অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩৫



এই প্রতিফলনই জগতের আবির্ভাবের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা—একধরনের অবিদ্যা-বিবর্ত-সৃষ্টি-বাদ, যেখানে সৃষ্টি কোনো বাস্তব উৎপত্তি নয়, বরং ব্রহ্মের চৈতন্যে অবিদ্যা-প্রতিফলিত এক কসমিক মায়া। ব্রহ্ম নিজে কখনোই পরিবর্তিত হন না; তিনি চিরনির্মল, নির্লেপ ও স্বপ্রকাশ। কিন্তু অবিদ্যার দুই শক্তি—বিক্ষেপশক্তি (যা নাম ও রূপের বৈচিত্র্য রচনা করে) এবং আবরণশক্তি (যা সেই বৈচিত্র্যের আড়ালে একত্বকে গোপন করে)—এই অপরিবর্তনীয় চৈতন্যেই ক্রিয়াশীল বলে প্রতীয়মান হয়।

ফলে, নাম ও রূপ, জীব ও ঈশ্বর, কারণ ও কার্য—সবই কেবল ব্রহ্মের সেই এক চৈতন্য-সত্তার প্রতিফলনমাত্র। যেমন সূর্য আয়নায় প্রতিফলিত হলে অসংখ্য সূর্যের মতো দেখা যায়, অথচ বাস্তবে সূর্য এক ও অবিভাজ্য, তেমনি ব্রহ্মও বহু জীবরূপে প্রতীয়মান হলেও স্বরূপে এক ও অদ্বিতীয়।

এই প্রতিফলনেই জগৎ আপাতভাবে “অস্তিত্বে” আসে, তবুও সেই অস্তিত্ব কেবল ব্যাবহারিক (ব্যবহারবাহ্য)—অর্থাৎ অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য, কিন্তু পরমার্থত সত্য নয়। কারণ জ্ঞানের প্রভায় এই প্রতিফলন লুপ্ত হলে অবশিষ্ট থাকে কেবল ব্রহ্ম—এক, চিরন্তন, অচল, স্বয়ং-আলোকিত চেতনা।

যোগ-বাশিষ্ঠ প্রবর্তিত দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ অদ্বৈত বেদান্তের এক সূক্ষ্ম ও মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব, যার মূল বক্তব্য—“দৃষ্টি ও সৃষ্টি এক।” অর্থাৎ, জগৎ কোনো বাহ্য বাস্তব সত্তা নয়; এটি চেতনার প্রতিফলনে, উপলব্ধির ভেতরেই উদ্ভূত ও লয়প্রাপ্ত হয়। এখানে দৃষ্টি মানে চেতনার ক্রিয়া বা উপলব্ধি, আর সৃষ্টি মানে সেই উপলব্ধির ফলত প্রকাশ। এই দুইটি কখনও পৃথক নয়—দেখা মানেই সৃষ্টি, উপলব্ধিই অস্তিত্ব।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যখন স্বপ্ন দেখেন—একটি নগরী, মানুষ, আকাশ, নদী, ঘটনা—সবই তখন আপনার কাছে বাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু জেগে ওঠার পর আপনি জানেন, সেই সবই ছিল আপনার নিজের চেতনার কল্পনা; কোনো বাহ্য বাস্তব বস্তু তখনও ছিল না। তবু স্বপ্নের মুহূর্তে সেই জগৎ সম্পূর্ণ বাস্তব মনে হয়েছিল, কারণ তখন “দৃষ্টি” ও “সৃষ্টি” ছিল অভিন্ন। ঠিক তেমনই, জাগ্রত অবস্থার এই দৃশ্যমান জগৎও চেতনার এক চলমান স্বপ্ন; প্রতিক্ষণ তা চেতনার দৃষ্টিতে সৃষ্টি হয়, প্রতিক্ষণই বিলীন হয়। মহাবিশ্ব কোনো স্থির সত্তা নয়—এটি চেতনারই অবিরাম প্রতিফলন, এক অন্তহীন দৃষ্টি-সৃষ্টি-চক্র।

এই দৃষ্টিতে অবিদ্যা কোনো পৃথক বা অতীত কারণ নয়; এটি প্রতিটি অভিজ্ঞতার অন্তঃস্থ আচ্ছাদন—চেতনা যখন নিজেকে কোনো সীমিত রূপে উপলব্ধি করে, তখনই সেই সীমাবদ্ধ উপলব্ধিই এক ক্ষণস্থায়ী সৃষ্টি হয়ে ওঠে। যেমন কেউ অন্ধকারে রশিকে সাপ বলে ভুল করেন, সেই মুহূর্তে সাপ বাস্তব হয়ে ওঠে তাঁর চেতনায়; কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে ভ্রম লুপ্ত হয়। এখানেই দেখা যায়—অবিদ্যা কোনো স্থায়ী শক্তি নয়, বরং প্রতিক্ষণই জ্ঞানের অভাব বা বিকৃত প্রতিফলনমাত্র। জগৎও তেমনই, চেতনার প্রতিফলনে প্রতিনিয়ত অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আবার জ্ঞানের আলোয় বিলীন হয়।

এই ধারণাকে শ্রী সুরেশ্বর ও প্রকাশাত্মন তাঁদের সন্নিধান-বাদ-এ আরও গভীরভাবে একত্রিত করেছেন। তাঁরা বলেন—অবিদ্যা ব্রহ্মের অন্তর্গত নয়, কারণ ব্রহ্ম চিরশুদ্ধ, অপরিবর্তনীয় ও কলঙ্কহীন; আবার অবিদ্যা ব্রহ্মের বাইরেও নয়, কারণ ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নেই। অবিদ্যা কেবল ব্রহ্মের সান্নিধ্যে প্রকাশিত হয়, যেমন আলোর সংলগ্নতায় ছায়া দৃশ্যমান হয়। আলো ছায়াকে সৃষ্টি করে না, কিন্তু তার উপস্থিতি ছাড়া ছায়াও ধরা পড়ে না। তেমনি চেতনা অবিদ্যার উৎপাদক নয়, কিন্তু তার সান্নিধ্য ছাড়া অবিদ্যার প্রতীতি সম্ভব নয়।

এই উদাহরণে আলো হলো চেতনা, ছায়া হলো অবিদ্যা। আলো যেমন ছায়ায় কলঙ্কিত হয় না, তেমনি চেতনা অবিদ্যার স্পর্শেও অমলিন থাকে। এই দৃষ্টিকোণেই অদ্বৈত বেদান্ত তার চূড়ান্ত সত্য উন্মোচিত করে—জগৎ কোনো স্বতন্ত্র বাস্তবতা নয়; এটি চেতনারই অন্তর্গত প্রতিফলন। আপনি যা দেখছেন, তা আপনি নিজেই সৃষ্টি করছেন; আর যে চেতনা দিয়ে আপনি দেখছেন, সেই চেতনার বাইরেই কিছু নেই। দৃষ্টি ও সৃষ্টি—জ্ঞান ও অস্তিত্ব—এ দুটোই শেষপর্যন্ত এক, এবং সেই একত্বের নামই ব্রহ্ম।

এই দৃষ্টিভঙ্গি ভামতী ও বিবরণের মধ্যে একটি জীবন্ত সেতু রচনা করে। ভামতী যখন বলে, অভিজ্ঞতার দিক থেকে অবিদ্যা জীবের মধ্যে, এবং বিবরণ বলে, চূড়ান্ত দৃষ্টিতে অবিদ্যা ব্রহ্মে প্রতীয়মান—তখন সন্নিধান-বাদ তাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে এটাই বলে যে, উভয়ই আপাতদৃষ্টিতে সত্য। ব্যাবহারিক প্রমাণের স্তরে অবিদ্যা ব্যক্তিগত মনে হয়, কারণ অভিজ্ঞতা মনস্তাত্ত্বিক; কিন্তু পারমার্থিক স্তরে, যেখানে একমাত্র ব্রহ্মই সত্তা, অবিদ্যা কেবল তাঁরই প্রতিফলন হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। এই দুই দৃষ্টির মিলনই তাদাত্ম্য-সম্বন্ধ—অর্থাৎ, আপাত-অভিন্নতা, যা বাস্তবে এক অধিষ্ঠানে বিলীন হয়।

তাদাত্ম্য-সম্বন্ধ শব্দটির অর্থই হলো “স্বরূপগত ঐক্য” বা “অস্তিত্বের অভিন্নতা”—অর্থাৎ এমন সম্পর্ক, যেখানে দুটি সত্তা আলাদা বলে মনে হলেও বাস্তবে তারা এক, অবিচ্ছেদ্য ও একই সত্তার ভিন্ন প্রকাশমাত্র। এটি অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম মৌলিক ধারণা, যা জীব, জগৎ ও ব্রহ্মের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়।

শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—“তৎ” মানে ‘ওই’ (ব্রহ্ম বা পরম সত্য), আর “আত্ম্য” মানে ‘আত্মা’ বা নিজস্ব স্বরূপ। তাই “তাদাত্ম্য” মানে “ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার একাত্মতা”—যেখানে আত্মা ও ব্রহ্ম, জ্ঞাতা ও জ্ঞান, কার্য ও কারণ—সবই একই চেতনার বিভিন্ন প্রতিফলন।

এটি বোঝাতে প্রাচীন ঋষিরা উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার—কুণ্ডল (পুরুষ ও নারী উভয়েরই কানে পরার গহনা), মাকড়ি (নারীদের কান-ফুল), আংটি—সবই দেখতে আলাদা, কিন্তু পদার্থত এক; এদের রূপ বদলায়, কিন্তু উপাদান অপরিবর্তিত থাকে। অলঙ্কারের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে স্বর্ণের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু স্বর্ণের অস্তিত্ব কোনো অলঙ্কারের উপর নির্ভর করে না। তেমনি, জগৎ নানা রূপে প্রকাশিত হলেও, তার মূলে রয়েছে এক অভিন্ন চেতনা—ব্রহ্ম।

ঠিক তেমনি আরেক উদাহরণ হলো মাটি ও মাটির পাত্র। পাত্র ভেঙে যায়, কিন্তু মাটি নষ্ট হয় না; পাত্রের সব রূপ আসলে মাটিরই রূপ। এই সম্পর্কই তাদাত্ম্য-সম্বন্ধ—যেখানে কার্য কারণ থেকে আলাদা নয়, বরং কারণেরই একটি রূপান্তর।

উপনিষদ এই সত্য প্রকাশ করেছে—“তৎ ত্বমসি শ্বেতকেতো” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)। অর্থাৎ, “হে শ্বেতকেতু, তুই সেই পরম সত্যই।” এখানে ‘তৎ’ (ব্রহ্ম) এবং ‘ত্বম্‌’ (জীব) আলাদা মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে তাদাত্ম্য আছে—জীব ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়, বরং ব্রহ্মেরই প্রতিফলন। যেমন সূর্যের প্রতিফলন ছোট্ট জলের পাত্রে সীমাবদ্ধ মনে হলেও তার আলো আসলে সূর্যেরই অংশ, তেমনি জীবসত্তা ব্রহ্মচেতনারই প্রতিফলন।

ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-এ বলা হয়েছে—“তাদাত্ম্যপদার্থঃ প্রত্যয়াদিব্যপদেশাৎ।” অর্থাৎ, শাস্ত্র যখন বলে, “সবই ব্রহ্ম”, তখন তা তাদাত্ম্য-সম্বন্ধের ভিত্তিতে বলা—কারণ বাহ্যভেদ নামমাত্র, সত্তায় এক। শঙ্করাচার্য এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “যেমন ঘট (পাত্র) মাটির থেকে ভিন্ন নয়, তেমনি জগৎও ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন নয়।”

তাদাত্ম্য-সম্বন্ধ তাই দেখায়, কার্য কখনও কারণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; জগৎ, জীব, ঈশ্বর—সবই এক পরম সত্তার প্রকাশ। এই উপলব্ধির পর জীব আর নিজেকে সীমিত বলে মনে করতে পারে না, কারণ সে বুঝে যায়—যে-চেতনা আমার মধ্যে, সেই চেতনা সর্বত্র। নদী যেমন সাগরে গিয়ে নিজের নাম হারায়, তেমনি জীবও ব্রহ্মে মিলিত হয়ে জানে—“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি-ই সেই ব্রহ্ম।

এই উপলব্ধিই তাদাত্ম্য-সম্বন্ধের চূড়ান্ত অর্থ—সকল ভেদ ঘুচে, সব নাম-রূপ মিলিয়ে, একমাত্র চেতনার জ্যোতিই সর্বত্র উদ্‌ভাসিত।

এই বিশ্লেষণগুলো কেবল তত্ত্বের অনুশীলন নয়; এগুলির উদ্দেশ্য অদ্বৈত দর্শনের সংগতি রক্ষা করা। কারণ যদি অবিদ্যা সত্যিই ব্রহ্মে অবস্থান করে, তবে ব্রহ্মের শুদ্ধতা নষ্ট হয়; আবার যদি তা সম্পূর্ণ বাইরে থাকে, তবে ব্রহ্মের সর্বব্যাপিত্ব ভঙ্গ হয়। তাই পরবর্তী আচার্যরা দেখিয়েছেন, অবিদ্যা ব্রহ্মের মধ্যে নয়, ব্রহ্মের নিকটে প্রতীয়মান—চেতনার সান্নিধ্যে, তার আলোয় প্রতিফলিত ছায়ার মতো।

অবশেষে এই সমস্ত তাত্ত্বিক পার্থক্য আত্ম-দর্শনের আলোয় ম্লান হয়ে যায়। যখন অপরোক্ষ-অনুভূতি বা আত্ম-সাক্ষাৎকার ঘটে, তখন বোঝা যায় যে, এই বিতর্কগুলো কেবল শিক্ষণীয় অধ্যারোপ—অজ্ঞানতার ছায়া ভাঙার জন্য তোলা প্রশ্ন। জ্ঞানের সূর্য উদিত হলে অবিদ্যা-আশ্রয়, আবরণ, বিক্ষেপ—সবই বিলীন হয়, এবং আত্মা-চৈতন্য একাকী জ্বলে ওঠে—অসীম, অদ্বিতীয়, আশ্রয়হীন, অবিদ্যা-র প্রতিটি সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানতত্ত্বের মূল সূত্রটি এই উপলব্ধির মধ্যে নিহিত যে, “জ্ঞান” কখনোই মনের নিজস্ব সৃষ্টি নয়—এটি চৈতন্যের (সাক্ষী-চৈতন্য) প্রতিফলনমাত্র। প্রতিটি অভিজ্ঞতা—যথার্থ জ্ঞান (প্রমা) হোক বা ভুল ধারণা (বিপর্যয়)—মনের (অন্তঃকরণ) উপর চেতনার আলো পড়ার ফল। তাই জ্ঞানের সত্যতা বা মিথ্যা বস্তুগত জগতে কোনো পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে বুদ্ধির সঙ্গে চৈতন্যের সম্পর্ক কতটা নির্মলভাবে ঘটছে, তার উপর।

জ্ঞানের মাধ্যম বা প্রমাণ তিনটি—প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শ্রুতি—যা একত্রে প্রমাণ-ত্রয় নামে পরিচিত। প্রত্যক্ষ, বা ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধি, ইন্দ্রিয় ও মনসের সংযোগে ঘটে। বস্তু দেখা, স্পর্শ করা, শোনা—এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধিই আমাদের জ্ঞানের প্রথম স্তর। কিন্তু দড়িকে সাপ বলে ভুল করা (রজ্জু-সর্প-দৃষ্টান্ত) প্রমাণ করে যে, প্রত্যক্ষও ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। কারণ অবিদ্যার আবরণ-শক্তি প্রকৃত অধিস্থান (দড়ি) আড়াল করে ফেলে, আর বিক্ষেপ-শক্তি তার উপর মিথ্যা চেহারা (সাপ) প্রক্ষেপণ করে। ফলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানও অবিদ্যা দ্বারা বিকৃত এবং তার ভিত্তি মিথ্যা বা মায়াময়।

দ্বিতীয় প্রমাণ অনুমান, যা যৌক্তিক সম্পর্ক বা ব্যাপ্তির উপর নির্ভর করে। যেমন ধোঁয়া দেখে আগুন অনুমান করা হয়। কিন্তু অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, অনুমান সর্বদা অভিজ্ঞতার সীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। কারণ কারণ ও ফল উভয়ই অনির্বচনীয় (বর্ণনীয় নয়), তাই অনুমান পারমার্থিক সত্যে পৌঁছাতে পারে না। এটি ব্যাবহারিক সত্তার জগতে সত্য, কিন্তু পরম সত্যকে উদ্‌ভাসিত করতে পারে না।

তৃতীয় ও সর্বোচ্চ প্রমাণ হলো শ্রুতি বা বেদান্তের বাক্য—যা অভিজ্ঞতা ও যুক্তির সীমা অতিক্রম করে সরাসরি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে। মহাবাক্য “তৎ ত্বম্ অসি”—“তুমিই সেই”—লক্ষণ-বৃত্তির মাধ্যমে আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা প্রকাশ করে। এখানে ভাষা ব্যবহার হয় গোপন করা পার্থক্য সরিয়ে দেওয়ার জন্য, সৃষ্টি করার জন্য নয়। এই শ্রুতি-প্রমাণই একমাত্র পারমার্থিক স্তরে সত্য।

অদ্বৈতের সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি হলো যে, অনুপস্থিতিও জ্ঞানের একটি রূপ। যখন কেউ বলে, “এখানে পাত্র নেই”, তখন সে অন্ধকার নয়, বরং উপস্থিত চৈতন্যের আলোকেই সেই অনুপস্থিতিকে উপলব্ধি করে। এই অভাব-প্রমাণ দেখায় যে, চৈতন্য এমনকি অস্বীকৃতির মধ্যেও প্রকাশিত থাকে—আত্মা-প্রকাশ সর্বত্র বিরাজমান। চিত্‌ কখনও অনুপস্থিত নয়; উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি উভয়েরই সাক্ষী।

এই সমস্ত প্রমাণ ও জ্ঞানের কার্যক্রমের গভীরে কাজ করে অবিদ্যা-র দুটি দোষ: আবরণ (গোপন করা) ও বিক্ষেপ (প্রক্ষেপণ করা)। আবরণ অধিস্থান বা সত্যকে আড়াল করে রাখে; বিক্ষেপ তার উপর মিথ্যা প্রতিরূপ আঁকে। শুক্তি-রজত-দৃষ্টান্তে যেমন ঝিনুকের উপর রুপার প্রক্ষেপণ হয়—এখানে আসলটি লুকিয়ে যায় এবং মিথ্যা চেহারা দেখা দেয়। যখন বাধক-জ্ঞান উদ্‌ভূত হয়—“এটি রুপা নয়, এটি ঝিনুক”—তখন আবরণ ভেঙে যায়, বিভ্রমের অবসান ঘটে।

এই যুক্তির ওপরই দাঁড়িয়েছে বাধ-বাদ, যে-মতবাদ বলে—প্রত্যেক ত্রুটি একটি উচ্চতর জ্ঞানের দ্বারা বিলোপিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো জ্ঞানকে অন্য কোনো সত্য খণ্ডন করেনি, ততক্ষণ সেটি প্রমা বা বৈধ জ্ঞান; কিন্তু যখন তা খণ্ডিত হয়, তখন সেটি অপ্রমা হয়ে যায়। এইভাবে জগৎও আপাত-সত্য—অভিজ্ঞতার স্তরে বৈধ, কিন্তু ব্রহ্ম-জ্ঞান উদয় হলে বাধিত হয়; অর্থাৎ, তার প্রামাণ্যতা বিলুপ্ত হয়।