অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৪১



শেষে বলা হয়েছে—“ইত্যেষা পরমার্থতা”, অর্থাৎ এ-ই পরমার্থ সত্য। এই অবস্থায় ব্রহ্ম একমাত্র সত্য; জগৎ, সৃষ্টি, সাধনা, মুক্তি—সবই আপেক্ষিক ও ব্যাবহারিক স্তরের ঘটনা, যা পরম দৃষ্টিতে কেবল মায়ার রূপ।

গৌড়পাদ এইভাবেই অজাতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন—যেখানে ব্রহ্ম চিরকাল অজাত, অবিনশ্বর, অপরিবর্তনীয়। যা-কিছু জন্মায়, তা কেবল মনের প্রক্ষেপণ; এবং যা কখনও জন্মায়নি, তার বিনাশও হয় না। শেষপর্যন্ত বলা যায়—বন্ধন নেই, মুক্তিও নেই; কেবল আত্মার চিরনির্বাণ স্থিতি, যা সর্বদাই ছিল, সর্বদাই আছে এবং সর্বদাই থাকবে।

সংসার কেবল এক অন্তহীন প্রতিফলন—চেতনার মরুভূমিতে ঝলমল-করা এক মরীচিকা। অবিদ্যা এই বিভ্রম, যেখানে স্থিরতার মধ্যে গতি, অবিভাজ্যের মধ্যে বিভাজন, অসীমের মধ্যে সীমা প্রতীয়মান হয়। যখন ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার উদিত হয়, তখন এই মরীচিকা আর থাকে না—বাস্তবতা বদলায় না, দৃষ্টি বদলায়; দেখা যায়, যা চিরকালই ছিল, তা কখনও আচ্ছন্ন ছিল না।

এই উপলব্ধি ভাষার সীমা ছাড়িয়ে যায়। কারণ ভাষা মানে পার্থক্য—আর যেখানে কেবল এক আছে, সেখানে নাম বা বর্ণনা অসম্ভব। তবুও ঋষিরা পরস্পরবিরোধী বাক্যে ইঙ্গিত করেছেন—“আত্মা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির সাক্ষী, তবুও তাদের দ্বারা অস্পর্শিত”। কিন্তু তুরীয়ে, সেই চতুর্থ অবস্থায়, সাক্ষীরও অবসান ঘটে, কারণ সাক্ষ্য দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই তিনটি চেতনার জ্যোতিতে একাকার হয়।

এ-ই হলো ব্রহ্মানুভব—কোনো ঘটনার মতো নয়, বরং চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের স্বীকৃতি। এখানে কোনো “প্রকাশ” ঘটে না; কারণ, যা প্রকাশ পেয়েছে, তা সর্বদাই প্রকাশিত ছিল। তখন স্পষ্ট হয় যে, যে-আবরণ গোপন করেছিল, যে-বিক্ষেপ প্রক্ষেপণ করেছিল, যে-অধ্যাস আবদ্ধ করেছিল—তাদের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বই কখনও ছিল না। অবিদ্যা ও মায়ার পর্দা কোনো সাধনা বা প্রচেষ্টার দ্বারা নয়, বরং একমুহূর্তের অন্তর্দৃষ্টিতে অপসারিত হয়—যেমন জ্ঞান-অগ্নি শুকনো ঘাসে আগুন ধরার মতো অজ্ঞানতাকে গ্রাস করে, কিছুই অবশিষ্ট রাখে না।

এই নিঃশব্দ সত্যের উপস্থিতিতে সমস্ত তত্ত্ব, যুক্তি ও দর্শন নিজে থেকেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। যা-কিছু বিতর্ক ও বিশ্লেষণ ছিল, তা আসলে বুদ্ধির খেলাই— ব্যাবহারিক স্তরে অর্থবহ, কিন্তু পারমার্থিক উপলব্ধির প্রান্তে এসে সম্পূর্ণ নিরর্থক। অদ্বৈত-বাদের ধারণাও তখন অদ্বৈত-অভিজ্ঞতার আলোয় নিজেই বিলীন হয়—শব্দ থেমে যায়, মন নত হয়, চিন্তা নিঃশেষ হয়।

আর তখন যা অবশিষ্ট থাকে, তা বর্ণনার অতীত—কারণ সেটি ভাষারও পূর্ববর্তী, চিন্তারও সীমার বাইরে। সেই এক, যাকে ঋষিরা বলেছেন—“একম্‌ এব অদ্বিতীয়ম্”—দ্বিতীয়হীন সেই একমাত্র বাস্তবতা। সে কোনো বস্তু নয়, কোনো ধারণাও নয়; বরং সমস্ত অস্তিত্বের নীরব কেন্দ্র, যেখানে সত্তা ও চেতনা একই তরঙ্গে মিলিত। সেই চিরন্তন দীপ্তিই জ্বলে থাকে জ্ঞানীর হৃদয়ে—অপরিসীম ব্রহ্মের শান্ত, অবিনশ্বর, অদ্বিতীয় জ্যোতিস্বরূপে।

ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায় (ষষ্ঠ প্রপাঠক), দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম মন্ত্র (৬.২.১): সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্। তদ্ধৈক আহুরসদেবেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত।।

অন্বয়: সোম্য (হে সোম্য); ইদম্ (এই [অর্থাৎ নামরূপের এই দৃশ্যমান জগৎ]); অগ্রে (আগে [অর্থাৎ প্রকাশের আগে); সৎ এব (সৎস্বরূপেই, যার অস্তিত্ব আছে তাই সৎ); একম্ এব (একমাত্র অখণ্ড); অদ্বিতীয়ম্ (যার দ্বিতীয় নেই); আসীৎ (ছিল); তৎ (একে, এই বিষয়ে); হ একে (কেউ কেউ [যেমন বৌদ্ধরা]); আহুঃ (বলেন); ইদম্ (এই [দৃশ্যমান জগৎ]); অগ্রে (প্রকাশের আগে); অসৎ এব (অসৎরূপে [অর্থাৎ যার অস্তিত্ব নেই]); একম্ এব অদ্বিতীয়ম্ (এক ও অদ্বিতীয়); আসীৎ (ছিল); তস্মাৎ অসতঃ (সেই 'অসৎ' বা শূন্য থেকে); সৎ জায়ত (সৎ উৎপন্ন হলো)।

সরলার্থ: হে সোম্য, এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপে [অস্তি মাত্র] বিদ্যমান ছিল। এই বিষয়ে কেউ কেউ বলেন, 'এই জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় অসৎরূপে বিদ্যমান ছিল' অর্থাৎ তখন কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। সেই অসৎ থেকেই সৎ হয়েছে।

ব্যাখ্যা: শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে না। গাছ আছে মানেই গাছটা কোনো বীজ থেকে হয়েছে, বীজটা দেখা যাক বা না-ই যাক। অনেকসময় দেখা যায়, কোনো বাড়ীর ফাটলে একটা গাছ হয়ে রয়েছে। গাছটা এল কোথা থেকে? নিশ্চয়ই একটা বীজ বাতাসে উড়ে এসে সেখানে পড়েছিল। বীজ ছাড়া তো আর গাছ হতে পারে না। ঠিক তেমনি, একটা অস্তিত্ব থেকেই কেবল আর একটা অস্তিত্বের উৎপত্তি সম্ভব। উপনিষদ এখানে সেকথাই বোঝাতে চাইছেন। বলছেন, এ জগৎ প্রকাশের আগেও এক অখণ্ড সত্তারূপে বিদ্যমান ছিল।

'সৎ' শব্দটির অর্থ 'যার অস্তিত্ব আছে'। বেদান্তশাস্ত্র এই সৎকে এক অখণ্ড সত্তা বলে বর্ণনা করেছেন। 'একমেবাদ্বিতীয়ম্'-যা এক ও অদ্বিতীয়, যা সর্বব্যাপী, নিরাকার, বাক্যমনাতীত ও শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ।

কোনো কোনো দার্শনিকের মতে, এই জগৎ প্রকাশ হওয়ার আগে কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। শূন্য থেকেই এই জগতের উদ্‌ভব।

বেদান্ত বলেন, ধরো, তুমি এক কুমোরের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছ। যাবার সময় দেখতে পেলে, কুমোরের হাতে একতাল মাটি। কয়েকঘণ্টা পর তুমি যখন আবার সেই পথেই ফিরছ, দেখলে, মাটির তাল থেকে নানারকমের পাত্র, বাটি, কাপ, প্লেট ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। প্রতিটি পাত্রেরই আলাদা নাম, আলাদা রূপ। কিন্তু মাটি একই। ঠিক তেমনি, এক ও অখণ্ড সত্তা (সৎ) নামরূপের এই জগৎরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। কিন্তু সৎ সৎই থাকেন। তাঁর কোনো বিকার হয় না।

কিন্তু নৈয়ায়িক, বৌদ্ধ এবং আরও কোনো কোনো দার্শনিকের মত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা বলেন, শূন্য থেকেই অস্তিত্বের উদ্ভব। প্রশ্ন উঠল, অতীতে যার অস্তিত্বই ছিল না, তার সম্বন্ধে এঁরা জানলেন কি করে? আবার একে এক ও অদ্বিতীয়ই-বা বলেন কী করে?

বস্তুতঃ, 'সৎ'-কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই এখানে 'অসৎ'-এর কথা বলা হয়েছে। কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেবো আর কোনটিকে উপেক্ষা করব, তা বুঝতে হলে আগে সেই বিষয়কে ভালোভাবে জানা দরকার। সেইজন্যই সৎ কী, তা বোঝানোর জন্যই এখানে 'অসৎ'-এর আলোচনা করা হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদের মন্ত্রটির উপরের ব্যাখ্যা স্বামী লোকেশ্বরানন্দের।

শঙ্করীয় অদ্বৈত-ঐতিহ্যের প্রধান ব্যাখ্যাপথগুলি একাধিক স্বতন্ত্র ধারা রূপে বিকশিত হয়েছে। প্রতিটি ধারাই ব্রহ্ম-চৈতন্য, মন বা বৃত্তি, এবং জগতের অভিজ্ঞতার পারস্পরিক সম্পর্ককে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছে। এই ধারাগুলি তাদের নিজ নিজ আচার্য, গ্রন্থ, দার্শনিক প্রেক্ষাপট ও উদাহরণের মাধ্যমে গঠিত; আর তাদের ভেদ ও সংযোগ অনুধাবন করলেই অদ্বৈত দর্শনের অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম ভাব-স্তরগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১। ভামতী-বাদ (Bhāmatī-vāda) হলো শঙ্করোত্তর অদ্বৈত বেদান্তের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-ধারা, যেখানে জ্ঞান-উৎপত্তি ও চৈতন্যের পারস্পরিক সম্পর্ককে মন-বৃত্তির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই ধারার সূচনা আচার্য বাচস্পতি মিশ্র-র ভামতী গ্রন্থে—যা শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-র ওপর এক বিশদ ও তর্কনিষ্ঠ উপভাষ্য। “ভামতী” শব্দটি এসেছে আচার্যের পত্নী ভামা-র নাম থেকে; কিংবদন্তি বলে, এই গ্রন্থ রচনাকালে ভামা দেবী মৌনসেবায় তাঁর সেবা করতেন, তাই বাচস্পতি তাঁর নামেই গ্রন্থটির নাম রাখেন।

এই তত্ত্বে বাচস্পতি বলেন—চৈতন্য সর্বব্যাপী, সর্বদা বর্তমান; কিন্তু অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান-প্রকাশ তখনই সম্ভব, যখন অন্তঃকরণ (মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার মিলিত সত্তা) চৈতন্যের প্রতিবিম্ব ধারণ করে। অন্য কথায়, চৈতন্য হলো সূর্য, মন হলো স্বচ্ছ কাচ, আর জ্ঞান হলো সেই কাচে প্রতিফলিত সূর্যালোক। সূর্য সর্বত্রই আছে, কিন্তু জানালা না খুললে তার আলো ঘরে প্রবেশ করে না—এই উপমাই ভামতী-বাদের কেন্দ্র।

ভামতী-বাদ আর বিবরণ-বাদ একে অপরের বিপরীত। প্রকাশাত্মা (বিবরণ-বাদ) বলেছিলেন, চৈতন্য নিজেই জ্ঞানের আলো, মন কেবল একটি সহায় উপাধি। কিন্তু ভামতী-বাদে বলা হলো, মনই আসল কাজ করে—মন-বৃত্তিই জ্ঞানের কার্যকর উপায় (vyāpāra), আর চৈতন্য সেই মন-বৃত্তিতে প্রতিফলিত (cid-ābhāsa) হয়ে “আমি জানি” এই অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।

বাচস্পতি মিশ্র, তাঁর ভামতী টীকায়, ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (১.১.৪ ও ২.৩.১৮)-এর ব্যাখ্যা প্রসারিত করে দেখান—চৈতন্য ও মন একত্রে কাজ না করলে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়। তাই তাঁর মতে, মনই হলো সেই “প্রতিফলনের আয়না”, যার মাধ্যমে ব্রহ্মচৈতন্য জ্ঞাতারূপে জেগে ওঠে।

এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়—অন্ধকারে যখন কেউ দড়িকে সাপ মনে করে, তখন এই ভ্রম বা অধ্যাস কেবল বাহ্য বস্তু বা চৈতন্যের কারণে নয়; বরং মন-বৃত্তির বিকারজনিত। চৈতন্য তখন সেই বিকৃত বৃত্তিতে প্রতিফলিত হয়ে “সাপ দেখছি”, এই ভ্রান্ত জ্ঞান সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে, আলো জ্বালালে যখন মন-বৃত্তি পরিবর্তিত হয়ে সত্য প্রতিফলন ধারণ করে, তখনই সঠিক জ্ঞান (rope cognition) উদিত হয়। অর্থাৎ, অজ্ঞান (avidyā) ও জ্ঞান—দুটিই মানসিক বৃত্তির অবস্থানভেদে উদ্‌ভূত।

ভামতী-বাদে বলা হয়েছে, অবিদ্যা বা অজ্ঞান জগদীশ্বর বা নিরাকার চৈতন্যে নয়, বরং জীব-চৈতন্যে থাকে—অর্থাৎ সেই সীমাবদ্ধ চৈতন্যে, যা মনের সঙ্গে যুক্ত। জীবের অন্তঃকরণ বা মন যখন মায়ার আচ্ছাদনে ঢেকে যায়, তখনই বিভ্রান্তি ও অজ্ঞান জন্মায়, আর জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

যখন এই মন-বৃত্তি সম্পূর্ণ নির্মল ও স্থির হয়ে যায়, তখন তার প্রতিফলনের ক্ষমতা হারায়—তখন চৈতন্য আর বাইরে বিকিরিত না হয়ে নিজের মধ্যেই স্থিত হয়, নিজের স্বরূপে দীপ্ত হয়—এটাই মুক্তি।

তাই দেখা যায়, ভামতী-বাদে মন ও চৈতন্য—দুটিই অপরিহার্য। মন ছাড়া জ্ঞানপ্রকাশ সম্ভব নয়, কারণ মনই চেতনার প্রতিফলনের ক্ষেত্র; কিন্তু চৈতন্য মন ছাড়া থেকেও থাকে, কারণ চৈতন্য কখনও লুপ্ত হয় না—মন থেমে গেলে শুধু জ্ঞানের ক্রিয়াধারা থেমে যায়, চৈতন্য নয়।

এই ধারার বিশ্লেষণ ও সূত্রবদ্ধ রূপ সংরক্ষিত রয়েছে ভামতী-কল্পতরু-পরিমল ত্রয়ীতে—যেখানে ভামতী-র ওপর ব্রহ্মানন্দ সরস্বতীর ‘কল্পতরু’ এবং তদুপরি অমলানন্দের ‘পরিমল’ টীকা গৃহীত। আচার্য অন্নপূর্ণা কুমার শাস্ত্রী-র সম্পাদিত সংস্করণে এই শৃঙ্খলিত ব্যাখ্যা-পরম্পরাই আজ “ভামতী-পরম্পরা” নামে স্বীকৃত।

ফলে ভামতী-বাদ এমন এক দার্শনিক সেতু, যেখানে চৈতন্য-বাদের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও মনোবৃত্তি-বাদের অভিজ্ঞতাগত বিশ্লেষণ মিলিত হয়ে জ্ঞানকে প্রতিফলন-তত্ত্ব (Pratibimba-vāda) রূপে ব্যাখ্যা করেছে—যা পরবর্তী কালীন অদ্বৈত-চিন্তায় “চিদাভাস-তত্ত্ব” হিসেবে অপরিহার্য স্থান লাভ করে।

২। অদ্বৈত বেদান্তের ইতিহাসে বিবরণ-বাদ শঙ্করোত্তর তিনটি প্রধান ব্যাখ্যা-ধারার একটি—অন্য দুটি হলো ভামতী-বাদ (বাচস্পতি মিশ্র রচিত ভামতী টীকা) এবং চিৎসুখাচার্যের তত্ত্বপ্রকাশিকা-ধারা। “বিবরণ” নামটি এসেছে আচার্য প্রকাশাত্মার পঞ্চপাদিকা-বিবরণ গ্রন্থ থেকে, যা পদ্মপাদের পঞ্চপাদিকা-র একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা। এই ধারার মূল তত্ত্ব হলো চৈতন্যের স্বয়ং-প্রকাশ বা স্বপ্রকাশ-ভাবনা—চৈতন্য নিজেই নিজের ও অন্য সব কিছুর প্রকাশক; তাকে আর কোনো বাহ্য উপাদানের প্রয়োজন হয় না।

প্রকাশাত্মা বলেন, জ্ঞান বা চৈতন্য অন্য কোনো মাধ্যমের দ্বারা প্রকাশিত হয় না, বরং নিজেই নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.৯)-এ বলা হয়েছে, “ন তত্র চক্ষুঃ গচ্ছতি, ন বাচো গচ্ছতি, ন মনঃ”—অর্থাৎ সেখানে চোখ পৌঁছায় না, বাক্য পৌঁছায় না, মনও নয়; কারণ চৈতন্যই সেই আলো, যা অন্য কিছু দ্বারা আলোকিত হয় না, বরং সমস্ত কিছুকে আলোকিত করে। এই ধারণাই “স্বপ্রকাশ-চৈতন্য”-এর মূল ভিত্তি। কঠ উপনিষদেও (২.২.১৫) বলা হয়েছে, “তম্‌ এব ভাবিতব্যম্‌”—অর্থাৎ যা চেতনা-রূপ, তাকেই উপলব্ধি করতে হবে, কারণ অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে তাকে চেনা যায় না।