কণ্ঠ ১ (প্রশ্ন তোলে সংকোচে): এই দেহ, এই মন, এই সংসার—এরা তো চোখের সামনে আছে…তাহলে তুমি বলো—আত্মাই সব, বাকিটা তুচ্ছ?
কণ্ঠ ২ (অবিচল দৃঢ়তায়): তুচ্ছ নয়, ছায়া। জগৎ যেন জলরঙে আঁকা স্বপ্ন, যা ভিজলেই মুছে যায়। আত্মা সেই কাগজ—যার উপর সব কিছু আঁকা, তবু যা অক্ষয়।
কণ্ঠ ১ (আশ্চর্যে): তবে যে অনুভব করি দুঃখ, অপমান, ভয়—সে কী?
কণ্ঠ ২ (ধীরে, দুঃখ-ভেদী করুণায় ভেজা সুরে): তা তোমারই ভুল চিন্তা—যখন তুমি নিজেকে দেহ ভাবো, মন ভাবো, তখনই জগৎ তোমার ওপর ক্ষমতা পায়। কিন্তু আত্মা? সে কখনও কাঁদে না, সে কখনও ব্যর্থ হয় না।
কণ্ঠ ১ (উপলব্ধির শিহরনে): আত্মা কি তবে আনন্দ, নির্ভরতা, গৌরব?
(কণ্ঠ ২): আত্মা শুধু নিজেই—না আশ্রিত, না নির্ভর, না তুলনীয়। সে কখনও রিক্ত হয় না, কারণ সে চির-সম্পূর্ণ।
দু-জন একসাথে (স্তব্ধতার ধ্রুপদে—দার্শনিক ধীরতায়, গহন ধ্বনিতে): জগৎ ক্ষণিক, আত্মা চিরন্তন। জগৎ রূপ, আত্মা আলো। জগৎ পরিবর্তন, আত্মা স্থিতি। একটি ছায়া, আরেকটি আকাশ। আমি আত্মা—অচঞ্চল, অবিনশ্বর, অদ্বিতীয়। এই দেহ, এই জগৎ—সবই মায়ার রেখাচিত্র। ছায়ার সঙ্গে আত্মার তুলনা হয় না, আলোকের গর্ব ছায়ায় কখনও মেশে না। আত্মাই গৌরব, বাকিটা কল্পনা—বিনাশের আগেই মুছে যায়।
কণ্ঠ ১ (ধীরে ধীরে প্রশ্ন তোলে): প্রতিটি জিনিসের তো একটা নাম আছে, প্রতিটি অনুভবের একটা রূপ…তবে তুমি বলো—নাম-রূপ সব মিথ্যা?
কণ্ঠ ২ (মৌনের গভীর থেকে উচ্চারিত স্বর): নাম-রূপ মানেই সীমা। যা সীমিত, তা সত্য নয়। যা-কিছু বলা যায়, ধরা যায়, চেনা যায়—সবই পরিবর্তনশীল ছায়া। ব্রহ্ম অনামা। তিনি কোনো রূপে আবদ্ধ নন—তাই তিনিই সর্বরূপ।
কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ে): তাহলে 'আমি', 'তুমি', 'আত্মা', 'ব্রহ্ম'—এই শব্দগুলোও কি ফাঁকি?
(কণ্ঠ ২): হ্যাঁ…এই শব্দ শুধু পথ, লক্ষ্য নয়। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটি ব্রহ্ম নয়—তাঁকে বলা যায় না, ভাবা যায় না।
কণ্ঠ ১ (ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে): তবে নামহীন অবস্থাতেই কি আনন্দ? রূপের পেছনে ছুটেই কি আমরা ক্লান্ত?
কণ্ঠ ২ (শান্ত হাসিতে): যেখানে কোনো নাম নেই, কোনো রূপ নেই, সেখানে নেই ভয়, নেই আশা—সেখানে আছ শুধু তুমি। তোমার আসল পরিচয়ই এ-ই—তুমি চিরনামহীন, চিররূপহীন চৈতন্য।
দু-জন একসাথে (মিশ্র কণ্ঠে, নিঃশব্দের গান হয়ে—গাঢ় ছায়ায় মোড়া ছন্দে): রূপে নয়, রসনায় নয়, চিন্তায় নয়—আমি যা, তা অভেদ, নিরাকার, অনির্বচনীয়। যা বলা যায় না, সেটাই সত্য। নাম মানে সীমা, রূপ মানে ভেদ। যেখানে নাম নেই, সেখানে মুক্তির পথ খোলা। আমি যা—তাতে নেই ভাষা, নেই রং, নেই রেখা। আমি অনির্বচনীয়, তাই আমি চিরন্তন।