এই অবস্থাকে বলা হয় মিথ্যাত্ব—“যা বিলোপিত, তবুও অভিজ্ঞ”। যেমন স্বপ্নে-দেখা পাত্রটি সত্য নয়, কিন্তু স্বপ্ন চলাকালীন তা অস্বীকার করা যায় না; জেগে উঠলেই বোঝা যায়, এটি মিথ্যা। একইভাবে, জাগ্রত জগতও সম্মিলিত মায়া দ্বারা টিকে থাকে, কিন্তু আত্ম-সাক্ষাৎকার ঘটলেই বিলুপ্ত হয়। জগৎ তাই না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব—এটি অনির্বচনীয়, অবিদ্যার সীমার মধ্যে আপাত-অস্তিত্বধারী।
এইভাবে অদ্বৈতের জ্ঞানতত্ত্ব দেখায়, সমস্ত অভিজ্ঞতাই আত্মা-প্রকাশের উপর নির্ভরশীল, এবং সমস্ত ত্রুটি বিলুপ্ত হয় বাধক-জ্ঞান-এর আলোয়। শেষপর্যন্ত কেবল চৈতন্যই অবশিষ্ট থাকে—যে-চেতনা সব প্রমাণেরও সাক্ষী, সব জ্ঞানেরও উৎস, এবং সমস্ত ভুল ধারণারও অবলুপ্তিকারী।
এই স্তরে এসে অদ্বৈত দর্শনের জ্ঞানতত্ত্ব তার পূর্ণতা লাভ করে। জ্ঞান কেবল তথ্যের সংযোজন নয়, বরং পার্থক্যের সম্পূর্ণ অবসান। প্রমাণ, প্রমাতা, প্রমেয়—এই ত্রয়ী জ্ঞানের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য উপাদান হলেও, তারা সকলেই সীমাবদ্ধ চেতনার (বৃত্তি-চৈতন্য) পরিধির মধ্যে অবস্থিত। যখন আত্মা-চৈতন্য নিজের স্বরূপে প্রকাশিত হয়, তখন এই ত্রয়ী-ব্যবহার নিজেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়—কারণ সাক্ষী-চৈতন্যে কোনো বিভাজন, কোনো সম্পর্ক, কোনো জ্ঞানক্রিয়া নেই। প্রমাণ আর প্রয়োজন হয় না, কারণ জানার ও জানার যোগ্যতার সমস্ত প্রয়োজন বিলুপ্ত হয়েছে।
এই অবস্থাই প্রকৃত তত্ত্ব-জ্ঞান-উৎপত্তি—যেখানে “জ্ঞানের উদয়” মানে কোনো নতুন বস্তুর জ্ঞান নয়, বরং সমস্ত ভেদ-বুদ্ধির লয়। এখানে জ্ঞান “উৎপন্ন” হয় না, কারণ আত্মা-চৈতন্য সর্বদাই জ্যোতির্ময়। মেঘ সরে গেলে সূর্য যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি অবিদ্যা-আবরণ সরে গেলে আত্মা প্রকাশিত হয়। এই উপলব্ধিই সর্বশেষ সত্য-বোধ—যেখানে সমস্ত দর্শন, তত্ত্ব, ও ব্যাখ্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নীরবতায় মিশে যায়।
অদ্বৈত বেদান্তে বৃত্তি-চৈতন্য, আত্মা-চৈতন্য এবং সাক্ষী-চৈতন্য—এই তিনটি পরিভাষা চেতনার সূক্ষ্ম স্তরভেদকে নির্দেশ করে। শাস্ত্র এগুলির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে, চেতনা কীভাবে প্রকাশিত হয় এবং জ্ঞান কীভাবে জন্ম নেয়।
আত্মা-চৈতন্য বলতে বোঝায় চেতনার মূল, শুদ্ধ ও অপরিবর্তনীয় রূপ—যা সর্বদা উপস্থিত, সর্বব্যাপী, এবং কোনো উপাধি যেমন দেহ, মন বা ইন্দ্রিয় দ্বারা স্পর্শিত নয়। এটি সেই “চিত্”—যিনি নিজেই জ্ঞানের উৎস, কিন্তু কোনো কিছুর দ্বারা নির্ভরশীল নন। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬.১১)-এ বলা হয়েছে—
“একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা। কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতানিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নিৰ্গুণশ্চ।।”
এই শ্লোকটি ঈশ্বরের অদ্বিতীয়, সর্বব্যাপী এবং নিরুপাধিক স্বরূপকে উদ্ঘোষ করে। এখানে বলা হয়েছে, সেই একমাত্র দেব, অর্থাৎ অদ্বিতীয় পরমাত্মা সর্বভূতে গূঢ় বা প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছেন। তিনি সর্বব্যাপী এবং সর্বভূতান্তরাত্মা—সকল জীবের অন্তরতম আত্মা। তিনি কর্মাধ্যক্ষ, অর্থাৎ সকল কর্মের ফলদাতা ও নিয়ন্তা; সর্বভূতানিবাস, অর্থাৎ সমস্ত জীব তাঁর মধ্যেই অবস্থান করে। তিনিই সাক্ষী, দ্রষ্টা, চেতা অর্থাৎ চৈতন্যদাতা; তিনিই কেবল, নিরুপাধিক ও নিৰ্গুণ, অর্থাৎ গুণের অতীত, একক ও শুদ্ধ।
সরলার্থে বলা যায়—তিনি অদ্বিতীয়, তবু সর্বভূতে বিরাজমান; তিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত, সকলের অন্তরাত্মা। তিনিই সকল কর্মের ফল প্রদানকারী, সকলের পালনকর্তা, চৈতন্যের মূল উৎস, নিরুপাধিক, নিৰ্গুণ ও মুক্ত সত্তা।
‘একঃ দেবঃ’—ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ‘দেবঃ’ শব্দের অর্থ জ্যোতির্ময়, কারণ ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতি এবং অন্য কোনো আলো দ্বারা আলোকিত হন না। তাই তাঁকে ‘একঃ দেবঃ’ বলা হয়েছে।
‘গূঢ়ঃ’ অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন। উপনিষদে বার বার বলা হয়েছে, ব্রহ্ম সর্বভূতের হৃদয়গুহায় লুকিয়ে আছেন। তাই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন—“দৃষ্ট নারায়ণে, দরিদ্র নারায়ণে, আর্ত নারায়ণে।” অর্থাৎ, ব্রহ্ম সৎ-অসৎ উভয় রূপেই প্রকাশমান, যদিও সৎ ব্যক্তির মধ্যেই তাঁর প্রকাশ অধিক। যেমন, নির্মল হ্রদের জলে সহজেই তলা দেখা যায়, কিন্তু ঘোলা জলে তল দেখা যায় না—তেমনি অসৎ হৃদয়ে ঈশ্বরগোপন থাকেন, আর সৎ হৃদয়ে তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হন।
‘সর্বভূতান্তরাত্মা’ মানে, ব্রহ্মই সকলের অন্তরতম সত্তা, সব কিছুর সার। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—“জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা।” দয়া মানে অহংবোধ; কিন্তু সেবা মানে পূজা—যেখানে অন্যকে ঈশ্বররূপে দেখা হয়। এইভাবেই সত্যসেবাই পূজায় রূপান্তরিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন, অন্যকে কেবল সমান ভাবলেই চলবে না, তার প্রতি শ্রদ্ধাও থাকতে হবে। তিনি দুঃখ করেছেন যে, ওই সেবা-সংস্কৃতি এককালে আমাদের জাতির ঐশ্বর্য ছিল, আজ তা বিস্মৃত হয়েছে। মূল শিক্ষা এই যে, সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন করাই সাধনার লক্ষ্য।
‘সর্বব্যাপী’ অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র বিরাজমান। এই ভাব উপলব্ধিই মা সারদার জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল—যেমন একদিন জয়রামবাটীতে কেউ ঝাঁটা ছুঁড়ে ফেললে, মা সারদাদেবী তৎক্ষণাৎ বললেন, “ওভাবে ফেললে কেন? ঝাঁটাটিকে ভালোভাবে রেখে এসো।” কারণ সেই ঝাঁটার মধ্যেও ব্রহ্ম বিদ্যমান। প্রত্যেক বস্তু, প্রত্যেক কর্মের মধ্যে সেই এক সত্তাই বিরাজমান।
‘কর্মাধ্যক্ষঃ’ মানে, তিনিই কর্মের অধিপতি ও ফলদাতা। আমরা কাজ করি, ফল ভোগ করি; কিন্তু কে সেই ফল প্রদান করেন? তিনিই বিধাতা, তিনিই কর্মের পারিশ্রমিক প্রদানকারী। যেমন শ্রমিক মজুরি পায়, তেমনি প্রতিটি কর্মফল ঈশ্বরই দান করেন।
‘সাক্ষী’ মানে যিনি শুধু দেখেন। জগতে যা-কিছু ঘটছে, তিনি তার সাক্ষী, দ্রষ্টা মাত্র। তিনি কিছুই করেন না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতে সব কিছু ঘটে। সূর্য যেমন ভালো-মন্দ উভয়কেই আলো দেয়, কিন্তু কারও ভালো বা মন্দ কর্ম সূর্যকে স্পর্শ করতে পারে না, তেমনি ব্রহ্মও নির্লিপ্ত ও অনাসক্ত।
‘চেতা’ অর্থাৎ যিনি চৈতন্য দেন। ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ বর্ণনার অতীত; তাঁকে কিছু দ্বারা নির্দিষ্ট করা যায় না। কেবল বলা যায়, তিনি শুদ্ধ চৈতন্য, আর তাঁর চৈতন্যেই জগৎ চৈতন্য লাভ করে—যেমন এক প্রদীপ থেকে অসংখ্য প্রদীপ জ্বলে ওঠে, কিন্তু মূল প্রদীপ নেভে না।
‘কেবলঃ’ শব্দের অর্থ একমাত্র বা শুদ্ধ। ব্রহ্ম ‘একমাত্র’, কারণ তাঁর দ্বিতীয় কিছু নেই। তাঁকে ‘কেবলঃ’ বলা হয়, কারণ অন্য কোনো উপাধি বা গুণ দ্বারা তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না; তিনি যা, তাই।
‘নির্গুণঃ’ মানে গুণের অতীত। সাধারণত আমরা জিনিসকে তার গুণ দ্বারা চিনি—ভালো-মন্দ, কালো-সাদা, লম্বা-বেঁটে ইত্যাদি। কিন্তু ব্রহ্ম কোনো গুণে চিহ্নিত নন, কারণ তিনিই সেই মূলসত্তা, যাঁর থেকে সব গুণের উদ্ভব। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ থেকেই সব বৈশিষ্ট্য উদ্ভূত, আর এই তিন গুণের উৎস ‘প্রকৃতি’ বা ‘মায়া’। ব্রহ্ম সেই মায়ারও অতীত—অতএব তিনি নির্গুণ, এক, চির-অপরিবর্তনীয় ও পরম চৈতন্যস্বরূপ।
যখন মন বা বুদ্ধি কোনো বস্তু, চিন্তা বা অনুভূতির রূপ গ্রহণ করে, তখন তাকে বলা হয় বৃত্তি, অর্থাৎ মানসিক তরঙ্গ। এই বৃত্তির সঙ্গে যখন আত্মা-চৈতন্য প্রতিফলিত হয়, তখন জন্ম নেয় বৃত্তি-চৈতন্য—যে-চেতনার মাধ্যমে আমরা বস্তু জানি বা অভিজ্ঞতা করি। বস্তু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মনে প্রতিফলিত হয়, মন সেই বস্তুর রূপে বৃত্তি ধারণ করে, আত্মা-চৈতন্য সেই বৃত্তিতে প্রতিফলিত হয়ে তাকে আলোকিত করে, এবং এই প্রতিফলিত চৈতন্যই আমাদের অভিজ্ঞতার রূপে প্রকাশিত হয়—যেমন “আমি ফুল দেখছি,” “আমি আনন্দিত,” “আমি ভাবছি।”
এই সম্পর্ককে সূর্য-আয়না-আলোর উদাহরণে বোঝানো হয়—সূর্য আত্মা-চৈতন্য, আয়না মন, আর প্রতিফলিত আলো হলো বৃত্তি-চৈতন্য। সূর্যের আলো আয়নায় পড়লে আয়না উজ্জ্বল হয়, এবং সেই আলো অন্য বস্তুকেও আলোকিত করে, অথচ সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থাকে।
তৃতীয় স্তর হলো সাক্ষী-চৈতন্য—যিনি মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়ের সমস্ত পরিবর্তনকে দেখেন, কিন্তু কখনও তাতে অংশগ্রহণ করেন না। এটি আত্মারই আরেক নাম, যখন তাকে দ্রষ্টা বা সাক্ষী রূপে বোঝানো হয়। মনের মধ্যে যখন চিন্তা, সুখ বা দুঃখ উদয় হয়, তখন সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী-চৈতন্য সব কিছু জানেন, কিন্তু নিজে অচঞ্চল থাকেন।
গীতার (২.১৪) “মাত্রাস্পর্শাস্তু কাউন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ” শ্লোকটি এখানে প্রাসঙ্গিক। এর তাৎপর্য হলো—সুখ ও দুঃখ, শীত ও উষ্ণতার মতো সমস্ত দ্বন্দ্ব বা অভিজ্ঞতা ইন্দ্রিয় ও তাদের বিষয়ের পারস্পরিক সংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন, কিন্তু আত্মা তার ঊর্ধ্বে। “মাত্রা” মানে ইন্দ্রিয়, আর “স্পর্শ” মানে তাদের সংযোগ। যখন ইন্দ্রিয় বাহ্য জগতের বস্তু ছোঁয়, তখন মন আনন্দ বা বেদনা অনুভব করে। কিন্তু এই অনুভব কেবল মন ও ইন্দ্রিয়ের স্তরে ঘটে—চেতনার অন্তরস্থ স্বরূপে নয়।
অদ্বৈত দৃষ্টিতে, এই শ্লোকটি মানুষকে শিক্ষা দেয়—সুখ বা দুঃখ কোনো বাস্তব বা স্বতন্ত্র সত্য নয়; তারা কেবল অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট আপাত-অভিজ্ঞতা, যেমন গরম বা ঠান্ডার অনুভব দেহে সীমাবদ্ধ, আত্মায় নয়। আত্মা তো সর্বদা অচল, অদ্বিতীয়, চিদানন্দরূপ; সে ইন্দ্রিয়ের পরিবর্তনে প্রভাবিত হয় না। যিনি এই ভেদ বোঝেন, তিনি জানেন—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সেই চেতনা, যা ইন্দ্রিয় ও মন উভয়কেই আলোকিত করছে।”
যেমন কেউ গরম বা ঠান্ডা জল ছোঁয়, দেহে প্রতিক্রিয়া ঘটে, কিন্তু জানে—“আমি এই দেহ নই, আমি তা দেখছি মাত্র।” ঠিক তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ বা দুঃখের অভিজ্ঞতাকেও কেবল দেখে যান, তাতে জড়িয়ে পড়েন না। তাঁর মধ্যে তখন জ্ঞানের স্থিতি জন্ম নেয়—“দ্রষ্টা দ্রশ্যাতীত,” অর্থাৎ, আমি দর্শক, অনুভব নয়। এই অবস্থাই স্থিতপ্রজ্ঞার সূচনা, যা পরে সম্পূর্ণ আত্মসাক্ষাৎকারে পরিণত হয়।
অদ্বৈতের ভাষায়, এই উপলব্ধিই মায়া-ভঙ্গের সূচনা। সুখ-দুঃখের সীমিত অভিজ্ঞতার বাইরে আত্মা চির-অবিকৃত, “অচল” ও “অদ্বিতীয়”—যিনি কোনো পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত নন, বরং যাঁর উপস্থিতিতেই সমস্ত পরিবর্তন সম্ভব। শ্লোকটি তাই কেবল সহিষ্ণুতার উপদেশ নয়; এটি আত্মানুভূতির আহ্বান—ইন্দ্রিয়ের ওঠানামার বাইরে সেই অচঞ্চল ব্রহ্মস্বরূপ আত্মাকে চিনে নেওয়ার শিক্ষা।
এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়—আপনি সিনেমা দেখছেন, চিত্রপটে কত রং, শব্দ ও ঘটনা পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু পর্দা অপরিবর্তিত। সেই অচঞ্চল পর্দাই সাক্ষী-চৈতন্য, আর সিনেমার নানান দৃশ্য হলো বৃত্তি-চৈতন্যের খেল।
আত্মা-চৈতন্য, বৃত্তি-চৈতন্য ও সাক্ষী-চৈতন্য—এই তিনটি আসলে এক বাস্তবতার তিনটি ভিন্ন প্রকাশ। আত্মা-চৈতন্য সর্বদা স্থির, বৃত্তি-চৈতন্য তার প্রতিফলন, আর সাক্ষী-চৈতন্য তার পর্যবেক্ষণধর্মী রূপ। মুক্তি মানে এই বোঝা—আমি কোনো বৃত্তি নই, আমি সেই সাক্ষী, যে সব বৃত্তিকে জানে, কিন্তু নিজে কখনও বদলায় না। শাস্ত্র তাই ঘোষণা করে—“দ্রষ্টা দ্রশ্যভেদে মিথ্যা বোধঃ, সাক্ষী চৈতন্যং একমেব সত্যম্।” অর্থাৎ, দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ভেদ ভ্রমমাত্র; একমাত্র সত্য সেই সাক্ষী-চৈতন্য—যিনি সব কিছুকে আলোকিত করেন।
এই জগতের দ্রষ্টা (আমি) এবং দৃশ্য (জগৎ)-এর মধ্যে যে দ্বৈততা বা পার্থক্য প্রতীয়মান হয়, তা আসলে অজ্ঞানতা (মায়া)-জনিত একটি ভ্রান্ত ধারণা। একমাত্র সেই সাক্ষী-চৈতন্যই (যা কোনো ভেদের দ্বারা প্রভাবিত হয় না) এক এবং অদ্বিতীয় সত্য।
অদ্বৈতের পূর্ববর্তী সমস্ত তত্ত্ব—বিবর্ত-বাদ (মায়াময় প্রক্ষেপণ), অজাত-বাদ (অসৃষ্ট বিশ্ব), প্রতিবিম্ব-বাদ (প্রতিফলিত চৈতন্য) এবং অবচ্ছেদ-বাদ (বিচ্ছেদের আপাত-রূপ)—সবই এই নীরব চেতনার মধ্যে মিলিত হয়। তারা যেন একই সূর্যের আলাদা আলাদা রশ্মি—প্রত্যেকটি একটি দিক থেকে সত্য, কিন্তু পূর্ণ আলোক প্রকাশ কেবল তখনই যখন সব মিলিয়ে এক অখণ্ড জ্যোতিতে পরিণত হয়।
এই উপলব্ধ আত্মা-সত্তা, যাকে বলা হয় জীবন্মুক্ত, তার দৃষ্টিতে জগত আর বন্ধনের ক্ষেত্র নয়; এটি এক প্রপঞ্চ, এক মরীচিকা, এক নৃত্য—যা বোঝার জন্য, পালানোর জন্য নয়। যেমন কেউ স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে এবং বোঝে যে, স্বপ্ন ছিল নিজের মনই, তেমনি জীবন্মুক্ত বোঝেন যে, সমস্ত প্রপঞ্চ তাঁরই চেতনার প্রকাশ।
তিনি আর কর্তা নন—কারণ কোনো পৃথক করণকারী নেই। তিনি কেবল সাক্ষী, যিনি নিজের প্রকৃতিতে অবিচল থেকে সকল কর্ম সম্পন্ন হতে দেখেন। তাঁর কাজের মধ্যে লোকসংগ্রহ থাকে—অর্থাৎ, অন্যদের জাগরণের জন্য সহজ স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতি। তাঁর মধ্যে কোনো অভিপ্রায় নেই, তবুও করুণা প্রবাহিত হয়; কোনো কর্তব্য নেই, তবুও কল্যাণ ঘটে।