরূপ বিবর্ত ঘটে। এই বিবর্ত বাস্তব পরিবর্তন নয়, বরং যেন এক দৃষ্টিভ্রম—যেখানে রূপ বদলাতে দেখা যায়, অথচ মূল সত্তা অপরিবর্তিত থেকে যায়।
এই ধারণার শাস্ত্রীয় ভিত্তি ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-তে নিহিত—“মৃৎঘটনয়ৈক্যদর্শনাৎ”—অর্থাৎ, যেমন মাটির ঘট, শরাভ (ভগবান শিবের একটি বিশেষ উগ্র মূর্তিরূপ), থালা প্রভৃতি নানা রূপ থাকলেও তাদের সকলের সত্তা একটাই—‘মাটি’; তেমনি সমগ্র জগতের রূপভেদ সত্ত্বেও তার আসল সত্তা এক ব্রহ্ম। শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে স্পষ্টভাবে বলেন—“যথা মৃৎপিণ্ডাৎ ঘটাদয়ো বিবর্তান্তরাণি, তথৈব ব্রহ্মণো নামরূপবিভাগাত্ জগদ্ভেদঃ”—যেমন মাটির বিভিন্ন আকারকে আমরা “ঘট”, “শরাভ”, “পাত্র” বলে নাম দিই, অথচ সেগুলি মাটি ছাড়া অন্য কিছু নয়; তেমনি নাম-রূপবিভাগ দ্বারা দেখা জগৎ ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোনো সত্তা নয়।
শঙ্করাচার্য স্পষ্টভাবে পরিণামবাদ বা pariṇāma-vāda-এর বিপরীতে বিবর্তবাদ বা vivarta-vāda ধারণা উপস্থাপন করেন।
সাংখ্য ও বৈশেষিক দর্শনে বলা হয়েছে, পরিণামবাদে কারণ বাস্তবভাবে রূপান্তরিত হয়ে কার্য হয়ে ওঠে—যেমন দুধ পরিণত হয়ে দই হয়; সেখানে দুধের আসল অবস্থা বদলে যায়। কিন্তু শঙ্করাচার্য বলেন, যদি ব্রহ্ম সত্যিই এমনভাবে রূপান্তরিত হতো, তাহলে সে আর অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী ও অচ্যুত থাকত না। ব্রহ্ম তো নিজেই চিরস্থির ও অবিকার—তাই তার মধ্যে কোনো বাস্তব পরিবর্তন হতে পারে না।
এই কারণেই শঙ্কর বলেন, জগৎ ব্রহ্মের কোনো “রূপান্তরিত অবস্থা” নয়; বরং এটি কেবল এক অভাস বা প্রতিফলন, যা চৈতন্যের আলোয় মায়ার মাধ্যমে দেখা যায়। যেমন, মরুভূমিতে সূর্যের আলোয় মরীচিকা দেখা যায়—পানি মনে হলেও তা আসলে নেই; তেমনি জগৎও চৈতন্যের অচল সত্তার এক মায়ামূলক প্রতিচ্ছবি মাত্র।
এই ভাবটি ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.১.৪)-এর বিখ্যাত “মৃৎঘট” উপমাতেও উপস্থিত—যথা সোম্যেকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্ বাচারস্তণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্।। অর্থাৎ, হে সোম্য, যেমন একখণ্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরী সব জিনিসকে জানা যায় [তেমনি আত্মাকে জানলেই সব কিছুকে জানা যায়]। জিনিসগুলি নামে আলাদা, কেবলমাত্র মাটিই সত্য।
শ্বেতকেতুর পিতা গুরুর কাছ থেকে ছেলেকে কোন আদেশ শোনার কথা বলছেন? তা হলো-সত্য এক। নাম-রূপ সেই সত্যের উপর আরোপিত মাত্র। নামরূপের জন্যই এক সত্যকে পৃথক বলে মনে হয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে তিনি মৃত্তিকার কথা বলেছেন। মাটির একটা পাত্রকে জানলেই মাটির তৈরি সব জিনিসকে জানা হয়ে যায়। কোন অর্থে? 'পাত্র' একটা নাম মাত্র। আসল বস্তু হল মাটি। মাটি দিয়ে নানারকমের জিনিস তৈরী হয়। তারা নামরূপে আলাদা হলেও মাটি মাটিই থাকে। পরিবর্তন কেবল নাম-রূপে, সত্তায় নয়। এখানেই “বিবর্ত” ধারণার উৎস—রূপভেদে বিভ্রম, সত্তায় ঐক্য।
ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের এই দুটি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টির প্রকৃত স্বরূপকে এক গভীর দার্শনিক দৃষ্টিতে উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেন—“ভূমিরাপোঽনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।” (গীতা ৭.৪) এখানে ভূমি (মাটি), আপঃ (জল), অনল (অগ্নি), বায়ু, খ (আকাশ), মন, বুদ্ধি ও অহংকার—এই আট উপাদানকে তিনি বলেছেন নিজের অপরা প্রকৃতি, অর্থাৎ জড় বা নিম্ন প্রকৃতি। এই প্রকৃতি পরিবর্তনশীল, অচেতন, এবং নিজে থেকে কিছু করতে অক্ষম; এটি কেবল চেতনার উপস্থিতিতে কার্যকর হয়।
এরপর তিনি বলেন—“অপরৈয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্। জীবভূতাং মহাবাহো, যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।” (গীতা ৭.৫) অর্থাৎ, “হে মহাবাহু অর্জুন! এই অপরা প্রকৃতির বাইরে আমার আরেক প্রকৃতি আছে—যা পরা বা শ্রেষ্ঠ। সেই পরা প্রকৃতি জীবরূপ, চেতনারূপ; এই চৈতন্যশক্তিই সমগ্র জগৎকে ধারণ ও চালনা করছে।”
এই দুটি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টিকে দুটি স্তরে ভাগ করেছেন—অপরা প্রকৃতি ও পরা প্রকৃতি। অপরা প্রকৃতি হলো জড়, যা আকার, গতি ও পরিবর্তনের ধারক, কিন্তু চেতনা-বর্জিত। পরা প্রকৃতি হলো চৈতন্য বা জীবাত্মা, যা সচেতন, প্রাণদায়ী ও জগতের অন্তর্নিহিত শক্তি। যেমন বিদ্যুৎ যন্ত্রকে সচল করে, তেমনি পরা প্রকৃতি জড় জগৎকে প্রাণ ও গতি দেয়।
এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন—ভগবানই উভয় প্রকৃতির মূল উৎস ও নিয়ামক। তিনি জড় প্রকৃতিতে রূপ নেন জগতের দৃশ্যমান রূপে, আর চেতন প্রকৃতিতে প্রকাশিত হন জীবের অন্তরস্থিত আত্মরূপে। ফলে সৃষ্টির সমগ্র ব্যপ্তি—স্থূল থেকে সূক্ষ্ম, জড় থেকে চেতন—সবই তাঁর মধ্যেই অবস্থিত, তাঁরই দীপ্তির বহুমুখ প্রতিফলন।
শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে এই ভাবনাটিকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তিনি বলেন—“অষ্টধা প্রকৃতিঃ মেয়া...আপরৈয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মেঁ পরাম্”—অর্থাৎ, “আমার এই অষ্টধা প্রকৃতি (মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার) নিম্ন প্রকৃতি; কিন্তু এর উপরে আছে আমার আরেক প্রকৃতি, যা পরা বা শ্রেষ্ঠ—সেই চৈতন্যস্বরূপ প্রকৃতি।” এই নিম্ন প্রকৃতি বা ভৌতিক উপাদানসমূহ আসলে ব্রহ্মচৈতন্যেরই বাহ্য বা আপাত প্রকাশ, যা পরিবর্তনশীল ও মায়ামূলক। কিন্তু পরা প্রকৃতি, অর্থাৎ চৈতন্য, একেবারেই অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী ও বাস্তব।
জগৎ ও তার সব উপাদান চৈতন্যেরই এক নিম্নস্তরের প্রকাশ, যেন এক আয়নায় প্রতিফলন; কিন্তু যে-চৈতন্য থেকে এই প্রতিফলন ঘটছে, সেই ব্রহ্ম চিরকাল একই, অচল ও সত্য।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—যেমন সমুদ্রের ঢেউ, ফেনা, তরঙ্গ নানা রূপে উদ্ভাসিত হলেও সমুদ্রের জল অপরিবর্তিত থাকে; তরঙ্গের আগমন-লয় সমুদ্রের প্রকৃত রূপকে পরিবর্তন করে না। একইভাবে, ব্রহ্মের মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটে, কিন্তু ব্রহ্মের নিজের চৈতন্যস্বরূপ কখনও বিকৃত বা পরিবর্তিত হয় না।
বিবর্ত-পরিণামবাদ এইভাবে মায়াবাদ-এর সঙ্গে অন্তর্নিহিতভাবে যুক্ত। মায়াই ব্রহ্মকে নানা রূপে প্রকাশিত করে, যেন এক নিরাকার আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে নানা বর্ণে বিভক্ত হয়, কিন্তু আলো নিজে পরিবর্তিত হয় না। তাই জগৎ “ব্রহ্মের অভাস”—যা মায়ার বিকল্প নয়, বরং মায়ার দ্বারা প্রতীয়মান। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (২.৫.১৯)-এ যেমন বলা হয়েছে—“নেহ নানাস্তি কিঞ্চন”—অর্থাৎ, “এখানে কোনো বহুত্ব নেই”—এই উক্তি ব্রহ্মের অবিকৃত একত্বকেই নির্দেশ করে।
বিবর্ত-পরিণামবাদ শেখায় যে, জগৎ আপাত বাস্তব, ব্রহ্ম পরম বাস্তব। সৃষ্টি, স্থিতি, লয়—সবই ব্রহ্মের চৈতন্য-আভাসের স্তরসমূহ; যেমন সিনেমার পর্দায় আলোর প্রক্ষেপণে দৃশ্যরূপ জন্ম নেয়, কিন্তু পর্দা কখনও পরিবর্তিত হয় না। সেই পর্দাই ব্রহ্ম, সেই আলোই চৈতন্য, আর দৃশ্যরূপই মায়া।
এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী অদ্বৈতাচার্যরা—বিশেষত বাচস্পতি মিশ্র (ভামতী), প্রকাশাত্মা (বিবরণ) এবং চিৎসুখাচার্য (তত্ত্বপ্রকাশিকা)—প্রত্যেকে পৃথকভাবে ব্যাখ্যা দিলেও মূল ঐক্য থেকে বিচ্যুত হননি: ব্রহ্ম অবিকৃত, জগৎ বিবর্তমাত্র।
৬। অভিন্ন-নিমিত্ত-উপাদান-কারণবাদ শঙ্করীয় অদ্বৈত বেদান্তের সেই মৌল তত্ত্ব, যা সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত্তি নির্ধারণ করে। এই মতে ব্রহ্মই একমাত্র কারণ, এবং তিনি একইসঙ্গে নিমিত্ত (সৃষ্টিকর্তা বা পরিকল্পক) ও উপাদান (দ্রব্য বা উপকরণ)। অর্থাৎ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—সবই ব্রহ্মের মধ্যেই ঘটে; জগৎ কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নয়, বরং সেই ব্রহ্মেরই মায়ামূলক প্রকাশ বা নাম-রূপভেদমাত্র।
এই নীতির প্রাচীনতম শাস্ত্রীয় ভিত্তি পাওয়া যায় ছান্দোগ্য উপনিষদের বিখ্যাত বাক্যে—“সদ্ অয়ম্ অগ্র আসীত্” (৬.২.১)—“এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বে ‘সৎ’ (অস্তিত্ব) মাত্র ছিল।” উপনিষদ এরপর বলে—“তদৈক্ষত বহু স্যাম্ প্রজায়েয়েতি” (৬.২.৩)—অর্থাৎ, সেই সৎ (ব্রহ্ম) নিজে চিন্তা করলেন—“আমি বহু হব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হব।” এখানে ‘তদৈক্ষত’ নির্দেশ করছে নিমিত্ত কারণ—সৃষ্টির প্রেরণা বা ইচ্ছা; আর ‘সৎ’ নিজেই উপাদান কারণ, কারণ তার থেকেই নাম-রূপের প্রকাশ। শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (১.৪.২৩)-এ বলেন—“সদ্বৈ সর্বমিদং কারণম্”—এই জগৎ সত্যরূপ ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোনো কারণ গ্রহণ করে না।
অর্থাৎ, ব্রহ্মই অভিন্নভাবে কারণ, কোনো পৃথক উপকরণ বা নির্মাতা নেই। যেমন সোনার নেকলেস, কঙ্কণ বা আংটি—সবই ভিন্ন ভিন্ন রূপে এক সোনার প্রকাশ, তেমনি ব্রহ্মও নানা নাম-রূপে প্রকাশিত হলেও স্বরূপে অবিকৃত থাকে। এখানে সোনার দৃষ্টান্তটি গুরুত্বপূর্ণ: সোনা হলো উপাদান কারণ (যা থেকে রূপের সৃষ্টি), আর সোনার স্বরূপেই নিহিত রূপদানক্ষমতা হলো নিমিত্ত কারণ। দুটি এক ও অভিন্ন।
এই দৃষ্টিতে, জগৎ ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন নয়, বরং ব্রহ্মেরই প্রক্ষেপ (manifestation)। তাই শঙ্কর বলেন—“ব্রহ্মণো হি মায়য়ৈব নামরূপে উপাচরিতে”—ব্রহ্ম নিজে পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু মায়ার মাধ্যমে নাম-রূপরূপে প্রকাশিত হয়। ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-এর “মৃৎঘটনয়ৈক্যদর্শনাত্” সূত্রে যেমন ঘট-মাটি দৃষ্টান্তে দেখা যায়, মাটি থেকে ঘট উৎপন্ন হলেও মাটির সত্তা অপরিবর্তিত থাকে, তেমনি ব্রহ্মও সকল রূপের মধ্যেও অপরিবর্তনীয়।
“অভিন্ন কারণতত্ত্ব” নীতি এভাবে পরিণত হয়েছে আপ্পাইয় দীক্ষিত (Appayya Dīkṣita)-এর সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ-এ। তিনি শঙ্করোত্তর সমস্ত ব্যাখ্যা—ভামতী, বিবরণ, তত্ত্বপ্রকাশিকা, পদার্থতত্ত্ববোধিনী প্রভৃতি—সমন্বিত করে দেখিয়েছেন যে, শঙ্করীয় দর্শনে কারণ ও কার্য পৃথক নয়, বরং একই সত্যের বিভিন্ন অভাস। তাঁর ভাষায়, “অভিন্নঃ কারণফলভেদঃ”—কারণ ও ফল অভিন্ন সত্তা; ভেদ কেবল মায়াজাত অভাস।
এই অভিন্ন কারণবাদ ব্রহ্মের দুই দিক নির্দেশ করে—
১. নিমিত্ত-রূপে ব্রহ্ম হলো সৃষ্টির “নিয়ন্ত্রক চেতনা” (যিনি সৃষ্টির প্রেরক, বুদ্ধিময় পরিকল্পক);
২. উপাদান-রূপে ব্রহ্ম হলো “অস্তিত্বের উপকরণ”—যার সত্তায় জগৎ প্রতীয়মান।
উদাহরণস্বরূপ, যখন স্বপ্নদ্রষ্টা নিজের মন থেকে স্বপ্নের জগৎ সৃষ্টি করে, তখন সে-ই স্বপ্নের উপাদানও, আবার সৃষ্টিকর্তাও; কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই। একইভাবে, জাগতিক সৃষ্টিও ব্রহ্মের চৈতন্যের মধ্যেই সম্পূর্ণ সংঘটিত।