কীভাবে কোনও কিছুকে বিশ্বাস করে ফেলতে হয়? সহজ! বিশ্বাস করতে শুরু করে দাও। একেবারে শিশুদের মতো করে। ওরা কী করে, জানো তো? একটা আইসক্রিম দূরে দেখেও ওটার জন্য এমনভাবে কান্না জুড়ে দেয় যেন ওটা ওরই, ও ওটা পেয়েই গেছে, তাই ওটাকে ও নিজের কাছেই রাখতে চায়। এখন কথা হলো, আমরা যা-কিছু বিশ্বাস করি, তা-কিছু কি সব সময়ই ভালো আমাদের জন্য? কিছুতেই না! আমরা যা চাই, তা পাই না কিংবা সাথে সাথেই পাই না। ওই অপ্রাপ্তি বা দেরিতে পাওয়াটাই হয়তো আমাদের জন্য দরকার, যা আমরা শুরুতে বুঝতে পারি না। স্বপ্ন বা চাওয়া যে তৎক্ষণাৎ সত্যি হয়ে যায় না, সে কারণে আমরা অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির হাত থেকে বেঁচে যাই। সময়ের আগেই প্রাপ্তি অনেকেই ঠিক হজম করতে পারে না। আবার এমনও হয়, সময় না হলে অনেক প্রাপ্তি কাজেই লাগানো যায় না, ফলে সেই প্রাপ্তি মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
আমি জানি, ভালোবাসার রং নীল। আমি ডায়রি লিখতে ভালোবাসি। তাই ভালোবাসার রঙেই মনের কথাগুলি লিখছি। আজকে তেমন কিছুই ঘটল না। দেখি, কাল কী ঘটে! কালকে আমার সাথে কী ঘটে দেখার জন্য আমি অপেক্ষায় আছি। এই অপেক্ষায় থাকার নামই বেঁচেথাকা।
দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে শুধু আমি ছাড়া আর কাউকেই আমি চাই না। আমার কেবলই নিজেকে হলেই চলবে, তবে একটু শান্তি এই যে, ঘুমানোর সময় প্রতিদিনই আমি অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হলেও রাতের পুরো পৃথিবীকে আমি নিজের মতো করে পাই। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে আমি শুধু আমাকেই চাই। আসলে, দিনের শেষে নিজের পাশে এক নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই কখনও পাওয়া যায় না। সেই বিচারে, সব মানুষই মূলত একা।
ঘৃণা আর ভালোবাসা কখনও একসাথে থাকতে পারে না। যার প্রতি ভালোবাসা আছে, তাকে ঘৃণা করা যায় না। আর যার প্রতি একবার ঘৃণা এসে যায়, তাকে আর কখনও ভালোবাসা যায় না। এ এক অদ্ভুত রীতি, এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে কেবল ভণ্ড ও স্বার্থপররা।
এই যে আমি কাগজের সাথেই সব সময় একা একা সময় কাটাই, তা আর ভালো লাগে না। জানি না, সামনে কী হবে, কী করব। সবার কাছে পাওয়া অবহেলা এখন আর সহ্য হয় না। মনে হয়, একটা চাকরি থাকলে সবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যেতাম। আবার ভাবি, একটা চাকরিই যদি থাকত, তা হলে কি আর কেউ এত অবহেলা করত? চাকরি পেয়ে গেলে তাই কাউকে আর দূরে চলে যেতে হয় না সবকিছু ছেড়েছুড়ে। যাদের চাকরি আছে, তাদের কদরও আছে। আমি অবশ্য ভালোই আছি, বেশ আছি! তবে ঝামেলা একটাই যে আমি অনেক বিশ্রামে আছি। শুধু বিশ্রামে থাকতে তো ভালো লাগে না। বিশ্রামে থাকলেই সব জ্বালা, অসময়ের সব ক্ষতের কথা বারবার মনে পড়ে যায়। ফলে, মাথায় এলোমেলো ভাবনা আসে, কলম এলোমেলো ভাবনা প্রসব করে।
সত্যিই তো! ভবিষ্যৎ কী, তার আমি কী জানি! কাল কী হবে আমার জীবনে, সেটাই-বা জানি নাকি? আজ হয়তো আমি যেটা ভেবে ভয় পাচ্ছি অথবা ভাবছি অন্যের জীবনের ঘটনা দেখে যে আমার পরিণতিও ওরকমই হবে, তা হয়তো আমার জীবনে ঘটবেই না! হয়তো আমার জীবন আর দশটা ওসব মানুষের জীবনের চাইতে একটু অন্যরকম হবে। হয়তো আমি খুব সুখী হব, সবাই আমাকে দেখে নিজেরাও সুখী হতে চাইবে। অথচ বোকার মতো কত রকমের ভয়ই না পাই প্রতিক্ষণই! আমার ভবিষ্যৎ হয়তো সবাই যেমন ভাবছে, তেমন কিছু হবেই না, ভালো কিছুই আছে আমার নিয়তিতে। আমি বোকার মতো শুধু শুধু এসব ভেবে ভয় পাই, আর হাজারটা চিন্তা মাথায় আসে, আর আমি হতাশ হয়ে যাই। কাল আমি কী হতে পারব, কী হতে পারব না, তা আজ সব সময়ই যে বলে দেওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। কাল এলেই কাল কেমন হবে, তা বোঝা যাবে। এত টেনশনের তো কিছু নেই।
কখনও মনে হয়, আমার জীবনের যত কষ্ট, তার সবকিছুর জন্য দায়ী এই কাগজ! যখন সময়গুলো খুব কষ্টে কাটে, কোনও দিকেই আর যাবার পথ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি, তখন কেউ এসে হাত ধরে পাশে থেকে বলে না, ‘ভয় পেয়ো না, আমি তোমার পাশেই আছি!’ কেউ বলে না, ‘অত চিন্তা কীসের তোমার? আমি আছি তো!’ শুধু এজন্যই সব দায় কাগজের! সময় ভালো বা খারাপ, যা-ই যাক না কেন, এই কাগজটাই শুধু সঙ্গে থেকেছে। কাগজ যদি না থাকত, তবে মনের দুঃখ লিখে ফেলার মতো তো কিছুই পেতাম না। তখন দুঃখেও ভরসা রাখা যায়, এমন কিছু না পেয়ে হয়তো ভয়ে জীবনে দুঃখকেই আর নিয়ে আসতাম না, আসার আগেই কৌশলে তাড়িয়ে দিতাম! কাগজ আছে বলেই দুঃখ পেতে ভয় করি না, কাগজে সব দুঃখকে স্থান দিয়ে দিই অনায়াসেই। মাঝে মাঝে এত যে বেশি খারাপ লাগে যখন দেখি, রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো কেমন যেন হিসাব করে, যে যার যার লেনদেন ঠিকঠাকই বুঝে নেয়। সব সম্পর্কই খুব তিক্ত আর ছাড়া ছাড়া মনে হয় কখনও কখনও। সবাই হিসেব খোঁজে, নিজেদের স্বার্থ বুঝে নেয়। শুধু আমিই বোকা, আমি কিছু বুঝি না। সত্যিই আমার শুধু এক আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি মন খুলে হাসছি, আমি ভালো আছি, এটা দেখলেই সবাই হিংসায় আমার সেই অল্প সুখটুকুও কেড়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কষ্ট দিয়ে কথা বলতে ইদানীং কেউ আর দ্বিধাবোধ করে না। আমি জানি না, আমাকে আমার জীবন কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সব জায়গায় অনিশ্চয়তা, তাও জীবনটাকে কোনওমতে ধরে আছি! আসলে জীবনটা ঠিক কোন দিকে টানছে, তা আমি বুঝতেই পারছি না! বারবার হোঁচট-খাওয়া, বারবার জীবনের মোড়-বদলানো, বারবার কষ্টে ভেঙে চুরমার হয়ে আবারও সব ভুলে নতুন করে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা! মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে হেরে যেতে! এত কীসের নেশা জীবন নিয়ে মেতে থাকার? যাক না সে যেখানে খুশি! আবার পরক্ষণেই মনে হয়, আমি হেরে যাব না, আমি জীবনকে আমার উপর জয়ী হতে দেবো না। সেই জীবন আবার কীসের জীবন, যে জীবন জীবনের কাছে হেরে যায়? জীবনের কাছে হেরে গিয়ে জীবনের কোনও মূল্য থাকে না। হে ঈশ্বর, আমি এখন সত্যিই ক্লান্ত! আর কোনও কিছুর পেছনে ছুটতে আমার ভালো লাগে না। তুমি যেদিকে চাও, সেদিকে আমাকে নিয়ে যাও। আমার নিজের কোনও পছন্দ নেই, আমার নিজের কোনও বিবেচনা নেই। আমার জন্য যা ভালো হয়, তুমি তা-ই করো। আমি আর নিজের মতো করে ভাবতে পারছি না!
এভাবেই সুখে-দুঃখে সময়ে-অসময়ে অজস্র স্মৃতি নিয়ে একজন অনিলার ডায়রির পাতাগুলো একসময় ভরে যাবে। হয়তো তখনও ভরতেই থাকবে, যখন আমি আর দুঃখ আঁকব না।
আমার অনুপস্থিতি দিয়েই তোমাকে আমি বোঝাব, আমিও ছিলাম। যখন ছিলাম, তখন তুমি বোঝোনি আমায়। অবহেলা করেছ, সস্তা ভেবেছ। তুমি একদিন বুঝবে, আমি সস্তা নই। বুঝবে, আমাকে অবহেলা করে তুমি তোমার জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা করেছ। সারাদিন অজস্রবার কান্না, বুক জ্বালাপোড়া। থেকে থেকে কাঁদছি শুধুই আর ভাবছি, আমার কিছু অভিমান ছিল, তুমি আমায় বুঝলে না কখনও। অত হিসেব করে তোমাকে বুঝাব ভেবে তো তোমার সাথে জড়িয়ে ছিলাম না আমি কখনওই। আমি ভালো হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম, তুমি দিলে না। আমায় বাধ্য করলে তোমায় বোঝাতে যে আমিও ছিলাম, তুমি তা বোঝোনি। প্রতিটি দিন যখন ক্লান্ত আমি তোমার ব্যবহারে বারবার, রাত পার হলেই সব ভুলে নিজেকে বুঝিয়েছি যে মানুষ তো ভুল করেই! তুমি তাও ভেবে নিয়েছ, তোমার প্রাপ্যটা তোমার অবহেলার পাওনা। ওটা ভেবে বুঝে নিয়েছ সবটুকুই। আমি আমার কোনও দোষ না দেখেও সহ্য করেছি দিনের পর দিন সবকিছুই। তুমি এখন থেকে সবই বুঝবে, আমার অনুপস্থিতি তোমাকে বোঝাবে, আমি এতদিন ছিলাম, আর তুমি আমায় কখনও বুঝোনি, বোঝার চেষ্টাও করোনি।
যেসব মানুষ কথা দেয় বেশি, উঠতে বসতে বিভিন্ন ধরনের প্রমিজ করে, বুঝতে হবে, তাদের মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। এসব মানুষের কথায় বিশ্বাস করার মানেই হলো দুই-পা একসাথে নদীতে ডুবিয়ে নদীর গভীরতা পরিমাপ করা। তখন সাঁতার না জানলে আপনি নিশ্চিতভাবেই পানিতে ডুবে যাবেন।
অনেকক্ষণ রাস্তায় একা একা হাঁটাহাঁটি করলাম। মনে অনেক প্রশ্ন এল, উত্তর না পেয়ে নিজেকে হাজারটা সান্ত্বনা দিয়ে যেনতেন এক একটা যুক্তি দাঁড় করালাম প্রশ্নগুলির জবাবে। মনে হচ্ছিল, বারবার এভাবে জীবনের বিভিন্ন অংশ থেকে নিজের এই বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রে আমার নিজের কোনও ত্রুটি হয়নি তো? আমার চেষ্টায় কি কোনও কমতি ছিল? আমার কী দোষ ছিল? হাজারবার প্রশ্ন করেও যেন কোনও লাভই হলো না! নতুন কোনও উত্তর মন থেকে এল না, শুধু বারবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছিল পুরনো কিছু উত্তর বা সান্ত্বনা। এসব কিছু, যা আমার জীবন থেকে না চাওয়া সত্ত্বেও থেকে গিয়েছিল, তার অনেক কিছুই সরেও গেছে। কিছু সরে গেছে, কেননা সেগুলোর কিছুই আমার ছিল না, আর ছিল না বলেই কোনও একটা উছিলায় ঠিকই সরে গেছে। হয়তো সে ক্ষেত্রে আমার দোষত্রুটিও থাকতে পারে, কিন্তু জীবন কেন আমাকে কোনও উত্তরই দিল না, আমি কেন এত প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর পাইনি, আমি জানি না। যা যা ঘটেছে আমার সাথে, আর যা যা ঘটবে আমার সাথে, এখন থেকে তার সবকিছুই আমি মেনে নিব। নতুন করে আর কিছুই চাইব না জীবনের কাছ থেকে। নতুন কোনও আশায় বুক বেঁধে নিজের জন্য আর কখনও কিছু চাইব না। আমি হেরে গেছি, মেনে নিলাম। আমি হার মানলাম, খুব সহজে ভেঙে পড়লাম আমি! এবার তোমরা খুশি তো?
আমি আমার নিজের সাথেই আর কোনও যোগাযোগ রাখব না। আমি অন্যায় চাই না। আমি সবকিছুই মানি না। পৃথিবীতে আমার জন্য কোনও জায়গা নেই শুধু সেখানেই, যেখানে শুধু অন্যায় হতে দেখা যায়। এতদিন আমার পাশেথাকা হতাশ মানুষগুলোকে আমি সব সময় আশা দিয়েছি, জীবনের নতুন পথ দিয়ে হাঁটতে শিখিয়েছি, আর আজ আমি নিজেই ব্যর্থ আর ক্লান্ত! কীভাবে মিথ্যেআশা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব, আমি জানি না। সারাজীবনই কি তবে আমি সবাইকে একটা মিথ্যেভরসার উপর বেঁচে থাকতে আশা জুগিয়ে যাব? তার চাইতে থাকুক না ওসব! আমি আর কাউকে জীবন নিয়ে মিথ্যেআশা দিয়ে রাখব না। যেহেতু আমার নিজের স্বপ্নই এখনও পূরণ হয়নি, সেহেতু ওদের আমি কী করে মিথ্যার উপর ভরসা করতে শেখাব? যে পথে চললে বা ভরসা রাখলে কাজ হবে কি হবে না, আমি নিজেই জানি না, সে পথে অন্যকে চলার পরামর্শ দিই কী করে? এ হয় না। তার থেকে ভালো, সবাই যেনতেনভাবে বাঁচতে শিখে নিক। সেটাই অনেক ভালো। অনেকসময়ই ভালো করতে গেলে উল্টা খারাপ হয়ে যায়। যে আশা পূরণ হবার নয়, সে স্বপ্ন আমি আর কাউকে দেখাব না কখনও। তবু আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই এজন্য যে উনি আমার জন্য একদম পারফেক্ট কোনও পৃথিবী সৃষ্টি করেননি। আমাকে টিকে থাকতে হবে, থাকতেই হবে। মৃত্যু পর্যন্ত যত কঠিন আর দুঃসহ পরিস্থিতিই আসুক না কেন, আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। এই যে লড়াইটা, টিকেথাকার খেলাটা, এর নামই জীবন।
ডায়রিতে আর কী লিখব, এখন বুঝি না। কী করলে কী হবে, আগে যাও আন্দাজ করতে পারতাম, এখন তো তাও আর পারি না। কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছি নিজেই নিজের কাছে। কিন্তু এমন থাকলে হবে না। নিজেকে আমার চিনতে হবে, জানতে হবে। আমাকে অনেক উপরে উঠতে হবে। আমাকে বাঁচতে জানতে হবে, খুশি থাকতে হবে। নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝতে হবে, না হলে জীবন তার নিয়মে আমাকে ঠকাবে এবং শুকিয়ে যাবে, কেননা জীবন তাকেই ঠকায়, যে নিজেকে ঠকায়। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমি এখন আর আগের মতো নেই, অনেক বদলে ফেলেছি নিজেকে। আমি একা একা ভালো থাকতে শিখে গেছি। আমি একলা পথে হাঁটতে শিখে গেছি। এখন আর কোনও কিছুকেই আমার তেমন আর ভয় করে না। আমি আমার আত্মসম্মানবোধকে ভয় পাই। আমি এটাও জেনে গেছি, ঈশ্বর যা যা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন, তার সবই ফিরিয়ে দেবেন। হয়তো-বা যতটা কেড়ে নিয়েছেন, তার চাইতে বহুগুণে বেশিই আমি ফেরত পাব। সময় হলেই পাব। মানুষ সময়ের আগে কোনও কিছু পায় না। সময়ের আগে কোনও কিছু পেলে মানুষ তা ধরে রাখতে পারে না।
একা আমি কখনওই ছিলাম না, কেননা আমার সাথে সব সময়ই আমি নিজে ছিলাম। বুঝলাম, জীবনের সব সঞ্চয়, সব ভালোবাসা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খরচ করে ফেললে আমি সেখান থেকে অনেক বড় কষ্ট পেতে পারি, যা কখনওই কোনও কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবার নয়। এজন্য আমি জীবন থেকে শিখেছি, কখনও সব আবেগ এক জায়গায় সীমাবদ্ধ করে রাখতে নেই, এতে করে নিজের ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হয় না। আমি এও শিখলাম, যতই খারাপ ঘটনা আমার সাথে হোক আর যতই ন্যায়-অন্যায় হোক না কেন, আমি কখনও তা গায়ে লাগাব না। এতে করে শুধু নিজের ক্ষতি হয়। আসলে কষ্ট গায়ে মেখে কোনও লাভ হয় না, তাই যত কষ্টই আসুক, সব সময় চেষ্টা করতে হবে নিজেকে ধীর-স্থির রেখে আগে থেকে সে সময়ের অস্থিরতা কাটাতে। মানুষ একবার তার কঠিন সময়ে যদি শুধু অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে না নেয়, তবে আমি নিশ্চিত, কোনও দুর্ঘটনাই তাকে ঘিরে ধরতে পারবে না।
কষ্টকে একা একাই জয় করতে হবে। এর মাঝে আনন্দ আছে, একটা শক্তি আছে। যখন আমরা কোনও কষ্ট একা একাই ভোগ করি এবং একদম একা একা সেই পথ অতিক্রম করি, তখনই আমরা প্রকৃত শক্তি লাভ করি এবং পুনরায় যখন অন্য কোনও সমস্যা বা কঠিন মুহূর্ত আমাদের ঘিরে ধরে, আমরা তখন বুঝতে পারি, আমরা আগের তুলনায় কতটা শক্ত হয়ে গেছি এবং নিজের সমস্যা নিজেই ধীরে ধীরে সমাধান করার শক্তি অর্জন করেছি। তখন আসলেই আমরা প্রকৃত শক্তি অর্জন করি। সেটাই আমাদের ব্যক্তিত্বকে আরও দৃঢ় করে দেয়। মানুষ কীসে বাঁচে? আমি জানি না। আমি জানি মানুষকে বাঁচতে হয়, আর সাথে এও জেনে নিয়েছি, যদি বাঁচতেই হয়, তবে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে খুশি রেখে বাঁচব এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনওই মরার মতো করে বাঁচব না। আমি শুধুই আমি হব। আমি একজন অসাধারণ মানুষ, নিজেকে সেটা বুঝিয়ে নিজের ভেতরে শক্তির জাগরণ ঘটাব এবং শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও চেষ্টা করে যাব। আমি হারার আগেই কখনও হার মানব না।
তুমি আর এমন কী! আমি তো তার থেকেও বেশি! আমার ঘুমই তো চলে গেল নিজেরই সৃষ্ট অচেনা চিন্তার নির্ভেজাল দেশে! আচ্ছা, আমি ঠিক মনে করতে পারি না, ঠিক কত বছর বয়স থেকে আমার এই ডায়রি-লেখার অভ্যাসটা হয়েছিল। ক্লাস সিক্স নাকি সেভেন, ঠিক মনে নেই। এর মাঝে কত কী লেখা শেষ হয়ে গেল! অযথা দুশ্চিন্তার জন্য কখনও ঘুম না পেলে ভাবি, খুলেই ফেলি আর একটা ডায়রি, লিখেই ফেলি কিছু কথা! কী হবে? হঠাৎ করেই ইদানীং হাত-পা ঠান্ডা হয়ে অসাড় হয়ে আসে। তখন পুরো পৃথিবীটাই কেমন যেন লাগে। এই যেমন, এখন ঘুম পাচ্ছে, খুব ঘুম পাচ্ছে, অথচ দুশ্চিন্তার কারণে ঘুমাতে পারছি না। যা-ই হোক, আমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই চাই একদম একা একা নিজেই সব সমস্যার সমাধান করতে। আমি এমনভাবে নিজেকে তৈরি করতে চাই, যাতে কোনও কঠিন মুহূর্তকেই আমার কাছে কঠিন মনে না হয়। আমি এখন এতটাই শক্ত হতে পেরেছি যে তেমন কোনও কাজেই আমি অন্যের সাহায্যের দরকার মনে করি না। আমি তা-ই করব আজীবন! আমি এক এক করে আমার জীবনের সব সমস্যার সমাধান করব আমি নিজেই। আমি হারার আগেই হেরে যাব না।
কষ্ট লাগবে, এর পরেও কষ্টের পর এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং আমি বের হয়ে আসবই! যা আমার ছিল না, তা কিছুতেই আমার হতে পারে না। এটাই সত্যি এবং এটাই আমাকে মেনে নিতে হবে। কে কী মনে করবে, সেভাবে নয়, নিজে যেভাবে নিজেকে সাজাতে চাই, সেভাবে করেই সাজাতে হবে, আর তাতে নিজের কোনও প্রকার কল্পিতদোষ খুঁজব না, অথবা অন্যের দেওয়া কষ্ট গায়ে মাখব না। কেউ তো আসেনি কখনওই আমার মন ভালো করে দিতে। কেউ আসেনি খোঁজ নিতে আমি কেমন আছি। কেউ জানতেও চায়নি ওসব। বন্ধু-বান্ধবী সবাই জানত, আমার মন খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন বুঝতে পারত, আমার মন ইদানীং আর আগের মত ভালো নেই। সবকিছুই অস্বাভাবিক হয়ে গেছে, কোনও কিছুই আমার স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। কিছু একটা আমার মাঝে মিসিং, তাও কেউ আসেনি একটু ভালো লাগাতে। দিনের শেষে সবাই যার যার স্বার্থ বুঝে নিয়েছে। হয়তো তারাই ঠিক, তারা ঠিক কাজটাই করেছে। তারাই ঠিক আছে, কেননা আমি এখন বুঝতে পারি, নিজের খুশি সব সময়ই নিজের কাছে।
ওকে যদি আমার পাওয়ার থাকত, তা হলে আমি ওকে অনেক আগেই পেতাম। ওকে না পাওয়ার কষ্টে সব শেষ করে দিতে ইচ্ছে করলেও আমি এসব কিছুই করব না। আমি নিজের জন্যই বাঁচব। আমি সামনের দিনগুলো নিজের সাথে কাটাব, এমন একটা মানসিক প্রস্তুতি আমার থাকতে হবে। আমি পৃথিবীতে এসেছি এমনি এমনিই চলে যাওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীতে এমন কিছু করে যাব, যাতে মৃত্যুর পরেও লোকে আমাকে মনে রাখে।
এই যে আমি একা আছি, আমি আসলে ভালো আছি। সামনে কী হবে কী হবে না, এসব চিন্তা করলে আমি মোটেও শান্তিতে থাকতে পারব না, আমার মাথা অকেজো হয়ে যাবে, শুধু এই একটা চিন্তাতেই। যখন আমার পাশের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করে রীতিমতো না বেঁচে থাকার উপক্রম করছে, তখন এই আমি উপলব্ধি করি, আমি বেশ ভালো আছি। আমি আমাকে নিয়ে ভালো আছি, আমি নির্ভেজাল আমাকে নিয়ে ভালো আছি। জীবন যখন যেভাবে যে দিকে টেনে নেয়, তখন সেভাবেই সে দিক থেকে মেনে নিয়ে ভালো থাকতে হয়, এটাই ভালোথাকার একমাত্র রীতি। অন্যথায়, অসময়ের বাজেচিন্তা নিয়ে পড়ে থাকলে আমি একেবারে দুশ্চিন্তায় মরে যাব। কে আসবে আমার জীবনে, কেউ কেন আসছে না এখনও, কেন ভালো বলতে যা বোঝায় তেমন মনের মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না, কেন কেউ আসছে না আমার পাশে, আমি কেন একা আছি, আমার কবে চাকরি হবে, আমি কবে সচ্ছল হব, কবে আরও সুন্দরী হব, কবে আমার দিন ঘুরবে…এসব চিন্তা করলে সত্যি আমি মরেই যাব! আর আমার পাশের মানুষগুলো আমাকে পাগল ভেবে ছেড়ে দূরে সরে যাবে। অবশ্য ওরা সেটা ভাববে না-ইবা কেন? আমি যদি প্রতিনিয়ত নিজের সাথে অন্যদেরও এসব বিষয় নিয়ে অবগত করি, যা আমার মনের মাঝে চলছে ওটা নিয়ে সবাইকে বিরক্ত করি, তা হলে সবাই তো আমাকে পাগলই ভাববে! নিজের মাথায় কী আছে কী নেই, তা দিয়ে অন্যকে বিরক্ত করা বা ভাবতে বাধ্য করা ফালতু লোকের কাজ।
আমি কেন সবার মন আর মূল্য পাবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি? আমি যেমন তেমনই হয়ে থাকছি না কেন? যদি আমি অন্যদের মন পাবার জন্য নিজেকে নিজের মনমতো না চালিয়ে অন্যের মনমতো তৈরি করি, তা হলে একদিন আমি ক্লান্ত হয়ে আবার নিজের স্থানে নিজের স্টাইলে ফিরে আসব। আর যেসব মানুষের মন জয় করার জন্য এসব করেছিলাম, তারা আমাকে তখন ত্যাগ করবে, আবারও আমি একা হয়ে যাব। তার চেয়ে বরং আমি যেমন আছি তেমনই থাকি, এতে আমার মঙ্গল। এতে করে যারা আমাকে, আমি যেমন, তেমন করেই ভালোবাসে, তারাই চিরকাল থেকে যাবে আমার পাশে। আমি সেসব মানুষকেই আমার জীবনে চাই। বাকিদের আমার এখনও লাগে না, সামনেও লাগবে না। লাগলেও আমি ওদের ছাড়াই চলতে শিখে নেব। আর হ্যাঁ, অযথা নিজেকে সবার কাছে সস্তা আর পাগল হিসেবে তুলেধরা সত্যিই বোকামি, কেননা তারা কখনওই আমাকে আমার মতো করে বুঝবে না। আমার মনটা বুঝবে না। আমার সাথে কী হচ্ছে, আমার মনে কী চলছে, তার কিছুই বুঝবে না। প্রত্যেকেই, সবকিছুর পরও, নিজের মাথায় যা আসে, তা-ই করে, তা-ই ভাবে। তা হলে নিজেকে কেন সবার কাছে ওরকম ছোট করতে যাব? কেন সবার হাসির পাত্র হব? ভালো থাকলে আমি নিজেকে নিয়ে ভালো থাকব। কাঁদলে নিজের সাথে নিজেই কাঁদব। যখন কোনও কিছুই ভালো লাগে না, তখন যা করতে মন চায়, তাই করব। অন্য কারও কথা মনে স্থান না দিয়ে সব সময় বর্তমানটাকেই নিয়ে বাঁচব। অতীত অথবা ভবিষ্যৎ, কোনওটাই তো এই মুহূর্তে সামনে নেই। অযথা দুশ্চিন্তা করব না। এসব কিছুই যে আমার হাতে নেই। অতীত তো চলে গেছে, ভবিষ্যৎ কী হবে, আমি জানি না। তা-ই যদি হয়, তবে ওই দুটোকে নিয়ে চিন্তা কেন করব? এতে শুধু দুশ্চিন্তাই বাড়বে। আমার হাতে শুধু আমার বর্তমানটাই আছে। শুধু আজকের দিনটা আছে নিজেকে খুশি রাখার জন্য। সব সময় একা একাই ভালো থাকব, নিজের অস্তিত্বকে কারও কাছে সস্তা করব না, নিজেকে কারও কাছে সস্তা হতে দেব না। যে যা-ই ভাবুক, আমি নিজেকে সব সময় ভালো রাখব। অন্য কেউ আমাকে ভালো রাখবে, সেই আশা আমি কখনওই করব না।
আমি একটা ছাগল। কোন একটা গাধা আবার আমার জীবনে আসবে, আর আমি ওকে পেয়ে ওকে হারানোর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকব। আর তখন সে ভয়ে ও যা-ই বলবে, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করব এবং তিনি আমায় আবার সেই ছাগলই ভেবে চরকির মতো ঘুরাবেন। এর পর যদি আমি ওর সামনে এমন ছাগল হয়ে যাই, তা হলে আমি যেন মরেই যাই। নাহয় আমার শিক্ষা হবে না, আর আমার নিজেরই শিক্ষা না হলে আমি ওকেও শিক্ষা দিতে পারব না। আমরা যখন কাউকে বলি, আমি ওকে দেখিয়ে দেবো, তখন আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমি কেবল তখনই তাকে দেখিয়ে দিতে পারব, যখন আমি নিজেকে আগে দেখিয়ে দিয়েছি, এর আগে কিছুতেই নয়। যে নিজেকে চড়টা মারতে পারে না, সে অন্যকে চড়-মারার কোনও অধিকারই রাখে না।
আমার সাথে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। আমি যখনই কোনও সুযোগ সামনে দেখি, কিংবা কোনও গুপ্তধনের খোঁজ পাই, তখন আমি এমন কারও জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, যার হাত ধরে আমি সেই সুযোগ বা গুপ্তধন নিতে পারি। আমি নিজের মতো থাকতে পারছি না কেন? কেন আমি অন্যের খুশিমতো নিজেকে বানিয়ে নিতে চাইছি? আমি আমার মনের মতো কাউকে খুঁজছি তো খুঁজেই চলেছি, আর পাচ্ছি না বলে দিন দিন আরও হতাশ হয়ে পড়ছি। কোনও মানে হয়? এই ক্লান্তিকর অবস্থা থেকে আমি মুক্তি চাই। এমনও দেখেছি, হয়তো এমন কেউ এল আমার জীবনে যে আমার জন্য পারফেক্ট। এর পর আমি কী করি? আমার আশেপাশের লোকজনের মতামত নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি, সে আমার জন্য কেমন হবে, সে আসলে কেমন, সে ভালো কি খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পর? বিভিন্ন লোকে তার সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করে, আমি সেগুলোর প্রত্যেকটিই আমলে নিই, সেসব মতামতের ভিত্তিতে কিছু কমন পয়েন্ট বাছতে শুরু করে দিই, এবং শেষমেশ নিজেই কনফিউজড হয়ে পড়ি। অতঃপর, ওকে আমার জীবনে আসতেই দিই না আর। পরে ওর কথা ভেবে কান্না করি, পস্তাই। তখন আমার অবস্থা দেখে আমার আশেপাশের ওই লোকগুলোর হাসি পায়, ওরা নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকে, আমি বাঁচলাম কি মরলাম, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই ওদের কারও নেই।
আমি বাঁচার জন্য মরতেও রাজি। বাঁচার মত বাঁচতে হলে যদি মৃত্যুর ভয়ও আসে, আমি তাও জয় করব নিজেকে ও মৃত্যুকে। আমি হয়তো কিছু সময়ের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে বাঁচব, তবু মৃত্যুকে ভয় করব না, নিজেকে সামলে রাখব ও সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাব। যেহেতু আমাদের বেঁচে থাকতেই হচ্ছে, সেহেতু বেঁচেথাকার সময়টাতে নিজেকে জীবনের নানান আয়োজনে ব্যস্ত রাখাই ভালো। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রেম একটা অভিশাপ। যদি কারও ক্ষতি করতে চাও, তা হলে যে করেই হোক, তাকে একটা প্রেম করিয়ে দাও! যারা প্রেম করে, তাদের সাথে শয়তান থাকে!
যে ব্যক্তি আমার জীবনের সব না-বলা ঘটনা জেনেও শুধু আমাকে ভালোবাসবে এবং তার সাথে নতুন জীবনের শুরুহওয়া থেকে শুরু করে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত নির্দ্বিধায় ভালোবেসে সে আমার সাথে থাকবে, আমার সব দুর্বলতা জানবে, কিন্তু আঘাত করবে না, আমি তাকেই বিয়ে করব।
নিজেকে এতটা কুঁকড়ে যেতে কখনওই দেখিনি আমি। এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি কখনও। কিছু একটা হচ্ছে আমার সাথে। আমি ঠিক কী করব, আর কোন পথে যাব, কী গ্রহণ করব, আর কোনটা বর্জন করব, সবই অদৃশ্যমানতা আর অনিশ্চয়তায় ভরে উঠছে। নিজেকে স্পষ্টই অসহায় দেখতে পাচ্ছি, যা কিনা আমি কখনওই ছিলাম না। এই আমি আমার অচেনা। এই আমাকে আমি কখনওই দেখিনি আগে। হারাতে না চাইলেও হারিয়ে গেল সে। শতচেষ্টার পরেও আমি এখন আর খুঁজে পাই না তাকে। আমার আরও কিছু করার ছিল কি না, সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না।
কেয়া যে ওর সংসার ছেড়ে সন্তান নিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিল, আমি জানি না এই ধকল সে আদৌ সহ্য করতে পারবে কি না। হয়তো আমাকে দেখে সে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে থাকবে, কিন্তু আসলে কতদূর পর্যন্ত নিজেকে শক্ত রাখতে এবং সুস্থ রাখতে পারবে, তা আমি জানি না। তবে আমি আমার দিক থেকে ওকে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, কারণ আমি এখন এসব সামলে নিতে শিখে গেছি। আমার কাছে এই দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়াটা সহজ। আমি ওর পাশে থাকব এবং প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার সব ধরনের পরামর্শ দেবো।
তার কথাগুলো সেদিন মেনে নিয়েছিলাম শুধু সেগুলো মেনে নিতে হবে বলেই, কেননা সে ক্ষেত্রে আমার কিছু করার, বলার অথবা জিজ্ঞেস করার কোনও অপশন ছিল না। জানি না আমি কেন অচল হয়ে পড়েছিলাম সেদিন এবং কোনও কিছুই আমার করার ছিল না। সেটা ছিল সত্যিই খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার, কিন্তু সহ্য করে নিতে পারার মতো সময় তখন হাতে ছিল না। যেটা করতে তুমি বাধ্য, সেটা তোমায় করতেই হবে। আর সেসব ক্ষেত্রে তেজস্বিতা দেখাতে গেলে কোনও প্রকার জয় তো হতোই না, বরং নিজের মূল্যবোধ মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হতো, যা আমি সজ্ঞানে কখনও করিনি। ‘কেন’ একটা মূল্যহীন শব্দ। সবকিছুর কেন হয় না। আমি এর অযথা-ব্যবহার করব না। পৃথিবীতে সবকিছুর উত্তর ‘কেন’ দিয়ে হয় না। পৃথিবীতে সব ‘কেন’র উত্তর সত্যিই হয় না। অনেক ‘কেন’ আছে, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সারাজীবনই চলে যাবে, কিন্তু উত্তর আর পাওয়া যাবে না। সেগুলোকে মেনে নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া ভালো।
আজ আমার অনার্স থার্ডইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে, কিন্তু রেজাল্ট কী, তা আমি এখনও জানতে পারিনি। আমি এজন্য একটু উদ্বিগ্ন হলেও হতাশ নই, কেননা যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। এখন এসব নিয়ে হতাশার কোনও কারণ নেই। আমি চাইলেও সেটাকে বদলাতে পারব না। সেটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। যদি চিন্তা করতেই হতো, তবে রেজাল্ট হওয়ার আগেই তা করা উচিত ছিল।
আজ আবার পুরনো একটা আঘাত পেলাম। আমি যাদের খুব বেশি বিশ্বাস করি, তারাই সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে না। আজ রেজাল্ট দিল এবং আমি আমার রেজাল্ট বের করে আমার বান্ধবীরটাও সাথে সাথে বের করলাম। যা দেখলাম, তাতে আঘাত পেতে হয়, কেননা ও কাল সন্ধ্যায়ও রেজাল্ট সম্পর্কে যা বর্ণনা দিয়েছে, তার সাথে এর কোনও মিল নেই। ও আমার এত বিশ্বস্ত বান্ধবী হয়েও এত বড় মিথ্যাকথা বলতে পারবে আমার সাথে, তা আমি সত্যিই ভাবিনি। ওর এতে করে কি খুব ভালো হয়েছে? আদৌ কি কোন লাভ হয়েছে? ও কেন ওরকম বানিয়ে বানিয়ে মনখারাপ করে থাকার অভিনয় করে বলল যে ওর রেজাল্ট ভালো হবে না, ও কিচ্ছু পড়াশোনা করেনি, আর পরীক্ষা খুবই খারাপ দিয়েছে? ওর ভালো রেজাল্ট কি আমি নিয়ে যেতাম বা যেতে পারছি? আমি আমার জীবন থেকে আরও একটা শিক্ষা নিলাম এই যে, যাকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করে পথ দেখাব, আমি যার ভালো চাইব, সে-ই সবার আগে আমার ক্ষতি করবে, আমাকে ভুল তথ্য দিবে। আচ্ছা, আমি এতটা রেগে যাচ্ছি কেন? কেন ওকে আমার সহ্যই হচ্ছে না? আমার রেজাল্ট ওর রেজাল্টের চাইতে বাজে হয়েছে, তাই? না কি ও আমার কাছের বান্ধবী হয়েও আমাকে ভুল তথ্য দিল বলে? আমি প্রায়ই পুরনো অনেক আঘাত নতুন করে পাই। কেন পাই? কেন আমি সেই পুরনো আমিটাকে আমার মধ্য থেকে বের করে দিতে পারি না, যে আমিটা আমাকে কেবলই দুঃখ দেয়?
আমি কী করব? তুমি এখন এলেও আমি আর হয়তো তোমাকে মেনে নিতে পারব না, কেননা আমি তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই হারিয়ে ফেলেছি। ঠিক যেভাবে এবং যেজন্য আমি পিয়াসকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, অথবা ঠিক যেভাবে শেষসময়ও ওর উপর আর একবিন্দুও ভরসা করতে পারিনি, তেমনি আমি তোমার প্রতিও কোনও আস্থা অনুভব করছি না। জানি না, জীবন আমাকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমার জন্য যা ভালো, আমার জীবনের জন্য যা ঠিক, তা-ই হচ্ছে আমার সাথে। আমি ঈশ্বরকে তাই বলি, তুমি আমাকে সে শক্তি দাও, যা পরিবর্তন করতে আমি নিজেই পারব না। যা আমি পরিবর্তন করতে পারব না, তা যেন আমি কষ্ট করে হলেও মেনে নিতে পারি। আর যা আমি পরিবর্তন করতে পারি, সে বিষয়ে আমায় শক্তি দাও এবং আরও পথ দেখাও। আমার নিয়তি আমাকে কোন দিকে টানছে, আমি এখনও তার কিছুই বুঝতে পারছি না। সবই অদৃশ্য অস্পষ্ট ঝাপসা লাগছে।
ভেতর থেকে সব ভেসে আসতে চায়। একটা একটা করে সবকিছুই চোখের সামনে চলে আসে। তা দেখে আমি শেষ হয়ে যাই, মনে শুধুই প্রশ্ন আসে, সে কেমন হবে? যা আমি হতে পারব না, সে কি আমাকে তা-ই হতে বলবে? এইসব প্রশ্নই আমাকে শেষ করে দেয়। আমার কেবলই নিজেকে ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। আমি ঠিক করেছি, আমি কোনও দোষ না করলেও যদি সে আমায় দুঃখ দেয়, শাস্তি দেয়, আমি ওকে হেসে বলব, তুমি তো পার শুধু আমার সাথেই! আচ্ছা, আমার মুখে এমন কথা শুনলে কি সে ফিক্ করে হেসে ফেলবে?
যাক! আমি আমার নিজের মতোই হব। আমি যেমন, ঠিক তেমনই হব। আমি যা পছন্দ করি এবং আমাকে যেগুলোতে মানায়, আমি সেগুলো নিয়েই বাঁচব। কাজটা সহজ নয়, জানি। এও জানি, সকলকে এই কঠিন পথেই সব শিখতে হয়, আর সে যেমন, দিনের শেষে সে তেমনই হয়। তার মতো মানুষ সে একজনই! এ পৃথিবীতে একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষ কখনওই মেলে না। কখনওই না! তাই আমি কারও অন্ধঅনুকরণ কখনও করিনি, আজও করছি না, সামনেও কখনও করব না। আমি আমার মতো। আমাকে নিয়ে কারও মুগ্ধ হতে হবে না। যদি হতেই হয়, তবে আমি যেমন, তেমনটা মেনে নিয়ে হতে হবে। কিংবা আমার সম্পর্কে সত্যি সত্যি জেনে নিয়ে মুগ্ধ বা বিরক্ত হতে হবে। কে আমায় কী ভাবল কী ভাবল না, আই ডোন্ট কেয়ার। আমি কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য এই দুনিয়ায় আসিনি। যদি কেউ ইমপ্রেসড হয়েই যায়, তবে সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা। সেটার জন্য, তাকে ওই অবস্থাতেই রেখে দেওয়ার জন্য তার মনের মতো নাচতে আমি পারব না। আমি কেমন, সেটা বোঝার কোনও দরকার নেই। আমাকে ভুল না বুঝলেই আমি খুশি।
জীবন এমনই! জীবন খুব সহজ নয়, অন্তত ততটা সহজ নয়, যতটা আশা করা যায়। জীবন এতটা কঠিন কিছুও নয়, যা ভেবে আমরা ভয়ে থাকি। জীবন এসবের মাঝামাঝি কিছু একটা, খুব বেশি সহজ বা কঠিন নয়। এই জীবনকে নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কোনও কিছু নেই। জীবনকে সিরিয়াসভাবে নিলেও জীবন যেমন থাকবে, সিরিয়াসভাবে না নিলেও জীবন তেমনই থাকবে। আমার বিশ্বাস, আমার ভরসা, আমার শক্তি সবকিছুই এক সৃষ্টিকর্তা। তিনি আমার হৃদয়ে বাস করেন। তাঁর সাথে কথাবলার মানেই হলো, আমার ভেতরের মানুষটির সাথে কথাবলা। হৃদয়ের সাথে এই সংযোগস্থাপনের নামই প্রার্থনা বা ইবাদত। আমি প্রার্থনায় বলি, জীবনের এই কঠিন পরীক্ষায় আর কঠিন মুহূর্তে আমি শুধু তোমাকে বিশ্বাস করে সামনে এগোতে চাই। তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। তুমি আমার সম্মান রক্ষা করো, আমার বিশ্বাস আরও শক্ত করো। তোমার উপর বিশ্বাস হারালে আমি ধ্বংস হয়ে যাব, জীবন শেষ হয়ে যাবে আমার। তুমি এই কঠিন মুহূর্তে আমাকে সাহায্য করো, আমাকে পথ দেখাও, আমাকে দয়া করো। জীবনে যেহেতু কষ্ট এসেছে, এই অবস্থা পরিবর্তন হতে সময় তো লাগবেই! আমি যেন ধৈর্য ধরতে পারি, নিজেকে ঠিক রাখতে পারি। আমি যেন তোমার তোমার সাহায্য নিয়ে সামনের দিকে চলতে পারি।
এভাবে এত কষ্টের ঠিক পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে এর পরই একদিন শেষ হয়ে যাবে সব কষ্টের পথ। প্রকৃত সুখ কষ্টের পরেই হয়তো আসে। আমি জানি না, তুমি কে। তুমি যে-ই হও, তুমি প্লিজ জলদি আমার জীবনে চলে আসো! অনেক তো হলো অপেক্ষা! আমি সত্যিই খুব কষ্ট পাচ্ছি…যতসব ফালতু আবেগ আমার! বারবারই মনে হচ্ছে, আমি কাউকে আমার জীবন নিয়ে পরীক্ষাকর্ম চালাতে দেবো না। আমি কোনও ল্যাবরেটরির গিনিপিক নিজেকে হতে দেবো না। আমি এইসব বুঝি আসলে। তবু, মন-বদলানো সহজ হলেও হৃদয়টাকে তো কখনওই বদলানো যায় না!
এখন আমার মধ্যে নতুন একটা ভয় কাজ করছে। আমি ভয় পাচ্ছি, এমন সিদ্ধান্তে থেকে গেলে শেষঅবধি আমাকে অর্থসংকটে পড়তে হতে পারে, যার জন্য আমি আমার লক্ষ্যগুলি থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হব। আমি উদ্বিগ্ন, কিন্তু অন্যমনস্ক নই। এর সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে এবং আমাকে তা করতেই হবে, নিজেকেই করতে হবে। তবে এখানে প্রাথমিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান, আবার প্রস্তুতিপর্বেও রয়েছে আশংকা। এখন থেকে আমার প্রতিটি কাজ করার সময় আমি ভেবেচিন্তে এবং সততার সাথে যথাযথ সুস্পষ্টতা বজায় রেখে করব। ওরকম করেই চলতে নিজেকে বদ্ধপরিকর রাখব। আমি চাই না, আমার সাথে আজকে অথবা পূর্বে ঘটে-যাওয়া কোনও ঘটনা অথবা সামান্য কিছুও আমাকে আমার ভবিষ্যতের খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদ অথবা দায়িত্বগ্রহণের ক্ষেত্রে বঞ্চিত করুক, পেছন থেকে টেনেছিঁড়ে ফেলে দিক। এক্ষেত্রে আমি নিজেকে প্রকাশ করার সময় বা আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গে হেরে যেতে পারি, অথবা আমার চরিত্র, সততা, মূল্যবোধজনিত বিষয়গুলো প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আর যদি তা-ই হয়, তবে আমি আটকে যাব। নিজেকে খোলাচিঠির মতো করে রাখা বা রাখতে পারা খুব কঠিন কিছু না, তবে এসব ক্ষেত্রে সর্বদাই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হয়, যা কিনা আমি অতীতের দিনগুলোতে যথাযথভাবে করতে পারিনি। তবে এগুলো খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না, কেননা আমার বর্তমান রেকর্ড যথেষ্ট শক্তিশালী এবং যৌক্তিক।
শঙ্কাবিহীন জীবন হয়তো মানুষকে আরও আশঙ্কায় ফেলে দেয়। আমি আমার জীবন নিয়ে কখনও খেলা করিনি এবং যতই এর জন্য চরমমূল্য দিয়ে বিচার করেছি, এটা নিয়ে আরও কিছু বিষয়ে ডুবে যেতে বাধ্য হয়েছি। আমি সুখের সংখ্যায় আসক্ত নই, আমি বরং সুখের মানের প্রতি আসক্ত। জীবন বৈচিত্র্যময়, এ কারণেই নিজেকে সকল ধরনের বৈচিত্র্যের জন্য তৈরি করে রাখতে হবে। একটা কথা বলি, বেশি বাড়লে ঝড়ে ভেঙে যায়। সব সময় এটি হয়ে আসছে, নিয়ম অনুযায়ী এটিই হবে। আমি আশা করছি, একদিন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে, সবকিছুই এখনকার বিপরীত হবে। হবেই হবে! এটাই নিয়ম, এটাই হয়ে আসছে। এর ব্যতিক্রম কিছু এবারও হবে না।
(চলবে…)