যখন বুদ্ধি দীর্ঘ সাধনা, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা ক্রমশ পরিশুদ্ধ ও স্থিত হয়, তখন মানুষের অন্তরে এক অদ্বিতীয় বাঁকবদল ঘটে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৪.২ এবং ৩.৭.২৩)-এ বলা হয়েছে—“তম্ এষ আত্মা অনুদ্রষ্টা দ্রষ্টা, অশ্রোতা শ্রোতা, অমতো মতা, অজ্ঞানো জ্ঞাতা”—অর্থাৎ, আত্মা কখনও ইন্দ্রিয়ের বস্তু নয়, সে নিজেই সকল অভিজ্ঞতার সাক্ষী। আমাদের চক্ষু যে দেখে, কর্ণ যে শোনে—এই দেখা ও শোনার পিছনে একটি শাশ্বত শক্তি রয়েছে। এই শক্তিই হলো আত্মা। এটি কেবল সাক্ষী (অনুদ্রষ্টা) হিসেবে বিদ্যমান। চোখকে আমরা দেখতে পাই না, কানকে আমরা শুনতে পাই না, কিন্তু এদের কাজ করার মূল কারণ এই আত্মা। আত্মা হলেন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মতা (মননকারী) এবং জ্ঞাতা (জানার কর্তা)—কিন্তু ইনি নিজেই নিজের বাইরে কোনো কিছুর দ্বারা দৃষ্ট, শ্রুত বা জ্ঞাত হন না। ইনি সর্বভূতের অন্তরে স্থিত।
সাধনা যখন মননের এই বিন্দুতে পৌঁছায়, তখন অবিদ্যার কার্যক্ষম ঘূর্ণন নিঃশেষিত হয়; অজ্ঞানতার বৃত্ত নিজে থেকেই থেমে যায়, এবং আত্মা-জ্ঞান উদিত হয়—যা কোনো নতুন তথ্যের অর্জন নয়, বরং সেই চিরন্তন সত্যের স্বতঃপ্রকাশ, যা সর্বদাই উপস্থিত ছিল।
এই জ্ঞান কোনো কার্যসিদ্ধ ফল নয়; এটি এক উন্মোচন, অলৌকিক সৃষ্টির নয়, মেঘ-সরে-যাওয়া সূর্যের মতো। যেমন সূর্য সর্বদাই উদিত, কেবল মেঘের আচ্ছাদন সরলেই দেখা যায়—তেমনি মুক্তি কোনো কৃত কর্মফল নয়, বরং আত্মার নিজ দীপ্তির স্বীকৃতি। মুন্ডক উপনিষদ (১.২.১২)-এ বলা হয়েছে—“পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো নির্বেদমায়ান্। নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন। তদ্ বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ সমিৎপাণিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্।।”—অর্থাৎ, "ব্রাহ্মণ (জ্ঞানার্থী) এই কর্ম দ্বারা অর্জিত লোকসমূহকে পরীক্ষা করে (বিচারপূর্বক) যেন বৈরাগ্য লাভ করেন, কারণ নিত্য বস্তু (মোক্ষ) অনিত্য কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত হয় না। সেই জ্ঞান লাভের জন্য তিনি হাতে সমিধ নিয়ে বেদজ্ঞ ও ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুকেই আশ্রয় করবেন।" জ্ঞানী জানেন, যে-কোনো কর্ম দ্বারা সেই অক্ষরাত্মা লাভ হয় না, কারণ কর্মের ফল ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আত্মা অনাদি ও অব্যয়।
বৈদিক কর্ম বা যজ্ঞের মাধ্যমে যে-ফল (যেমন স্বর্গ বা অন্যান্য ভোগস্থান) লাভ করা যায়, তা সবই অনিত্য ও নশ্বর। কারণ, যা-কিছু কাজ (কৃত) দ্বারা অর্জিত, তা চিরস্থায়ী হতে পারে না। এই সত্য উপলব্ধি করে জ্ঞানার্থী ব্যক্তিকে বৈরাগ্য অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু কর্মের ফল দ্বারা মোক্ষ বা ব্রহ্মজ্ঞান (যা অকৃত/নিত্য) লাভ করা যায় না, তাই সেই জ্ঞান লাভের জন্য (তদ বিজ্ঞানার্থং), তিনি অবশ্যই গুরুকে আশ্রয় করবেন (গুরুমেব অভিগচ্ছেৎ)—যিনি হাতে সমিৎ (পূজার কাঠ) নিয়ে যাবেন, যিনি বেদজ্ঞ (শ্রোত্রিয়ম্) এবং ব্রহ্মে নিষ্ঠাবা (ব্রহ্মনিষ্ঠম্)।
অবিদ্যার দুটি শক্তি—আবরণ (আত্মাকে গোপন করা) ও বিক্ষেপ (ভুল আরোপণ)—এই জ্ঞানের আলোয় ক্রমে বিলীন হয়। প্রথমে আবরণ-নিবৃত্তি ঘটে: অজ্ঞানতার পর্দা সরে যায়, আত্মা দৃশ্যমান হয়। তারপর বিক্ষেপ-নিবৃত্তি—ভুল প্রক্ষেপণ, যেমন “আমিই দেহ”, “আমিই মন”, “আমিই কর্তা”—নিজে থেকেই পতিত হয়। একবার যখন দ্রষ্টা ও দৃশ্যের পার্থক্য স্পষ্ট হয়, তখন মিথ্যা আরোপণ নিজের শক্তি হারায়, এবং আত্মা উপলব্ধি করে—“আমি ব্রহ্ম”—অহং ব্রহ্মাস্মি। কৈবল্যোপনিষদ (২.১০) এই সত্য ঘোষণা করে—"স এব সর্বং যদ্ ভূতং যচ্চ ভব্যং সনাতনম্। জ্ঞাপয়িত্বা স্বমাত্মানং সর্বং তু পরিকল্লিতম্।।”—সেই (আত্মাই) সব কিছু—যা ছিল (অতীত), যা হবে (ভবিষ্যৎ), এবং যা-কিছু সনাতন (চিরন্তন)। নিজের স্বরূপ (আত্মা)-কে জানলে, এই দৃশ্যমান সবকিছুই কেবল কল্পনা (মায়া বা আরোপ) বলে জ্ঞান হয়। আমি-ই ব্রহ্ম, এর বাইরে কিছু নেই।
এই পর্যায়ে সাধক আত্মা ও অনাত্মার মধ্যকার সূক্ষ্ম বিভাজন উপলব্ধি করতে শেখেন। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.১-৫)-এ বর্ণিত “পঞ্চকোষ” তত্ত্বে আত্মার এই পর্যায়ক্রমিক উন্মোচন স্পষ্ট করা হয়েছে—অন্নময় (দেহ), প্রাণময় (প্রাণ), মনোময় (মন), বিজ্ঞানময় (বুদ্ধি), আনন্দময় (সুখবোধ)—এই পাঁচ আবরণ একে একে অতিক্রম করে আত্মা নিজেকে চিনে ফেলে। এই অতিক্রমণের পথই “নেতি নেতি”—“এটা নয়, এটা নয়”—যা বৃহদারণ্যক উপনিষদ (২.৩.৬)-এ বলা হয়েছে, আত্মাকে কোনো বিশেষ গুণে নির্ধারণ করা যায় না, কারণ সে গুণাতীত।
যখন সাধক উপলব্ধি করেন যে, মন, বুদ্ধি, চিন্তা—সবই চেতনার দৃশ্যমাত্র, তখন এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি জাগে: দ্রষ্টা কখনো দৃশ্য নয়, এবং যা দেখা যায়, তা দ্রষ্টার বাইরে। এই উপলব্ধিই “দৃক্-দৃশ্য-বিবেক” তত্ত্বের মূল; দ্রষ্টা চিরসাক্ষী, পরিবর্তনের অতীত, আর দৃশ্য পরিবর্তনশীল, অনিত্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি অদ্বৈতের পরম বাস্তববোধের কেন্দ্র, যেখানে চেতনা অপরিবর্তনীয় সত্য, বাকিসব তারই প্রতিফলন।
বোধের স্তরেই মানুষের চেতনা তার সমস্ত আপেক্ষিক অবস্থা অতিক্রম করে চিরন্তন আত্মস্বরূপে স্থিত হয়। জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিনটি অবস্থাই আত্মার অভিব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গমাত্র। মাণ্ডূক্য উপনিষদ এই তিন অভিজ্ঞতাকে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, জাগ্রত অবস্থায় চেতনা বহির্মুখ—ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জগতকে আলোকিত করে; স্বপ্নে মন নিজেই সৃষ্ট জগৎকে দেখায়; আর সুষুপ্তিতে মন ও ইন্দ্রিয় উভয়ই লীন, সেখানে জ্ঞান-অজ্ঞান, সুখ-দুঃখ—সব দ্বন্দ্ব ক্ষণিকভাবে নিস্তরঙ্গ। কিন্তু তবুও আত্মা সেখানে অবিচল সাক্ষী—সে ঘুমের আনন্দকেও আলোকিত করে।
এই তিন অভিজ্ঞতা—বহির, অন্তর ও আচ্ছন্ন—সবই পরিবর্তনশীল। কিন্তু যে-চেতনা এই তিনটির মধ্যেও অবিচল থাকে, যার কোনো বিকার বা সীমা নেই, তাকেই তুরীয় বলা হয়েছে। মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৭)-এর মূল বাণী—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বহিঃপ্রজ্ঞং, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞং, ন প্রজ্ঞানঘনম্, ন প্রজ্ঞং, ন অপ্রজ্ঞং; অদৃষ্টম্, অব্যবহার্যম্, অগ্রাহ্যম্, অচিন্ত্যম্, অব্যপদেশ্যম্, একাত্মপ্রত্যয়সারম্, প্রপঞ্চোপশমম্, শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতম্—চতুর্থম্ মন্যন্তে, স আত্মা, স বিজ্ঞেয়ঃ।” অর্থাৎ, আত্মা না অন্তরের, না বহিরের, না চিন্তাযোগ্য, না বর্ণনাযোগ্য; সে এক, নিস্তরঙ্গ, শান্ত, শুভ, অদ্বৈত—তাকেই চতুর্থ, তুরীয় বলা হয়, আর তাকেই জানা প্রয়োজন।
“নান্তঃপ্রজ্ঞম্”—না (নয়) + অন্তঃপ্রজ্ঞ (যা ভেতরের জ্ঞানসম্পন্ন, অর্থাৎ স্বপ্নের মতো অন্তর্মুখ চেতনা) অর্থাৎ, আত্মা কোনো অন্তর্মুখী জ্ঞান নয়।
“ন বহিঃপ্রজ্ঞম্”—না (নয়) + বহিঃপ্রজ্ঞ (যা বাহ্য জ্ঞানসম্পন্ন, অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থার মতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) অর্থাৎ, আত্মা কোনো বহির্মুখী জ্ঞানও নয়।
“ন উভয়তঃপ্রজ্ঞম্”—না (নয়) + উভয়তঃপ্রজ্ঞ (যার জ্ঞান উভয়—অন্তর ও বহির) অর্থাৎ, আত্মা অন্তর-বহির উভয় জ্ঞানেরও অতীত।
“ন প্রজ্ঞানঘনম্”—না (নয়) + প্রজ্ঞান-ঘন (ঘন জ্ঞান, অর্থাৎ এক অজ্ঞতার আবৃত জ্ঞান, যেমন সুষুপ্তি) অর্থাৎ, আত্মা নিছক চেতনার ঘনীভবন নয়।
“ন প্রজ্ঞম্, ন অপ্রজ্ঞম্”—আত্মা না জ্ঞানী (প্রজ্ঞ) না অজ্ঞানী (অপ্রজ্ঞ); সে এই দুই বিপরীত ধারণারও ঊর্ধ্বে।
“অদৃষ্টম্”—যা দেখা যায় না, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।
“অব্যবহার্যম্”—যা কোনো প্রয়োগ, ক্রিয়া বা পার্থিব ব্যবহারে আসে না।
“অগ্রাহ্যম্”—যা ধরা যায় না, ইন্দ্রিয় বা বুদ্ধির দ্বারা ধারণযোগ্য নয়।
“অচিন্ত্যম্”—যা চিন্তা করা যায় না, কারণ চিন্তা সবসময় দ্বৈততায় নির্ভরশীল, আর আত্মা অদ্বৈত।
“অব্যপদেশ্যম্”—যা শব্দ বা সংজ্ঞার দ্বারা প্রকাশ করা যায় না, যা বর্ণনার অতীত।
“একাত্মপ্রত্যয়সারম্”—এক (এক), আত্ম (আত্মা), প্রত্যয় (অভিজ্ঞতা বা চেতনা), সারম্ (মূল সার)—যার সার একত্বের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা; অর্থাৎ যার প্রকৃতি এক আত্মচেতনা।
“প্রপঞ্চোপশমম্”—প্রপঞ্চ (জগতের বহুত্ব, দ্বৈত প্রকাশ) + উপশম (নিস্তরঙ্গ বা প্রশমিত হওয়া)—যেখানে সমস্ত জাগতিক বিভেদ ও প্রপঞ্চ সম্পূর্ণরূপে লীন।
“শান্তম্”—যা চিরশান্ত, চঞ্চলতাহীন, নীরব ও স্থির।
“শিবম্”—যা শুভ, মঙ্গলময়, কল্যাণস্বরূপ।
“অদ্বৈতম্”—যা দ্বিতীয় কিছু নয়, সম্পূর্ণ অখণ্ড, একমাত্র সত্য।
“চতুর্থম্ মন্যন্তে”—চতুর্থ (চতুর্থ) + মন্যন্তে (মনুষ্যরা মনে করে)—বেদান্তীরা একে “চতুর্থ অবস্থা” বলেন, কারণ এটি জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির ঊর্ধ্বে।
“স আত্মা, স বিজ্ঞেয়ঃ”—সঃ (তিনি/সেই) আত্মা (আত্মা) সঃ বিজ্ঞেয়ঃ (সেই জানা উচিত)—এ তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে যিনি, তিনিই প্রকৃত আত্মা, এবং তিনিই জানার যোগ্য একমাত্র সত্য।
এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে—আত্মা কোনো অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী জ্ঞান নয়, কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা চিন্তাযোগ্য বস্তু নয়; সে সমস্ত দ্বৈত ধারণার ঊর্ধ্বে এক অনন্ত, মঙ্গলময়, নিস্তরঙ্গ চেতনা—যিনি নিজেই সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী, এবং যাঁকেই বলা হয়েছে তুরীয়, অর্থাৎ চতুর্থ, পরম, সর্বব্যাপী আত্মা।
তুরীয় শব্দটি সংখ্যাগত কোনো “চতুর্থ” অভিজ্ঞতা নির্দেশ করে না; এটি কোনো নতুন অবস্থা নয়, বরং সমস্ত অবস্থার আধার।
জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থার মধ্য দিয়ে চেতনা নিজের বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। জাগ্রতে তা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জগৎকে জানে; স্বপ্নে মন নিজেরই প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে; আর সুষুপ্তিতে, সমস্ত ভেদ সাময়িকভাবে লীন হয়, কিন্তু অজ্ঞানতার আচ্ছাদন রয়ে যায়। তুরীয় এই তিনের বাইরে নয়—এই তিনকেই আলোকিত করা সেই এক চেতনা, যা তাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, অথচ নিজে কোনো অবস্থার অন্তর্ভুক্ত নয়।
এই কারণেই গৌড়পাদ আচার্য তাঁর মাণ্ডূক্য কারিকা (১.১০)-এ বলেছেন—“নৈব জাগরণং স্বপ্নো, নৈব সুপ্তং, নৈব চ তুরীয়ম্।”—অর্থাৎ, “আত্মা না জাগ্রত, না স্বপ্ন, না সুষুপ্তি, এমনকি তুরীয়ও নয়।” এর অর্থ এ নয় যে, তুরীয় নেই, বরং এ-ই বলা হয়েছে—তুরীয় কোনো ‘অবস্থা’ নয়; এটি সেই চেতনা, যা সমস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে বিরাজমান, কিন্তু তাদের দ্বারা স্পর্শিত নয়।
উপনিষদীয় ভাষায়, আত্মা “দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন”—এই তিনের অতীত। জাগ্রত অবস্থায় দ্রষ্টা দেখে দৃশ্য; স্বপ্নে মন নিজেই দ্রষ্টা ও দৃশ্য দুটোই হয়ে ওঠে; সুষুপ্তিতে উভয়ই নিস্তরঙ্গ থাকে। কিন্তু এই তিনের মধ্যেই এক সত্তা অবিচল থাকে—যে দেখছে, জানছে, কিন্তু নিজে কখনও দেখা জিনিসে পরিণত হয় না। সেই সত্তাই তুরীয়।
এভাবে বলা যায়, তুরীয় হলো চেতনার নিঃশর্ত উপস্থিতি—যা সমস্ত অভিজ্ঞতার পেছনে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। যেমন পর্দা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়েও সব ছবিকে ধারণ করে, কিন্তু নিজে ছবির অংশ হয় না—তেমনি আত্মা সব অবস্থাকে ধারণ করে, আলোকিত করে, কিন্তু কখনও অবস্থার পরিবর্তনে বদলে যায় না।
তাই তুরীয় কোনো নতুন উপলব্ধি নয়—এটি সেই মৌলিক সত্য, যা সর্বদা বর্তমান। সাধক কেবল সেটিকে চিনে নেন; নতুন কিছু অর্জিত হয় না, বরং মায়ার আচ্ছাদন সরলে প্রকাশিত হয় সেই এক নিত্য, অচল, স্বপ্রভ আত্মা—যিনি জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তিরও সাক্ষী, অথচ তাদের কোনোতেই আবদ্ধ নন।
এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে দিয়েছেন—তুরীয়ই একমাত্র বাস্তব চেতনা, বাকিগুলি মায়ার প্রক্ষেপণ। যেমন সাগর অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু তার ঢেউ ওঠানামা করে—তেমনি আত্মা স্থির, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি তারই তরঙ্গ। এই অবস্থাতেই আত্মা উপলব্ধ হয় চিদানন্দরূপে—চিরসচেতন ও চিরআনন্দময়।
যখন সাধক এই তুরীয় স্বরূপে স্থিত হন, তখন তাঁর কাছে সমস্ত অভিজ্ঞতা এক নিস্তরঙ্গ ঐক্যে মিশে যায়। জাগ্রত জগৎ তখন মায়ার নয়, বরং আত্মারই প্রসার; স্বপ্ন তখন বিভ্রম নয়, বরং চেতনার কল্পনা; সুষুপ্তি তখন অচেতন নয়, বরং এক শান্ত প্রশান্তির ছায়া। আর তুরীয়ে স্থিত হলে এই তিনই এক অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মচেতনার ধারায় মিলিত হয়—যেখানে কোনো জাগরণ কিংবা নিদ্রা নেই, কেবল আছে অনন্ত স্বপ্রকাশিত দীপ্তি, যা সব অভিজ্ঞতার অন্তর্নিহিত সত্য।
তাই মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয় কোনো দূরবর্তী লক্ষ্য নয়; এটি প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি ভাবনায় জেগে-থাকা সেই আত্মার নিস্তরঙ্গ সত্তা। যে এটি উপলব্ধি করে, সে জানে—চেতনা কখনও ভাঙে না, হারায় না; কেবল প্রকাশের পর্দা সরে গেলে তার দীপ্তি নিজেই দেখা দেয়। তখন জীবন হয়ে ওঠে সেই চিরন্তন উক্তির প্রতিধ্বনি—“শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্”—শান্ত, মঙ্গলময়, অদ্বিতীয় ব্রহ্মচেতনা।