অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩১


এই চিন্তারই অনুরণন আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.১)-এ পাই—“সদ্‌ বৈ সোম্য ইদমগ্র আআসীত্‌, একমেবাদ্বিতীয়ম্‌।”—"হে সৌম্য! সৃষ্টির পূর্বে এই জগৎ নিশ্চিতভাবে কেবলমাত্র 'সৎ' (একমাত্র সত্য বা ব্রহ্ম)-রূপে বিদ্যমান ছিল, যা এক এবং অদ্বিতীয় (ছিল)।" এই এক “সৎ” থেকেই সৃষ্টি প্রকাশিত হয়েছে, এবং প্রলয়ের সময় পুনরায় সেই এক সত্তায় লীন হয়ে যায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩.১)-এ বলা হয়েছে—“যতো বৈ ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎ প্রত্যভিশংবিশন্তি তদ্বিজ্ঞানস্‌।”—"যা থেকে এই সকল প্রাণী বা বস্তু উৎপন্ন হয়, যার দ্বারা উৎপন্ন হয়ে তারা জীবন ধারণ করে, এবং (প্রলয়ের সময়) যার মধ্যে তারা পুনরায় প্রবেশ করে ও লীন হয়ে যায়—তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো।" যা থেকে সমস্ত সত্তা জন্ম নেয়, যার দ্বারা টিকে থাকে এবং যার মধ্যেই লীন হয়—সেই কারণ বীজই ব্রহ্ম।

তান্ত্রিক দর্শনের বিন্দু-তত্ত্ব আসলে চেতনার স্ব-সংহতি ও স্ব-উদ্‌ভাসের এক দার্শনিক চিত্ররূপ, যেখানে সমস্ত সৃষ্টি-প্রক্রিয়া, তার স্থিতি ও অন্তিম লয়—সবই এক পরম চেতনার অন্তর্গত ছন্দে মিশে থাকে। “বিন্দু” এখানে কোনো জ্যামিতিক বিন্দু নয়, বরং চেতনার সেই আদিসংহত বিন্দু, যেখানে শক্তি নিজের উৎস, অর্থাৎ শিবের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিমগ্ন। এই অবস্থায় শিব ও শক্তির মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না—চেতনা ও তার প্রকাশ, স্থিতি ও স্পন্দ, শান্তি ও ক্রিয়া, সবই এক অভিন্ন ঐক্যে নিবদ্ধ।

তন্ত্রে বলা হয়েছে, “বিন্দুরূপঃ পরঃ শম্ভুঃ শক্তিরূপা চ পার্বতী, তয়োরৈক্যং মহাদ্বৈতং তস্মাৎ সর্বং প্রপঞ্চিতম্‌।” (রুদ্রযামল তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ৫.১৪)। অর্থাৎ, পরমশিব বিন্দুরূপ, আর পার্বতী শক্তিরূপ; এই দুইয়ের ঐক্য থেকেই সমগ্র প্রপঞ্চ, সমস্ত দৃশ্যমান বিশ্ব, প্রকাশিত। এখানে “বিন্দু” আসলে “কারণ বীজ”—যেখানে সৃষ্টির সমস্ত সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এটি শূন্য নয়, বরং পূর্ণ; এটি বিশ্রাম নয়, বরং অনন্ত সম্ভাবনার নিঃশব্দ ঘনতা।

তন্ত্রে “বীজ” শব্দটি সর্বদা চেতনার সম্ভাবনাকে বোঝায়। যেমন বীজের ভেতরে বৃক্ষ লুকানো থাকে, কিন্তু বৃক্ষ জন্মালে বীজের সত্তা তাতে বিলীন হয় না, তেমনি এই বিন্দুর ভেতরেই সমগ্র বিশ্ব সুপ্ত। যখন চেতনা নিজের অন্তর্গত সম্ভাবনাকে অনুভব করতে শুরু করে—যখন শক্তি শিবের মধ্য থেকে উন্মীলিত হয়—তখন এই বিন্দুতে এক সূক্ষ্ম আন্দোলন জাগে, যা “স্পন্দ” নামে পরিচিত। এই স্পন্দই সৃষ্টির প্রথম কম্পন, প্রথম ধ্বনি, প্রথম “নাদ”। অভিনবগুপ্ত এই প্রক্রিয়াকে তন্ত্রালোক (১.৩৮)-এ “চিতির অভাস”—অর্থাৎ “চেতনার নিজের অভাস” নামে বর্ণনা করেছেন। চিতি বা পরমচেতনা, নিজের মধ্যে কম্পিত হয়ে, নিজের প্রতিফলনে নিজেরই প্রকাশ ঘটায়।

এখানে সৃষ্টি কোনো বাহ্য শক্তির দ্বারা সংঘটিত নয়—চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে খেলছে, নিজেকে চেনে, নিজেকে অনুভব করে, আর সেই আত্ম-আবেশ থেকেই প্রকাশের প্রবাহ শুরু হয়। এই প্রকাশই শক্তি, এই শক্তির উচ্ছ্বাসই “নাদ”, এবং এই নাদের ঘনতা থেকেই শব্দ, রূপ, গতি ও কালের জন্ম। তাই তন্ত্র বলে, “বীজং শক্তিঃ, ফলং বিশ্বম্‌।” (শক্তিসংহিতা তন্ত্র, ২.১২)—পরাশক্তিই সেই আদিবীজ, আর তাঁর প্রকাশই চিদ্রূপ বিশ্ব।

এই বিন্দু-অবস্থা ত্রিগুণাতীত—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, এমনকি কাল ও দিকের সীমাও এখানে অনুপস্থিত। কুলার্ণব তন্ত্র (১.৮৫)-এ একে বলা হয়েছে, “বিন্দুনাদকালাতীতং তদেব পরমং পদম্‌।”—অর্থাৎ, বিন্দু, নাদ ও কালের অতীত যেই অবস্থা, সেটিই পরম পদ, ব্রহ্মস্বরূপ। অর্থাৎ, বিন্দু কোনো স্থানিক বা কালিক সত্তা নয়; এটি সেই চিরন্তন চেতনার বিন্দু, যা নিজেই সমস্ত স্থান ও কালের কারণ।

এই বিন্দু-তত্ত্বের মধ্যেই ত্রিমুখী শক্তির প্রকাশ নিহিত—সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়। শিব-শক্তির ঐক্যাবস্থায় বিন্দু স্থির; যখন শক্তি উদ্‌ভাসিত হয়, তখন সৃষ্টি ঘটে; যখন আবার শক্তি নিজ উৎসে ফিরে যায়, তখন লয়। এই ওঠানামাই প্রপঞ্চের চিরন্তন স্পন্দন, যা কখনও থামে না, কখনও নতুন কিছু সৃষ্টি করে না—শুধু নিজের অন্তর্লীন নৃত্যে বিশ্বকে অনন্তভাবে রূপ দেয়।

তান্ত্রিক বিন্দু-তত্ত্ব কেবল সৃষ্টির সূচনা নয়; এটি সেই চেতনার বোধ, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এক অনন্ত সমীকরণে পরিণত। চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, অর্থাৎ “কারণ বীজ” এখানেই নিজেকে বিশ্বে প্রকাশ করে, আবার বিশ্বকেও নিজের মধ্যে ধারণ করে। শিবের স্থিরতা ও শক্তির গতি এই বিন্দুতেই পরস্পর আলিঙ্গিত; আর এই আলিঙ্গন থেকেই উদ্‌ভাসিত হয় অস্তিত্বের সমস্ত রূপ—নাদ, কণ্ঠ, রূপ, কাল, জীবন ও জগৎ।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৩৮)-এ এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন “চিতির অভাস”—চেতনা নিজের মধ্যেই কম্পিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তিনি লিখেছেন, “চিতিরভাসসত্তায়াম্‌ বিশ্বসিদ্ধিঃ প্রপঞ্চিতাঃ।”—অর্থাৎ, “চেতনার নিজের অভাস বা আত্মউদ্‌ভাস থেকেই এই সমগ্র বিশ্বসৃষ্টি সম্পন্ন।” এই “অভাস” মানে চেতনার স্ব-প্রকাশ, তার অন্তঃস্পন্দন, যা কোনো বাহ্য শক্তি নয়, বরং চেতনারই অন্তর্গত গতি। এই স্পন্দ তত্ত্বের ইঙ্গিত আমরা স্পন্দকারিকা (১.১)-তে পাই—“চিতিরেতান্নমো ভূয়াৎ‌ স্বানুভূতিয়েতরান্‌ জনান্‌, আনন্দসন্দোহাদ্বিশ্বম্‌ স্পন্দনাত্মনির্মিতম্‌।”—“চিতি নিজ অভিজ্ঞতার আনন্দে স্পন্দিত হয়ে এই বিশ্বকে নির্মাণ করে।” অর্থাৎ, চেতনা নিজের আনন্দে নিজেই কম্পিত হয়, আর সেই আনন্দ-স্পন্দনের ঢেউই জগতের রূপে প্রতিফলিত হয়।

এই ভাবনার সারাংশ শক্তিতত্ত্বেও পাওয়া যায়—যেখানে বলা হয়, “বীজং শক্তিঃ, ফলং বিশ্বম্‌।”—এই বাণী শক্তিসংহিতা তন্ত্র (২.১২)-এর। অর্থাৎ, “পরাশক্তিই বীজ, আর তার ফলই চিদ্রূপ বিশ্ব।” এই কথায় প্রকাশ পেয়েছে এক গভীর অদ্বৈত সত্য—বিশ্ব কোনো শিব থেকে পৃথক সৃষ্টি নয়; এটি শক্তির বিকাশরূপে শিবেরই প্রকাশ। শক্তিই কারণ, বিশ্ব তার ফল; কিন্তু কারণ ও ফল পরস্পরের থেকে পৃথক নয়—যেমন স্বর্ণ ও অলঙ্কার, সাগর ও তরঙ্গ। কুলার্ণব তন্ত্র (১.৮৫)-এ বলা হয়েছে, “বিন্দুনাদকালাতীতং তদেব পরমং পদম্‌।”—অর্থাৎ, “বিন্দু, নাদ ও কাল—এই তিনের অতীত অবস্থাই পরম পদ, ব্রহ্মস্বরূপ।” বিন্দু এখানেও পরমচেতনার নিরাকার একতা, যেখানে সৃষ্টি ও লয় উভয়ই মিলিত।

তন্ত্রে “বিন্দু” বা “কারণ বীজ” মানে শিব-শক্তির একাত্ম অবস্থা—যেখান থেকে চেতনা নিজেকে প্রথম উপলব্ধি করে, এবং সেই আত্ম-উপলব্ধিই স্পন্দ রূপে বিশ্বকে জাগিয়ে তোলে। এই বিন্দু কখনও ক্ষুদ্র নয়; এটি মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে নাদ, শব্দ, রূপ, কাল, ক্রিয়া সবই একমুহূর্তে গৃহীত ও লীন। অভিনবগুপ্তর ভাষায়, যখন চেতনা নিজেকে স্পর্শ করে, তখন সৃষ্টি ঘটে; আর যখন নিজেকে বিশ্রামে রাখে, তখন লয় ঘটে। এই চিরন্তন গতি ও স্থিতির সমাহারই “বিন্দু”—কারণ, শক্তি (বীজ) ও শিব (চেতনা) এখানে অবিচ্ছিন্ন, অনাদি, অনন্ত।

পরমশিবই কারণ বীজ, শক্তিই তার সম্ভাবনা, আর বিশ্ব সেই সম্ভাবনার প্রসারিত রূপ। সৃষ্টি ও স্রষ্টা এক, কারণ সেই এক বিন্দু থেকেই সমস্ত উদ্‌ভব ও পুনর্লয়। তন্ত্রের ভাষায়—“শিবঃ শক্ত্যাযুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ, প্রভবিতুম্‌।” (তন্ত্রালোক ১.৫)—“শিব যখন শক্তির সঙ্গে যুক্ত হন, তখনই তিনি প্রকাশ বা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।” সুতরাং, কারণ বীজ আসলে চেতনার নিজেরই সংহত বিন্দু—যেখানে শিব ও শক্তি, জ্ঞান ও ক্রিয়া, স্থিতি ও স্পন্দ—সবই এক অভিন্ন পরম চেতনার অনন্ত উদ্‌ভাস।

সাংখ্য ও যোগ দর্শনের প্রেক্ষিতে “কারণ বীজ” ধারণাটি এক গভীর দার্শনিক অর্থ বহন করে, কারণ উভয় দর্শনেই সৃষ্টির মূল কারণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে চেতনা (পুরুষ) ও প্রকৃতির দ্বৈত বাস্তবতার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে।

সাংখ্য দর্শনের ভাষায়—“প্রকৃতির্বিকৃতিঃ প্রভবতি” (সাংখ্যসূত্র ১.৬৬)—অর্থাৎ, “সমস্ত বিকার বা কার্য প্রকৃতি থেকেই উৎপন্ন হয়।” এখানে প্রকৃতি কোনো জড় বা নিস্পন্দ পদার্থ নয়, বরং ত্রিগুণাত্মিকা এক আদিম অবস্থা—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণের সাম্যরূপে অব্যক্তভাবে অবস্থান করছে। এই অব্যক্ত, অবিকৃত, অনাদি সত্তাই “প্রধান” বা “মূল প্রকৃতি” নামে পরিচিত। এটি নিজের মধ্যে সমস্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা ধারণ করে—অর্থাৎ, এটি “কারণ বীজ”—কিন্তু নিজে চেতনা নয়। চেতনা, অর্থাৎ “পুরুষ”, এর সংস্পর্শে এলেই প্রকৃতির স্থিতসাম্য ভঙ্গ হয়, আর তখন সৃষ্টি প্রকাশিত হয়।

এই প্রক্রিয়াকে সাংখ্যে বলা হয় “সঙ্ঘর্ষ”—চেতনা (পুরুষ) প্রকৃতিকে আলোকিত করে, আর প্রকৃতি নিজের গুণসমূহের দ্বারা জগৎ নির্মাণে প্রবৃত্ত হয়। কপিল মুনি এই তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করেছেন—“পুরুষার্থমিদং জগৎ‌”—এই জগৎ পুরুষের অভিজ্ঞতার জন্য। প্রকৃতির সংস্পর্শেই মহৎ (বুদ্ধি), অহংকার, তন্মাত্রা, ইন্দ্রিয়, মন—এভাবে চব্বিশ তত্ত্ব বিকশিত হয়। কিন্তু এই সমস্ত কার্যরূপ প্রকাশ প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনারই বিকাশ; চেতনা কেবল আলোকিত করে, নিজে কখনও পরিবর্তিত হয় না। এই অবস্থায় প্রকৃতি সেই “কারণ বীজ”—যেখান থেকে সমস্ত কার্যরূপ প্রকাশ, কিন্তু যেটি নিজে কখনও কার্য নয়।

অন্যদিকে যোগদর্শন, যদিও সাংখ্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত, তবু ঈশ্বরতত্ত্ব যুক্ত করে তাকে আরও গভীর আধ্যাত্মিক মাত্রা দিয়েছে। পতঞ্জলির যোগসূত্র (১.২৪)-এ বলা হয়েছে—“সঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ।”—অর্থাৎ, ঈশ্বর হলেন এক “বিশেষ পুরুষ”, যিনি কখনও “ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়” দ্বারা স্পর্শিত হন না। এই ঈশ্বরই চেতনার পরম ও নিখিলরূপ—যিনি সমস্ত জ্ঞানের আদিসূত্র (সর্বজ্ঞ), এবং যাঁর মধ্যে সমস্ত কর্মের কারণ সুপ্ত থাকে কিন্তু যিনি নিজে কর্মরূপে প্রকাশিত নন। এই অবস্থায় ঈশ্বরই “কারণ বীজ”—চিরশুদ্ধ চেতনা, যিনি সৃষ্টির প্রেরক, কিন্তু কর্মের অংশগ্রহণকারী নন।

যোগসূত্র (১.২৫)-এ আরও বলা হয়েছে—“তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্‌।”—“ঈশ্বরেই সর্বজ্ঞতার আদিবীজ নিহিত।” এখানে “বীজ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেই চিরন্তন জ্ঞানচেতনার প্রতীক হিসেবে, যা থেকে সমস্ত বিজ্ঞান, বোধ এবং চেতনার রূপ উৎপন্ন। এই “সর্বজ্ঞবীজ” ঈশ্বরেরই স্বরূপ; তিনি কালাতীত, কারণ ও কার্যের পারস্পরিক নির্ভরতাকে অতিক্রম করে আছেন।

সাংখ্যে “কারণ বীজ” হলো প্রকৃতি—চেতনার আলোক স্পর্শে প্রকাশিত সম্ভাবনা; যোগে “কারণ বীজ” হলো সেই চেতনা নিজেই—ঈশ্বর বা বিশেষ পুরুষ—যিনি সমস্ত সৃষ্টির উৎস, কিন্তু নিজে কখনও পরিবর্তিত হন না। একদিকে প্রকৃতি হলো “সৃষ্টি-শক্তি”, অন্যদিকে পুরুষ বা ঈশ্বর সেই “সাক্ষী চেতনা”—উভয়ের সংযোগেই বিশ্বরূপ প্রকাশিত।

এই তত্ত্বের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো—সৃষ্টি কোনো বহিরাগত কার্য নয়; এটি প্রকৃতির ভেতরে নিহিত সম্ভাবনার উদ্‌ঘাটন, যা কেবল চেতনার উপস্থিতিতে বিকশিত হয়। তাই ঈশ্বর বা পুরুষ কখনও “করেন” না, তিনি কেবল “অলৌকিক উপস্থিতি” দ্বারা প্রকৃতিকে জাগিয়ে তোলেন—যেমন সূর্য নিজে কিছু করে না, কিন্তু তার আলোয় পদার্থের রং, গতি ও প্রাণ জেগে ওঠে। ঠিক তেমনি চেতনা বা ঈশ্বরই সেই অদৃশ্য কারণ বীজ—যার মধ্যে থেকেই প্রকৃতি, এবং তার দ্বারা জগৎ, চেতনার প্রতিফলন হয়ে উদ্‌ভাসিত হয়।

বৌদ্ধ যোগাচার দৃষ্টিতে “বীজ” (bīja) ধারণাটি ব্যবহৃত হয়েছে “আলয়বিজ্ঞান”-এ—চেতনার গভীরে প্রতিটি অভিজ্ঞতা এক-একটি বীজরূপে স্থিত থাকে, যা পরবর্তীকালে ফল দেয়। এখানে “কারণ বীজ” মানে চেতনার ধারাবাহিকতা, যা কখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় না। জৈন দর্শনে একই ধারণা আত্মার অন্তর্নিহিত শক্তির রূপে প্রকাশিত—প্রত্যেক আত্মায় অসীম জ্ঞান ও শক্তি সুপ্ত থাকে, কিন্তু মলিনতার কারণে তা প্রকাশিত হয় না। যখন অবিদ্যা ও আসক্তি লুপ্ত হয়, তখন সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মুক্তির বৃক্ষে পরিণত হয়।

কারণ বীজ কোনো কল্পিত বা দূরবর্তী ধারণা নয়; এটি চেতনার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার প্রতীক। বৃক্ষ যেমন বীজে নিহিত, তেমনি সমগ্র বিশ্ব কারণ বীজের অন্তর্গত—সৃষ্টির আদিতেও, মধ্যেও এবং অন্তেও সেই চেতনা অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান।