অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩২



গীতাতেও (১৫.৬) কৃষ্ণ এই একই বাণী পুনরুচ্চারিত করেছেন—“ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ। যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।। ” অর্থাৎ, “যে-ধামে সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নির কোনো আলো প্রয়োজন হয় না, সেই আমার পরম ধাম—যেখানে একবার গিয়ে কেউ আর ফিরে আসে না।” গীতার এই শ্লোকটি আত্মার চূড়ান্ত গন্তব্য, অর্থাৎ পরম ব্রহ্মধাম বা চেতনার ধামকে নির্দেশ করছে—যা কোনো স্থলবিশেষ নয়, বরং এক অবস্থা, যেখানে সমস্ত দ্বৈততা, পরিবর্তন ও অন্ধকার বিলীন হয়ে যায়। কৃষ্ণ এখানে বলেন, “ন তদ্‌ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।”—অর্থাৎ, সেই স্থানে সূর্যের আলো, চাঁদের জ্যোতি কিংবা অগ্নির দীপ্তি প্রয়োজন হয় না। কারণ, সেখানে কোনো বাহ্যিক আলোক নেই; বরং স্বয়ং চেতনার জ্যোতি সর্বত্র দীপ্ত।

এই “তদ্‌ ধাম পরমং মম”—অর্থাৎ, “আমার পরম ধাম”—বাক্যাংশটি গভীর প্রতীকবহ। এটি বোঝায় যে, সেই পরম ধাম আসলে কৃষ্ণরূপ ব্রহ্মচেতনার অবস্থান, যেখানে আত্মা নিজের উৎসে মিলিত হয়। “যদ্‌ গত্বা ন নিবর্তন্তে”—এই অংশটি বলে, যে একবার সেই উপলব্ধি লাভ করে, সে আর অজ্ঞান বা সংসারের বন্ধনে ফিরে আসে না। এই প্রত্যাবর্তনহীনতা কোনো ভৌগোলিক না, বরং মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক—যখন জ্ঞানের আলোয় মায়ার অন্ধকার লুপ্ত হয়, তখন চেতনা আর ভ্রমে পড়ে না।

বেদান্ত দৃষ্টিতে এই “ধাম” মানে ব্রহ্মের স্বয়ং-জ্যোতি—চেতনার অন্তর্লীন দীপ্তি। সূর্য, চন্দ্র বা অগ্নির আলো এখানে বাহ্য প্রতীক; তারা সেই পরম চৈতন্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ব্রহ্মের দীপ্তি এইসব আলোকেরও উৎস। তাই বলা হয়, এটি বাহ্য আলোক নয়, আত্মালোক—যেখানে জানার, দেখার বা আলোকিত হবার কোনো পৃথকতা নেই।

যেমন একটি বাতি চারপাশকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজেকে আলোকিত করতে আরেকটি বাতির প্রয়োজন হয় না, তেমনি ব্রহ্মচেতনা সবকিছুকে জ্ঞাপিত করে, কিন্তু নিজে কারও দ্বারা জ্ঞাত নয়—নিজেই জ্ঞাতা, নিজেই জ্ঞেয়, নিজেই জ্ঞান। এই জন্যই কঠোপনিষদ (২.২.১৫)-এ বলা হয়েছে—“তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।”—“তাঁরই আলোয় এই সবকিছু আলোকিত।”

গীতার এই শ্লোকের মর্ম হলো—যে-মানুষ নিজের অন্তরে সেই আত্মদীপের জ্যোতিকে উপলব্ধি করতে পারে, সে বাহ্যজগতের আলোয় নয়, নিজের চেতনার দীপ্তিতেই জেগে ওঠে। তখন আর ফিরে আসা নেই—কারণ তখন সে পৌঁছে গেছে সেই এক, অদ্বিতীয়, পরম দীপ্ত চেতনার ধামে, যা সকল আলোকের উৎস এবং সকল জ্ঞানের চূড়ান্ত ভিত্তি। ব্রহ্মের জ্যোতি কোনো বাহ্য আলোক নয়; এটি চেতনার নিজস্ব দীপ্তি, যা সব আলোককে আলোকিত করে।

এই তত্ত্বকে মুণ্ডক উপনিষদ (২.২.১০) আরও সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করেছে—“তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।” অর্থাৎ, “তাঁর আলোর দ্বারাই সব কিছু আলোকিত।” এই এক বাক্যে ব্রহ্মের স্বয়ং-প্রকাশত্ব (Self-luminosity) প্রকাশিত। যেমন সূর্য নিজেকে আলোকিত করতে আরেক সূর্যের প্রয়োজন হয় না, তেমনি ব্রহ্মকেও জানাতে কোনো জ্ঞান বা উপায়ের প্রয়োজন নেই—তিনি নিজেই জ্ঞানের উৎস, নিজেই জ্ঞান, নিজেই জানা।

বেদান্তিক দৃষ্টিতে, এই ব্রহ্ম-জ্যোতি কোনো প্রতীক নয়; এটি সেই চেতনার স্বরূপ, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্ত—সব অবস্থার ঊর্ধ্বে বিরাজমান। গৌড়পাদ আচার্য তাঁর মাণ্ডূক্য কারিকা (১.১৬)-এ বলেছেন—“নান্যদস্তি কিঞ্চন।”—“চেতনার বাইরে আর কিছুই নেই।” অর্থাৎ, যা-কিছু আমরা দেখি, শুনি, অনুভব করি—সবই সেই চেতনার প্রতিফলন।

উদাহরণস্বরূপ, যেমন আয়নায় মুখের প্রতিফলন কেবল তখনই দেখা যায়, যখন আলো পড়ে; তেমনি ইন্দ্রিয় ও মন কেবল তখনই সচল হয়, যখন সেই চেতনার আলো তাতে প্রতিফলিত হয়। ঘুমের সময় এই আলো আংশিক আচ্ছন্ন হয়, তাই আমরা জাগতিক বস্তু দেখি না; কিন্তু আত্মা তবুও থাকে—কারণ ঘুমশেষে আমরা বলি, “আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম”—এই স্মৃতিই প্রমাণ করে যে, চেতনা কখনও নেভে না।

“ন তত্র সূর্যো ভবতি... তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি”—এই বাণী শুধু ব্রহ্মের মাহাত্ম্য নয়; এটি আত্ম-অন্বেষণের নির্দেশ। যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে, সমস্ত আলোক, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত আনন্দ আসলে নিজের চেতনারই বিকিরণ—তখন সে বাহ্যজগতের আলোয় নয়, নিজের অন্তর্জ্যোতিতে আলোকিত হতে শেখে। তখনই সে বুঝতে পারে, সূর্য, চন্দ্র, তারা—সবই তাঁরই অভিব্যক্তি; তিনিই সেই পরম দীপ্তি, যিনি সর্বত্র, সর্বদা, নিজের মধ্যেই উদ্‌ভাসিত।

“সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানম্‌”—অর্থাৎ, জ্ঞান নিজে কোনো বাহ্যিক সঞ্চয় নয়; এটি আত্মার স্বরূপই, যা কেবল সত্ত্বগুণের স্বচ্ছতায় প্রকাশিত হয়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.৯)-এ বলা হয়েছে—“ন তত্র সূর্যো ভবতি, ন চন্দ্রতারকম্‌... তমেব ভূতং বিবৃতং, তমেব ভূতং পশ্যতি।”—“যেখানে সূর্য, চন্দ্র বা নক্ষত্রের আলো পৌঁছায় না, সেই আত্মজ্যোতি নিজেই সব কিছু আলোকিত করে।” সত্ত্বগুণ সেই আলোর মাধ্যম, যা এই আত্মজ্যোতিকে প্রকাশিত করে।

অন্যদিকে, রজোগুণ (গতি, স্পৃহা, আসক্তি) মনকে ক্রমাগত বাহিরমুখী করে তোলে। কর্ম, ইচ্ছা ও ফলের প্রত্যাশা এই গুণের দ্বারা জন্মায়—তাই কৃষ্ণ বলেন, “রজসঃ লোভঃ”—রজোগুণ থেকে লোভ উৎপন্ন হয়। লোভ এখানে কেবল ধনলোভ নয়; এটি যে-কোনো আকাঙ্ক্ষার প্রতীক—যা মনকে এক অনন্ত অসম্পূর্ণতার বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখে।

তামসিক অবস্থা (অজ্ঞান, জড়তা, অন্ধকার) আবার চেতনার পতন। তমোগুণে মনের স্থবিরতা জন্ম নেয়—তাহলে প্রমাদ (অবিবেচনা), মোহ (ভ্রম) এবং অন্ধকার (অচেতনা) ছেয়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে না, এবং আত্মা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

জ্ঞান কেবল বৌদ্ধিক বা পাঠ্য বিষয় নয়; এটি চেতনার এক প্রাকৃতিক অবস্থা, যা সত্ত্বগুণে উদ্‌ভাসিত হয়। সত্ত্ব মানেই আত্মার প্রতিফলন, আর আত্মার প্রতিফলন মানেই জ্ঞান। তাই সত্ত্বগুণের বিকাশই মুক্তির প্রথম শর্ত।

গীতায় (১৪.২৬) কৃষ্ণ আরও বলেন—“মাম্‌ চ যোগ্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে, স গুণান্‌ সমতীত্যৈতান্‌ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।”—যিনি নিরন্তর ভক্তি ও যোগের দ্বারা আমাকে সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করে ব্রহ্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ, সত্ত্বগুণ জ্ঞানের জন্ম দেয়, কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি তখনই ঘটে, যখন জ্ঞান নিজেই গুণাতীত চেতনার সঙ্গে একীভূত হয়।

“সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানম্‌”—এই শ্লোকাংশটি সমগ্র আত্মবিকাশের নকশা হয়ে ওঠে: তমোগুণ থেকে জড়তা দূর করতে হবে, রজোগুণকে সংযত করে কর্মে রূপ দিতে হবে, আর সত্ত্বগুণকে শুদ্ধ করে চেতনার আয়না পরিষ্কার করতে হবে—যাতে আত্মা নিজেই নিজের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, আর মানুষ উপলব্ধি করে: জ্ঞান কোনো প্রাপ্তি নয়, এটি আত্মার স্বাভাবিক দীপ্তিরই উন্মোচন।

কপিলদেব দেখিয়েছেন, পুরুষ যখন গুণের আসক্তি ত্যাগ করে, তখন সে প্রকৃতির দাস নয়, বরং ঈশ্বরচেতনার সাক্ষী ও প্রতিফলনরূপে জাগ্রত। এই অবস্থাই মুক্তি—যেখানে আত্মা প্রকৃতির আবর্তের বাইরে এসে নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, আর সেখানে আর কোনো শোক বা মোহ থাকে না, কেবল চিরন্তন শান্তি ও চিদানন্দর দীপ্তি।

“যেমন বৃহৎ উপাদান ক্ষুদ্র কণারূপে প্রকাশিত, তেমনি পরমাত্মা জীবরূপে বিকশিত।” অর্থাৎ, ঈশ্বর নিজের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে জীবরূপে আবির্ভূত হন—এই আত্মবিস্তারই পরাশক্তির লীলা।

শেষপর্যন্ত, “পরাশক্তি” মানে সেই অদৃশ্য বীজ, যেখানে শিব ও শক্তি, চেতনা ও প্রকৃতি, ঈশ্বর ও জীব—সবই এক চক্রে যুক্ত। সৃষ্টি সেখানে কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়, বরং আত্মার অন্তর্গত নৃত্য—“চিত্‌ স্পন্দ” বা “শক্তি স্পন্দ”।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে গীতার ৯.১৮ শ্লোকটি ব্রহ্মের অভিন্ন নিমিত্তোপাদান কারণত্ব—অর্থাৎ সৃষ্টির উপাদান ও নিয়ন্ত্রক উভয় কারণই তিনিই—এই তত্ত্বের উজ্জ্বল প্রকাশ। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “গতিঃ ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃত্‌।”—এই এক পঙ্‌ক্তিতেই তিনি ব্রহ্মের সমস্ত দিক—অন্তঃস্থিত, বাহ্যনিয়ন্তা, ও পরমাশ্রয়—একত্রে প্রকাশ করেছেন।

অদ্বৈতের ভাষায়, “গতি” মানে সেই চূড়ান্ত লক্ষ্য বা পরমাবস্থান—ব্রহ্ম, যাঁর মধ্যে সমস্ত গমন, পরিবর্তন ও সাধনার শেষ পরিণতি ঘটে। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬.৮.৭) বলা হয়েছে—“তৎ ত্বম্‌ অসি”—“তুই সেই”; অর্থাৎ সমস্ত যাত্রার অন্তিম গন্তব্য, আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ উপলব্ধিই প্রকৃত ‘গতি’।

“ভর্তা” মানে ধারণকারী, যিনি জগৎকে টিকিয়ে রাখেন, কিন্তু নিজে অচল। যেমন গীতার অন্যত্র (৯.৪) কৃষ্ণ বলেন—“ময়ি সর্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।”—“আমার মধ্যে এই সমগ্র জগৎ গাঁথা, যেমন সুতার মধ্যে মুক্তাগুলি গাঁথা থাকে।” এখানে “ভর্তা” মানে সেই অভ্যন্তরীণ চেতনা, যা সমস্ত নাম-রূপকে ধারণ করে, কিন্তু তাতে নিজে কখনও জড়ায় না—যেমন মাটির পাত্রের নানা রূপ থাকলেও মাটি একই।

“প্রভুঃ” মানে নিয়ন্তা, যিনি অদ্বিতীয় শাসক, কিন্তু তাঁর শাসন কোনো বাহ্যিক আদেশ নয়—এটি চেতনার স্বাভাবিক নিয়ম। ব্রহ্মসূত্র (২.১.১৪)-এ বলা হয়েছে—“ঈশ্বরঃ কারণম্‌।”—“ঈশ্বরই কারণ।” কিন্তু এই কারণত্ব কোনো কার্যসৃষ্টি নয়; এটি ব্রহ্মের স্ব-উজ্জ্বল সত্তা, যাঁর উপস্থিতিতেই সব কিছু ঘটে।

“সাক্ষী” মানে দ্রষ্টা—যিনি প্রত্যক্ষ, কিন্তু অংশগ্রহণ করেন না। উপনিষদ (বৃহদারণ্যক ৩.৭.২৩)-এ বলা হয়েছে—“যঃ সর্বাণি ভূতানি অন্তরো যময়তি, যঃ সর্বাণি ভূতানি ন বিদু, যস্য ভূতানি শরীরম্‌, যঃ আন্তর্যামী অমৃতঃ।”—“যিনি সকল সত্তার অন্তরে বিরাজমান, যাঁকে তারা জানে না, যাঁর জন্যে তারা শরীররূপ, সেই অন্তর্যামীই অমৃত।” কৃষ্ণের ‘সাক্ষী’ শব্দটি সেই অন্তর্যামিতত্ত্বের প্রতিফলন—তিনি প্রত্যেক কর্ম, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার নিঃস্পৃহ সাক্ষী।

“নিবাসঃ” মানে আশ্রয় বা ভিত্তি—যেখানে সমস্ত অস্তিত্ব অবস্থান করছে। মুণ্ডক উপনিষদ (২.২.১১)-এ বলা হয়েছে—“যস্মিন্‌ প্রজাহ্নি সমস্তি বিশ্রান্তা নিত্যসঞ্জ্ঞায় তমে হুভন্তে।”—“যার মধ্যে সমস্ত প্রাণ বিশ্রাম লাভ করে, সেই নিত্যকে মুনিরা প্রণাম করেন।” অর্থাৎ সমস্ত জীবের অস্তিত্বের ভিত্তি তিনিই।

“শরণং সুহৃত্‌” মানে আশ্রয় ও অন্তরঙ্গ বন্ধু—অর্থাৎ তিনি কেবল শাসক নন, হৃদয়েরও সর্বাধিক নিকটতম সত্তা। গীতার (৫.২৯)-এ কৃষ্ণ বলেন—“সুহৃদং সর্বভূতানাম্‌ জ্ঞাত্বা মা শান্‌তিম্‌ ঋচ্ছতি।”—“যিনি সকল সত্তার সুহৃদ, তাঁকে জানলে মানুষ শান্তি পায়।” এই “সুহৃদ” ভাবটি অদ্বৈতের দৃষ্টিতে সর্বান্তর্যামী ব্রহ্মেরই প্রতীক—যিনি ‘অন্য’ নন, বরং আত্মারই স্বরূপ।

এই শ্লোকের প্রতিটি শব্দেই কৃষ্ণ নিজের মধ্যে জগতের সমস্ত স্তরকে এক করেছেন—সৃষ্টি, পালন, নিয়ন্ত্রণ, সাক্ষিত্ব, আশ্রয় ও প্রেম—সবই এক চেতনার প্রকাশ। দ্বৈত দৃষ্টিতে এগুলো আলাদা আলাদা ভূমিকা, কিন্তু অদ্বৈতের দৃষ্টিতে এগুলো এক অভিন্ন ব্রহ্মসত্তার বিভিন্ন প্রকাশমাত্র। তিনিই পরাশক্তি, যিনি একই সঙ্গে জগতের ভেতরে জাগ্রত, কারণ তিনি প্রত্যেক প্রাণে সঞ্চারিত; আবার জগতের ঊর্ধ্বে, কারণ তাঁর অস্তিত্ব কোনো নাম-রূপে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি অন্তর্নিহিত এবং তারও অতীত—এই দুইয়েরই ঐক্য। এই উপলব্ধিই অদ্বৈতের পরম বোধ, যেখানে জানার শেষ পরিণতি হলো: “ব্রহ্মই সর্বত্র, আমিই সেই।”

এই উপলব্ধিতেই তত্ত্বত বলা যায়—পরাশক্তিই কারণ বীজ, কারণ তিনিই চেতনার মূল কেন্দ্র, এবং সমস্ত সৃষ্টির সূক্ষ্ম সম্ভাবনা তাঁর মধ্যেই চিরন্তনভাবে নিহিত থাকে। তিনি ব্রহ্মরূপে অবিকৃত, আবার শক্তিরূপে প্রকাশমান; তাঁর থেকেই সব কিছু উদ্‌ভব, তাঁর দ্বারা সব কিছু ধারণ, আর তাঁর মধ্যেই সব কিছু লীন। এখানেই জ্ঞানী উপলব্ধি করেন—সৃষ্টির প্রতিটি গতি, প্রতিটি প্রাণের শ্বাস, প্রতিটি চিন্তা, এক অনন্ত পরাশক্তির জাগরণেরই রূপ—যিনি সব কিছুর মধ্যে থেকে নিজেকেই অনন্তভাবে চেনেন।