এই চূড়ান্ত পরিণতিই বিদেহমুক্তি নামে পরিচিত, যদিও এটি কোনো ধ্বংস বা বিলয় নয়। এটি ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক লয়—যেখানে ব্যক্ত আত্মা চিরন্তন সমগ্রে মিশে যায়, যেমন নদী সাগরে প্রবেশ করে নিজের নাম হারায়, কিন্তু জলরূপেই অব্যাহত থাকে। এই অবস্থায় নেই কোনো রূপ বা নাম, নেই কারণ বা ফল, এমনকি “ঊর্ধ্বে” বা “নিম্নে”—এই ধারণাগুলিও অর্থহীন হয়ে যায়।
অবশিষ্ট থাকে কেবল এক নীরব দীপ্তি—শুদ্ধ ব্রহ্ম, যিনি কখনও জন্মগ্রহণ করেন না, কখনও বিনষ্ট হন না, এবং কখনও কোনো ক্রিয়ার অধিকারী নন। তিনি নিঃক্রিয় কিন্তু সর্বব্যাপী, নীরব কিন্তু স্বয়ং-আলোকিত। সেই ব্রহ্মই জীবের অন্তরাত্মা, সেই ব্রহ্মই জগতের অন্তর্নিহিত শক্তি, সেই ব্রহ্মই ঈশ্বর—একই সত্তা নানা রূপে উদ্ভাসিত।
এখানে এসে সব পার্থক্য, সব নীতি, সব তর্ক ও পথ থেমে যায়। বুদ্ধি নত হয়, ভাষা নিস্তব্ধ হয়, চিন্তা থেমে যায়—এবং অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই এক অচল, অনন্ত, চির-প্রশান্ত চেতনা, যা নিজের দীপ্তিতে নিজেকে প্রকাশ করে, আর যা জানার পর আর কিছু জানার থাকে না।
অবিদ্যার আশ্রয় কোথায়—এই প্রশ্নটি আপাতভাবে সহজ হলেও, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অদ্বৈত বেদান্তের গভীরতম দার্শনিক অনুসন্ধান। কারণ এই প্রশ্নই নির্ধারণ করে জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক, এবং জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি কীভাবে সম্ভব হয়।
ভামতী-প্রবাহ, যা বাচস্পতি মিশ্রের অদ্বৈত ব্যাখ্যার ধারা, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে। তাদের মতে, অবিদ্যা জীবের মধ্যেই অবস্থান করে—এই জীব মানে সেই চৈতন্য, যা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ বলে মনে করে। অর্থাৎ, অবিদ্যা কোনো বাহ্যিক শক্তি নয়; এটি সেই অভ্যন্তরীণ ভ্রান্তি, যার ফলে আত্মা নিজেকে দেহ-মন হিসেবে চেনে।
তাই জীবই অবিদ্যার আশ্রয়, কারণ জীবই হলো সমস্ত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র—যেখানে জ্ঞান, অজ্ঞান, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিক্রিয়া ঘটছে। এই দৃষ্টিতে অবিদ্যা ব্যষ্টিগত, অর্থাৎ প্রত্যেক জীবের নিজস্ব অজ্ঞান আছে, যা তার মানসিক প্রবণতা ও অভিজ্ঞতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই ব্যাখ্যা ব্রহ্মের শুদ্ধতা ও অপরিবর্তনীয়তা বজায় রাখে। যদি ব্রহ্ম সত্যিই সর্বশুদ্ধ, সর্বব্যাপী ও স্বপ্রকাশ চৈতন্য হন, তবে তাঁর মধ্যে কোনো অজ্ঞানতা প্রবেশ করতে পারে না। আলোয় যেমন অন্ধকারের স্থান নেই, তেমনি ব্রহ্মে অবিদ্যার অস্তিত্ব নেই। তাই অবিদ্যা কেবল জীবের স্তরে কার্যকর, যেখানে চেতনা মনের প্রতিবিম্বে প্রতিফলিত হয়।
এই অবস্থায় মুক্তি মানে কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন নয়; বরং জীবের অন্তরে জ্ঞানোদয়—এক মানসিক জাগরণ। যখন চেতনা বুঝতে পারে যে, “আমি দেহ নই, মন নই, আমি শুদ্ধ ব্রহ্ম”—তখন অজ্ঞানতার পর্দা সরে যায়। এই জাগরণই অবিদ্যার বিলয়, আর সেখানেই শুরু হয় প্রকৃত মুক্তি।
অন্যদিকে, পদ্মপাদাচার্য প্রবর্তিত বিবরণ শাখা এই প্রশ্নে আরও সূক্ষ্ম ও অধিবিদ্যাগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। তাদের মতে, যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র পরমসত্তা, এবং তাঁর বাইরে কোনো স্বতন্ত্র বাস্তবতা নেই, তাই অবিদ্যারও কোনো আলাদা আশ্রয় থাকা সম্ভব নয়। অবিদ্যা কেবল ব্রহ্মের উপর আরোপিত (অধ্যাসিত)—তাঁর স্বরূপে নয়, তাঁর উপাধিমাত্রে প্রতীয়মান। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ব্রহ্ম সত্যিই অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন বা পরিবর্তিত হন; এটি কেবল এক প্রতিফলন বা আপাত-প্রকাশের প্রক্রিয়া, যেমন বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—যেমন স্বচ্ছ স্ফটিক একটি লাল ফুলের পাশে রাখলে নিজেই লালচে দেখায়, অথচ আসলে তার স্বচ্ছতা অক্ষুণ্ণ থাকে; তেমনি ব্রহ্মও অবিদ্যা-উপাধির সংস্পর্শে সীমাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান হন, কিন্তু নিজের শুদ্ধ, অস্পৃষ্ট স্বরূপে অপরিবর্তিত থাকেন। এই দৃষ্টিতে অবিদ্যা আর কেবল মানসিক বিভ্রান্তি নয়; এটি এক মহাজাগতিক নীতি—মায়া, যা ঈশ্বর-সত্তার সৃজনশক্তি হিসেবে সমগ্র প্রপঞ্চের কারণ।
অদ্বৈত বেদান্তে অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার আশ্রয় নিয়ে ভামতী ও বিবরণ—এই দুই শাখার মধ্যে যে-পার্থক্য, তা কেবল দার্শনিক অবস্থানের নয়; এটি আত্মা, জগৎ ও মুক্তির সম্পর্ক-সংক্রান্ত দুটি ভিন্ন আভ্যন্তরীণ দর্শনচিন্তার প্রতিফলন। উভয়ই শঙ্করাচার্যের মূল শিক্ষার অনুসারী, তবু ব্যাখ্যার সূক্ষ্মতার স্তরে তাদের অবস্থান ভিন্ন।
ভামতী শাখা (বাচস্পতি মিশ্র প্রবর্তিত) অবিদ্যার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে। তাদের মতে, অবিদ্যা ব্যক্তিগত—এটি জীবের অন্তঃকরণ বা বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত। আত্মা নিজে শুদ্ধ চৈতন্য, কিন্তু সেই চৈতন্য যখন মন-বুদ্ধি-অহং-এর প্রতিবিম্বে প্রতিফলিত হয়, তখন “আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি সুখী বা দুঃখী”—এই ভ্রান্ত আত্মবোধ জন্ম নেয়। এই প্রতিফলিত চৈতন্যই “চিদাভাস” নামে পরিচিত, এবং এই প্রতিফলনের আয়নাই অবিদ্যার ক্ষেত্র।
“চিদাভাস” শব্দটি ভারতীয় দর্শনে—বিশেষত অদ্বৈত বেদান্ত ও যোগ দর্শনে—চেতনার রহস্য উন্মোচনের এক সূক্ষ্ম প্রতীক। শব্দটি দুটি উপাদানে গঠিত—“চিৎ”, অর্থাৎ পরম চেতনা বা জ্ঞান, এবং “আভাস”, অর্থাৎ ছায়া, প্রতিফলন, বা প্রতিচ্ছবি। অতএব, “চিদাভাস” মানে সেই প্রতিফলিত চেতনা, যা সীমিত মন-উপাধির আয়নায় অসীম ব্রহ্মের এক ক্ষণস্থায়ী দীপ্তি হয়ে উদ্ভাসিত হয়।
যখন পরমচৈতন্য বা ব্রহ্ম অন্তঃকরণে (মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহং) প্রতিফলিত হয়, তখন সেই প্রতিফলিত চৈতন্যকেই বলা হয় চিদাভাস। এটি যেন অসীম আকাশের আলো কোনো ক্ষুদ্র জলাশয়ে পড়ে ক্ষণিক কম্পন সৃষ্টি করছে—আলো আকাশেরই, কিন্তু প্রতিফলনটি সীমিত। ব্রহ্ম চির-নির্মল, অপরিবর্তনীয়; কিন্তু তাঁর এই প্রতিফলন, মন নামক সূক্ষ্ম দেহে প্রতিফলিত হয়ে, নিজের সত্য সত্তাকে ভুলে সীমিত সত্তা—“আমি”—রূপে প্রতীয়মান হয়। এই প্রতিফলিত চৈতন্যই সুখ-দুঃখ ভোগ করে, কর্মের দায় গ্রহণ করে, এবং অহংকারে জড়িয়ে পড়ে। এখানেই শুরু হয় জীবত্বের নিত্য নাটক।
এই তত্ত্ব বোঝাতে প্রাচীন আচার্যরা সূক্ষ্ম রূপক ব্যবহার করেছেন—যেমন সূর্য, জল, আর সূর্যের প্রতিবিম্ব। সূর্য হলেন ব্রহ্ম, জল হলো অন্তঃকরণ, আর জলে প্রতিফলিত সূর্য হলো চিদাভাস। সূর্য অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু জলের কম্পনে প্রতিবিম্ব নড়ে বলে মনে হয়। ঠিক তেমনি, মন চঞ্চল হলে চেতনার প্রতিফলনও বিচলিত বলে প্রতীয়মান হয়, অথচ পরমচৈতন্য চিরস্থির, অচল ও অদ্বিতীয়।
জীব যখন নিজেকে এই প্রতিফলনের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে, তখনই সে বন্ধনের ভেতরে প্রবেশ করে। মুক্তি মানে এই ভ্রান্তি ভেদ করে প্রতিফলনের পেছনের সত্য আলোকসত্তাকে—অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মচৈতন্যকে—নিজস্ব স্বরূপ হিসেবে চিনে নেওয়া।
এই “চিদাভাস”-তত্ত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত দুটি মৌলিক ধারণা হলো কারণ শরীর (Causal Body) ও অহংকার (Ego)।
কারণ শরীর হচ্ছে সেই সূক্ষ্মতম পর্দা, যেখানে চেতনার প্রতিফলন প্রথম গঠিত হয়। এটি অবিদ্যা বা মায়ার নিঃশব্দ স্তর—সুপ্ত বাসনা, কর্মফল ও সংস্কারের আধার। এই কারণ শরীরেই পরমচৈতন্যের প্রথম প্রতিফলন ঘটে, যা চিদাভাস নামে পরিচিত। গভীর নিদ্রার অবস্থায় জীব এই কারণ শরীরে অবস্থান করে—সেখানে জ্ঞান বা অজ্ঞান কিছুই সক্রিয় নয়, কেবল সুপ্ত আনন্দের বীজ রয়ে যায়।
অন্যদিকে, অহংকার সেই মানসিক শক্তি, যা চিদাভাসকে সীমিত করে “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা”—এই ভ্রম সৃষ্টি করে। চিদাভাস যখন মন ও বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তার প্রতিফলন বিকৃত হয়ে ব্যক্তিগত ‘আমি’-বোধের জন্ম দেয়। এভাবেই পরমচৈতন্য, প্রতিফলনের সীমাবদ্ধতায়, নিজেকে ছোটো, পরিবর্তনশীল, দুঃখভোগী বলে ভুল করে। অহংকারের এই মিথ্যা অভিব্যক্তিই জীববন্ধনের কারণ—যেখানে চেতনা নিজের দীপ্তিকে বস্তুসত্তায় স্থানান্তরিত করে।
কারণ শরীর হলো চিদাভাসের নিঃশব্দ আশ্রয়—চেতনার সম্ভাবনার বীজ, আর অহংকার হলো সেই প্রতিফলনের বিকৃত প্রকাশ—যেখানে ব্রহ্ম ভুল করে নিজেকে জীব মনে করে। এই দুই স্তরের মধ্যেই অবিদ্যা কার্যকর; এবং এই বিভ্রমের অন্তরালেই সত্যের পরম প্রতিফলন জ্বলে—অবিচ্ছিন্ন, স্বপ্রকাশ, অদ্বিতীয় ব্রহ্মরূপে। যখন জীব বুঝতে পারে, “আমি এই প্রতিফলন নই, আমি সেই আলো”—তখন সমস্ত বন্ধন গলে যায়, এবং চিদাভাস নিজেই আত্মবোধের সূর্যে লীন হয়।
ভামতী শাখা বলে—অবিদ্যা জীবাশ্রয়ী, অর্থাৎ জীবের মধ্যেই তার স্থান; কারণ অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, শোক, মোহ সবই জীব-চেতনার স্তরে ঘটে। মুক্তি তাই এখানে এক মনস্তাত্ত্বিক রূপান্তর—যখন বুদ্ধি আত্মজ্ঞান-বৃত্তিতে উদ্ভাসিত হয়, তখন অজ্ঞানতার আবরণ ভেদ করে আত্মা নিজের চির-শুদ্ধ স্বরূপে প্রকাশিত হয়। মুক্তি মানে নতুন কোনো সত্তার অর্জন নয়, বরং অন্তরে অন্ধকারের অপসারণ। এই দৃষ্টিতে, অবিদ্যা এক “ব্যষ্টি” বা ব্যক্তিগত বাস্তবতা।
অন্যদিকে, বিবরণ শাখা (পদ্মপাদাচার্য প্রবর্তিত) অবিদ্যাকে মানসিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখে না; তারা তাকে ব্রহ্মের মহাজাগতিক প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যা করে। তাদের মতে, যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র পরমসত্তা—চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও অদ্বিতীয়—তাই তাঁর বাইরে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা বা চেতনার ক্ষেত্র থাকতে পারে না। অবিদ্যা তাই কোনো জীবের সম্পত্তি নয়; এটি ব্রহ্মচেতনার উপর আপাতভাবে আরোপিত এক প্রক্ষেপণ—যেমন স্বচ্ছ স্ফটিক একটি লাল ফুলের পাশে লালচে দেখায়, অথচ নিজে রং ধারণ করে না।
এই দৃষ্টিতে ব্রহ্ম কখনও অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন হন না; অবিদ্যা কেবল তাঁর মায়াশক্তি—এক কসমিক সম্ভাবনা, যার মধ্য দিয়ে নাম ও রূপের বহুত্ব প্রকাশিত হয়। ফলে অবিদ্যা এখানে সমষ্টিগত (সামষ্টিক); এটি ব্যক্তিগত মন নয়, বরং মহাজাগতিক চৈতন্যে কার্যকর। মুক্তি তাই এখানে মনোস্তাত্ত্বিক নয়, বরং অধিবিদ্যাগত—মহামায়ার বিলয়ে জগৎ ও জীব উভয়ই ব্রহ্মরূপে অবশিষ্ট থাকে।
এই দুই দৃষ্টিকোণ মুক্তির ধারণাতেও সূক্ষ্ম পার্থক্য আনে। ভামতী মতে, মুক্তি ব্যক্তিগত অন্তর-জাগরণ—যখন জীব নিজের মনের বিভ্রম থেকে জেগে ওঠে; বিবরণ মতে, মুক্তি সর্বব্যাপী উন্মোচন—যখন সমগ্র মায়া বা কসমিক অজ্ঞান বিলীন হয়। একদিকে মুক্তি মনোযোগের কেন্দ্রে (অন্তঃকরণে), অন্যদিকে মুক্তি চেতনার সমগ্র দিগন্তে (ব্রহ্মচৈতন্যে)।
তবুও, এই দুই ধারাই এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়—অবিদ্যার বিলোপে। উভয়ই স্বীকার করে যে, অবিদ্যা-নিবৃত্তি দুই ধাপে ঘটে: প্রথমে আবরণ-নিবৃত্তি, যেখানে অজ্ঞানতার পর্দা সরিয়ে যায়; পরে বিক্ষেপ-নিবৃত্তি, যেখানে নাম-রূপের প্রক্ষেপণ থেমে যায়। এবং, উভয়েরই এক ও একমাত্র কারণ ব্রহ্মজ্ঞান—যা কোনো নতুন কিছু সৃষ্টি করে না, বরং কেবল মেঘ সরিয়ে দেয়, যাতে সর্বদা দীপ্ত সূর্য, অর্থাৎ আত্মা, স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়।
ভামতী অবিদ্যাকে দেখে অভিজ্ঞতার অন্তর্গত অন্ধকার হিসেবে, আর বিবরণ দেখে সৃষ্টির পূর্বাবস্থার কসমিক পর্দা হিসেবে। একটির দৃষ্টি আত্ম-মনস্তত্ত্বে, অপরটির দৃষ্টি মহাব্রহ্মে; তবুও দুটির গন্তব্য এক—অজ্ঞান ভেদ করে আত্মার স্বরূপপ্রকাশ, যা অদ্বৈত বেদান্তের মর্মবাণী: “ব্রহ্ম সত্যম্, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব ন অপরঃ।”
অবিদ্যা-আশ্রয়-বিতর্ক আসলে অদ্বৈত দর্শনের দুটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ—একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরে, অন্যটি মহাজাগতিক বাস্তবতার স্তরে। একটির কেন্দ্রে জীব, অন্যটির কেন্দ্রে ব্রহ্ম; কিন্তু উভয়ের গন্তব্য একই—অবিদ্যা বিলুপ্ত হলে আর আশ্রয়ের প্রশ্নই থাকে না, কারণ অবিদ্যার কোনো বাস্তব আশ্রয় ছিল না। অবশেষে, যা থাকে, তা একমাত্র চেতনা—স্বয়ং-আলোকিত, অদ্বিতীয়, অনির্বচনীয় ব্রহ্ম।
অদ্বৈত বেদান্তের পরবর্তী চিন্তাবিদরা, ভামতী ও বিবরণ—এই দুই ঐতিহ্যের অবিদ্যা-সংক্রান্ত ব্যাখ্যাকে একত্রে মেলাতে চেয়েছিলেন, যেন একপাশের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অপরপাশের মহাজাগতিক তত্ত্বের মধ্যে এক সমন্বিত সেতু গড়ে ওঠে। তাঁদের মতে, অবিদ্যা না একান্তভাবে ব্যক্তিগত, না একান্তভাবে মহাজাগতিক; বরং এটি এক প্রতিবিম্বিত প্রকাশ, যেখানে অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মচেতনা সীমিত বুদ্ধির আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে সীমাবদ্ধতার ছায়া সৃষ্টি করে।