বিবরণ-বাদে চৈতন্যই চূড়ান্ত আলোক—যে নিজের মধ্যেই দীপ্ত, এবং তার আলোয়ই সমগ্র জগৎ ও সমস্ত জ্ঞান সম্ভব। বিবরণ-বাদ এই স্বয়ংপ্রকাশ চৈতন্যকে “জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম” হিসেবে স্থাপন করে। এখানে মন বা বৃত্তি কেবল উপলক্ষ্য (occasion) বা সহায় উপাধি—অর্থাৎ, যখন কোনো বস্তু উপলব্ধ হয়, তখন মন-বৃত্তি সেই বস্তুর আকার ধারণ করে এবং চৈতন্য সেই আকারে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু প্রকাশাত্মার মতে, এই প্রতিফলন প্রকৃত জ্ঞানের উৎস নয়; জ্ঞানের উৎস চৈতন্য নিজেই। তাই মুক্তির অবস্থায় যখন মন ও ইন্দ্রিয় বিলীন, তখনও চৈতন্যের দীপ্তি নিভে যায় না। এই তত্ত্বে মুক্তি মানে মন-ইন্দ্রিয়-বৃত্তির নিবৃত্তি নয়, বরং স্বপ্রকাশ চৈতন্যের নিজের দীপ্তি-রূপে অবস্থান।
প্রকাশাত্মা একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দিয়েছেন—যেমন একটি দীপশিখা নিজের আলোতেই জাজ্বল্যমান, তার দীপ্তির জন্য অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন নেই; ঘরের দেওয়াল (মন) থাক বা না থাক, দীপের স্বপ্রকাশতা অক্ষুণ্ণ থাকে। মন থাকলে চৈতন্য সেই মন-আকৃতি জগৎকে আলোকিত করে; মন না থাকলে সে নিজ-দীপ্ত চেতনারূপে থাকে। এই কারণেই তিনি বলেন, “চৈতন্যং স্বয়ং-প্রকাশম্।”
এই তত্ত্বের মূল ভাবনা আসলে ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে—বিশেষ করে (২.৩.১৮)-এ, যেখানে শঙ্করাচার্য “দর্শন” (দেখা) ও “দর্শনীয়” (যাকে দেখা হচ্ছে) —এই দুইয়ের ঐক্যের কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য হলো, জ্ঞান আর চৈতন্য আসলে এক জিনিস, কারণ জানার ঘটনাও চৈতন্যেরই প্রকাশ।
পরবর্তী আচার্যরা, যেমন চিৎসুখাচার্য, প্রকাশানন্দ সরস্বতী ও সচ্চিদানন্দ যতীন্দ্র, এই ভাবনাটিকেই আরও স্পষ্ট করে “চেতনার স্বয়ং-দীপ্তি” নামে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে, চৈতন্য নিজের আলোয় নিজেকে ও সব কিছু দেখতে পারে—এটি এমন এক আলো, যা অন্য কোনো উৎসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—যখন আমরা জেগে থাকা বা স্বপ্নাবস্থায় কোনো বস্তু দেখি, তখন সেই দেখা-প্রক্রিয়ায় জ্ঞাত, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনেরই একত্ব ঘটে। কিন্তু যখন আমরা গভীর নিদ্রায় থাকি, তখন কোনো বস্তু বা মন-বৃত্তি থাকে না; তবুও জেগে উঠে আমরা বলি—“আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম, কিছু জানতাম না।” এই “আমি কিছু জানতাম না”-র অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, চৈতন্য সুষুপ্তিতেও জাগ্রত ছিল, যদিও কোনো বস্তুর প্রতি নিবিষ্ট হয়নি। এ-ই চৈতন্যের স্বপ্রকাশতা—যা কখনও অনুপস্থিত হয় না, এমনকি জ্ঞানের অভাবও যার জ্ঞানে ধরা পড়ে।
বিবরণ-বাদ শঙ্করোত্তর অদ্বৈত বেদান্তে এমন এক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে, যেখানে চৈতন্য জ্ঞানের উপাদান নয়, বরং জ্ঞান-স্বরূপ; আর মুক্তি মানে সেই চৈতন্যের নিজস্ব দীপ্তিতে স্থিতি।
৩। চিৎসুখাচার্যের তত্ত্বপ্রকাশিকা-ধারা হলো অদ্বৈত বেদান্তের এক গভীর ও যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা-পথ। শঙ্করাচার্যের পরবর্তী কালে তিনি এমনভাবে অদ্বৈত দর্শনকে ব্যাখ্যা করেন, যাতে তা আরও স্পষ্ট, যুক্তিসংগত ও আত্মপ্রকাশকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। চিৎসুখাচার্য ছিলেন দ্বাদশ শতকের একজন বড়ো দার্শনিক, যিনি ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-র উপর তত্ত্বপ্রকাশিকা নামে একটি বিশদ টীকা লেখেন। এই গ্রন্থে তিনি ভামতী ও বিবরণ দুই ধারার ভাব একত্র করেছেন—একদিকে মনের ভূমিকা ও অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়াকে স্বীকার করেছেন, আবার অন্যদিকে বলেছেন চৈতন্য বা আত্মা নিজেই স্বপ্রকাশ, অর্থাৎ নিজের মধ্যেই দীপ্ত। তাঁর অন্য একটি বই চিদ্বিলাস-এও তিনি বলেছেন, চৈতন্যই সব কিছুর উৎস, আর জগৎ তারই এক অভাস বা প্রতিফলন।
চিৎসুখাচার্যের মতে, চৈতন্য বা বোধ নিজে থেকেই আলোকিত—একে অন্য কিছু আলোকিত করতে পারে না। আমরা যা জানি বা অনুভব করি, সবই এই চৈতন্যের আলোয় ধরা পড়ে। তাই জ্ঞান কোনো মানসিক ক্রিয়ার ফল নয়, বরং চৈতন্যের নিজের উজ্জ্বলতার প্রকাশ। তত্ত্বপ্রকাশিকা (১.১.৪)-এ তিনি লিখেছেন—“বোধস্য স্বপ্রকাশত্বং ন তু মনোবৃত্তিসংযোগাত্”—মানে, জ্ঞান মন-এর ক্রিয়ার ফল নয়, বরং চেতনার নিজের দীপ্তি থেকেই তা জন্মায়। তাই জ্ঞানের ওপর কোনো অন্ধকার বা আচ্ছাদন পড়ে না; চৈতন্য নিজে সর্বদা আলো, যা কখনও নিভে যায় না। আর মায়া বা অবিদ্যা কোনো আলাদা শক্তি নয়—এ কেবল চৈতন্যের সীমিতভাবে প্রতীয়মান হওয়া, একধরনের আপাত আবরণ মাত্র।
চিৎসুখাচার্য মন ও চৈতন্যের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভামতীর প্রতিফলন-তত্ত্বকে আংশিকভাবে গ্রহণ করেন। তিনি বলেন—মন কেবল অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র, চৈতন্য নিজে অবিকৃত ও স্বাধীন। মন-প্রতিফলন জ্ঞানের উপায় হতে পারে, কিন্তু চৈতন্য কখনও সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর মতে, জ্ঞানের তিন ধাপ—জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—আসলে এক চৈতন্যের তিনটি অভিব্যক্তি মাত্র; ভেদ কেবল অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণ থেকে।
মায়া সম্পর্কেও তিনি গভীর বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তত্ত্বপ্রকাশিকা-য় তিনি বলেন, মায়া না পুরো সত্য, না পুরো মিথ্যা—এটি অনির্বচনীয়। জগৎ তাই ব্রহ্মচৈতন্যেরই অভাস, তার অপরিবর্তনীয় দীপ্তির এক আয়নাবৎ প্রতিফলন। এর ফলে তিনি গৌড়পাদের অজাতবাদ (যেখানে সৃষ্টিকে অস্বীকার করা হয়েছে), শঙ্করের বিবর্তবাদ (যেখানে সৃষ্টিকে মায়ামূলক বিভ্রম বলা হয়েছে), এবং ভামতী-বিবরণ ধারার প্রতিফলনবাদ—এই তিনের মধ্যে এক সুনিপুণ সংগতি স্থাপন করেন।
চিৎসুখাচার্য তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে সূর্য ও আলোর উপমা দিয়েছেন। যেমন সূর্য নিজের দীপ্তিতে সব কিছুকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজের আলো দেখার জন্য অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন হয় না, তেমনি চৈতন্যও নিজের দ্বারা নিজেকে ও জগৎকে প্রকাশ করে। মন এখানে কেবল পাত্র বা মাধ্যম; আলো (চৈতন্য) সেই পাত্রে প্রতিফলিত হলেও নিজে কখনও তার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। আবার আয়নার দৃষ্টান্তেও এই ভাব বোঝানো হয়েছে—মুখ ও প্রতিবিম্ব আলাদা বলে মনে হলেও তারা অবিচ্ছেদ্য, তেমনি জগৎও চৈতন্যের অভিন্ন অভাস।
তত্ত্বপ্রকাশিকা তিনটি প্রধান অদ্বৈত ভাবধারাকে একত্র করেছে—বিবরণ-ধারার “চৈতন্য নিজেই স্বপ্রকাশ”, ভামতী-ধারার “মন-প্রতিফলনের মাধ্যমে জ্ঞানের উদয় হয়” এবং গৌড়পাদের “অজাতবাদ”, যেখানে বলা হয়, সৃষ্টি আসলে কখনও ঘটেই না। চিৎসুখাচার্য এই তিন দৃষ্টিকে মিলিয়ে যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও আত্মপ্রকাশের ভিত্তিতে এক পূর্ণাঙ্গ ও সুসংহত তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন। চিৎসুখাচার্যের তত্ত্বপ্রকাশিকা শঙ্কর-পরবর্তী অদ্বৈত চিন্তাকে যুক্তিসঙ্গত কাঠামোয় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে চৈতন্য নিজেই স্বপ্রমাণ, আর মন কেবল তার স্বচ্ছ প্রতিফলনের মাধ্যম।
চৈতন্য স্বপ্রকাশ ও স্বতঃসিদ্ধ, মন কেবল তার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র; মায়া অনির্বচনীয়, জগৎ অভাসমাত্র; ব্রহ্ম এক, অচল, অথচ নিজের দীপ্তিতে বহুরূপে প্রকাশিত। এখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনেরই মিলন এক চৈতন্যে, যা স্বয়ং নিজের ও বিশ্বচেতনার একমাত্র উৎস।
৪। দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ অদ্বৈত বেদান্তের এক সূক্ষ্ম ভাবধারা, যার মূল কথা হলো—“যা দেখা যায়, তা দেখার সঙ্গেই সৃষ্টি হয়।” অর্থাৎ দেখা আর সৃষ্টি আসলে একসঙ্গে ঘটে; আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়। আমরা যা দেখি, তা আমাদের চেতনার মধ্যেই গঠিত এক অভিজ্ঞতা—বাইরে কোনো স্বতন্ত্র বাস্তব বস্তু নেই।
এই মতটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আচার্য প্রকাশানন্দ সরস্বতী তাঁর বেদান্তসিদ্ধান্তমুক্তাবলী গ্রন্থে। পরবর্তীতে আচার্য নানাদীক্ষিত সেটির উপর সিদ্ধান্তপ্রদীপিকা নামে টীকা লিখে এই ধারণাটিকে আরও যুক্তিনির্ভর ও শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
প্রকাশানন্দ বলেন—যে-জগৎকে আমরা বাইরে দেখি, সেটি কোনো স্বাধীন বস্তুমূলক বাস্তব নয়; বরং চেতনারই প্রক্ষেপণ। মাণ্ডূক্য উপনিষদ-এর গৌড়পাদীয় ভাষ্যে যেমন বলা হয়েছে—“মায়ামাত্রমিদং দ্বৈতমদ্বয়ং পরমার্থতঃ”—অর্থাৎ দ্বৈত-জগৎ কেবল মায়া, পরমার্থে কেবল এক অদ্বয় চেতনা। দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ এই বাক্যটিকেই এক নতুন রূপে বিশ্লেষণ করে বলে—যতক্ষণ দর্শন ঘটে, ততক্ষণই সৃষ্টি ঘটে। দেখা বন্ধ হলে সৃষ্টিও বিলুপ্ত।
এই ভাবটি বোঝাতে প্রকাশানন্দ স্বপ্ন-দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছেন। স্বপ্নে আমরা একটি পূর্ণ জগৎ দেখি—নগর, মানুষ, আলো-অন্ধকার, সুখ-দুঃখ—সবই বাস্তব মনে হয়। কিন্তু জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের জগৎ লুপ্ত হয়ে যায়; কেউ বলতে পারে না, স্বপ্নের শহর কোথায় গেল। কারণ সেটি দর্শন-প্রক্রিয়ার মধ্যেই উদিত ও বিলীন। একইভাবে, জাগ্রত জগৎও চৈতন্য-দৃষ্টির মধ্যেই উৎপন্ন। দেখা-হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দেখা-বস্তু বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়; অন্যথায় নয়।
এই মতের শাস্ত্রীয় ভিত্তি পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এর (১.৪.৭) বিখ্যাত উক্তিতে—“যত্র হি দ্বৈতমিভ ভূতি, তদিতর ইতো মন্যতে,” অর্থাৎ যেখানে দ্বৈততা বা “দুই” ভাবের অভিজ্ঞতা হয়, সেখানেই মানুষ অন্যকে চিনতে পারে; কিন্তু যখন কেবল একমাত্র আত্মা বিদ্যমান, তখন “অন্য” বলে কিছু ভাবার প্রশ্নই ওঠে না।
দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ এই শ্লোককে মন-কেন্দ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করে বলে, “দেখা” মানেই “অন্য”-র ধারণা সৃষ্টি হওয়া। অর্থাৎ, আমরা যা দেখি, তা দেখার ক্রিয়াতেই তৈরি হয়; বাইরের কোনো বস্তুর আলাদা অস্তিত্ব নেই—চৈতন্যই নিজের দৃষ্টিতেই জগৎকে রচনা করে।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি চোখ বন্ধ করেন, তৎক্ষণাৎ আপনার জগৎ-অভিজ্ঞতা লুপ্ত হয়ে যায়। আপনি বলতে পারেন না যে, জগৎ আপনার অজ্ঞানে থেকেও বাস্তবে টিকে আছে, কারণ আপনি জানেন না, সেটি কেমন ছিল। আবার চোখ খুললেই, দৃষ্টি-রূপ প্রক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে জগৎ-অভিজ্ঞতা জেগে ওঠে। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদের ভিত্তি।
আচার্য প্রকাশানন্দ সরস্বতীর উপস্থাপিত দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ এক গভীর মননশীল তত্ত্ব, যেখানে দেখা ও সৃষ্টির সম্পর্ককে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই তত্ত্ব অভাসবাদ বা বিবর্ত-বিস্তারবাদ থেকে মৌলিকভাবে আলাদা।
অভাসবাদে বলা হয়—জগৎ চৈতন্যের প্রতিবিম্বরূপ; অর্থাৎ চৈতন্য যেন একটি আয়না, আর জগৎ তার প্রতিফলন। এই ভাবনায় “চৈতন্য” (যা দেখে) এবং “জগৎ” (যা দেখা যায়)—এই দুইয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু স্পষ্ট পার্থক্য থেকে যায়। যেমন, মুখ আর আয়নায় দেখা মুখ দুই আলাদা সত্তা হলেও সম্পর্কিত। কিন্তু দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ এই বিভাজনটিকেই অস্বীকার করে। প্রকাশানন্দ বলেন—“জগৎ কোনো প্রতিফলন নয়, বরং দর্শন বা দেখা-ক্রিয়াই তার প্রতিষ্ঠা।”
এখানে দেখা আর সৃষ্টি আলাদা নয়, বরং একসঙ্গে ঘটে। এই ধারণাকে তিনি co-emergent seeing বা দর্শন-সহ-সৃষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ, “দেখা” মানেই “সৃষ্টি”—আমরা যা দেখি, সেই দেখা-ঘটনাতেই তার অস্তিত্ব গঠিত হয়। কোনো কিছু আলাদা করে বাইরে থাকে না, যা আগে থেকেই বিদ্যমান, পরে এসে চেতনা তাকে দেখে ফেলবে—এমন নয়। বরং চেতনা যখন দেখে, তখনই দেখা-বস্তুর উদয় হয়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে চৈতন্যকে বলা হয়েছে “দৃষ্টিমাত্র-চৈতন্য”—অর্থাৎ চৈতন্যের একমাত্র ধর্মই হলো দেখা। তার অন্য কোনো গুণ নেই, কোনো উপকরণ নেই, কোনো সহায়কও নেই। চৈতন্য দেখা ছাড়া অন্য কিছু করে না, আর সেই দেখার মধ্যেই জগতের সম্ভাবনা জেগে ওঠে। এই দেখাই সৃষ্টির মূল, এই দেখাই অস্তিত্বের কারণ।
এই ভাবকে সহজভাবে বোঝানো যায় একটি উদাহরণ দিয়ে। যেমন, স্বপ্নে আমরা একটি শহর দেখি, মানুষ দেখি, শব্দ শুনি—সবই আমাদের চেতনার ভেতরে ঘটছে। স্বপ্ন শেষ হলে সেই শহর বা মানুষ আর কোথাও থাকে না, কারণ তারা আলাদা কোনো বাহ্য বাস্তব সত্তা নয়, বরং আমাদের চেতনারই মুহূর্তিক প্রকাশ। দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ সেই অর্থে বলে, জাগ্রত জগৎও চেতনার মধ্যেই গঠিত—এখানে দেখা আর সৃষ্টি একইসঙ্গে ঘটে।
এই তত্ত্বকে পাশ্চাত্য দর্শনের নির্দিষ্ট কিছু ধারার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। আঠারো শতকের আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলি (George Berkeley) বলেছিলেন—“Esse est percipi,” অর্থাৎ “to be is to be perceived”—“অস্তিত্ব মানেই উপলব্ধ হওয়া।” তাঁর মতে, কোনো বস্তু আমাদের চেতনার বাইরে স্বতন্ত্রভাবে থাকে না; আমরা যেভাবে দেখি, তেমনভাবেই তার অস্তিত্ব গঠিত হয়। প্রকাশানন্দের দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদও একই কথা বলে—জগৎ দেখা ছাড়া নেই, দেখা মানেই সৃষ্টি।