লোকটা

সেদিন ঊষালগ্নে ত্রিলোচন সিদ্ধান্ত আর নীলমণি বেদান্ততীর্থ গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। এটা তাঁদের প্রতিদিনের ব্যাপার। দু-জনেই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। দুজনের হৃদ্যতাও অত্যন্ত গভীর।




তাঁরা যখন আপনমনে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে পথ চলছিলেন, তখন কে একজন কোথা থেকে যেন চিৎকার করছিল, দয়া করে আমায় একটু সাহায্য করুন।




প্রথমটায় তাঁরা কেউ তা খেয়াল করেননি, কারণ দু-জনেই তখন ঈশ্বরচিন্তায় অত্যন্ত মগ্ন ছিলেন। কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে আসতেই চিৎকারটা তাঁরা স্পষ্ট শুনতে পেলেন।




প্রথমে তাঁরা দু-জনেই বেশ একটু হচকিয়ে গেলেন। তখন‌ও ভোরের আলো তেমন ফুটে ওঠেনি। পৃথিবীর চোখ থেকে তখন‌ও ঘুমজড়ানো ভাব কাটেনি। কেবল কিছু পাখি কলকল করে অনেক কথা বলছে। দূরদূরান্ত থেকে বেজে-ওঠা দু-একটা কারখানার ভোঁ বাজছে। বাদবাকি সবটাই নিস্তব্ধ।




তা ছাড়া যে-পথে তাঁরা চলেছেন, সেটা অনেকটা বনপথের মত। শহর এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে। পাকা পথ ধরে গেলে দূরত্বটা বেশ কিছু বেড়ে যায় বলে, তাঁরা এই পথেই যাতায়াত করে থাকেন। আজ কোথা থেকে এই বিঘ্ন উপস্থিত!




এই নির্জন পথে, এই প্রত্যূষে কে কী কারণে অমন চিৎকার করতে পারে, তা কিছুতেই ঠাওর করতে পারলেন না তাঁরা। কিন্তু কোনো কারণ জানা না থাকলেও, দু-জনেরই গা যেন ছমছম করে উঠল। দু-জনে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ব্যাপারখানা কী?




নীলমণি বেদান্ততীর্থ যেন মোটেই ভীত নন, এমন‌ই ভঙ্গিতে বললেন, অত ভয় পাবার কী আছে, ত্রিলোচন? যতক্ষণ দেহে এই উপবীত আছে, কণ্ঠে গায়ত্রী-মন্ত্র আছে, ততক্ষণ স্বয়ং যম‌ও এ দেহ স্পর্শ করার সাহস পাবে না। সামান্য মানুষ তো কোন ছার!




: সে কি আর জানিনে, নীলমণি? হৃদয়ে যদি এইটুকু বিশ্বাস না থাকে, তবে এতদিনের এই জপতপ পূজা-পার্বণ সবই তো মিছে। বলতে বলতে দু-পা এগিয়ে গিয়ে অসীম সাহসে শুধোলেন, কে? কে অমন করে চিৎকার করছে?




: আমি! আমি চিৎকার করছি। দয়া করে আমায় একটু সাহায্য করুন।




: আমরা তো তোমায় দেখতেই পাচ্ছিনে। তুমি কোত্থেকে বলছ?




: আজ্ঞে! একটা কুয়ো দেখছেন তো?




: কুয়ো? ও কী বললে, নীলমণি? কুয়োতে কি কেউ বাস করে? বুকের মধ্যে একটা দারুণ ধড়ফড়ানি শুরু হল ত্রিলোচন সিদ্ধান্তের।




: হুস্! এই সেই পিশাচি মায়ার খেলা। দীন ব্রাহ্মণকে পরীক্ষা নিচ্ছেন শ্রীহরি। তবে আমরাও প্রস্তুত। ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ না করে জ্ঞানত জলস্পর্শ করিনি। নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত আচারবিচার পালন করে এসেছি। আমাদের ভয় কাকে?




এত কথার পরও দু-জনের কেউই আর এগিয়ে যাবার মতো সাহস পেল না। এক জায়গায় দাঁড়িয়েই নীলমণি বেদান্ততীর্থ তখন আপ্রাণ জোরে বললেন, দ্যাখো, তুমি যে-ই হও, ব্রাহ্মণের কর্তব্যে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা কোরো না। আমাদের পথ ছেড়ে দাঁড়াও। আহ্নিকের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সে পাপ তোমাকেই স্পর্শ করবে।




: দোহাই ঠাকুরমশাই! বড়ো বিপদে পড়েই আপনাদের সাহায্য প্রার্থনা করছি। আপনারা রুষ্ট হবেন না।




: তুমি কি সত্যিই মানুষ? ত্রিলোচন পেছন থেকে সজোরে প্রশ্ন করেন।
: সে কী কথা, ঠাকুরমশাই?
: তা কোথা থেকে আসা হয়েছে?
: নিজের গ্রাম থেকে।
: নাম?




: আমার নাম? হ্যাঁ, নাম একটা আমার ছিল তো। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমি তো এখন আমার নাম মনে করতে পারছি না।




: হুম, বুঝেছি। ত্রিলোচন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। বললেন, আমি আগেই সন্দেহ করেছিলুম, এ সেই পিশাচির খেলা, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পূজা-পার্বণ আর যাগযজ্ঞে বিঘ্ন সৃষ্টি করাই যাদের কাজ। অতএব, নীলমণি আর কোনোরূপ মানসিক চাঞ্চল্য না রেখে একাগ্রচিত্তে গায়ত্রী জপ করো আর এগিয়ে চলো!




এবারে তাঁরা দু-জনেই তারস্বরে মন্ত্র জপ করতে লাগলেন।




কিন্তু যে-ই তাঁরা পা বাড়ালেন, অমনি লোকটা আবার চিৎকার করে উঠল, আপনারা কি চলে যাচ্ছেন? আপনারা চলে গেলে আমি যে সত্যি সত্যি মারা যাবো, ঠাকুরমশাই। আমাকে ফেলে যাবেন না আপনারা। দোহাই আপনাদের।




ওর এই আর্তচিৎকারে সিদ্ধান্ত মশাই একটু বিচলিত বোধ করলেন। মনে মনে যথেষ্ট ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কি সত্যিই বিপদাপন্ন? কিন্তু তাতে সঠিক প্রশ্নটি করা হলো না ভেবে তিনি শুধরে নিয়ে বললেন, বলি, তুমি সত্যিই মানুষ তো?




: আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠাকুরমশাই। আমি সত্যি সত্যি একজন মানুষ ছিলাম।




কথা শুনে গা-টা শিরশির করে উঠল সিদ্ধান্তের। বললেন, ছিলাম? আর এখন? মানে বর্তমানে?




শরীর দু-জনের কাঁপছে।




লোকটা বলল, এখন তো খাবি খাচ্ছি—প্রায় মৃত। আর তো ভেসে থাকতে পারছি না।




আবার দু-জনে দু-জনার দিকে তাকাল। কী যে ঘটছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত অবিশ্বাস্য সাহসে নীলমণি বলল, একবার কূপের ভেতরটা দেখবো নাকি, ত্রিলোচন? মনে হচ্ছে, লোকটা সত্যিই বিপদাপন্ন।




ত্রিলোচন একটুও না নড়ে বললেন, অবশ্যই দেখবে। যথার্থ বিপদে নিজেকে উৎসর্গ করাটাই ব্রাহ্মণের অবশ্যকর্তব্য। অতএব, তুমি অগ্রসর হও।




নীলমণি তখন গলাটা ঈষৎ লম্বা করে জিজ্ঞেস করলেন, এই প্রত্যূষে তুমি এখানে কী করছিলে?




: আজ্ঞে, শুধুমাত্র খাদ্যের সন্ধান।




: এটা তো পশুপক্ষীর আহারের সময়। মানুষ এ সময় ইষ্টদেবতার স্তব করে থাকে।




: ঠাকুরমশাই, পেটে জ্বালা থাকলে আর কারও নাম মনেই আসে না যে!




: বুঝেছি, বুঝেছি। লোকটা নিতান্তই পশুজীবন যাপন করছে। জগৎপিতাকে বিস্তৃত হয়ে এরা তাঁরই দেওয়া আহার্যের সন্ধানে জীবনভর ঘুরে বেড়ায়। এক বারও তাঁর করুণাভিক্ষা করে না। ঈশ্বর এদের কী করে ক্ষমা করবেন, বলো তো, ত্রিলোচন?




ত্রিলোচন এবার একটু এগিয়ে এসে বললেন, দ্যাখো ভাই, এক বার করুণাময়ের নাম স্মরণ করো, দেখবে, সব বিপদ দূর হয়ে গেছে।




: কর্তামশাই, অসংখ্য ব্যাং আর কত যে পোকা আমায় অনবরত কামড়াচ্ছে, তার ঠিক নেই। তা ছাড়া, আমার হাত-পায়েও তেমন জোর পাচ্ছি না। আমি আর খুব বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারব না, পণ্ডিতমশাই। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি কিছু করুন।




: কী করে আমরা তোমায় ওখান থেকে তুলব, ভাই? আমরা তো গঙ্গায় অবগাহন করে ফিরছি। ওখান থেকে টেনে তোলার কোনো ব্যবস্থাই আমাদের হাতে নেই। তা ছাড়া জায়গাটি এত জনবিরল যে, ডাকলেও কারও সাড়া পাওয়া যাবে না। আমাদের কথা শোনো, ভাই, আমরা ব্রাহ্মণ, অতএব মিথ্যাভাষণে অভ্যস্ত নই। তুমি একাগ্রচিত্তে দয়াময় নারায়ণকে ডাকো, তিনি নিশ্চয়ই তোমায় উদ্ধার করবেন।




: উঃ বাপরে! আবার কীসে কামড়াল!




: তুমি কোথা থেকে আসছ?




: মনে পড়ছে না। আমার গ্রামের নাম মনে পড়ছে না। আমার নিজের নামও মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে, তিন মাস হল আমার চাকরি গেছে। কারখানায় লক-আউট। ঘরে যা ছিল সব বিক্রি শেষ। তবুও পেটের জ্বালা শেষ হয় না। গতরাত্রে ছোটো ছেলেটাকে এমন মার মেরেছি যে, রাতেই ওর জ্বর এসে গেছে। শেষ রাত্তিরেই তাই ওর জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এখানে প্রচুর পাকা বেল পেয়েও গেলাম। কিন্তু ওকে দিতে পারলাম না।




: কেন?




: আমি যে কুয়োর ভেতর পড়ে গেলাম। পা-টা হঠাৎ ফসকে গেল। সেই থেকে অনেক চেষ্টা করছি, ঠাকুরমশাই, কিছুতেই উঠতে পারছি না। কুয়োটা খুবই পুরোনো আর ভাঙা। মাঝে মাঝে ফেটেও গেছে। ভেবেছিলাম, ফাটলের ফাঁকে ফাঁকে পা রেখে উঠে যাব। কিন্তু এতে এত শ্যাওলা যে, পা রাখাই দায়। তা ছাড়া জল এত ঠান্ডা যে, হাত-পা জমে যাচ্ছে। তার উপর বিশ্রী পচা গন্ধ। এরপরও যদি আপনারা একটু সাহায্য না করেন, তাহলে আমি নির্ঘাত মারা পড়ব।




: দ্যাখো ভাই, ঈশ্বর বড়োই দয়াময়। তিনিই তোমায় ওখানে ফেলেছেন, আবার তিনিই তোমায় টেনে তুলবেন। আমরা কে? আমরা আসলে কেউ নই। গীতায় ভগবান নিজের মুখে সেকথাই বলে গেছেন। বলি, তুমি হিন্দু তো?




: সে তো ঠিক মনে পড়ছে না। এখন আর আমার কিছুই মনে পড়ছে না।
: তুমি কে?
: বলতে পারব না।
: কোথা থেকে আসছ?
: মনে নেই।
: বলি, জাত-ধর্ম কিছু আছে তো?
: ঠিক মনে নেই।




: ব্যস্ হয়ে গেল! ওর মতিভ্রম হয়েছে, বুঝলে, সিদ্ধান্ত? বেদান্ততীর্থের কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে এল। তিনি আবার বললেন, লোকটা যদি হিন্দু হতো, তাহলে এই অন্তিম সময়ে এক বার অন্তত তার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করত। তা যখন করছে না, তখন সে নিশ্চিতভাবেই যবন।




: তা কেন হবে? যবন কি মৃত্যুকালে তার ঈশ্বরকে ডাকে না?




: আরে, রেখে দাও ওদের ঈশ্বর! ওদের তো গোটাটাই অনাচারে ভর্তি। চলো, চলো, এবার একটু পা ফেলে চলো। এদিকে আহ্নিকের সময় পার হতে চলল। যত্তসব অনাসৃষ্টি আর কি!




চলতে গিয়ে ত্রিলোচন সিদ্ধান্তের ঊরুর পেশিতে হঠাৎ টান ধরায় বাধ্য হয়েই তাঁকে একটু থামতে হলো। সেই অবকাশে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, দ্যাখো, তুমি হতাশ হয়ো না। আমাদের আহ্নিকের সময় বয়ে যাচ্ছে, তাই একটু এগোচ্ছি। পথে যদি কোনো লোকের সাক্ষাৎ পাই তো তোমার কথা নিশ্চয়ই বলব।




বেলা আরও কিছুটা বাড়ল। লোকটাও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে প্রাণের দায়েই চিৎকার করে উঠছিল। আবার থেমেও যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে দু-একটা ছোটো ছেলে-মেয়ে শুকনো কাঠ-পাতা কুড়োতে এসে লোকটাকে দেখতে পেল এবং হাঁকতে হাঁকতে ছুটতে ছুটতে কিছু লোক জড়ো করে ফেলল। এরা বেশিরভাগই শহরের প্রান্তবাসী। শহরের কলকারখানায় বা অফিস-আদালতে কাজ করে। এরাও কী করবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। একজন বলল, চট করে একটা শক্ত আর লম্বা দড়ি নিয়ে আসুন কেউ, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।




আর-একজন তৎক্ষণাৎ বলল, ওরকম দড়ি এখানে কোথায় পাওয়া যাবে?
: কিন্তু পেতে তো কিছু হবে? না কি সবাই মিলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেই চলবে?
: তা তো চলবে না। কিন্তু কিছু মালপত্তর তো চাই, নইলে কী দিয়ে কী করা যাবে?
: আমারও তো সেই কথা। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, সব নিধিরাম সর্দার।
: এই যে শুনছেন? আপনার তো সাইকেল আছে, আপনি একটু ঘুরে দেখুন না। কোথাও যদি কিছু পান।
: এই ভোরবেলায় কোথায় কার বাড়ি গিয়ে খুঁজব, বলুন তো?
: তাহলে কী করা যাবে? সবাই মিলে চুপচাপ বসে থাকব? ওদিকে লোকটার তো সব শেষ হয়ে এল।
: আমি বলি কী, এখান থেকে কেউ একজন কুয়োতে নেমে পড়ুন। তারপর, আমরা দু-জনকেই টেনে তুলব। একজনের বুদ্ধিমান প্রস্তাব।
: অন্য একজন মন্তব্য করলেন, এ না হলে আর বুদ্ধি বলে কাকে? একজন চোখের সামনে ডুবতে বসেছে, তার কিছু করা যাচ্ছে না। আবার আর-একজনকে ডোবানোর মতলব।
লোকটা ফোঁস করে ওঠে। বলে, কোন কথার কোন মানে, তা না বুঝেই ফালতু মন্তব্য না করাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
: তা বুদ্ধিমান মশাই, নিজেই নেমে পড়ুন না তাহলে।
: আমার পক্ষে সম্ভব হলে কাউকে খোশামুদ করতুম না। এতক্ষণে নেমে পড়তুম।
: পারছেন না কেন?
: আমার যে হার্টের ব্যারাম আছে।
: বাপরে! একদম হার্ট? বলি, এতক্ষণে হার্টফেইল হয়নি তো?
হাঃ হাঃ! হোঃ হোঃ! হিঃ হিঃ! সবাই বেশ উপভোগ করল রসিকতাটুকু। একজন যথাসাধ্য গম্ভীর সুরে বললেন, এটা কি রসিকতা করার সময়? দয়া করে আপনারা একটু সিরিয়াস হোন।
: দেখুন মশাই, যা দেখছি, তাতে আমাদের পক্ষে কিছু না করতে যাওয়াই ভালো। তাতে হিতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে।
: অতএব?
: অতএব, কেউ একজন শহরে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলেই সবচেয়ে ভালো হবে।
: এটা মন্দ প্রস্তাব নয়।




সবাই মোটামুটি একমত হলো। কাজেই, একজন তৎক্ষণাৎ সাইকেলে চেপে শহরে চলে গেল। বাকিরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যার যার হাতের কাজটুকু সেরে নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ বলল, যাই, একটু চা খেয়ে আসি। কেউ বলল, কয়লাটা বাড়িতে পৌঁছে না দিলে উনুনই জ্বলবে না। কারওবা রেশন তোলার তাগিদ। যে দু-চারজন তখনও সেখানে ছিল, তারা নিচু সুরে তখনও নানারকম শলাপরামর্শ করছিল। খানিক বাদেই লোকটা শহর থেকে ফিরে এল। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো পুলিশ না দেখে সবাই বিস্মিত।
: কী হলো? আপনি একা এলেন কেন? ওদের একেবারে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলেন না?
: না।
: কেন?
: ওরা এল না।
: এরকম সিরিয়াস কেইসেও ওরা এল না!
: এর মানে কী? এসব বজ্জাতি আর কতদিন চলবে? বক্তার কণ্ঠে কৈফিয়ত দাবির ভঙ্গি।
: ওখানে কোন রাজকার্যটি তাঁরা করছেন?
: চালওয়ালিদের সঙ্গে লড়াই চলছে শহরে।
: চালওয়ালি? সাবাস ব্যাটা! এ না হলে বীরপুরুষ বলে কাকে?
: তা যা-ই বলুন, ইতোমধ্যে ওরা ইট-পাথর ছুড়ে দু-জন বীরপুঙ্গবের কপাল ফুটো করে দিয়েছে।
: জীতে রহো, লক্ষ্মীবাইরা সব! কুত্তার বাচ্চাগুলোকে একটু শিক্ষা দিয়ে দাও। শালারা যারটা খায়, তাকেই ঠ্যাঙায়।
: তা লোকটার কী হবে? তারও তো প্রায় সব শেষ হয়ে এল।
: ও মশাই, শুনছেন? পরিস্থিতি তো খুবই খারাপ। কী করব, ভেবে পাচ্ছিনে।
: দরকার নেই।
: তার মানে?
: আপনাদের আর কিছু করতে হবে না।
: কেন?
: কারণ আমি ডুবেই যাচ্ছি। আমার হাত-পা সব অসাড় হয়ে এসেছে। আর পারছিনে।
: পারছেন না? কী বিপদ! আর-একটু অপেক্ষা করুন। এক্ষুনি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শহরের লোক জেনে গেছে। কোনো একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
: কিন্তু আমার যে ঘুম পাচ্ছে। ভীষণ ঘুম।
: কী সর্বনাশ! ঘুম পাচ্ছে?




ইতোমধ্যে এই দুর্ঘটনার খবর শহরময় ছড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে একদল তরুণ সাইকেলে কিছু সাজসরঞ্জাম নিয়ে সেখানে উপস্থিত। তারা এসেই অপেক্ষমাণ জনতাকে লক্ষ করে বলল, কী ব্যাপার? আপনারা সেই থেকে এখানে কী করছেন? এখনও তুলতে পারলেন না লোকটাকে? তবে এখানে কী হুজুং-বুজুং করছেন? সরে যান, সরে যান সব! অ্যাই পিটু, তুই এখনি গাছে চড়ে যা।




পিটু নামের ছেলেটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তড়াক তড়াক করে গাছে উঠে গেল। আগের ছেলেটা বলল, নে, এই দড়িটা ধর। বলেই সে দড়িটা ওর দিকে ছুড়ে দিল, আর পিটু চট করে সেটা লুফে নিল। বাকি ছেলেরা কুয়োটার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল।




দলপতির নির্দেশ এল, দড়িটার এক মাথা গাছের ডালের সঙ্গে বেশ কষে বাঁধ। আর এক মাথা কুয়োর ভেতর ছেড়ে দে।




যথানিয়মে সব করা হল। দলপতি এবার কুয়োর মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, এই যে বড়দা, শুনছেন? আপনি দড়ির মাথাটা শুধু শক্ত করে ধরে রাখুন। আর কিছু আপনাকে করতে হবে না। আমরা আপনাকে ঠিক ঠিকমতো টেনে তুলব। এই, সব রেডি?




: রেডি, ওস্তাদ।




কিন্তু লোকটা দলপতির কথার জবাবও দিল না। দড়িটাও ধরল না। তখন সে-ই আবার বলল, কী হলো, বড়দা? দড়িটা ধরুন। অপারেশন শুরু হবে। কী মুশকিল, দেরি করছেন কেন?




: মিছেই চ্যাঁচাচ্ছ, গুরু। মাথাটা প্রায় অর্ধেকটাই ডুবে গেছে। বড়দা তো কেলিয়ে গেছেন। দেখছ না?




: তাহলে তো কেইসটা পাংচার হয়ে যাবে। ঠিক আছে, কুছ পরোয়া নেই। বাঘা যখন এসে গেছে, তখন ফয়সালা একটা হবেই। পিটু, তুই তাহলে সড়সড় করে নেমে যা। এক হাতে বড়দার গলাটা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবি, আর-এক হাতে দড়িটা। পারবি তো?




: রাইট, ওস্তাদ।
: এই, তোরা সব আরও দূরে যা। আমরা দু-জনকেই টেনে তুলব।




প্রত্যেকে যে যার পজিশন নিল। পিটু নিচে নামছিল।




হঠাৎ বাজখাঁই গলার একটা চিৎকার। অ্যাই বাঘা, অ্যাই পিটু! খবরদার আর এক ইঞ্চিও নড়বি না। ওই অপারেশন থামা, নইলে সব ভোগে চলে যাবি।




দৃঢ় সে কণ্ঠ।




: লোকটা মারা পড়ছিল, আমরা ওকে টেনে তুলছি। (বাঘার দৃঢ় কণ্ঠ।)
: এটা আমাদের এলাকা, তোরা টেনে তুলবার কে রে, মদনা? আমরা তুলতে জানি না?
: বেশ তো, তোদের হাতেই দিয়ে যাব।
: শালা, কী করুণাময় রে!




বলেই নিজের সঙ্গী-সাথীদের দিকে চেয়ে হাসল রকেট। বলল, ওর মতলবটা বুঝলি তো, ভেকু? লোকটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বিকেলের মিটিংয়েই বলবে শালা, এ-ই হচ্ছে আপনাদের প্রগতিশীল পঞ্চায়েতপ্রধান কেবলারাম বামনের ভূমিকা। নিজের এলাকায় একটা জলজ্যান্ত লোক পাঁচ-সাত ঘণ্টা খাবি খেয়ে মরল, কেউ একজন তাকে বাঁচাতে এগিয়েও এল না। অথচ তারা কি খবরটা জানত না? নিশ্চয়ই জানত। কিন্তু তবুও কেউ এল না। কেন? না, লোকটা তো কোনো কাজের নয়! তবে আর কী! সে জলে ডুবেই মরুক আর আগুনেই পুড়ে মরুক, তাতে দলের কী আসে যায়? দলই এদের কাছে সব, আর কেউ কিস্‌সু নয়। এ-ই এদের প্রগতিশীলতার নমুনা। বেড়ে চাল চেলেছ, ওস্তাদ। কিন্তু ওসব চাল এখানে চলবে না। যাও, হটো সব।




: যদি না যাই? (বাঘার নির্ভীক প্রশ্ন।)
: তাহলে লাশ পড়বে।
: ভয় দেখাবি না। আমরাও মায়ের দুধ খেয়েছি।
: বেশ করেছ! এবার সেই মায়ের কোলে ফিরে যাও।
: যাব না। তোর ক্ষ্যামতাটাই দেখব।
: বেশ। ভেকু, অপারেশন শুরু হোক। (একটু থেমে বলল,) স্টার্ট!




বলার সঙ্গে সঙ্গে দুমদাম বোমাবাজি শুরু হয়ে গেল। নিরস্ত্র লোকেরা অবস্থা অনুমান করে আগেই সরে গিয়েছিল। শুধু দুই দলের যোদ্ধারা বীর বিক্রমে লড়ছে। চারিদিক ধোঁয়া আর ধুলোয় অন্ধকার। কিছুটা সময় বাদে সব নিস্তব্ধ। কারও হাতে লেগেছে, কারও পায়ে বা মাথায়। শেষ হিসেবে দেখা গেল, বাঘার দলের পিটু, যে দড়ি ধরে ঝুলছিল, একটা বোমার আঘাতে সে-ই শুধু মারা গেছে।




সেদিন বিকেলে ওই দুটো মৃতদেহ নিয়ে ওরা বিরাট এক শোকমিছিল বের করল। শহরের নানা পথ পরিক্রমা করল ওরা। বড়ো গম্ভীর সে মিছিল। বড়ো থমথমে। মাঝে মধ্যে বজ্রগম্ভীর চিৎকার। শহিদ পিটু, যুগ যুগ জীয়ো! শহিদ, তোমায় ভুলছি না, ভুলব না। পিটুর মৃতদেহ মিছিলের একেবারে সামনে। শবদেহ যতটা গৌরবময় করা সম্ভব, তা সবই করেছে ওরা। নানা ফুলে দেহটি প্রায় ঢাকা। তা ছাড়া পালঙ্কের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো। ধুনুচিতে ধোঁয়াও দেওয়া হচ্ছে। মৃতের মুখে চন্দনের ফোঁটা। অশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত মৃত পিটু।




ওই মিছিলের একেবারে শেষের দিকে অপরিচিত লোকটার শবদেহ। এত বড়ো মিছিলেও যার কোনো উল্লেখই হচ্ছে না। নেহাতই একটি মরা মানুষের মতো সে চুপচাপ। দু-পাশের অপেক্ষমাণ জনতার কে একজন দুঃসাহসী প্রশ্ন করে, ওটা কে?




মিছিলের সংক্ষিপ্ত জবাব, কেউ নয়। এমনি একটা লোক।
Content Protection by DMCA.com