অপরিচিত



জনমানবশূন্য গভীর রাত সংকেত দেয় কোনো এক অতর্কিত দুঃসংবাদের; আপনাকে বড়ো নিরুপায় লাগছে! শুনশান এ রাতের শেষ হয়েও—যেন হলো না শেষ; ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবী যে অদ্ভুত ভয়ংকর মায়া ধারণ করে—তা খুব সম্ভবত যে-কোনো মানুষেরই পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়; সাধারণ মানুষের ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করতে না পারলে—এই বিমোহিত সুর আপনাকে বিচলিত করতে পারবে না।

আপনি এখানে এসেছেন…কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে? আপনার ভয় করছে না? না…মানে, এতটা গভীর রাতে কবরস্থানের এই জায়গাটাতে সচরাচর কাউকে আগে কক্ষনো চোখে পড়েনি; আপনি কে, বলুন তো?

আমি একজন কপর্দকশূন্য মানুষ; তবে, আপনি আমাকে যতখানি নিঃস্ব অনুমান করছেন…নিঃসন্দেহে, আমি তার ধারেকাছেও নেই!

আহ্! উদ্‌বেগ বাড়িয়ে আমাকে বিব্রত করবেন না! আপনি হঠাৎ আত্মহত্যাকেই কেন মুক্তির একমাত্র পথ বলে ভাবছেন? তবে, আপনার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, যা আমার নজর কেড়েছে—সত্যিই আপনি অসাধারণ।

কেন, বলুন তো?

আপনার দূরদৃষ্টি নিঃসন্দেহে অতিপ্রখর, যা স্রষ্টার নৈকট্যে আপনার আত্মসমর্পণের এই ভিন্নতর উপায়ই বলে দেয়—আপনার চিন্তনে পরিস্ফুটিত হয় এক বিশেষ রূপরেখা।

আমার জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো…আগে অবশ্য এমন ছিল না। আমার এইটুকু স্পষ্ট করে মনে আছে—আগে আমার কখনোই এমন দমবন্ধ লাগেনি বাঁচতে; মনে হয়—সারাক্ষণই কেউ আমার শ্বাসরোধ করে রেখেছে। আসলে আমি মেনে নিতে পারছি না—আমার নিজের বলতে একটা মানুষও নেই। আমি আমার ভেতরকার মানুষটাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম—যত বাধাই আসুক, আমি এ পথে হাঁটতে থাকব; কিন্তু আমি যে আর পারছি না!

তবুও যেন চেষ্টা করে চলেছি সব কিছু ঠিক করার; আমার চেষ্টায় নিশ্চিতভাবেই ত্রুটি রয়েছে, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার। আমি কি তবে এতটাই একা হয়ে গিয়েছি? সবার থেকে আলাদা হয়ে বাঁচতে শেখাটাই সব থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে—এ যেন আমার একমাত্র লক্ষ্য।

সমস্যা একটাই, আপনি যখন মৃত্যুকে খুব করে চাইবেন—মৃত্যু তখন আসবে না। আমার জীবনের সব কষ্টের সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে, এমনটা মনে হলেও—তা ভুল হবে না। আপনি হয়তো যুক্তি দিতে পারেন—আমার চেয়েও খারাপ অবস্থানে থেকে…মানুষ জীবনটাকে চালিয়ে নিচ্ছে তো!

তাতে কী হয়েছে? তারা পারলে আমাকেও পারতে হবে, এমন কোনো চুক্তি আছে কি? আমার জীবনের সমস্যাগুলো আমার কাছে পাহাড়সমান হয়ে গিয়েছে; আমার যদি সেই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই না থাকে…আপনি আমাকে যতভাবেই বুঝিয়ে দিন না কেন—আমার পক্ষে কি আর…এই জীবনের প্রতি মায়া বাড়ানো সম্ভব?

এসব আপনাকে বলে আমার কী লাভ? তবে কী, জানেন?...আপনাকে উপেক্ষা করা সহজ নয়—অনুমান ঠিকই করেছেন…আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি; আমি ধরেই নিচ্ছি—আমরা অপরিচিত।

আমরা কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন বা পরস্পরবিরোধী নই। এমন মনোভাব আপনাকে মানায় না। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আপনার কখনোই ছিল না; নিজের অস্তিত্বে আস্থা রাখুন। এটা একটা নতুন পথ—তাই আপনার স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি কষ্ট হচ্ছে। শুরুতেই এই পথ সম্পর্কে আমি আপনাকে অবগত করেছি; ভুলবশত নয়, বরং‌ স্বেচ্ছায় আপনি এ পথে হেঁটেছেন। একাকীই হেঁটেছেন, কখনও কেউ আপনার সাথে ছিলই না—মজার ব্যাপার, আপনি তা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন!

আপনি দেরিতে হলেও…নিজেকে শূন্য করার জন্য যে-পথে হাঁটার প্রয়োজন—সেই শক্তির অন্বেষণকে আবশ্যক বলে মনে করেছেন। মনে রাখবেন, প্রথম পদক্ষেপটিই আপনার গন্তব্য নির্ধারণ করে দেবে। আপনাকে অভিনন্দন।

এটি সম্ভবত আপনার সাথে আমার—শেষ কথোপকথন।