এখানে—
“শান্তম্” মানে সেই নিস্তরঙ্গ চৈতন্য, যেখানে কোনো বিকার নেই, কোনো গতি নেই;
“শিবম্” মানে পরম মঙ্গল—যিনি কল্যাণের উৎস, দুঃখের অতীত, সম্পূর্ণ পূর্ণতা;
“অদ্বৈতম্” মানে যিনি এক, দ্বিতীয় কিছুর দ্বারা সীমাবদ্ধ নন।
এই তিনটি শব্দ—শান্ত, শিব, অদ্বৈত—একত্রে আত্মার পরম স্বরূপকে প্রকাশ করে। তিনি অভিজ্ঞতার কোনো বস্তু নন, তিনি অভিজ্ঞতার স্বয়ং আলোকদাতা। তাঁর মধ্যে জাগতিক ভেদ-অভেদ, সুখ-দুঃখ, জানা-অজানার দ্বন্দ্ব বিলীন হয়। “শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্” কেবল বর্ণনা নয়, এটি এক অনুভববাক্য—যেখানে আত্মা প্রকাশিত হয় তার স্বরূপে: নিস্তরঙ্গ শান্তি, চিরমঙ্গলময় শিবত্ব, আর অখণ্ড অদ্বৈত সত্তা। এই উপলব্ধিতেই আত্মা ব্রহ্মে মিলে যায়, যেখানে জানার আর কিছু থাকে না—কেবল চিরন্তন আত্মদীপ্তি।
এই আত্মচেতনা তিনটি অভিজ্ঞতাজগৎ অতিক্রম করে—জাগ্রত (বহিরানুভব), স্বপ্ন (অন্তরানুভব) ও সুষুপ্তি (অবিদ্যার আনন্দ)। কিন্তু এই তিন অবস্থাই তুরীয় চৈতন্যের ওপর ভর করে থাকে। এই তুরীয়ই আত্মার স্বরূপ—চিদানন্দ, যা কখনও ভাঙে না, হারায় না, কেবল প্রকাশিত হয়।
জাগ্রত, স্বপ্ন ও গভীর নিদ্রা—এই তিন তরঙ্গের পেছনে যে অবিচল সত্তা, তাকেই বলা হয় আত্মা। সে দৃশ্যমান নয়, তবু সকল দৃশ্যের আলোকদাতা। সে সৃষ্টি করে না, তবু সমস্ত সৃষ্টি তার মধ্যেই ঘটে। এই উপলব্ধিই মুক্তি—যেখানে জীব অবিদ্যার সমস্ত স্তর ভেদ করে নিজের শুদ্ধ চৈতন্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
গীতার ৫.৮-৯ শ্লোকদুটি কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মিলনবিন্দু—যেখানে কৃষ্ণ দেখিয়েছেন, সত্য জ্ঞানী ব্যক্তি কখনও “কর্ম করেন না”, অথচ তাঁর মধ্য দিয়েই সমস্ত কর্ম সম্পন্ন হয়।
“নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ। পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।” (৫.৮) অর্থাৎ, ব্রহ্মে যুক্ত তত্ত্বজ্ঞানী (যিনি আত্মাকে জেনেছেন) ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, আঘ্রাণ, আহার, গমন, নিদ্রা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সমস্ত কাজ করার সময়ও মনে করেন, "আমি কিছুই করছি না"।
“প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্ণন্নুন্মেষন্ নিমেষন্নপি বা। ইন্দ্রিয়েন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।।” (৫.৯) অর্থাৎ, তিনি কথা বলা, ত্যাগ করা (মলমূত্র), গ্রহণ করা, চোখ খোলা বা বন্ধ করার মতো সব কাজ করার সময়েও এই দৃঢ় ধারণা রাখেন যে, "ইন্দ্রিয়গুলিই তাদের নিজ নিজ বিষয়ের (ইন্দ্রিয়ার্থেষু) মধ্যে বিচরণ করছে।"
এই দুটি শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগের মূল দর্শন ব্যাখ্যা করছেন: আত্মা অকর্তা। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, সমস্ত শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপ প্রকৃতির গুণসমূহ (সত্ত্ব, রজ, তম) দ্বারা চালিত ইন্দ্রিয়গুলি সম্পন্ন করে। জ্ঞানী এই ক্রিয়াগুলিরসাক্ষী মাত্র, তাই তিনি নিজেকে কর্মের ফল বা বন্ধনের সঙ্গে যুক্ত করেন না, ফলে তিনি মুক্ত থাকেন।
তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি ব্রহ্মতত্ত্ব জানেন, তিনি জানেন যে, “আমি কিছুই করি না”। দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, গন্ধ নেওয়া, খাওয়া, চলা, ঘুমানো, শ্বাস নেওয়া—সবই ইন্দ্রিয়ের কার্য; আর ইন্দ্রিয়েরা ইন্দ্রিয়বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল। তিনি মনে করেন না যে, “আমি করছি”, বরং উপলব্ধি করেন, সমস্তই ব্রহ্মে নিবিষ্ট।
এই কথার দার্শনিক মর্ম এই—অদ্বৈত বেদান্তে “কর্ম” ও “কর্তা”র বিভেদই মায়ার মূল। সাধারণ মানুষ মনে করে, “আমি দেখি”, “আমি শুনি”, “আমি খাই”, কিন্তু “আমি” আসলে সেই আত্মা নই, যিনি চিরসাক্ষী, কর্মের অংশগ্রহণকারী নন। আত্মা নিজে কোনো কাজ করে না—ইন্দ্রিয় ও মনই প্রকৃতির উপাদান হিসেবে ক্রিয়াশীল। গীতা (৩.২৭)-এ কৃষ্ণ এই কথাই বলেছেন—“প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ। অহংকারবিমূঢাত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।”—অর্থাৎ, প্রকৃতিই গুণসমূহের দ্বারা সমস্ত কর্ম সম্পন্ন করে, কিন্তু অহংকারে মোহিত ব্যক্তি ভাবে, “আমি করছি।”
যখন সাধক “তত্ত্বজ্ঞ” হন—অর্থাৎ ব্রহ্মের ঐক্য উপলব্ধি করেন—তখন তাঁর মনে আর কোনো কর্তৃত্ববোধ থাকে না। দেখা, শোনা, স্পর্শ—সবই ঘটে, কিন্তু তিনি জানেন, তা চেতনার মধ্যে ঘটছে; চেতনা নিজে অচল, অক্রিয়, নিস্পৃহ। যেমন আয়না সব ছবি প্রতিফলিত করে কিন্তু কোনো ছবি ধারণ করে না, তেমনি আত্মা সমস্ত কর্ম, অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কখনও তাতে লিপ্ত হয় না।
এই অবস্থাতেই মানুষ প্রকৃত “যোগী”—যিনি জগতের মধ্যে থেকেও জগতের ঊর্ধ্বে। তাঁর ক্রিয়া, বাক্য, চিন্তা—সবই স্বতঃস্ফূর্ত, অহংবর্জিত। তিনি জানেন, কর্ম চলছে, কিন্তু কর্তা কেউ নেই; ফল আসছে, কিন্তু ভোগী কেউ নেই। সবই ব্রহ্মচেতনারই উদ্ভাস—যেখানে “আমি” আর “কর্ম” আলাদা নয়, উভয়ই সেই এক চেতনার তরঙ্গ।
এই অবস্থাই গীতার পরিভাষায় স্থিতপ্রজ্ঞ বা জীবন্মুক্ত অবস্থা—যেখানে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা ঈশ্বরানুভূতিরই প্রকাশ। তিনি বাহ্যত খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, কথা বলছেন, কিন্তু অন্তরে জানেন—“ইন্দ্রিয়েন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্”—ইন্দ্রিয়ই ইন্দ্রিয়বস্তুর সঙ্গে লীন, আত্মা নয়।
এই শ্লোকের মূল শিক্ষা হলো—সত্য জ্ঞান মানে কর্ম ত্যাগ নয়, বরং কর্তৃত্ববোধের ত্যাগ। যখন জানার ব্যক্তি নিজেকে কর্মের সাক্ষী হিসেবে উপলব্ধি করে, তখন জীবনই হয়ে ওঠে উপাসনা—প্রত্যেক কর্মই ব্রহ্মে নিবিষ্ট, প্রতিটি নিঃশ্বাসই "ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।" (ঈশাবাস্য উপনিষদ, মন্ত্র ১) অর্থাৎ, এই জগতে যা-কিছু চলছে, সবই ঈশা (ঈশ্বর/ব্রহ্ম) দ্বারা আবৃত বা নিয়ন্ত্রিত।—এই জ্ঞানে দীপ্ত।
শেষপর্যন্ত এই সাক্ষীভাবই জীবনের পরিণতি—যেখানে আর কিছু অর্জনের নেই, কিছু ত্যাগেরও নেই। সব কিছু আত্মাতেই লীন, আত্মা সব কিছুর মধ্যেই দীপ্ত। এই অবস্থাতেই জ্ঞান ও মুক্তি এক, সাধনা ও সিদ্ধি অভিন্ন। এখানেই বেদান্তের চূড়ান্ত ঘোষণা—“ব্রহ্ম বিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি।” (মুণ্ডক উপনিষদ: তৃতীয় মুণ্ডক, দ্বিতীয় খণ্ড, মন্ত্র ৯)—যিনি ব্রহ্মকে জানেন (উপলব্ধি করেন), তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।
রূপকের মাধ্যমে আত্মা ও জগতের সম্পর্ক যে কত সূক্ষ্ম ও অভিজ্ঞতামূলক, তা ধাপে ধাপে উপলব্ধি করা যায়। দর্শনের ভাষা এখানে কেবল ধারণার বর্ণনা নয়, বরং অভিজ্ঞতার প্রতীকভাষা—যাতে চেতনা নিজের প্রকৃতি চিনে নিতে পারে।
ঘট-আকাশ-মহাকাশ ন্যায় এর প্রথম উদাহরণ। একটি মাটির ঘট বা পাত্রের ভেতরে যে-আকাশ আছে, সেটি বাইরে আকাশ থেকে আলাদা নয়। ঘট ভাঙলেই বোঝা যায়, আকাশ কখনও ভেতরে-বাইরে বিভক্ত ছিল না; বিভাজনটি ঘটের সীমানার ভ্রম। তেমনি, আমাদের শরীর বা মনও আত্মার সীমা নয়, বরং এক অস্থায়ী উপাধি—যা চেতনার অসীম বিস্তারে আপাত এক পরিধি তৈরি করে। আত্মা সর্বব্যাপী মহাকাশের মতো; দেহ বা মন কেবল ঘটের মতো, যা একসময় বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু আত্মা থাকে অবিচ্ছিন্ন, অপরিবর্তনীয়। এই ন্যায় শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে ব্যবহার করেছেন, এটা দেখানোর জন্য যে, আত্মা কখনও দেহ বা মন দ্বারা সীমাবদ্ধ হয় না, যেমন আকাশ কখনও ঘট দ্বারা বিভক্ত হয় না।
এরপর আসে দর্পণ-প্রতিবিম্ব ন্যায়। এখানে মুখ আত্মার প্রতীক, আর দর্পণ হলো মন। দর্পণের স্বচ্ছতা যেমন প্রতিফলনের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করে, তেমনি মন যত পরিশুদ্ধ হয়—রাগ, দ্বেষ, অহংকার থেকে মুক্ত হয়—ততই আত্মার আলো তাতে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়। যখন মন অশান্ত, তখন প্রতিফলন বিকৃত; আত্মা তখনও অপরিবর্তিত, কিন্তু প্রতিফলন বিকৃত বলে আমরা মনে করি, আত্মা আচ্ছন্ন। যেমন মেঘ সূর্যকে ঢাকে না, কেবল আমাদের দৃষ্টি আড়াল করে, তেমনি মন মলিন হলে আত্মা লুকিয়ে যায় বলে মনে হয়।
শুক্তি-রজত ন্যায় বা ঝিনুকের উদাহরণটি অদ্বৈতের এক গভীর রূপক। চাঁদের আলোয় ঝিনুকের খোলস রুপার মতো দেখায়—এটাই মায়া। এখানে জ্ঞানের ভ্রম আমাদের প্রতারিত করে; আমরা যা দেখি, তা সত্য মনে করি, অথচ ঝিনুক কখনও রুপায় পরিণত হয়নি। জ্ঞান প্রকাশিত হলে—অর্থাৎ আলো বাড়লে—ভ্রম লুপ্ত হয়। তেমনি, আত্মা সর্বদা ব্রহ্ম, কিন্তু অবিদ্যার অন্ধকারে আমরা দেহ, মন ও কর্মকে আত্মা বলে ভুল করি। জ্ঞান উদিত হলে সেই ভুল মুছে যায়, কিন্তু আত্মার স্বরূপে কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
আর রাহু-চন্দ্র-গ্রহণ দৃষ্টান্ত হলো অবিদ্যার সীমিত শক্তির চমৎকার রূপক। আকাশে চাঁদের উপর ছায়া পড়ে, মনে হয়, যেন রাহু চাঁদকে গ্রাস করেছে; কিন্তু বাস্তবে ছায়া কেবল চোখে-পড়া এক প্রতিবিম্ব। চাঁদ অক্ষত থাকে। তেমনি, অবিদ্যা বা মায়া আত্মার দীপ্তিকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, কেবল দৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটায়—আমরা “অন্ধকার” বলে যা দেখি, তা আত্মার দীপ্তির অনুপস্থিতি নয়, উপলব্ধির অভাব।
এই ন্যায়গুলির মাধ্যমে শরীর-ত্রয়ের ধারণাও স্পষ্ট হয়। স্থূল শরীর, যা পাঁচটি মহাভূত দ্বারা গঠিত, জাগ্রত অবস্থায় সক্রিয়—আমাদের দৃশ্যমান দেহ, যা খাদ্য দ্বারা পুষ্ট ও মৃত্যুর দ্বারা নশ্বর। সূক্ষ্ম শরীর, যা মন, বুদ্ধি, অহং ও প্রাণের সমষ্টি—এটি স্বপ্নাবস্থায় ক্রিয়াশীল, যেখানে আমরা দেহ ছাড়াও চিন্তা ও অনুভব করি। কারণ শরীর, যা অবিদ্যা ও সংস্কারের ভাণ্ডার—সুষুপ্তিতে সক্রিয় থাকে, যখন সব কর্ম ও চিন্তা নিস্তব্ধ, কিন্তু চেতনা সুপ্ত সম্ভাবনায় রয়ে যায়।
এই তিন শরীরের মধ্যে আত্মা সর্বদা নিত্য, স্থিত ও অক্রিয়। স্থূল শরীর ক্রিয়াশীল, সূক্ষ্ম শরীর চিন্তাশীল, কারণ শরীর সম্ভাবনাময়—কিন্তু আত্মা সব কিছুর সাক্ষী, যিনি কখনও “করেন না”, কেবল “আলোকিত করেন”।
এসব রূপক আমাদের শেখায়—জ্ঞান কেবল দার্শনিক ধারণা নয়, বরং অন্তর্জগতের এক প্রতিফলিত অভিজ্ঞতা। যখন কেউ এই ন্যায়গুলি হৃদয়ে আত্মস্থ করে, তখন সে বুঝতে শুরু করে, আত্মা দেহে আবদ্ধ নয়, মন দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়, বরং সব কিছুর মধ্যে আলোকিত সেই এক চেতনা—যার সাক্ষাৎই সত্য ব্রহ্মজ্ঞান।
মুক্তি অর্থ এই তিন স্তরের সঙ্গে অভিন্নতাকে অতিক্রম করা। যখন অনুসন্ধানকারী উপলব্ধি করেন যে, “আমি দেহ নই”, “আমি মন নই”, “আমি কারণ বীজও নই”—তখন তিনি শর্তহীন আত্মা, অদ্বিতীয় চেতনা হিসেবে নিজেকে চেনেন। তখন জীব আর শরীরের অধিবাসী সত্তা নয়; সে ব্রহ্মের স্বয়ং প্রকাশ।
“কারণ বীজ” শব্দবন্ধটি ভারতীয় দর্শনের অন্যতম মৌল ধারণা—যেখানে সৃষ্টি, চেতনা ও ব্রহ্মের পারস্পরিক সম্পর্ক এক অনন্ত চক্রে ব্যাখ্যা পায়। বেদান্ত, তন্ত্র, সাংখ্য, যোগ, জৈন ও বৌদ্ধ প্রত্যেক দর্শনই এই “কারণ বীজ” বা “মূল কারণ”-এর ধারণাকে নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করেছে। কিন্তু সকলের গভীরে এক অদ্বৈত সত্য নিহিত—সৃষ্টি কখনও শূন্য থেকে নয়, বরং চেতনারই প্রকাশরূপে উদ্ভাসিত হয়।
বেদান্ত মতে, “কারণ বীজ” মানে ব্রহ্ম নিজেই—সেই চিরন্তন চেতনা, যিনি সৃষ্টির কর্তা, উপাদান ও নিয়ন্ত্রক। ব্রহ্মসূত্র (১.১.২)-এ বাণী এসেছে—“জন্মাদ্যস্য যতঃ”—অর্থাৎ, "যা থেকে এই জগতের জন্ম (সৃষ্টি), স্থিতি (পালন) এবং লয় (বিনাশ) হয়, তিনিই ব্রহ্ম।" এই সূত্রটি ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ (তাঁর কার্যগত বৈশিষ্ট্য) নির্ধারণ করে। এই সূত্রটি প্রমাণ করে যে, ব্রহ্মই হলেন এই নিখিল জগতের পরম কারণ বা আদি উৎস। এটিই ব্রহ্মকে জানার প্রথম দার্শনিক পদক্ষেপ।
শঙ্করাচার্য এখানে স্পষ্ট বলেছেন, এই ব্রহ্মই “অভিন্ন নিমিত্তোপাদান কারণ”—অর্থাৎ, তিনি কর্তা (নিমিত্ত) ও উপাদান (উপাদান) উভয়ই। তাই গীতা (৭.১০)-এ কৃষ্ণ ঘোষণা করেন—“বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্। বুদ্ধি বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।।”—"হে পার্থ, আমাকেই সকল প্রাণীর চিরন্তন বীজ বা আদি কারণ বলে জানো। আমি বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।" এই শ্লোকটি বোঝায় যে, জগতের প্রতিটি বস্তুর মূলে যে সৃষ্টির শক্তি বা সনাতন সত্তা নিহিত আছে, তা স্বয়ং ভগবানই (ব্রহ্ম)। এটি “কারণ বীজ” ধারণার সবচেয়ে সুস্পষ্ট বেদান্তীয় ব্যাখ্যা—ঈশ্বরই সেই আদিবীজ, যিনি সমস্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা নিজের মধ্যে ধারণ করে আছেন। যেমন বীজের মধ্যে বৃক্ষের পূর্ণ রূপ গোপনে থাকে, তেমনি ব্রহ্মের মধ্যেই সমস্ত নাম-রূপ সম্ভাবনারূপে নিহিত।