অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৩১



“কারণ বীজই ব্রহ্ম”—এই ঘোষণা বেদান্ত দর্শনের সমস্ত দার্শনিক অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ এখানে “বীজ” মানে কোনো পদার্থগত কারণ নয়, বরং সেই চিরন্তন চেতনা, যিনি সমস্ত অস্তিত্বের উৎস, স্থিতি ও পরিণতির একমাত্র আশ্রয়। ব্রহ্ম এই অর্থে সৃষ্টির ভেতর ও বাইরে উভয় স্থানেই—তিনি “উপাদান কারণ” (যার দ্বারা সৃষ্টি গঠিত) এবং “নিমিত্ত কারণ” (যিনি সৃষ্টির কর্তা)—দুই-ই একসঙ্গে। তাই শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন—“অভিন্ন নিমিত্তোপাদান কারণত্বং ব্রহ্মণঃ।”—ব্রহ্মই সৃষ্টির অভিন্ন কারণ ও উপাদান।

গীতা (৯.১৮)-র বাণী—“গতিঃ ভর্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃত্‌।”—এই ব্রহ্মতত্ত্বেরই সহজ প্রকাশ। অর্থাৎ, তিনি গন্তব্য (সব সত্তার চূড়ান্ত লক্ষ্য), ভর্তা (ধারণকারী, যাঁর দ্বারা সব কিছু স্থিত), প্রভু (নিয়ন্ত্রক), সাক্ষী (অদ্বিতীয় পর্যবেক্ষক), নিবাস (যিনি সব অস্তিত্বের আশ্রয়) এবং সুহৃত (অন্তর্যামী সদয় বন্ধু)। এই এক শ্লোকেই ব্রহ্মের “অস্তিত্বের পূর্ণ চক্র”—উৎপত্তি, স্থিতি, লয় ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষতা—সব একত্রে প্রকাশিত।

এই অর্থে, “কারণ বীজ” ব্রহ্মের আরেক নাম—যিনি অপরিবর্তনীয়, কারণ তিনি কখনও ক্রিয়ার অংশ হন না; অদ্বিতীয়, কারণ তাঁর বাইরে আর কিছুই নেই; সর্বব্যাপী, কারণ তিনি সব কিছুর মধ্যে অন্তর্গত; এবং চিরন্তন, কারণ তিনি কালেরও কারণ। এই ব্রহ্মের ভেতরেই সমস্ত সম্ভাবনা নিহিত—সৃষ্টি, কার্য, কর্ম, সময়, স্থান, এবং প্রতিটি সত্তার জীবন্ত জাগরণ। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩.১)-এ এই সত্য ঘোষণা করা হয়েছে—“যতো বৈ ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎ প্রত্যভিশংবিশন্তি, তদ্বিজ্ঞানস্‌।”—অর্থাৎ, “যার থেকে সমস্ত জীবের জন্ম, যে দ্বারা তারা স্থিত, এবং যে দিকে ফিরে যায়, সেই জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মই কারণ।” এই মন্ত্রটি ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ (সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কারণ) বর্ণনা করে।

এই ব্রহ্মকে “বীজ” বলা হয়, কারণ তিনি সমস্ত অস্তিত্বের “অভ্যন্তর কারণ”—যেমন বীজে বৃক্ষ লুকানো থাকে, তেমনি বিশ্ব ব্রহ্মে সম্ভাবনারূপে বিদ্যমান। কিন্তু এখানে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে—বীজ যখন বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়, তখন বীজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়; কিন্তু ব্রহ্ম কখনও পরিবর্তিত হন না, তবুও তাঁর মধ্য থেকেই সৃষ্টি প্রকাশিত হয়। এই ধারণা স্পষ্ট হয়েছে মুণ্ডক উপনিষদ (১.১.৭)-এ—“যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহণ্তে চ”—“যেমন মাকড়সা নিজের দেহ থেকে জাল তৈরি করে এবং পরে তাতেই ফিরে যায়, তেমনি ব্রহ্ম নিজের থেকেই সৃষ্টি করে, আবার নিজেই সব কিছু টেনে নেন।” এখানে “মাকড়সা” হলো ব্রহ্ম, আর “জাল” হলো বিশ্ব—উভয়ই একই চেতনার দুই ভিন্ন অবস্থান।

ব্রহ্মের এই সৃষ্টিশক্তিকে বেদান্তে বলা হয় “মায়া”—যা “অনির্বচনীয়”, অর্থাৎ না সম্পূর্ণ বাস্তব, না সম্পূর্ণ অবাস্তব। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.১০)-এ বলা হয়েছে—“মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্‌।”—“প্রকৃতিকে জানো মায়া হিসেবে, আর মায়ার অধীশ্বর তিনিই মহেশ্বর।” ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা বিশ্ব প্রকাশ করেন, কিন্তু নিজে তাতে লিপ্ত হন না; তাই তিনি চিরন্তন সাক্ষী। এই মন্ত্রটি শাক্ত এবং শৈব দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যা মায়াকে (জগতের উপাদান) ঈশ্বরের শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ঈশ্বরকে সেই শক্তির নিয়ামক বা স্বামী হিসেবে স্থাপন করে। এটি অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে জগতের মিথ্যাত্বকেও ব্যাখ্যা করে।

এই ব্রহ্মই সেই কারণ বীজ—যিনি নিজের মধ্যেই সমস্ত সম্ভাবনাকে ধারণ করেন। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়, কর্ম ও ফল, জ্ঞান ও অজ্ঞান—সবই তাঁরই ভেতরে চক্রাকারে ঘটে, যেমন সমুদ্রের তরঙ্গ সমুদ্র থেকেই উঠে, সমুদ্রেই বিলীন হয়, আর কখনোই সমুদ্র থেকে পৃথক হয় না।

গীতার ৭.৫ শ্লোকের এই তত্ত্ব—“অপরৈয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মেং পরাম্‌, জীবভূতাম্‌ মহাবাহো, যয়েদং ধার্যতে জগৎ‌।”—বেদান্ত দর্শনের দৃষ্টিতে এক গভীর সৃষ্টিতত্ত্বের প্রকাশ। এখানে কৃষ্ণ কেবল দুটি প্রকৃতির পার্থক্য করছেন না; তিনি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত দ্বিমাত্রিক বাস্তবতাকে উন্মোচন করছেন—একটি জড়, একটি চেতন; একটি সীমিত, একটি অসীম; একটি দৃশ্যমান, একটি অদৃশ্য। কিন্তু এই দুই প্রকৃতি পরস্পর বিরোধী নয়—বরং একই পরম চেতনার দুই রূপ, যেমন ঢেউ ও সমুদ্র আলাদা নয়।

“অপরা প্রকৃতি” হলো সেই নিম্ন শক্তি, যা পদার্থ, মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহং এবং পাঁচ মহাভূত—এই আটভাগে বিভক্ত (গীতা ৭.৪)। এই শক্তি জগৎকে রূপ, গতি ও বৈচিত্র্য দেয়। কিন্তু এই প্রকৃতি নিজে চেতন নয়; এটি যন্ত্রের মতো কাজ করে। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে—“পরঞ্চিখানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভূঃ।” (কঠ উপনিষদ ২.১.১)—“প্রভু এই ইন্দ্রিয়সমূহকে বহির্মুখী করেছেন।” অর্থাৎ, অপরা প্রকৃতি বাহ্যজগতে মনোনিবেশ করে, আর তার ফলে আমরা চেতনার উৎসকে বাইরে খুঁজে ফিরি।

কিন্তু কৃষ্ণ এখানেই বলেন—এই বাহ্য, জড় প্রকৃতির অতিরিক্ত আরেক প্রকৃতি আছে—“পরা প্রকৃতি”—যা “জীবভূতা”, অর্থাৎ জীবরূপে প্রকাশিত চেতনা। এই পরাশক্তিই জগৎকে ধারণ করে—“যয়েদং ধার্যতে জগৎ‌।” অর্থাৎ, জগতের যা স্থিতি, প্রাণ, জ্ঞান, চেতনা—সবই এই পরাশক্তির দ্বারা পরিচালিত।

অদ্বৈত বেদান্তে এই পরাশক্তিই চিদাকাশ—চেতনার আকাশ—যার মধ্যে সব কিছু ঘটে, কিন্তু যা নিজে অচল ও অপরিবর্তনীয়। কৃষ্ণ এখানে বলছেন না যে, জীব ও ঈশ্বর দুই আলাদা সত্তা, বরং জানাচ্ছেন—ঈশ্বরের চেতনার এক ক্ষুদ্র প্রতিফলনই জীবচেতনা। উপনিষদে বলা হয়েছে—“দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া...” (ঋগ্‌বেদ ১০.১১৪.৩, মুণ্ডক উপনিষদ ৩.১.১, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪.৭)—দুই পাখি একই বৃক্ষে বসে আছে—একজন খাচ্ছে (অভিজ্ঞতার ভোক্তা), আর অন্যজন কেবল দেখছে (চেতনার সাক্ষী)। এখানে খাওয়ার পাখি জীব, আর দেখার পাখি ঈশ্বরচেতনা—দুই-ই একই বৃক্ষে, অর্থাৎ একই আত্মায় অবস্থিত।

এই পরাশক্তি বা চেতনার মূলবীজকেই গীতা অন্যত্র (১৫.৭) “মমৈবাংশঃ” বলে ব্যাখ্যা করেছে—“আমারই এক অংশ জীবরূপে প্রকাশিত।” অর্থাৎ, প্রতিটি জীব ঈশ্বরের চেতনারই অংশবিশেষ, যেমন সূর্যের আলো প্রতিটি রশ্মিতে প্রকাশিত হয়, কিন্তু সূর্য নিজে অখণ্ড থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬.১১)-এ বলা হয়েছে—“একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা...”—একই দেবতা সকল সত্তার অন্তরে গোপনে অবস্থান করছেন; তিনি জগতের অভ্যন্তরীণ প্রাণস্বরূপ।

এই শ্লোক হিন্দু দর্শনের ঈশ্বরবাদ (Theism) এবং অদ্বৈতবাদ (Non-dualism)-কে একত্রিত করে। এটি বলে যে, সেই পরম ঈশ্বর বা ব্রহ্মই প্রতিটি জীবের অন্তরে গুপ্ত রূপে অবস্থান করেন, তিনি সমস্ত কর্মের ফলদাতা এবং প্রকৃতির গুণ থেকে মুক্ত শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ।

এই পরাশক্তির কাজ তিন স্তরের—সৃষ্টি (উৎপত্তি), স্থিতি (ধারণ) ও লয় (প্রলয়)। এই তিন ক্রিয়া ত্রিদেব-তত্ত্বের মাধ্যমে প্রতীকায়িত হয়েছে—ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর—কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই তিনই একই চেতনার তিন অভিব্যক্তি। ব্রহ্মসূত্র (১.৪.২৩)-এ শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেন—“জগতঃ কারণং ব্রহ্ম।”—ব্রহ্মই জগতের কারণ, কারণ তিনি মায়া বা প্রকৃতির দ্বারা প্রকাশিত হয়ে এই তিন ক্রিয়ায় নিজেকে অভিনয় করান, তবু নিজে অপরিবর্তিত থাকেন।

তাই কৃষ্ণ যখন বলেন, “যয়েদং ধার্যতে জগৎ‌”—এর অর্থ, চেতনা নিজে জগৎকে ধারণ করছে, কিন্তু জগৎ চেতনার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। যেমন সূর্যের আলোয় পৃথিবীর কার্য ঘটে, কিন্তু পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন সূর্যকে স্পর্শ করে না। এই চেতনার পরাশক্তি স্থিত, নিরাকার, নিঃসংশ্লেষ, তবু সর্বত্র কার্যকর।

এই তত্ত্বের আরেক গভীর দিক হলো—জীব, প্রকৃতি ও ঈশ্বর একে অপরের ভিন্ন নয়, বরং বিভিন্ন স্তরের প্রকাশ। শ্রীমদ্‌ভাগবত (৩.২৬.৩)-এ বলা হয়েছে—“সত্ত্বং রজস্তম ইতি প্রকৃতিঃ ন গুণা মতাঃ। পুরুষঃ শোকমোহাভ্যাং বিমুক্তো বিমুচাতে।।” তৃতীয় স্কন্ধের এই শ্লোকটি আসলে শ্রীভগবান্‌ কপিলদেবের শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা, যেখানে তিনি তাঁর মাতা দেবহূতিকে পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন—এটি ভগবত দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু, যা পরে যোগ, সাংখ্য ও অদ্বৈত দর্শনের সেতুবন্ধন তৈরি করে।

এখানে বলা হয়েছে, সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিনটি প্রকৃতির গুণ বা ধর্ম; এগুলি পুরুষ বা চেতনার গুণ নয়। পুরুষ স্বভাবতই নির্গুণ, অর্থাৎ এই তিন গুণের ঊর্ধ্বে। এই ধারণাটি সাংখ্য দর্শন ও গীতা (১৪.২২-২৫) উভয় স্থানেই বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছে—“গুণানেতানতীত্য ত্রিন্‌ দেহী দেহসমুদ্ভবান্‌... সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।”—অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি এই তিন গুণ অতিক্রম করে, তিনি সুখ-দুঃখে, সোনা-মাটিতে, জয়-পরাজয়ে সমান—সেই চেতনা আর প্রকৃতির পরিবর্তনে প্রভাবিত হয় না।

শ্রীমদ্‌ভাগবতের এই শ্লোক সেই তত্ত্বকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে: আত্মা প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সে কেবল সাক্ষী। যতক্ষণ আত্মা প্রকৃতিকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে দেখে—অর্থাৎ দেহ, মন, বুদ্ধি, অহং-কে ‘আমি’ বলে ভাবতে থাকে—ততক্ষণ সে মোহ ও শোক দ্বারা আক্রান্ত। কিন্তু একবার যখন জ্ঞানী উপলব্ধি করেন যে, এই সকল গুণ কেবল প্রকৃতির বিকার, তখন তাঁর মধ্যে আত্মা ও অনাত্মার পার্থক্য (বিবেক) জাগে, এবং সেই বিভাজনের মধ্য দিয়েই মুক্তির সূচনা ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, যেমন আয়নায় প্রতিবিম্ব নড়াচড়া করে, কিন্তু মুখ নিজে স্থির থাকে—তেমনি প্রকৃতির তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) সর্বদা পরিবর্তনশীল, অথচ পুরুষ বা আত্মা চিরস্থির, চিরসাক্ষী। কঠোপনিষদ (২.১.১১) এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.১৯, ৪.৫.১৫)-এ বলা হয়েছে—“অযং পুরুষো নাভ্যগ্রাহ্যো, নেহনানাস্তি কিঞ্চন।”—“এই পুরুষ (আত্মা) স্পর্শাতীত এবং এখানে কোনো দ্বৈততা নেই।” আত্মা হলেন অস্পৃশ্য, নির্গুণ এবং একমাত্র সত্য, এবং এই জগতে ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নেই—সব কিছুই এক ও অদ্বিতীয় (অদ্বৈত)।

“শোক-মোহাভ্যাং বিমুক্তঃ”—এই বাক্যাংশ মুক্তির নির্ণায়ক: শোক (দুঃখ) মানে তামসিক অন্ধকার, আর মোহ (আসক্তি ও বিভ্রম) মানে রজসিক গতি; যখন এই দুটি শক্তি নিবারিত হয়, তখন সত্ত্ব স্বচ্ছ হয়—আর সত্ত্বের স্বচ্ছতাতেই আত্মার দীপ্তি প্রতিফলিত হয়।

গীতার (১৪.১৭) শ্লোকটি হলো—সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং রজসঃ লোভ এব চ। প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতো জ্ঞানমেব চ।। এর অর্থ: সত্ত্বগুণ থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান; রজোগুণ থেকে জন্ম নেয় লোভ; আর তমোগুণ থেকে জন্ম নেয় প্রমাদ (অবিবেচনা), মোহ (অজ্ঞান) এবং অন্ধকার। এখানে শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতির তিনটি মৌলিক গুণ—”সত্ত্ব, রজ, তম”-এর দ্বারা মানবচেতনার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করেছেন। এই তত্ত্ব বেদান্ত, সাংখ্য এবং যোগ—সব দর্শনেরই অভিন্ন ভিত্তি।

সত্ত্ব (শুদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সাম্য) হলো চেতনার আলো। এটি জ্ঞান, শান্তি ও সমত্বের মূল উৎস। যখন মন সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং আত্মার প্রতিফলন তাতে স্পষ্ট দেখা যায়। যেমন একটি শান্ত, স্থির জলে আকাশের প্রতিবিম্ব সম্পূর্ণ স্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু জলে ঢেউ উঠলে বা কাদা জমলে সেই প্রতিবিম্ব বিকৃত হয়—তেমনি মন যখন রাজসিক কর্মোদ্যম বা তামসিক জড়তার প্রভাবে অশান্ত হয়, তখন আত্মার দীপ্তি আচ্ছন্ন হয়; কিন্তু সত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হলে সেই আত্মজ্যোতি পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হয়।

ব্রহ্ম বা পরমচেতনা নিজেই সমস্ত আলোর উৎস, যাঁকে আলোকিত করতে অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন হয় না। কঠোপনিষদ (২.২.১৫)-এ বলা হয়েছে—“ন তত্র সূর্যো ভবতি, ন চন্দ্রতারকম্‌ নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতো’য়মগ্নিঃ। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং, তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।” অর্থাৎ, “যেখানে সূর্য, চন্দ্র, তারা কিংবা অগ্নি কোনো আলো দেয় না, সেখানে কেবল সেই ব্রহ্মেরই দীপ্তি সর্বত্র বিরাজমান; তাঁর আলোর দ্বারাই এই সমস্ত জগৎ আলোকিত।”