আমার চলতি সময় ঠায় থমকে আছে… না না, আজ নয় তো, বহু বছর আগে থেকেই! এখন তো শিখেই গেছি কান্না গিলে বেদনাগুলি হজম করে হেসে খেলতে! এখন আমি কষ্টেসৃষ্টে হয়েছি ‘পরিণত’…! হাসি পায় এই শব্দটিতে…পরিণত! এই সামান্য শব্দটুকুই এখন যেন গরীবের লাখ টাকার স্বপ্ন হয়ে নিরত কাজে…ব্যস্ত অবিরত! হায় রে জীবন! জীবন এমনও হয়! ভালোবাসাও যেখানে কাঁটা হয়ে ঠিকই হাজিরটা হয়! জন্মটাই যার জন্মান্তরের পাপ হয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, তারও আবার…সত্যি তুমি হাসালে বটে! আমি যে জন্ম থেকেই একটা লস-প্রজেক্ট! এমন মানুষ জীবনে আর কতটুকুই-বা করতে পারে! বুঝি একেই বলে ডেসটিনেশন! কী জানি! ওরা বলে, পরিশ্রম করলে কী কী যেন হয়ে যায়! মনে তো হয়, পরিশ্রম করার ক্ষমতাটাই মানে মানে বিদেয় হয়েছে আমার মধ্য থেকে! কতটা হতভাগ্য হলে বাধ্য হয়েই বেঁচে থাকতে হয়, তা বোধহয় যে থাকে না, সে জানে না। মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে, নতুবা মৃত্যুকে বরণ করবার সাহসটাই দেখাতে পারে না! বেশিরভাগ মানুষ আসলে মরে যায়, মৃত্যুবরণ করে না। আমি এই ভীতু চোখে, মৃত্যুর সাথে বরণের মেলবন্ধনের যথেচ্ছাচারিতা দেখতে দেখতে বড্ড ক্লান্ত! যে মানুষটি আজ রাতটাই শেষ রাত ভেবে মরে যাচ্ছি…যাচ্ছি বলে ঘুমিয়ে পড়েও আচমকাই সকালটা দেখতে বাধ্য হয়, তার সাথে বাকিদের একপৃথিবীসমান ফারাক রয়েছে। আরে বাবা, মরে-যাওয়া মানুষ নরক দ্যাখে না রে, ওদের যে বেঁচে থেকেই নরক দেখতে হয়! গরিব যে, তাকে তো দেখাই যায় গরিব, আর বড়োলোক হয়েও যে গরিব, তার যে কী কষ্ট! তাকে কী বলা যায়? সে না পারে নিজেকে গরিব বলতে, না পারে বড়োলোকির দেমাক দেখাতে! সে কী করে কী না করে, সে খোঁজ কাউকে দেওয়া কখনও হয়েই ওঠে না! এখন মনে হয়, পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় যে, সেও অন্তত আমার তুলনায় ভালো থাকে! তাকে অন্তত…কষ্ট কী, কষ্ট হলে খারাপ লাগলে কেমন লাগে, ওসব বুঝতে হয় না, কান্না গিলতে শিখতে হয় না, কিংবা কষ্ট হজম করতে জানতে হয় না। সব থেকে কাছের মানুষগুলোর কষ্টের কারণ হতে হয় না, তাদের কষ্ট পেতে দেখেও অসহায়ের মতো নির্বাক দর্শক হয়ে থাকতে হয় না। এই জটিল পৃথিবীর জটিল মানুষগুলোর সাথে বন্ধুত্বের মতো ভয়ানক কাজটি অন্তত করতে হয় না তাকে! প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার সময় পরবর্তী নতুন কোনও আশার আলোয় রাঙা একটি সকাল দেখবার মিথ্যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি আজ ক্লান্ত! ক্লান্ত!…এ কথাটি বলতেও যেন ক্লান্ত বোধ হয় এখন! এতটা অকর্মণ্য হয়ে কেউ কী করে পৃথিবীতে জন্মায়! দেবতুল্য বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে জন্মানোকে আমার আগের জন্মের পুণ্যের ফল বলব, না কি বাবা-মায়ের বিগত জন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলব, সেটাই বুঝি না! কী করে নিজেকে অসহায় বানিয়ে তাদেরকেও অসহায় করতে তুলতে হয়, সবাই আমাকে দেখে এটা শিখুন! আরও একটি দিন আমায় বাঁচতে হবে ভাবলেই যেন দম আটকে আসে…মনে হয়, ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে… বেঁচে থাকার চাইতে বড়ো শাস্তি আর কী হয়, সেটা এই মুহূর্তে আমার জানা নেই! এমনও জীবন হয়! এটাকেও বেঁচে থাকা বলে! হ্যাঁ, জানি, তুলনায় আনলে আরও অসংখ্য মানুষের বেদনার্ত জীবন বেরিয়ে আসবে, যা হয়তো দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না! আমি তো তার ছিটেফোঁটাও জানি না! কিন্তু আমি যে ওদের মতো অতটা নির্লোভ নই! ভালোভাবে সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকবার লোভে লোভী হয়ে যে পাপ আমি করেছি…সে পাপের শাস্তি বিনা আপত্তিতে পূর্ণ আয়ু নিয়ে বেঁচে থেকেই আমায় ভোগ করতে হবে!