গোটা পৃথিবীতে কতটি ধর্ম আছে, তা জানেন? প্রায় সাড়ে চার হাজার! প্রতিটি ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করেন: তাঁদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, তাঁদের ধর্মগ্রন্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, তাঁদের ধর্মের মানুষই কেবল সঠিক পথে আছে, তাঁদের অনুসৃত ধর্মমতই সুন্দর ও সঠিক। সকল ধর্মেই স্বর্গে যাবার রাস্তা বলে দেওয়া আছে। তাই অন্য কেউ স্বর্গে যাবেন কি যাবেন না, তা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হবার সত্যিই কিছু নেই। আমরা যেন ভুলে না যাই, অন্য কেউ স্বর্গে যেতে পারল কি পারল না, তা দিয়ে আমার নিজের স্বর্গে যাবার পথে কোনও বাধার সৃষ্টি হয় না। কাউকে নিজের স্বর্গে নেবার জন্য টানাটানি করে যে ব্যক্তি, তার নিজের স্বর্গটি নিশ্চয়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিজের কর্মের দিকেই আমাদের সমস্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকুক, কেননা অন্য কারও কর্মফলে কারও স্বর্গযাত্রা সহজও হয় না, কঠিনও হয় না। ভিন্ন মানুষের স্বর্গও ভিন্ন। সত্য হচ্ছে এই, প্রতিটি ধার্মিক মানুষের কাছেই তাঁর নিজের ধর্মটি বড়ো আদরের, পরম শ্রদ্ধার, অসীম ভালোবাসার। নিজের বাবা, মা কিংবা সন্তান যেমনই হোক, সবার কাছেই এই মানুষগুলি ভীষণ কাছের, অভ্যস্ততার, আবেগের ধন। এই ধনটি সম্পর্কে নিছকই গায়ের জোরে অন্য কারও বিচার-বিবেচনা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বিরক্তিকর। ঠিক একইভাবে, নিজের ধর্মটিও ধার্মিক মানুষের কাছে প্রচণ্ড আবেগের একটি জায়গা। সেখানে অন্য কেউ এসে আঘাত করলে কেউই তা সহ্য করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে অন্য কারও বিশ্বাসকে আক্রমণ করে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা কিংবা আচরণ প্রকাশ করা কখনওই সম্ভব নয়। কোনও সম্প্রদায়কে আক্রমণ করেন যে ব্যক্তি, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। যা-কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তা-কিছু কখনওই ভুল হতে পারে না। বাঁচার যে পথটি কারও ন্যূনতমও ক্ষতির কারণ হয় না, তা চিরকালই সত্য ও নির্ভুল। যা নিয়ে আমি বাঁচছি না, কিন্তু কেউ-না-কেউ বেঁচে আছে, তা নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার নির্ভার অবলম্বন হিসেবে স্বীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারও নেই। তা নিয়ে কোনও নেতিবাচক মতামতপ্রকাশ অন্ধত্ব ও মূর্খতারই নামান্তর। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, তা অবশ্যই সত্য ও সুন্দর। ধর্মসৃষ্টির ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখব, পৃথিবীতে ধর্মের উৎপত্তিই হয়েছে শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। প্রতিটি ধর্মই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলে। হিংসাদ্বেষ, হানাহানি, দাঙ্গাবাজি, খুনোখুনি, অসহিষ্ণুতা ইত্যাদিকে কোনও ধর্মেই আশ্রয় কিংবা প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। প্রতিটি ধর্মই সুন্দর, প্রতিটি ধর্মই অপরিহার্য, প্রতিটি ধর্মই মানবিক। তাই কে কোন ধর্মের, তা বিবেচনায় আনার চাইতে অনেক বেশি জরুরি, কে কেমন মানুষ, তা বিবেচনায় আনা। মানুষের যা ধর্ম, তা কখনও মিথ্যে হতে পারে না। কর্মের পরিচয় যেন কোনোভাবেই ধর্মের পরিচয়ে কালিমালেপন না করে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রতিটি ধার্মিক ব্যক্তিরই কর্তব্য। পরমত ও পরধর্মের প্রতি সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতাই আধুনিক মানুষের প্রথম বৈশিষ্ট্য। সকল উপাসনালয় এবং ধর্মবিশ্বাসের উপর শ্রদ্ধার জন্মই শিক্ষার প্রথম শর্ত। কোন ধর্ম কী শিক্ষা দেয়, তা সম্পর্কে মানুষ অনুমান করতে পারে সেই ধর্মের অনুসারীদের আচরণ দেখে। সকল ধর্মের এবং সকল মতের মানুষের স্বচ্ছন্দ বিচরণেই পৃথিবী আরও বেশি সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কোনও ধর্মের হিংস্র বাহ্যিকতায় যদি মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না পারে, তবে ধরে নিতে হবে, ধর্মাচরণে বড়ো ধরনের গলদ আছে, কেননা প্রত্যেক ধর্মই শান্তির বারতা নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা প্রথমেই মানুষ, তার পরে ধর্মানুসারী। হিন্দুত্ব, মুসলমানত্ব, বৌদ্ধত্ব, খ্রিস্টানত্বসহ যা-কিছু আছে, তার চাইতে অনেক অনেক উপরে মনুষ্যত্বের দৃঢ় অবস্থান। জন্মসূত্রে যে কেউই যে-কোনও ধর্মের ছায়াতলে বেড়ে উঠতে পারে, এতে সত্যিই কৃতিত্বের কিছু নেই। তবে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে চাইলে অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ধর্মই মানুষ হতে শেখায়। তাই যে ব্যক্তি মানুষই হতে পারল না, তার সমস্ত ধর্মাচরণ ও ধর্মবিশ্বাস ভ্রান্ত। মানুষ কর্মেই মানুষ, ধর্মে নয়। মানুষ হয়ে মানুষের অপমান ও লাঞ্ছনা করার দীক্ষা দেয় যা, তা কিছুতেই ধর্ম নয়, ঘোরতর অধর্ম। এই পৃথিবীর সব কিছুই এক স্রষ্টার সৃষ্টি। সেই হিসেবে কে কোন ধর্মবিশ্বাসে বেড়ে উঠবে এবং বেঁচে থাকবে, তা-ও সেই মহান স্রষ্টারই সিদ্ধান্ত। একমাত্র তিনিই জানেন, কার নিয়তিতে কোন ধর্ম লেখা আছে। যার জন্য যে ধর্ম উত্তম, তিনি তাকে সেই ধর্মের সুশীতল ছায়ায় পৃথিবীতে পাঠান এবং বাঁচিয়ে রাখেন। স্রষ্টার এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তের চর্চা নিঃসন্দেহে স্রষ্টার সিদ্ধান্তের প্রতি চরম অবমাননার শামিল। যার যে ঘরে জন্ম নেবার কথা, সে সেই ঘরেই জন্ম নিয়েছে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার মানে স্রষ্টার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা। যে সৃষ্টিকে ঘৃণা করে, সে প্রকারান্তরে স্রষ্টাকেই ঘৃণা করে। সৃষ্টিকে যে নিজের খেয়ালে বিচার করে, প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টার ক্ষমতাকেই সে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ধর্মের মূল সৌন্দর্যটি কর্মেই নিহিত। যার কর্ম কুৎসিত, আচরণ আগ্রাসি, ভাষা বেপরোয়া, তার ধর্মশিক্ষা পুরোপুরিই বৃথা। মানুষের প্রধান পরিচয় মনুষ্যত্ব। এই পরিচয়ে যে পরিচিত হতে পারল না, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, সে আসলে মানুষের মধ্যেই পড়ে না। ধর্মের নিকৃষ্টতা প্রকাশ পায় অনুসারীদের গায়ের জোরে, ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায় অনুসারীদের আচরণের জোরে। কথায় ও আচরণে নিজের ধর্ম নিয়ে অন্যকে ভুল ধারণায় পৌঁছতে বাধ্য করা অনেক বড়ো একটি পাপ। এই পাপের পুরোটা দায়ই অনুসারীদের অজ্ঞতার, ধর্মের নয়।