অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩৯



এই উপলব্ধি-পর্যায়ে অদ্বৈত বেদান্তের রূপকগুলো আর কেবল ব্যাখ্যার সরঞ্জাম নয়, বরং চেতনার পর্দা উন্মোচনের জন্য ব্যবহৃত আয়না। দর্পণ-প্রতিবিম্ব-ন্যায় সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখায় জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক। অন্তঃকরণই হলো সেই দর্পণ, যেখানে ব্রহ্মের চেতনা প্রতিফলিত হয়—এই প্রতিফলনই চিদ্‌ভাস, যা আমরা জীব বলে জানি। দর্পণের স্বচ্ছতা যত বেশি, প্রতিফলন তত নিখুঁত; মন যত শুদ্ধ, চেতনার প্রতিবিম্ব তত নির্ভুল। কিন্তু প্রতিফলন কখনও মূল মুখে পরিণত হয় না—ঠিক যেমন জীব কখনও ব্রহ্মের পরিপূর্ণতা ধারণ করতে পারে না, কেবল তার আলোয় আলোকিত হয়। যখন মন জানে যে, সে কেবল প্রতিফলন, তখন ভুল অভিন্নতা ভেঙে যায়—এটাই স্বীকৃতির মুহূর্ত, আত্ম-জ্ঞান-এর উদয়।

আত্মা-বিম্ব-ন্যায় সেই বোধকে প্রসারিত করে: সমস্ত মনের ভেতরে প্রতিফলিত একটিই আলোকস্রোত—ব্রহ্ম-চৈতন্য। অজ্ঞান জীবকে মনে করায় যে, তার নিজস্ব স্বাধীন আলোক আছে, সে নিজেই উৎস। কিন্তু জ্ঞান যখন জাগে, তখন বোঝা যায়, সব আলো এক সূর্যের বিকিরণ মাত্র; “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—এই উপলব্ধি তাই আত্মস্বীকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।

অদ্বৈত সহজভাবে বলে—চেতনা একটাই, কিন্তু আমরা তাকে চার রকমের ভঙ্গিতে “অভিজ্ঞতা” করি। বুঝতে সুবিধার হবার জন্য ধরুন, আপনারই ঘরে একটাই বাতি জ্বলে আছে; ঘরের সাজ পালটালে আলো বদলায় না, শুধু আলোর পড়ার ধরন বদলে যায়। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থায় ঘরের সাজ পালটায়; তুরীয়ে বোঝা যায়, আলোটি সবসময় একই ছিল।

জাগ্রত অবস্থা হলো দিনের বেলা চোখ খোলা রাখার সময়টা। আপনি বাজারে যান, ফোন ধরেন, কাজ করেন—মন বাইরে ছুটে ছুটে জগৎকে ধরে। যেমন ক্যামেরা বাইরে তাকিয়ে ছবি তোলে, তেমনি ইন্দ্রিয় আর মন মিলে “বাইরের” জগৎকে ফ্রেম করে। এখানে আনন্দ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি—সব কিছু খুব “বাস্তব” মনে হয়। কিন্তু লক্ষ্য করুন, এসব ঘটনার খবর কে রাখছে? যে-সচেতনতা বলতে থাকে—“আমার সাথে এটা ঘটছে”—সে তো ভিতরে (ভেতরে) স্থিরই আছে।

স্বপ্নে দৃশ্য পালটায়, ক্যামেরা তখন আর বাইরে নয়, ভেতরে ঘুরে যায়। চোখ বন্ধ, তবু পাহাড়-নদী-মানুষ-কথাবার্তা সব চলছে। বাইরে কিছু ঘটছে না—তবু ভেতরের পর্দায় সিনেমা চলছে এবং আপনি হাসছেন, ভয় পাচ্ছেন, দৌড়োচ্ছেন। স্বপ্ন প্রমাণ করে, “জগৎ” মানে শুধু বাইরের বস্তু নয়; মন নিজেই দৃশ্য বানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থাকে—এই স্বপ্নযাত্রার সাক্ষী কে?

সুষুপ্তি বা গভীর ঘুমে সিনেমা থেমে যায়। না বাইরের দৃশ্য, না ভেতরের স্বপ্ন—কিছুই নেই; শুধু ঘুম ভেঙে আমরা বলি, “বড্ড ভালো ঘুম হলো”—মানে, সেখানে ছিল একধরনের নিস্তরঙ্গ সুখ, কিন্তু তখন “আমি” বা “জগৎ” জেগে ছিল না। সহজ উদাহরণ—বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু টিভি-মোবাইল-লাইট সব বন্ধ; তাই কোনো ছবি বা শব্দ নেই। তবু বিদ্যুৎ গেছে, তা নয়—বাস্তবে এর প্রমাণ: ঘুম ভাঙার পরে সতেজতা থাকে। এই অবস্থায় চেতনা আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই; অজ্ঞানতার একটা পর্দা ঢেকে থাকে।

এখন ধরুন, একই ঘরের মধ্যে বসে আপনি লক্ষ করলেন—বাইরে তাকিয়ে দেখা, ভেতরে স্বপ্ন দেখা, আর কিছুই না দেখে গভীর বিশ্রামে থাকা—এই তিনটিই যেন এক ছবির তিনটি দৃশ্য। আলাদা আলাদা দৃশ্য হলেও আলোর উৎস কিন্তু এক। অদ্বৈত যাকে “তুরীয়” বলে, সেটাই সেই আলোর ভাবনা—এটি কোনো নতুন দৃশ্য নয়, বরং যে-আলো তিন দৃশ্যকেই সম্ভব করে, তার স্বীকৃতি। ঠিক সিনেমা-হলের পর্দার মতো—অ্যাকশন দৃশ্য, রোমান্স দৃশ্য, অন্ধকার ইন্টারভ্যাল—সবই আসে যায়, কিন্তু সাদা পর্দা একই থাকে এবং কোনো দৃশ্যই পর্দাটাকে বদলাতে পারে না। তুরীয় হলো ওই “পর্দা-স্বরূপ” চেতনা—শান্ত, অচঞ্চল, এক।

আরও সহজ করে ধরুন—সমুদ্র আর ঢেউ। জাগ্রতে বড়ো বড়ো ঢেউ তটে আছড়ায়; স্বপ্নে ঢেউ ভেতরের উপসাগরে ওঠে; সুষুপ্তিতে ঢেউ থেমে সমুদ্র স্তব্ধ; তুরীয়ে বোঝা যায়—ঢেউ যা-ই হোক, আসলে সবই জল। অথবা বিদ্যুতের উদাহরণ—পাখা ঘোরে, বাতি জ্বলে, হিটার গরম হয়; যন্ত্র বদলালে কাজ বদলায়, কিন্তু বিদ্যুৎ একই। জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি এই তিন “যন্ত্র”, আর তুরীয় হলো “বিদ্যুৎ”—যা সব কাজকে সম্ভব করে, কিন্তু নিজে কোনো কাজ নয়।

প্রয়োগিক আরেকটা ছবি ভাবুন—আপনার স্মার্টফোন। হোম-স্ক্রিনে আপনি অ্যাপ চালান—এ ভাবটা জাগ্রত। এয়ারপ্লেন মোডে নেট ছাড়া নিজের ভেতরের ডেটা নিয়ে খেলেন—এ স্বপ্ন। ফোন সম্পূর্ণ স্লিপ-মোডে—এ সুষুপ্তি। কিন্তু ফোনের অপারেটিং-সিস্টেম তো সব সময় আছে; স্ক্রিন অফ হলেও সেটাই সব কিছুর ভিত্তি—এই “ওএস”-বোধটাই তুরীয়-চেতনা, যা সব অবস্থা জুড়ে একই রকম থাকে।

মূলকথা হলো—প্রথম তিন অবস্থা “আমি কেমন অভিজ্ঞতা করছি”, সেটা বদলায়; তুরীয়ে বোঝা যায়, “আমি কে”—যে সব অভিজ্ঞতারও আগের, সব দৃশ্যেরও পেছনের স্থির সাক্ষী। তাই অদ্বৈত বলে, তুরীয় কোনো চতুর্থ “অভিজ্ঞতা” নয়; এটি অভিজ্ঞতার পাটাতন। জাগ্রতে আপনি জগৎ দেখেন, স্বপ্নে মন-জগৎ দেখেন, সুষুপ্তিতে কিছুই দেখেন না; তুরীয়ে আপনি সেই “দেখারও” আগের নির্মল সত্তাটিকে চেনেন—যার উপস্থিতিতে দেখা-না-দেখা তিনটিই সম্ভব হয়। এই বোধটি একবার স্পষ্ট হলে, দিনের ভিড়, রাতের স্বপ্ন আর গভীর ঘুম—সব কিছুর মধ্যেই ভেতরের সেই শান্ত, উজ্জ্বল, অচঞ্চল “আমি”-বোধটি অপরিবর্তিতভাবে টিকে থাকে; তখন প্রপঞ্চ থেমে যায় না, কিন্তু প্রপঞ্চের ভেতরই শান্তি দেখা দেয়, কারণ আপনি জানেন—ঢেউ যতই উঠুক, জলে জল ছাড়া আর কিছুই ঘটছে না।

যখন এই প্রপঞ্চ-মিথ্যা-বোধটি জাগে যে, জগৎ কেবল আপাত-প্রকাশ, তখন প্রপঞ্চ-উপশম স্বতঃসিদ্ধ হয়। বাহ্যিক কার্যক্রম চলে, কিন্তু জ্ঞানীর ভেতরে কোনো কর্তা-ভাব বা ভোগ-ভাব থাকে না। তিনি বিভ্রমের মধ্যে কাজ করেন, কিন্তু বিভ্রম তাঁকে আর স্পর্শ করতে পারে না। যেমন আগুনের প্রকৃতি জানা মানুষ আর আগুনে পোড়ে না, তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞানী জগৎকে দেখে, কিন্তু তার দ্বারা আবদ্ধ হন না।

এসব ন্যায়-উপমা—দড়ি-সাপ, ঝিনুক-রুপা, গন্ধর্ব-নগর, দর্পণ-প্রতিবিম্ব, ঘট-আকাশ—সবই সেই চিরন্তন শিক্ষার প্রতিফলন: অবিদ্যা কখনও কিছু সৃষ্টি করে না, কেবল আচ্ছাদন করে; জ্ঞান কিছু নতুন আনে না, কেবল আচ্ছাদন সরিয়ে দেয়। যখন সেই জ্ঞান উদয় হয়, তখন এই রূপকগুলোও নিজের কাজ শেষ করে নীরবতায় মিশে যায়। তখন, যা থাকে, তা আর কোনো চিত্র, কোনো প্রক্রিয়া, কোনো প্রমাণ নয়—কেবল শুদ্ধ ব্রহ্ম—স্বয়ং-আলোকিত, দ্বিতীয়-রহিত, প্রক্ষেপণ বা প্রত্যাহার-অতীত, কারণ-প্রভাবের ঊর্ধ্বে—সেই নীরব আলো, যা নীরবতাকেও আলোকিত করে।

অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তি কোনো অর্জনের বস্তু নয়, বরং জ্ঞানের মধ্য দিয়ে নিজের স্বরূপে প্রত্যাবর্তন। মুক্তি মানে কিছু পাওয়া নয়, বরং, যা সবসময়ই ছিল—নিজস্ব স্বচৈতন্যের অনাবৃত উপলব্ধি—তারই উন্মোচন। অবিদ্যা এই চেতনার উপর এক আচ্ছাদন; মোক্ষ মানে সেই আচ্ছাদনের অপসারণ, অর্থাৎ, অবিদ্যা-নিবৃত্তি।

অদ্বৈত সাধনার প্রথম ধাপেই অনুসন্ধানী আত্মা বুঝতে শেখে, মুক্তির পথে যাত্রা কোনো হঠাৎ প্রাপ্তি নয়—এটি ধীরে ধীরে অন্তরের পরিশুদ্ধি ও দৃঢ় অনুধ্যানের ফল। এই পরিশুদ্ধির উপায়ই বলা হয়েছে সাধন-চতুষ্টয়।

প্রথম ধাপ বিবেক—যে-শক্তি মানুষকে শেখায়, কী নিত্য আর কী অনিত্য, কী আত্মা আর কী অনাত্মা, কী সত্য আর কী মিথ্যা। যেমন ঘুম থেকে জাগার পর স্বপ্নের ঘটনাগুলি অবাস্তব বলে স্পষ্ট হয়, তেমনি বিবেকের আলোয় জগৎ ও দেহের ক্ষণিক রূপ ম্লান হয়ে আত্মার চিরসত্তা উদ্‌ঘাটিত হয়।

দ্বিতীয় ধাপ বৈরাগ্য, যা সমস্ত ইন্দ্রিয়ানন্দ, ভোগ বা বস্তুপ্রাপ্তির আকর্ষণ থেকে মনকে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনে। এখানে দমন নয়, স্বাভাবিক বিচ্ছেদ—কারণ জ্ঞানী দেখে, যা নশ্বর, তা ধারণার যোগ্য নয়। তাই বৈরাগ্য মানে উদাসীনতা নয়, বরং গভীর অন্তঃস্থিত শান্তি, যেখানে আকাঙ্ক্ষা নিজে থেকেই ক্ষীণ হয়ে আসে।

তৃতীয় ধাপ ষট্‌সম্পত্তি, অর্থাৎ ছয়টি গুণের বিকাশ। এর মধ্যে শম মনকে প্রশমিত করে; দম ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখে; উপরতি মনকে বাহ্য অন্বেষণ থেকে ফিরিয়ে অন্তর্মুখ করে; তিতিক্ষা সমস্ত সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ, লাভ-অলাভ সহ্য করার ক্ষমতা দেয়; শ্রদ্ধা গুরুবাক্য ও শাস্ত্রবাক্যের প্রতি অবিচল আস্থা সৃষ্টি করে; আর সমাধান একাগ্রচিত্ত হয়ে আত্মস্বরূপে স্থিত থাকার ক্ষমতা দেয়। এই ছয় গুণ মিলে মনকে এমন এক শান্ত স্থিতিতে স্থাপন করে, যেখানে জ্ঞান সহজে প্রতিফলিত হয়।

শেষধাপ মুমুক্ষুত্ব—মুক্তির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এটি কেবল মানসিক বাসনা নয়; এটি আত্মার তৃষ্ণা, সেই অন্তর্লীন আহ্বান যা মানুষকে সমস্ত ভোগ, কর্ম ও চিন্তার জঞ্জাল অতিক্রম করে পরম শান্তির দিকে চালিত করে। শঙ্করাচার্য বলেছেন—“মুমুক্ষুত্ববিহীনা জনা না শাস্ত্রে না গুরৌ রতাঃ”—অর্থাৎ মুক্তির তৃষ্ণা ছাড়া কোনো সাধনা স্থায়ী ফল দেয় না।

এই চারধাপ একত্রে আত্ম-অনুসন্ধানের পূর্ণ সোপান গঠন করে। বিবেক নির্দেশ দেয়, বৈরাগ্য মুক্তি দেয়, ষট্‌সম্পত্তি মনকে শুদ্ধ করে, আর মুমুক্ষুত্ব তাকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়—যেখানে জ্ঞান নিজেই মুক্তি হয়ে উদ্‌ভাসিত হয়।

এই প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলে, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন নামক তিন স্তরের জ্ঞানপদ্ধতি শুরু হয়। শ্রবণে শিষ্য প্রথমবার শোনে যে, “তৎ ত্বম্ অসি”—“তুমিই সেই”—এমন মহাবাক্যগুলো কেবল বচন নয়; তারা চেতনার পরিসীমা নাড়িয়ে দেয়। মননে বৌদ্ধিক সংশয় দূর হয়—মন প্রশ্ন করে, যুক্তি করে এবং ধীরে ধীরে দ্বৈততার মায়া চিনে নেয়। নিদিধ্যাসনে এই বোঝাপড়া গভীরে প্রবেশ করে, অভ্যাসগত বিপর্যয় গলে যায়; আত্মা ও ব্রহ্মের ভেদবোধ নিঃশেষ হয়।

যখন সাধক ধীরে ধীরে অনিত্যতার সীমা পেরিয়ে নিত্যতায় স্থিত হতে শেখে, তখন তার অন্তরে একদিন সেই অনুধ্যান পূর্ণতা লাভ করে। সেই মুহূর্তে কোনো নতুন কাজ বা ক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না—কারণ জ্ঞান কোনো বাহ্য ক্রিয়ার ফল নয়; এটি প্রকাশমাত্রেই জাগ্রত হয়, যেমন সূর্য কখনও উদিত হয় না, কেবল মেঘ সরে গেলে দেখা দেয়। তেমনি আত্মজ্ঞানও সর্বদা বিদ্যমান, কেবল অজ্ঞতার মেঘ সরলেই তা “উদিত” বলে প্রতীয়মান হয়।

এই উদয়কে বোঝাতে শাস্ত্র বলে—আবরণ-নিবৃত্তি ও বিক্ষেপ-নিবৃত্তি একসাথে ঘটে। আবরণ হলো অজ্ঞতার সেই আচ্ছাদনশক্তি, যা আত্মার প্রকৃত স্বরূপকে গোপন রাখে। সূর্যের আলো যেমন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যায়, অথচ কখনও নিভে যায় না, তেমনি আত্মার স্বরূপও আবরণের কারণে আড়াল থাকে—“আমি কে”, এই অজ্ঞতা থেকেই তার সূচনা। এটি সেই অন্তর্মুখ পর্দা, যা জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ হতে বাধা দেয়।

অন্যদিকে বিক্ষেপ হলো প্রক্ষেপণশক্তি—যা এই অজ্ঞতার পটভূমিতে মিথ্যা ধারণার জগৎ রচনা করে। যখন সত্য আচ্ছন্ন থাকে, তখনই মনের পর্দায় ভ্রমরূপে অসংখ্য নাম-রূপ, ভাবনা, অনুভূতি ও কর্মের ছায়া নাচতে থাকে। দড়িকে সাপ বলে ভ্রম দেখা যেমন আবরণ ও প্রক্ষেপণের যুগল ক্রিয়া, তেমনি ব্রহ্মকে আড়াল করে জগৎ-প্রক্ষেপণও তেমনি মায়ার দ্বৈত কাজ।

সাধনার অগ্রগতিতে প্রথমে আবরণ-নিবৃত্তি ঘটে—অজ্ঞতার পর্দা ছিঁড়ে যায়, সত্যের প্রথম আলোকরশ্মি প্রতিভাত হয়। তারপর বিক্ষেপ-নিবৃত্তি—প্রক্ষেপিত বিভ্রমের রূপগুলি জ্ঞান-আলোয় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য হারায়, যেমন সূর্যোদয়ে অন্ধকার ও ছায়া বিলীন হয়। তখন মনও নিজের বিকারমুক্ত, প্রশান্ত রূপে স্থিত হয়।

এই অবস্থায় মন নিজের মিথ্যা স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। আগের মতো আর “আমি ভাবছি” বা “আমি করছি”, এই অহংবোধ থাকে না। মন তখন কেবল চেতনার স্বচ্ছ প্রতিবিম্বমাত্র—চলমান কিন্তু নিস্পৃহ। শাস্ত্র একে বলে মনোনাশ, অর্থাৎ মনের বিভ্রমের অবসান, তবে কোনো ধ্বংস নয়। এটি মনের স্বরূপে প্রত্যাবর্তন—যেখানে মন আর কোনো নতুন কর্মফল সৃষ্টি করতে পারে না।