অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩৮



এই কার্যকারণ সম্পর্ককে অদ্বৈত তিনভাবে বিশ্লেষণ করে—উপাদান কারণ, নিমিত্ত কারণ ও সম্বন্ধ কারণ। উপাদান কারণ হলো যা থেকে কিছু তৈরি হয়, যেমন সোনা থেকে কুণ্ডল বা কানফুল; নিমিত্ত কারণ হলো সৃষ্টিকারী, যেমন কুমোর পাত্র বানায়; সম্বন্ধ কারণ হলো তাদের সংযোগরূপ নীতি। কিন্তু ব্রহ্ম নিজেই সব—নিমিত্তও তিনিই, উপাদানও তিনিই, সম্পর্কও তিনিই। তাই বলা হয়, ব্রহ্মই কারণ ও ফল উভয়। জগৎ ব্রহ্ম থেকে পৃথক কোনো সত্তা নয়; এটি তাঁরই মায়ারূপ প্রকাশ।

এখানেই আসে “হেত্বাভাস” শব্দটির গভীর অর্থ—‘হেতু’ অর্থাৎ কারণ, ‘আভাস’ অর্থাৎ ছায়া বা প্রতীয়মানতা। হেত্বাভাস মানে “কারণের প্রতিচ্ছায়া”—যা দেখতে কারণের মতো, কিন্তু আসলে নেই। ঠিক তেমনি, জগতের সমস্ত কারণ-ফল সম্পর্কই ব্রহ্মচেতনার উপর মায়ার ছায়া; তারা বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু তাদের নিজস্ব স্বরূপ নেই। এই কারণেই বলা হয়—অদ্বৈত বেদান্তে সমস্ত কার্যকারণ-তত্ত্ব অবশেষে এক বৃহৎ হেত্বাভাসে পরিণত হয়, এক প্রমাণিক বিভ্রমে, যা অভিজ্ঞতার পর্যায়ে যুক্তিসংগত হলেও চূড়ান্ত সত্যে স্বরূপহীন।

যেমন, স্বপ্নে আমরা দেখি—আমি চলছি, কথা বলছি, অনেক ঘটনা ঘটছে। স্বপ্নের মধ্যেই সব কারণ-ফল, সময়, যুক্তি প্রযোজ্য। কিন্তু জেগে ওঠার পর বোঝা যায়, কিছুই ঘটেনি, কারণ “আমি” এবং “স্বপ্ন” উভয়ই এক চেতনার ভিন্ন প্রকাশ। অদ্বৈত সেই জাগরণের অবস্থাই “ব্রহ্মজ্ঞান” বলে—যেখানে সমস্ত প্রমাণ, যুক্তি, কারণ ও ফল একে একে বিলীন হয়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল চেতনার এক অখণ্ড স্বরূপ—যা না কোনো হেতু দ্বারা প্রমাণিত, না কোনো প্রমাণের উপর নির্ভরশীল।

এই কারণেই বলা হয়, জ্ঞানের আলো জ্বলে উঠলে কোনো নতুন সৃষ্টি হয় না; কেবল অজ্ঞানতার মেঘ সরে যায়, এবং ব্রহ্ম, যা সবসময়ই ছিল, তা নিজের দীপ্তিতে প্রকাশিত হয়। কার্যকারণ-তত্ত্ব তখন হারিয়ে যায় না—সে নিজের সীমিত বাস্তবতা থেকে মুক্তি পায়, ব্রহ্মচেতনার অনন্ত সত্তায় লীন হয়। তখন বোঝা যায়, কারণ, ফল, প্রমাণ, প্রমাণ্য—সবই ব্রহ্মেরই খেলা, এবং চূড়ান্ত সত্যে সবই সেই এক চেতনার নীরব উদ্‌ভাস।

এভাবে অদ্বৈত বেদান্তে সমস্ত কার্যকারণ-তত্ত্ব অবশেষে এক বৃহৎ হেত্বাভাস—এক প্রমাণিক বিভ্রমে রূপান্তরিত হয়। জগৎকে তখন আর স্বাধীন বাস্তবতা হিসেবে দেখা যায় না; বরং এটি চেতনার ওপর আরোপিত এক সম্পর্কমাত্র। যে কারণ ও ফল আমরা আলাদা মনে করি, তারা আসলে এক অদ্বিতীয় চৈতন্যের দ্বৈত প্রতিফলন।

এই উপলব্ধির গভীরে যুক্তির সীমা ভেঙে যায়। কারণ, যুক্তি যতক্ষণ দ্বৈত, ততক্ষণ সে নির্ভর করে সম্পর্ক, পার্থক্য ও প্রমাণের ওপর। কিন্তু যখন বোধ জাগে যে, সমস্ত সম্পর্কই চেতনার অন্তঃপ্রকাশ, তখন বোঝা যায়—কারণ ও ফল, প্রমাণ ও প্রমাণ্য, দৃষ্টা ও দৃশ্য—সবই সেই এক অখণ্ড ব্রহ্মচেতনার অন্তর্গত।

তখন “হেতু” আর কোনো সত্য নয়, “প্রমাণ” আর কোনো আলাদা শক্তি নয়; সব কিছুর মধ্যে প্রকাশ পায় সেই এক চিদাকাশ—যেখানে প্রতিটি যুক্তি নিজেই আত্মবিসর্জন দেয়। জ্ঞানের আলোয় যখন অজ্ঞান বিলীন হয়, তখন বোঝা যায়, জগৎ কোনো ভুল নয়, আবার কোনো সত্যও নয়—এটি কেবল এক চিরন্তন চেতনার উদ্‌ভাসিত সম্ভাবনা, যা প্রতিক্ষণ জন্ম নিচ্ছে এবং লয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

এই বোধই অদ্বৈতের পরিণতি—যেখানে যুক্তি মায়ায় বিলীন, মায়া ব্রহ্মে লীন, আর ব্রহ্ম থাকে নিঃশব্দ, অচল, স্বয়ং-প্রকাশিত।

যখন এই নির্ভরতার সত্য উপলব্ধ হয়, তখন মিথ্যাত্ব আর অস্বীকার নয়—এটি হয়ে ওঠে অবলম্বনবোধ। তখন জ্ঞান ও অজ্ঞান উভয়ই তাদের উৎস অদ্বৈত চৈতন্যে বিলীন হয়। যা অবশিষ্ট থাকে, তা কোনো চিন্তা বা উপলব্ধির বিষয় নয়, বরং সেই চিরন্তন স্বয়ং-প্রকাশিত সচেতনতা—যা জানে, যা জানার মধ্যেও বিদ্যমান এবং যা জানা যায়, এমন সব কিছুরও ঊর্ধ্বে।

এই স্তরে এসে প্রমা ও অপ্রমা, সংশয় ও অনুভব, বিপর্যয় ও প্রত্যয়—সবই এক অনবচ্ছিন্ন চেতনার অভিব্যক্তি হয়ে যায়। আবরণ ও বিক্ষেপের খেলা থেমে যায় এবং অবশিষ্ট থাকে একমাত্র ব্রহ্ম-বস্তু-জ্ঞান—যে-জ্ঞান নিজেকে জানে, যা কোনো বাধ দ্বারা ব্যাহত নয়, যা মধ্যস্থতাহীন এবং যা কোনো প্রচেষ্টার ফল নয়। এই জ্ঞানেই সব দ্বন্দ্বের অবসান, সব ভ্রমের অবলুপ্তি এবং সমস্ত প্রমাণের চূড়ান্ত সার্থকতা।

অদ্বৈত বেদান্তে বিভ্রম কেবল একটি মানসিক ত্রুটি নয়—এটি অভিজ্ঞতার নিজস্ব স্থাপত্য, যা অবিদ্যা-র ছায়ায় গঠিত। বিভ্রমের এই সূক্ষ্ম যান্ত্রিকতাকে বোঝাতে শাস্ত্র অসংখ্য দৃষ্টান্ত, ন্যায় বা চিত্রণমূলক উপমা ব্যবহার করেছে—প্রতিটি ভিন্ন কোণ থেকে একই সত্যকে উন্মোচন করে যে, চেতনা কখনও কলুষিত হয় না, কেবল এর প্রতিবিম্বই বিকৃত হয়।

মন জগৎকে যেভাবে উপলব্ধি করে, তা অনেকটা ঝিনুকে রুপা দেখার মতো—শুক্তি-রজত-ন্যায়। দূরত্ব, আলো-অন্ধকারের ভেদ ও ইন্দ্রিয়ের অপ্রতুলতা মিলে মন একটি অপরিচিত বস্তুর উপর পরিচিত কোনো চিত্র আরোপ করে। এখানে “রুপা” বাস্তব নয়, কিন্তু উপলব্ধি বাস্তবের মতো কাজ করে—আশ্চর্যজনকভাবে মন সেই প্রক্ষেপণের মধ্যেই বাস করে, ভয় পায়, আকাঙ্ক্ষা করে। জগৎও তা-ই—ব্রহ্মের আলোকেই উজ্জ্বল, কিন্তু অজ্ঞান সেই আলোকের প্রতিফলনে “বহির্বিশ্ব” নামের বিভ্রম সৃষ্টি করে। যখন জ্ঞান-আলো উদয় হয়, প্রতারণা বিলীন হয়; মুক্তোর মতোই ব্রহ্ম তখন প্রকাশিত হয় নিজের সত্য রূপে।

রজ্জু-সর্প-ন্যায় এই বিভ্রমের সবচেয়ে প্রাণবন্ত প্রতিরূপ। সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় দড়িকে সাপ বলে ভুল করা—এই মুহূর্তেই ভয়, আন্দোলন, চেতনার সম্পূর্ণ বিকৃতি। অথচ দড়িটি কখনও সাপ হয়নি। ব্রহ্মও তেমনই—এক, অবিনশ্বর, চিরন্তন—তবুও মনের বিক্ষেপ-শক্তি সেই একটিকে বহুত্বে বিভক্ত করে। দ্রষ্টা বিভ্রান্ত হয়ে ঐক্যের উপর প্রক্ষেপণ করে অনন্ত জগতের প্রতিচ্ছবি, তারপর সেই প্রক্ষেপণের ফাঁদে পড়ে ভোগভ্রান্তিতে ঘুরে বেড়ায়। বাধক-জ্ঞান যখন উদয় হয়, তখন তা কোনো “নতুন দড়ি” তৈরি করে না—কেবল ভুল আলোক-নিবেদন সরিয়ে দেয়। জগৎ তাই সৃষ্টও নয়, ধ্বংসও নয়—শুধু ভুলভাবে দেখা এবং পরে সঠিকভাবে দেখা একটি প্রক্রিয়া।

“আলোক-নিবেদন” শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থই তার দার্শনিক অন্তর্গত অর্থকে প্রকাশ করে। “আলোক” মানে আলো বা জ্যোতি—যা জ্ঞান, চেতনা, বা ব্রহ্ম-প্রকাশের প্রতীক। “নিবেদন” মানে অর্পণ, সমর্পণ, উৎসর্গ। ফলে “আলোক-নিবেদন” বলতে বোঝায়—নিজের সমস্ত সত্তা, চিন্তা, কর্ম ও অহংকারকে সেই পরম আলোর কাছে নিবেদন করা, যেন ব্যক্তি-সীমা বিলুপ্ত হয়ে যায়, এবং চেতনা তার স্বরূপ ব্রহ্মজ্যোতিতে লীন হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে আলোক-নিবেদন কোনো বাহ্য পূজার আচার নয়; এটি অন্তর্জাগরণের এক মুহূর্ত—যেখানে ‘আমি জানি’, ‘আমি দেখি’, ‘আমি অনুভব করি’—এই সমস্ত ‘আমি’-ভাব গলে গিয়ে কেবল আলোকেরই প্রকাশ ঘটে। “আলোক” এখানে কেবল দীপ্তি নয়; এটি চিদ্‌রূপ ব্রহ্মের প্রতীক, সেই স্বয়ং-প্রকাশিত চেতনা যা সমস্ত কিছু আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কোনো কিছুর দ্বারা আলোকিত হয় না।

যেমন গীতা (১৫.৬)-য় কৃষ্ণ বলেন—“ন তদ্‌ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ। যদ্‌ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।” অর্থাৎ, যে-ধামে সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নির কোনো আলো প্রয়োজন হয় না—সেই ধামই আমার পরম আলো। এই ‘ধাম’ বা পরম আলোই সেই চেতনার প্রতীক, যেখানে পৌঁছে সমস্ত অন্ধকার অর্থহীন হয়ে যায়। আলোক-নিবেদন মানে সেই পরম ধামের প্রতি আত্মসমর্পণ—যেখানে চেতনা নিজের উৎসের সঙ্গে একীভূত হয়।

এই নিবেদন তাই কোনো ক্রিয়া নয়; এটি এক অন্তরবোধ, এক আধ্যাত্মিক সমর্পণ। উপনিষদীয় ভাষায়, “তম্‌ এব বিদিত্বা অতিমৃত্যুম্‌ এতি” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩.৮)—"কেবল তাঁকেই (পরম পুরুষ বা ব্রহ্মকে) জানতে পেরে মৃত্যু অতিক্রম করা যায়"। আলোক বা ব্রহ্মকে জেনে যায় যে, সে মৃত্যুকে অতিক্রম করে। অর্থাৎ, জ্ঞানের আলোয় আত্মার সত্য প্রকাশিত হলে মৃত্যু, অন্ধকার, বিভ্রান্তি আর কোনো অর্থ রাখে না।

দার্শনিকভাবে, আলোক-নিবেদন হলো অহং-এর দাহন। “আমি কর্তা”, “আমি জ্ঞানী”, “আমি উপাসক”—এই ধারণাগুলিকে সেই জ্ঞানের আগুনে সমর্পণ করা, যার মধ্যে সব পরিচয় বিলীন হয়ে যায়। তখন চেতনা আর ব্যক্তিগত নয়; সে ব্রহ্মজ্যোতির এক অবিচ্ছেদ্য তরঙ্গ।

শ্রীমদ্‌ভাগবত (৩.২৬.৩)-এ বলা হয়েছে—পরম পুরুষোত্তম ভগবান হলেন পরম আত্মা, এবং তাঁর কোনো আদি বা শুরু নেই। তিনি প্রকৃতির জড় গুণাবলি (সত্ত্ব, রজ, তম) থেকে অতীত এবং এই জড় জগতের অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে। তিনি সর্বত্র অনুভূতিযোগ্য (বা জ্ঞেয়), কারণ তিনি স্বয়ংপ্রকাশ, এবং তাঁর সেই স্বয়ংপ্রকাশ দীপ্তিতে বা তেজে এই সমগ্র সৃষ্টি ধারণ ও পালিত হচ্ছে। “জ্ঞানং আলোকে,” অর্থাৎ জ্ঞানই আলো। এই জ্ঞানই ব্রহ্মের প্রকৃত প্রতিফলন। তাই “আলোক-নিবেদন” মানে সেই ব্রহ্মজ্ঞানকে নিজের অন্তরে জ্বালিয়ে রাখা—যেখানে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের ভেদ আর থাকে না।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ দীপ জ্বালিয়ে বলে, “এই আলো আমি ঈশ্বরকে নিবেদন করলাম,” তাহলে বাহ্যভাবে তা একটি আচার। কিন্তু যদি তার হৃদয়ে এই অনুভব জাগে—“এই আলোই আমার চেতনা, এই দীপ্তিই সেই পরম”—তখন সেটিই হয় প্রকৃত আলোক-নিবেদন। তখন নিবেদনকারী, নিবেদিত বস্তু এবং যাঁকে নিবেদন করা হচ্ছে—এই তিনের ভেদ মুছে যায়। অবশিষ্ট থাকে কেবল আলোক—অখণ্ড, স্বয়ং-প্রকাশিত, ব্রহ্মচৈতন্য।

শেষপর্যন্ত, আলোক-নিবেদন হলো জীব থেকে ব্রহ্মের যাত্রা নয়, বরং সেই স্বীকৃতি যে, জীব সর্বদাই ব্রহ্ম ছিল। মায়ার অন্ধকারে যে আলো আচ্ছন্ন ছিল, জ্ঞানের নিবেদনে সে আবার জেগে ওঠে—চিরন্তন দীপ্তিতে, নীরব ব্রহ্মজ্যোতির মধ্যে।

গন্ধর্ব-নগর-দৃষ্টান্ত আরও সূক্ষ্ম; এখানে বাস্তবতার স্থাপত্য নিজেই মায়াময়। দিগন্তে মেঘের আকারে গঠিত এক কল্পিত নগরীর মতো মহাবিশ্বও সুবিন্যস্ত, সুনিয়ন্ত্রিত, কারণ-কার্য-বিবর্তনের ছন্দে বাঁধা; তবুও এটি সারবত্তাহীন—কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। জীব সেই মরীচিকায় মুগ্ধ হয়ে স্থায়িত্বের সন্ধান করে—যেন মেঘের শহরে বাসস্থান গড়তে চায়। কেবল তখনই মুক্তি ঘটে, যখন বিবেক-বায়ু সেই মেঘগুলি ছড়িয়ে দেয়—তখন প্রতীয়মান শহর বিলীন হয়, কিন্তু কোনো ধ্বংসাবশেষ থাকে না, থাকে শুধু নীল আকাশ—নির্ভার ও অসীম।

রাহু-চন্দ্র-গ্রহণ-দৃষ্টান্ত অবিদ্যার আবরণ-শক্তির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। অজ্ঞ মানুষ ভাবে, রাহু চাঁদকে গ্রাস করেছে, অথচ চাঁদের আলো কখনও নেভে না; কেবল দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়। তেমনি আত্মা-প্রকাশ কখনও লোপ পায় না—অবিদ্যা কেবল মনের প্রতিফলনে বাধা দেয়। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন-এর মাধ্যমে সেই বাধা দূর হলে, আলো আবার দেখা দেয়, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা কখনও নিভে যায়নি।

ঘট-আকাশ-মহাকাশ-ন্যায় জীব-ব্রহ্ম-ঐক্যের দার্শনিক নির্যাস। একটি পাত্রের ভেতরের স্থানকে আমরা বাইরের স্থান থেকে আলাদা ভাবি, অথচ তা অসম্ভব—স্থান এক ও অভিন্ন। পাত্রই কেবল সীমাবদ্ধতার প্রতীক—নাম ও রূপের উপাধি। পাত্র ভেঙে গেলে ভিতর ও বাইরের স্থান একাকার হয়ে যায়, যেমন জীব-চেতনা জ্ঞান-বিবেকের আঘাতে তার মিথ্যা সীমানা হারায় এবং মহাকাশ-স্বরূপ ব্রহ্মে মিলিত হয়।

এই সমস্ত দৃষ্টান্ত মিলে এক সত্য প্রকাশ করে—অবিদ্যা কখনও সত্যকে সৃষ্টি করে না, কেবল আচ্ছাদন করে। জ্ঞান কিছু তৈরি করে না, কেবল আচ্ছাদন সরায়। শামুক, দড়ি, মেঘ, চাঁদ, পাত্র—সবই শিক্ষার উপায়, যাতে অনুসন্ধানকারী বুঝতে পারে যে, তার দেখা প্রতিটি “জগৎ” নিজেরই চেতনার প্রতিফলন। যখন সেই চেতনা নিজেকে নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে, তখন সকল দৃষ্টান্ত থেমে যায়, সব ভ্রম নিঃশেষ হয় এবং, যা অবশিষ্ট থাকে, তা একমাত্র স্বয়ং-আলোকিত ব্রহ্ম—যা কখনও আবৃত হয়নি, কখনও উদিতও হয় না।