এই অবস্থায় প্রারব্ধ-কর্মই কেবল অবশিষ্ট থাকে—যা শরীরের স্তরে তার গতি শেষ করে। পোড়া দড়ির মতো এই কর্মও বাহ্যত বিদ্যমান, কিন্তু তার বাঁধবার ক্ষমতা নেই। বাসনা দগ্ধ, চিত্ত নির্মল এবং চেতনা অনির্বাণ—এই ত্রয়ীই জীবন্মুক্তের লক্ষণ।
অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে এই বর্ণনা মুক্তির চূড়ান্ত স্তর, অর্থাৎ বিদেহমুক্তি-র অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে। এখানে “প্রপঞ্চ” মানে জগৎ, নাম-রূপের বহুমাত্রিক প্রকাশ—যা অবিদ্যার কারণে বাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে এই বিভ্রম ভঙ্গ হয়। তখন জ্ঞানী ব্যক্তি বোঝেন, প্রপঞ্চ কোনো বাস্তব সৃষ্টি নয়; এটি কেবল চেতনার প্রতিফলন, যেন আয়নায় দেখা আলোর নাচন। সেজন্য তাঁর কাছে জগৎ আর বিভ্রান্তি নয়—তিনি উপলব্ধি করেন, জগৎ আসলে মায়ার বিকার, কিন্তু তার মধ্যেও ব্রহ্মের চিদানন্দময় সত্তা বিদ্যমান।
“প্রপঞ্চ-মিথ্যা-বোধ” মানে এই জ্ঞান যে, জগতের যে-বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা আপাত; তার অন্তরস্থ সত্য একমাত্র চৈতন্য। কিন্তু এই বোধ জগৎ-বিরোধী নয়—এটি জগতের মধ্যেই সত্যের উপলব্ধি। তাই তাঁর কাছে জগত বিলীন হয়ে যায়নি, বরং শান্তি, স্থিতি ও চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রপঞ্চ-উপশম—অর্থাৎ সব প্রকাশের গভীর শান্তিতে বিলীন হওয়া, যেখানে চেতনা একক, স্থির ও স্বতঃপ্রকাশ।
এই অবস্থাই বিদেহমুক্তি—মৃত্যুর পর আত্মার বিলুপ্তি নয়, বরং ব্যক্তিসীমার স্বাভাবিক অবসান। যেমন নদী সাগরে মিশে যায়, কিন্তু সাগরের জলে নিজেই পরিণত হয়, তেমনি জীবাত্মা চেতনার মহাসমুদ্রে লীন হয়ে যায়। সেখানে নাম, রূপ, কারণ, প্রভাব—সবই মুছে যায়। “আমি” বা “তুমি” এমনকি “ঊর্ধ্বে” বা “অতিক্রম” এই ধারণাগুলিও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
অবশিষ্ট থাকে কেবল এক, অনন্ত, অনির্বচনীয় সত্তা—শুদ্ধ ব্রহ্ম। সেই ব্রহ্মই চিদানন্দরূপ—অপরিবর্তনীয়, স্বয়ংপ্রকাশিত, অবিদ্যা ও বিদ্যা উভয়েরই অতীত; গৌড়পাদ আচার্য যাকে বলেন “প্রপঞ্চোপশমম্ শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্”—অর্থাৎ প্রপঞ্চের উপশম, শান্তি, শিবত্ব ও অদ্বৈত—এই চারটি একসঙ্গে মিলে যে চিরসত্য প্রকাশিত হয়, তা-ই বিদেহমুক্ত আত্মার অবস্থান। সেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই স্থিত, অখণ্ড, অচল ও চির-নির্মল।
বিদেহমুক্তি (Videhamukti) একটি গভীর দার্শনিক ধারণা, যা ঘটে দৈহিক মৃত্যুর পরে—অর্থাৎ, যখন জীবন্মুক্ত আত্মা দেহরূপ উপাধি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে ব্রহ্মে একীভূত হয়। ভারতীয় দর্শনে, বিশেষ করে অদ্বৈত বেদান্ত ও যোগ দর্শনে, মুক্তির ধারণাকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে—জীবন্মুক্তি এবং বিদেহমুক্তি। এই দুই অবস্থা মূলত একই জ্ঞানের ভিন্ন স্তর—প্রথমটি জীবদ্দশার অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয়টি তার চূড়ান্ত পরিণতি।
জীবন্মুক্তি (Jīvanmukti) সেই অবস্থা, যখন একজন ব্যক্তি জীবিত অবস্থাতেই আত্মজ্ঞান লাভ করেন এবং প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত বলে নিজেকে জানেন। তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনি দেহ, মন বা ইন্দ্রিয় নন—তিনি সেই চির-শুদ্ধ, চির-চৈতন্য আত্মা, যিনি কখনও জন্মান না, কখনও মরেন না। এই আত্মবোধের ফলে তাঁর মধ্যে আর কোনো আসক্তি বা ভয় থাকে না। তিনি কর্ম করেন, কিন্তু আর কর্মফলে আবদ্ধ হন না। তাঁর শোক-মোহ, সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়—সবই সমবস্থায় দেখা দেয়; কারণ তিনি জানেন, সবই প্রপঞ্চ, আর আমি তার সাক্ষী। জীবন্মুক্ত পুরুষের জন্য কর্মের অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু তা কেবল প্রারব্ধ কর্ম—অতীতের বীজের স্বাভাবিক ক্ষয়মাত্র, যেমন পোড়া দড়ির রূপ আছে, কিন্তু বাঁধার শক্তি নেই। এই অবস্থায় মানুষ দেহে অবস্থান করেও দেহ-সীমার ঊর্ধ্বে বাস করেন—তিনি জগতের মধ্যে থেকেও জগতের ঊর্ধ্বে, যেমন পদ্ম জলমধ্যে থেকেও জলে ভেজে না।
বিদেহমুক্তি হলো সেই চূড়ান্ত মুক্তি, যা জীবন্মুক্ত পুরুষ দেহত্যাগের পর লাভ করেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কারণ শরীর—অর্থাৎ সেই সূক্ষ্মতম বীজ, যেখানে অজ্ঞানতা ও বাসনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে—সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। তখন আর কোনো জন্ম নেই, কোনো পুনরাবির্ভাব নেই; আত্মা তার চিরন্তন স্বরূপে ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়। সেখানে ব্যক্তিত্ব বা উপাধির কোনো অস্তিত্ব থাকে না, কেবল এক চির-অখণ্ড, স্বয়ং-প্রকাশিত চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম।
এই দুই অবস্থার পার্থক্য সময়ে, কিন্তু সত্যে নয়। জীবন্মুক্তি হলো আত্ম-জাগরণ, আর বিদেহমুক্তি সেই জাগরণের চূড়ান্ত পরিণতি। জীবন্মুক্ত পুরুষ জগতের মধ্যে থেকে জগতের ঊর্ধ্বে বাস করেন, আর বিদেহমুক্ত অবস্থায় তিনি জগতের ঊর্ধ্বেই বিলীন হয়ে যান। জীবন্মুক্তি হলো আলোর উপলব্ধি, বিদেহমুক্তি সেই আলোর মধ্যে সম্পূর্ণ লয়।
সংক্ষেপে বলা যায়—জীবন্মুক্তি ঘটে দৈহিক জীবনের মধ্যেই, যখন জ্ঞানলাভের মাধ্যমে মানুষ মুক্ত থাকে; আর বিদেহমুক্তি ঘটে দৈহিক মৃত্যুর পরে, যখন দেহ-উপাধি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে আত্মা ব্রহ্মে চিরলয় লাভ করে।
বিদেহমুক্তি সব সময়ই দৈহিক মৃত্যুর পর ঘটে। এটি কোনো বিলোপ নয়, বরং ব্যক্তিসত্তার স্বতঃস্ফূর্ত লয়—যেখানে আত্মা তার চিরন্তন স্বরূপে ফিরে যায়। নাম, রূপ, কারণ, প্রভাব—সবই সেখানে নিঃশেষ হয়, এমনকি “ঊর্ধ্বে” বা “অতিক্রম” ধারণাটিও অর্থহীন হয়ে পড়ে। অবশিষ্ট থাকে কেবল এক অনন্ত, অনির্বচনীয়, স্বয়ং-প্রকাশিত সত্তা—শুদ্ধ ব্রহ্ম, চিদানন্দরূপ, অদ্বিতীয়, এবং সমস্ত দ্বৈততার অতীত—যিনি সর্বদা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানতত্ত্বের এই স্তরে এসে “ভ্রম”—অর্থাৎ, ভুল উপলব্ধি—শুধু জ্ঞানের ত্রুটি হিসেবে নয়, বরং অভিজ্ঞতার নিজস্ব যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। জ্ঞান এবং অজ্ঞান মুখোমুখি দুই বিপরীত শক্তি নয়; তারা একই চেতনার ভিন্ন বিকৃতি, যেমন আলো আর ছায়া একে অপরের ব্যাখ্যা। চেতনা নিজেই কখনও কলুষিত হয় না, কিন্তু যখন মন, ইন্দ্রিয় ও উপাধি দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়, তখন সেই অপরিবর্তনীয় আলো বিকৃত প্রতিবিম্বে রূপান্তরিত হয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে। এই বিকৃতি-ই ভ্রম।
অবিদ্যা অনাদি—এর কোনো সূচনা নেই—কিন্তু অনন্ত নয়, কারণ জ্ঞান (বিদ্যা) উদয় হলে এটি বিলুপ্ত হয়। যখন জ্ঞানের আলোক (অপরোক্ষ-অনুভব) চেতনার মধ্যেই আত্ম-প্রকাশ করে, তখন আবরণ-শক্তি ছিন্ন হয়, বিক্ষেপ-শক্তি তার অবলম্বন হারায়। তখন জীব উপলব্ধি করে যে, সে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই মুহূর্তে জ্ঞান আর অজ্ঞান পরস্পরবিরোধী নয়; তারা একে অপরের ব্যাখ্যা হয়ে, শেষপর্যন্ত একে অপরকে বিলীন করে দেয়।
যতক্ষণ উপাধি (দেহ-মন-ইন্দ্রিয়) সক্রিয়, ততক্ষণ প্রমাণ তথা জ্ঞানের উপায় কাজ করে। ইন্দ্রিয়-উপলব্ধি, অনুমান, শব্দ বা শ্রুতি—সবই চেতনার প্রতিবিম্বিত রূপে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যখন মন শুদ্ধ হয়, চিত্ত প্রশান্ত হয় এবং বাসনা-বৃত্তি নিঃশেষ হয়, তখন মন দর্পণের মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। সেই স্বচ্ছতার মধ্যে আত্মা নিজেই আত্ম-প্রকাশ করে—কোনো প্রমাণ, কোনো যুক্তি, কোনো ইন্দ্রিয় আর প্রয়োজন হয় না।
এই স্তরে জ্ঞানতত্ত্ব আর কোনো “জ্ঞানের পদ্ধতি” নয়; এটি ভ্রমের যন্ত্রবিদ্যা—মিথ্যা উপলব্ধি কীভাবে গঠিত হয় এবং কীভাবে তা বিলুপ্ত হয়, তার একটি বিশ্লেষণ। জগৎ, অভিজ্ঞতা ও মন সবই সেই একই প্রক্ষেপণ-প্রক্রিয়ার রূপ—একই যান্ত্রিকতায় সৃষ্টি, স্থিতি ও বিলয় ঘটে। অদ্বৈত এভাবে অভিজ্ঞতাকে একটি প্রমাণতান্ত্রিক নকশা হিসেবে বিশ্লেষণ করে, যেখানে প্রত্যেক উপলব্ধি একধরনের “ভ্রমের সৃষ্টিতত্ত্ব”।
অদ্বৈত বেদান্তে সমস্ত কার্যকারণ-তত্ত্বের বিশ্লেষণ এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়—যেখানে যুক্তির সীমা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তিশাস্ত্র জগৎকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধরে নেয় যে, প্রত্যেক ফলের পেছনে একটি কার্যকর কারণ আছে, এবং সেই কারণকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা, নির্ধারণ ও প্রতিপন্ন করা সম্ভব। কিন্তু অদ্বৈত এই যুক্তির অন্তর্গত সীমাবদ্ধতাকে উন্মোচন করে বলে—যে-জগৎকে আমরা কার্যকারণ-সম্পর্কে ভাবছি, সেই জগৎই আসলে আপাত-প্রত্যয়, মায়ার প্রতিফলন। ফলে, যে-কারণসমূহকে যুক্তিবিদরা “অসিদ্ধ,” “অনৈকান্তিক” ও “বাধিত” বলে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলি কেবল পৃথক উদাহরণ নয়; বরং গোটা প্রপঞ্চই এই তিন ভ্রান্ত কারণের এক মহা-সমষ্টি।
অসিদ্ধ কারণ—অর্থাৎ, যে-কারণ নিজের অস্তিত্বই প্রমাণ করতে পারে না; এই দৃষ্টিতে জগৎও অসিদ্ধ। আমরা যা দেখি, তা আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনের মাধ্যমে নির্মিত এক ধারণা মাত্র; তার নিজস্ব স্বাধীন বাস্তবতা প্রমাণ করা যায় না। যেমন, মরীচিকার জলে তৃষ্ণার্ত হরিণ দৌড়য়, কিন্তু সেই জলের অস্তিত্ব অসিদ্ধ। তেমনি জগৎও ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলনমাত্র, যার নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই।
অনৈকান্তিক কারণ—যে-কারণ সর্বত্র সমভাবে প্রযোজ্য নয়—এই প্রকার ভ্রান্তির উদাহরণে দেখা যায়, কোনো এক কারণ কখনো ফল উৎপন্ন করে, আবার কখনও করে না। যেমন, অগ্নি কখনো উষ্ণতা দেয়, কিন্তু স্বপ্নে-দেখা অগ্নি তা দেয় না। তেমনি, প্রপঞ্চের কারণও একাধিক শর্তে নির্ভরশীল—স্থান, কাল, ব্যক্তি, অবস্থা—সবই নির্ভরতার ফল। অতএব, এর কোনো চূড়ান্ততা নেই।
বাধিত কারণ—যা অন্য প্রমাণ দ্বারা খণ্ডিত হয়—এই প্রকার ভ্রান্তি মায়ার প্রকৃত প্রকৃতি বোঝাতে সবচেয়ে উপযুক্ত। যেমন, রাতে রশিকে সাপ বলে ভুল হয়, কিন্তু আলো জ্বালানোমাত্র সেই কারণ বিলুপ্ত হয়। তেমনি জ্ঞানোদয়ের আলো জ্বাললেই প্রপঞ্চরূপ কারণ ও কার্য উভয়ই বিলীন হয়, কারণ তাদের মিথ্যাভাব প্রকাশিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে “কার্যকারণ-তত্ত্ব” বা ‘কারণ-ফল সম্পর্কের বিশ্লেষণ’ এক গভীর দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন করে—যেখানে জ্ঞানের আলোয় যুক্তির সীমা ও মায়ার প্রকৃতি একসঙ্গে উদ্ঘাটিত হয়। সাধারণভাবে যুক্তিশাস্ত্র বলে, প্রতিটি ফলের পেছনে একটি কার্যকর কারণ আছে, এবং সেই কারণকে আমরা প্রত্যক্ষ, অনুমান বা শাস্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারি। যেমন—বীজ থেকে গাছ জন্মায়, আগুন থেকে ধোঁয়া ওঠে, মাটি থেকে পাত্র তৈরি হয়।
কিন্তু অদ্বৈত এই সম্পর্কের নিজস্ব অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করে। কারণ অদ্বৈতের মূল তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই বাস্তব নয়। যে-জগৎকে আমরা কারণ ও ফলের বন্ধনে বাঁধা দেখি, সেটি কেবল আপাতভাবে প্রতীয়মান; ব্রহ্মচেতনার ওপর মায়ার এক অরোপমাত্র। এই জন্যই শঙ্করাচার্য বলেছেন—“অজাতম্ অজম্ চ তদ্বিদ্বান্”—জগৎ আসলে কখনোই জন্মায়নি, জন্ম ও উৎপত্তি কেবল অজ্ঞানতার প্রতিফলন।
অদ্বৈত দর্শনের এই অন্তর্দৃষ্টি দুটি স্তর নির্ধারণ করে—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয়, চিরন্তন, চিদানন্দরূপ; জগৎ পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী এবং নাম-রূপ-নির্ভর। ফলে জগৎ ও তার কার্যকারণ সম্পর্ক পরমার্থে সত্য নয়; এটি কেবল মায়ার পরিসরে এক ব্যাবহারিক বাস্তবতা। এই কারণেই বলা হয়—কার্যকারণ সম্পর্ক নিজেও এক হেত্বাভাস, অর্থাৎ এক প্রমাণিক বিভ্রম।
যুক্তিশাস্ত্র হেত্বাভাসকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছে—অসিদ্ধ, অনৈকান্তিক ও বাধিত। অদ্বৈত বেদান্ত এই তিনটিকেই জগতের প্রতীক হিসেবে দেখে। অসিদ্ধ কারণ হলো, যে-কারণ নিজেই প্রমাণিত নয়—যেমন মরীচিকার জলের অস্তিত্ব। জগৎও সেইরকম—আমরা দেখি, অনুভব করি, কিন্তু স্বাধীনভাবে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। সে কেবল চেতনার মধ্যে প্রতীয়মান। অনৈকান্তিক কারণ মানে, যা সর্বত্র প্রযোজ্য নয়—যেমন আগুন উষ্ণতা দেয়, কিন্তু স্বপ্নের আগুন দেয় না। তেমনি প্রপঞ্চের কারণ-ফলও শর্তাধীন—স্থান, কাল, ব্যক্তি ও পরিস্থিতির নির্ভরশীল। তাই এর সর্বজনীনতা নেই। বাধিত কারণ আবার এমন কারণ, যা অন্য প্রমাণ দ্বারা খণ্ডিত হয়—যেমন রশি-সাপের ভ্রম আলো জ্বাললেই বিলীন হয়। তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে সমস্ত কার্যকারণ সম্পর্ক, জগতের বাস্তবতা, মায়ার প্রক্ষেপণ—সবই নিজের ভ্রান্ত স্বরূপে প্রকাশিত হয়ে মুছে যায়।
অদ্বৈত বলে, জগৎ না সম্পূর্ণ সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা—বরং নির্ভরশীল, শর্তাধীন এবং বিলুপ্তিযোগ্য। এটি “সদসদ্বিলক্ষণা”—সৎ-অসৎ-বিলক্ষণা—যা না পুরোপুরি বাস্তব, না পুরোপুরি অবাস্তব। যেমন স্বপ্নে অভিজ্ঞ/দেখা নগরী ও মানুষ জাগরণের সময় বিলীন হয়, তেমনি জ্ঞানোদয়ের পর এই জাগতিক কার্যকারণ জালও এক বৃহৎ বিভ্রম বলে প্রতীয়মান হয়। অভিজ্ঞতা থেকে যায়, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার বস্তুগত বাস্তবতা বিলুপ্ত হয়।