“কারণ বীজ” কোনো স্থানিক বা কালিক বিন্দু নয়; এটি সেই সর্বব্যাপী, চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম, যিনি নিজের মধ্যেই সৃষ্টি-লয়ের অনন্ত চক্র ধারণ করেন। সব সৃষ্টি তাঁর থেকেই উদ্ভূত, সব প্রাণ তাঁর দ্বারা টিকে আছে, এবং সব কিছু অবশেষে তাঁর মধ্যেই বিলীন হয়—যেমন তরঙ্গ থেকে জলের উদ্ভব, স্থিতি ও লয়—তেমনি বিশ্ব, প্রাণ ও চেতনা—সবই ব্রহ্মের অনন্ত উদ্ভাসে স্থিত।
ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ঋষি ঊদ্ধালক আরুণি তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছেন, যেখানে তিনি এক অবিস্মরণীয় বাক্য উচ্চারণ করেন—“স য এষোঽণিমা, ঐতদাত্ম্যমিদং সর্বম্। তৎ সত্যং, স আত্মা। তৎ ত্বমসি শ্বেতকেতো।। ” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)। এই বাক্য অদ্বৈত বেদান্তের প্রাণ—যেখানে ব্রহ্ম ও আত্মার অভিন্নতা ঘোষণা করা হয়েছে। ঊদ্ধালক তাঁর পুত্রকে বোঝাতে চান যে, যা জগতের অন্তঃস্থ চেতনা, যা প্রতিটি জীবের প্রাণ, জ্ঞান ও অস্তিত্বের ভিত্তি—তুমিই সেই।
“স য এষোঽণিমা”—এই বাক্যে “অণিমা” শব্দের অর্থ হলো অতি সূক্ষ্ম, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এটি কোনো জড় বস্তু নয়; এটি সেই অদৃশ্য চেতনা, যা সর্বব্যাপী, অবিভাজ্য, এবং যার দ্বারা সমস্ত জগৎ আলোকিত। যেমন সূর্য নিজে স্থির থেকেও সমস্ত দিককে আলোকিত করে, তেমনি এই সূক্ষ্ম চেতনা নিজে অপরিবর্তিত থেকেও প্রতিটি জীব, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অভিজ্ঞতায় প্রবিষ্ট।
ঊদ্ধালক বলেন—“ঐতদাত্ম্যমিদং সর্বম্”—এই সমগ্র জগৎ, যত কিছু আমরা দেখি, শুনি, অনুভব করি—সবই এই এক চেতনার দ্বারা পরিব্যাপ্ত। এর বাইরে কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। এটি সেই চেতনা, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্ত—সব অবস্থার মধ্য দিয়ে অপরিবর্তিত থাকে; যা সমস্ত অভিজ্ঞতার পেছনে নীরব সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান।
এরপর তিনি বলেন—“তৎ সত্যং”—“ওটাই সত্য।” এখানে “সত্য” মানে কোনো আপেক্ষিক সত্য নয়, বরং সেই পরম, অবিনাশী, অচল সত্তা, যা কখনো সৃষ্টি বা বিনাশের অধীন নয়। নাম-রূপের জগৎ নিত্য পরিবর্তনশীল; তাই তা পরম সত্য নয়, বরং ব্যবহারিক সত্য। এই জগতের সমস্ত নাম, রূপ ও ঘটনা সেই এক চেতনার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু চেতনা নিজে তাদের উপর নির্ভরশীল নয়।
ঊদ্ধালক আরও বলেন—“স আত্মা”—এই ব্রহ্মই আত্মা। অর্থাৎ, যাকে আমরা ‘আমি’ বলে অনুভব করি, সেই আত্মা আসলে আলাদা কোনো ব্যক্তি-সত্তা নয়; সে ব্রহ্মেরই প্রতিফলন, সেই চিরন্তন চেতনার স্থানীয় প্রকাশ। এই উপলব্ধিই অদ্বৈতের কেন্দ্রীয় বোধ—যেখানে জীব, ঈশ্বর ও জগৎ তিনে কোনো বাস্তব বিভাজন থাকে না, কেবল চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশমাত্র।
শেষে ঊদ্ধালক ঘোষণা করেন—“তৎ ত্বমসি শ্বেতকেতো”—“তুমিই সেই।” এই বাক্যটি কেবল শিক্ষার সমাপ্তি নয়, বরং জ্ঞানের উদয়। এখানে ঋষি তাঁর পুত্রকে বলতে চান—যে-ব্রহ্ম সমস্ত জগতের অন্তর্নিহিত সত্য, সেই ব্রহ্মই তোমার স্বরূপ; তুমিই সেই এক চেতনারই প্রকাশ। তোমার যে “আমি” অনুভূতি, সেটিই আসলে সেই চেতনার সীমিত প্রতিফলন। অজ্ঞানের পর্দা সরলেই এই সীমা বিলীন হয়ে যায়, আর তুমি উপলব্ধি করো—“আমি সেই, সর্বব্যাপী, চিরন্তন আত্মা।”
এই শিক্ষা ছান্দোগ্যের নয় খণ্ডে নয় বার পুনরাবৃত্ত হয়েছে—যা “নববিধ তৎ ত্বমসি” নামে পরিচিত। এটি মানুষকে স্মরণ করায় যে, মুক্তি কোনো ভবিষ্যৎ লাভ নয়, বরং নিজের স্বরূপের জাগরণ। গীতায় (২.৭২) কৃষ্ণও বলেন—“এষা ব্রাহ্মী স্থিতি পার্থ, নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।”—যে এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত, সে আর বিভ্রান্ত হয় না। অর্থাৎ, ‘তৎ ত্বমসি’-র উপলব্ধি মানেই অদ্বৈত বোধের স্থিরতা—যেখানে জ্ঞান, জানার উপায় ও জানার বিষয়—সবই এক হয়ে যায়।
জগৎ ও আমি, ব্রহ্ম ও জীব, এক ও বহুর মধ্যে যে-বিভাজন দেখি, তা কেবল মায়ার পর্দা। পর্দা সরে গেলেই প্রকাশ পায় সেই এক সত্য—চিরন্তন, অদ্বিতীয়, চিদানন্দরূপ আত্মা—যিনি সর্বত্র, সর্বকালে, নিজের মধ্যেই উদ্ভাসিত।
এই উপলব্ধি ঈশ্বর ও জীবের সম্পর্ককেও নতুনভাবে প্রকাশ করে। ঈশ্বর হলেন সেই ব্রহ্ম, যিনি মায়া-উপাধি দ্বারা শর্তিত—অর্থাৎ, সমষ্টিগত চেতনা; আর জীব হলেন সেই একই ব্রহ্ম, যিনি অবিদ্যা-উপাধি দ্বারা সীমাবদ্ধ—ব্যক্তিগত চেতনা। তাদের মধ্যে যে-ভেদ প্রতীয়মান, তা কেবল উপাধির প্রক্ষেপণ। যখন উপাধি-নিবৃত্তি ঘটে, তখন ভেদ বিলীন হয়; ঈশ্বর ও জীব একীভূত হয়ে আত্মা-ব্রহ্ম-ঐক্য-জ্ঞান প্রকাশিত হয়।
এই অবস্থায় মহাবাক্যগুলি তাদের অন্তর্নিহিত দীপ্তি পায়। “তৎ ত্বম্ অসি” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)—“তুমিই সেই”—দুইয়ের ভেদ মুছে দেয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়কে এক সারাংশে মিলিয়ে দেয়। “অহম্ ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১০)—“আমিই ব্রহ্ম”—অহংকারের সীমারেখা দ্রবীভূত করে, “প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম” (ঐতরেয় উপনিষদ ৩.৩)—“চেতনা ব্রহ্ম”—চেতনাকেই একমাত্র পরম সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করে, এবং “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ ২)—“এই আত্মাই ব্রহ্ম”—অদ্বৈতকে তাৎক্ষণিক, প্রত্যক্ষ সত্য হিসেবে উদ্ভাসিত করে। এরা মিলে ব্রহ্মতত্ত্বের পূর্ণ প্রকাশ ঘটায়—বুদ্ধিগত নয়, অস্তিত্বগত।
এই উপলব্ধির চূড়ান্ত পরিণতি হলো নির্বিকল্প-সমাধি—এক এমন অবস্থা, যেখানে জানার প্রক্রিয়াটিরও অবসান ঘটে। এখানে আর কোনো “আমি জানি” বা “আমাকে জানতে হবে” এই ভাবটি অবশিষ্ট থাকে না, কারণ জানার প্রয়োজনই বিলুপ্ত হয়। জ্ঞান তখন নিজের কর্তব্য সম্পূর্ণ করে, অবিদ্যার নিবৃত্তির জন্য যে-ভূমিকা নিয়েছিল, তা শেষ হয়—যেমন প্রদীপের আলো কেবল অন্ধকার দূর করার জন্য, অন্ধকার সরে গেলে আলো নিজের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করে নেভে না, বরং সূর্যের সঙ্গে একীভূত হয়।
এই অবস্থায় যা অবশিষ্ট থাকে, তা আর কোনো জ্ঞান নয়, কোনো অভিজ্ঞতাও নয়—বরং ব্রহ্মানুভব, অর্থাৎ আত্মার নিজের মধ্যেই নিজের প্রকাশ। এটি চেতনার মধ্যে কোনো নতুন ঘটনা নয়, বরং চেতনা নিজেকে নিজের আলোয় চিনে ফেলা। এখানে চেতনা আর কোনো বিষয়কে আলোকিত করছে না, বরং নিজেকেই প্রতিফলিত করছে।
এই ব্রহ্মচেতনা স্বয়ং-প্রকাশ—তাকে প্রকাশ করার জন্য অন্য কিছু লাগে না; স্বয়ং-স্থিত—তাকে ধারণ করার জন্য কোনো আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই; এবং স্বয়ং-আলোকিত—তাকে জানাবার জন্য কোনো জানার প্রক্রিয়া নেই। এখানে জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, ও জ্ঞান—এই তিন স্তরের বিভাজন সম্পূর্ণ বিলীন।
অবশিষ্ট থাকে কেবল এক অবিভক্ত চেতনা, যা নির্মল, অচল ও অদ্বিতীয়। এই চেতনা কোনো ক্রিয়া নয়, কোনো ফল নয়—এটি স্বরূপসিদ্ধ সত্য, চিদ্-আনন্দ-রূপ। এই অবস্থায় মানুষ উপলব্ধি করে—যা-কিছু ছিল জানার, সবই সেই এক চেতনার তরঙ্গমাত্র, আর সেই চেতনার বাইরে আর কিছুই নেই। এখানেই জ্ঞানের পূর্ণতা, এখানেই আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ—যেখানে জ্ঞান মিশে যায় অস্তিত্বে, এবং থাকে শুধু এক অনন্ত, উদ্ভাসিত, স্বয়ং দীপ্ত ব্রহ্ম।
যখন চেতনা তার স্বরূপে জেগে ওঠে, তখন জানার সমস্ত কাঠামো—প্রমাণ, প্রমাতা ও প্রমেয়—এক অনির্বচনীয় নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যায়। প্রমাণ, যা ছিল জ্ঞানের মাধ্যম; প্রমাতা, যে জানত; এবং প্রমেয়, যা জানা হতো—এই তিনের ভিন্নতা কেবল অবিদ্যা-প্রক্ষেপিত এক স্বপ্ন ছিল। অদ্বয়-জ্ঞান উদিত হলে সেই স্বপ্নের সমস্ত পার্থক্য গলে যায়, একক চৈতন্যে মিশে যায়, যেখানে আর জানার কোনো প্রক্রিয়া নেই, কেবল জানাই আছে—অথবা আরও গভীরভাবে বললে, কেবল “আছে”। এটিই তত্ত্ব-জ্ঞান-উৎপত্তির প্রকৃত অর্থ—এটি কোনো নতুন সত্যের উদ্ভব নয়, বরং বিভেদের মায়ার সম্পূর্ণ অবসান।
অদ্বৈত বেদান্তে এই উপলব্ধি এমন এক অবস্থান, যেখানে সমস্ত তত্ত্ব, মত ও উপপত্তি অবশেষে তাদের আপাত পার্থক্য অতিক্রম করে এক অভিন্ন সত্যে মিলিত হয়। মানুষ যখন জ্ঞানের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়—যেখানে আত্মা ও ব্রহ্ম এক হিসেবে প্রতিভাত—তখন এই ভেদবুদ্ধি বিলুপ্ত হয়।
বিবর্ত-বাদ (vivarta-vāda) বলে, সৃষ্টি কোনো বাস্তব পরিবর্তন নয়, বরং ব্রহ্মের চেতনারই আপাত প্রতিফলন। যেমন রজ্জুতে সাপের ভ্রম দেখা যায়, তেমনি অজ্ঞানের প্রভাবে ব্রহ্মে জগতের ভ্রম দেখা দেয়।
গৌড়পাদ আচার্যের মাণ্ডূক্য কারিকায় উল্লিখিত অজাত-বাদ (ajāta-vāda) বলে, সৃষ্টি কখনও ঘটেইনি—কারণ ব্রহ্ম অনাদি, অনন্ত, অপরিবর্তনীয়। তাই জন্ম, সৃষ্টি, ও বিলয়—সবই কেবল মায়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা বিভ্রম।
প্রতিবিম্ব-বাদ (pratibimba-vāda) এই মায়ার কার্যপ্রণালী বোঝায়। আত্মা বা চেতনা সর্বত্র একই, কিন্তু মানসিক উপাধির উপর তার প্রতিবিম্ব বিভিন্ন রূপে প্রতিফলিত হয়। যেমন এক সূর্যের আলো নানা জলে নানা ঢঙে প্রতিফলিত হয়, অথচ সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থাকে।
অবচ্ছেদ-বাদ (avaccheda-vāda) দেখায়, জগতের বহুত্ব কেবল চেতনার উপর আরোপিত সীমাবদ্ধতার প্রতীক। যেমন আকাশ এক, কিন্তু স্থানভিত্তিক ভাগে তাকে “ঘট-আকাশ”, “মহাকাশ”, “মাঠের আকাশ” বলে ডাকা হয়—তবু আকাশ বাস্তবে অবিভাজ্য।
এই সমস্ত তত্ত্ব তাই এক সত্যের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ—যেমন এক আলো নানা প্রিজমে নানা রঙে বিভক্ত হয়, কিন্তু উৎস এক। যখন জ্ঞান-উদয় ঘটে, তখন এই সব দর্শন, তত্ত্ব ও যুক্তি নিজের সীমায় এসে থেমে যায়; সেখানে শুধু থাকে অভিজ্ঞতা, নীরব উপলব্ধি। শাস্ত্রের ভাষায়—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—“এই সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম।”
তখন আর কোনো ভেদবুদ্ধি থাকে না—না জ্ঞাতার, না জ্ঞেয়ের, না জানার প্রক্রিয়ার। সমস্ত তত্ত্ব, বিতর্ক, ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি এক নীরব সত্যে বিলীন হয়ে যায়—যেখানে দর্শন নিজেই দর্শনাতীত হয়ে ওঠে, এবং মানুষ উপলব্ধি করে যে, সমস্ত বিভাজনের আড়ালে ছিল কেবল একই চেতনা—অখণ্ড, অনন্ত, চির-উজ্জ্বল ব্রহ্ম।
এই অবস্থায়, যে-জীব এতদিন মুক্তির সন্ধান করছিল, সে হঠাৎই উপলব্ধি করে—সে কখনোই আবদ্ধ ছিল না। এ যেন অন্ধকারে আলো জ্বালানো নয়, বরং বুঝে ফেলা যে, আলো সবসময়ই জ্বলছিল, কেবল চোখ বন্ধ ছিল। এই জাগরণেই সে জীবন্মুক্ত—জীবিত অবস্থাতেই মুক্ত।
তার চলাফেরা, বাক্য ও চিন্তা এখনও জগতে প্রবাহিত, কিন্তু সে আর জগতের অন্তর্গত নয়। যেমন কেউ স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে জানে—স্বপ্নের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তা বাস্তব নয়—তেমনি এই জ্ঞানী ব্যক্তি জগতের সব ঘটনায় অংশ নেন, অথচ অন্তরে থাকেন অদ্বৈত চেতনার স্থিতিতে।
তার কর্ম চলতে থাকে, কিন্তু তা কেবল প্রারব্ধ কর্ম—অতীতের শক্তির অবশিষ্ট গতিবেগ। সেই কর্মও যেন পোড়া দড়ি—রূপ আছে, কিন্তু বাঁধার ক্ষমতা নেই। সে আর কিছু করে না, কারণ “আমি কর্তা” এই অহংবোধই তার মধ্য থেকে নিঃশেষ হয়েছে।
তার মন সম্পূর্ণ বাসনামুক্ত, চিত্ত প্রশান্ত, চেতনা অবিচল। তিনি জগৎকে দেখেন, কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়েন না—যেমন স্বচ্ছ আয়নায় প্রতিবিম্ব পড়ে, কিন্তু আয়নায় ওতে দাগ লাগে না। তাঁর কাছে জগৎ প্রতারণা নয়, বরং চেতনার পবিত্র প্রতিফলন, এক divine play—লীলার আয়না।
এই দৃষ্টিতে প্রপঞ্চ কোনো শৃঙ্খল নয়; বরং এক উদ্ভাসিত মায়া, যা অজ্ঞান থাকলে বেঁধে রাখে, আর জ্ঞান উদিত হলে শান্ত সৌন্দর্যে পরিণত হয়। এখানেই জীবনের ও মুক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না—সবই একই চেতনার নৃত্য, যেখানে জানা, থাকা ও হওয়া এক হয়ে যায়।
এই অবস্থাকেই বলা হয় প্রপঞ্চ-মিথ্যা-বোধ—অর্থাৎ জগতের মায়াময় স্বরূপের প্রত্যক্ষ জ্ঞান। এখানে মানুষ বুঝতে পারে, যা-কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, অনুভূত হয়—সবই এক আপাত প্রকাশ, এক চেতনার খেলার দৃশ্য। আর এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে আসে প্রপঞ্চ-উপশম, যেখানে সমস্ত বিভাজন ও অস্থিরতা নিস্তরঙ্গ নীরবতায় বিলীন হয়ে যায়। তখন মহাবিশ্বের সমস্ত জটিলতা, গতি ও বহুত্ব এক নীরব স্বচ্ছতায় গলে যায়—যেন তরঙ্গ শান্ত সাগরে মিশে তার আলাদা পরিচয় হারায়।