ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯৬তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো ছেষট্টি

………………………………………………………

এক। একটা চরিত্র আঁকছি। উত্তম পুরুষে। চরিত্রটি কিছুটা হুমায়ূন আহমেদের হিমুর মতো। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে আমি আমার শ্রদ্ধাটা এভাবেই জানাচ্ছি।

লেখাটির ১ম অংশ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পোস্ট করব। ততক্ষণের জন্য আপনাদের একটা মজার কাজ দিই। খুঁজে বের করুন তো দেখি, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর হিমু চরিত্রটি কোন বইয়ের কোন চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন? (আমার কোনও এক লেখায় এর উত্তর আছে, যাঁদের ওটা পড়া আছে, তাঁদের মনে থাকার কথা।)

বাই দ্য ওয়ে, আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

দুই। সুবোধ ঘোষের লেখা ‘শুন বরনারী’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম হিমাদ্রিশেখর দত্ত। লোকে তাকে ডাকে হোমিও হিমু, হিমুদা এসব নামে। হোমিও হিমু স্বভাবে পরোপকারী, বোহেমিয়ান, নিঃস্পৃহ, সরল, মহানুভব। নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াকেই হিমু নিজের জীবনের ব্রত করে নিয়েছিল।

বইটি হুমায়ূন আহমেদের খুউব প্রিয়। তাঁর হিমু চরিত্রটি হিমাদ্রিশেখর দত্তের চরিত্রের অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট, এমন তথ্য জানার পর থেকে উপন্যাসটি খুঁজতে শুরু করি। বইটার হার্ডকপি ছিল দুষ্প্রাপ্য, সে সময় ফেসবুকের চলও তেমন ছিল না। অনেক অনেকদিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজেও বইটা যখন পাচ্ছিলাম না, খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, তখন একদিন ‘অমর বই ঘর’ নামের একটা পুরনো বইয়ের দোকানে প্রায় প্রতিদিনের অভ্যাসবশত নানান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে সুবোধ ঘোষের কিছু লেখার সংকলনে উপন্যাসটা পেয়ে গেলাম। সেদিন কী যে খুশি হয়েছিলাম, লিখে বোঝাতে পারব না! আমার বইয়ের নেশা ছিল কল্পনাতীত রকমের ভয়াবহ!

সেইদিন দোকানের বিক্রয়কর্মীকে খুশিতে জড়িয়ে ধরে উনার হাতে অনেকটা জোর করে ১০০টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলাম, ভাইয়া, এটা দিয়ে মিষ্টি খাবেন। আপনি নিজেও জানেন না, আপনি আমার কী উপকার করেছেন! (এমন আনন্দ হয়েছিল অনেক দিন পর, যেদিন বহুদিন খোঁজার পর ইতালো ক্যাভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিজ’ বইটা খুঁজে পেয়েছিলাম।)

পরবর্তীতে উত্তম কুমার অভিনীত ‘শুন বরনারী (১৯৬০)’ মুভিটা দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম।

ভাল কথা, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সেই লেখাটির ১ম অংশ পোস্ট করব, যে লেখায় আপনারা হুমায়ূনের হিমুকে কিছুটা খুঁজে পাবেন।

তিন। বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কীরে, কেমন আছিস?

আমি বললাম, এইতো বশ আছি!

(পরে খেয়াল করলাম, একটা এ-কার ভুলে পড়েনি। ঠিক করা দরকার। এরপর ভাবলাম, কী দরকার ঠিক করার? ঠিকই তো আছে!………..আহা, আমরা মনের ভুলে কত ঠিক কথা বলে ফেলি!)

চার। একসময়, তোমাকে না চাওয়াই ছিল আমার সারাজীবনের অহংকার।

আর এখন, তোমাকে না পাওয়াই হল আমার সারাজীবনের আফসোস।

পাঁচ। আপনি যদি কারও প্রতি এমন অন্যায় করেন যে উনি আপনার কাজে ভীষণ ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন, এতটাই যে—

উনি আর কখনওই আপনার এলাকার আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না,

উনি আর কখনওই আপনার প্রতিষ্ঠানের আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না,

উনি আর কখনওই আপনার লিঙ্গের আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না,

উনি আর কখনওই আপনার পেশার আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না,

উনি আর কখনওই আপনার অবস্থানের আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না,

—তবে জেনে রাখুন, আপনি একজন পাপী। আপনার জন্যই একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারা—এর চাইতে বড়ো শাস্তি আর হয় না। মানুষকে অবিশ্বাস করে বাঁচা অসম্ভব রকমের কঠিন, এটি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। কোনও কারণ ছাড়াই কাউকে এমন মানসিক কষ্টে রাখার শাস্তি আপনি পাবেনই। আপনি না পেলেও আপনার চোখের সামনে আপনার প্রিয় কোনও মানুষ পাবে। হয়তোবা, আপনার সন্তানই পাবে, আপনার জীবদ্দশাতেই। আপনার চোখের সামনেই ছটফট করবে। ওকে বাঁচাতে আপনি কিছুই করতে পারবেন না, কেবল অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন।

অপেক্ষা করুন, সময় কাউকে ক্ষমা করে না।

যে অন্যায় আপনি উনার সাথে করেছেন, তার জবাব দিয়েই আপনাকে মরতে হবে।

ছয়। লোকে আর্টের দাম দিতে চায় না, কার্পণ্য দেখায়। ভাবে, এটার জন্য এত দাম দেয়ার কী আছে? বেশি সময় তো খরচ হয়নি ওটার পেছনে। এরকম মূর্খতা দেখলে খুব বিরক্ত লাগে।

কিছু গার্ডিয়ান টিউটরের বেতন দেয়ার আগে একশোবার চিন্তা করেন। মাস্টার মাত্র এক ঘণ্টা করে পড়ায়, তাও সপ্তাহে তিন দিন, এত টাকা দিয়ে ফেলছি কেন! অথচ, ভাল মাস্টারের ছয় মিনিটের আড্ডা থেকে যা শেখা যায়, খারাপ মাস্টারের ছয় ঘণ্টার পড়ানো থেকেও তা শেখা যায় না।

ইনবক্সে টেক্সট পাই। ভাইয়া, আমাকে মাত্র দশ মিনিট সময় দেন।

(ভাবি, যার কাছে আমার দশ মিনিট ‘মাত্র’ মনে হয়, তাকে দশ সেকেন্ডও দেয়ার কোনও মানে হয় না।)

আপনাকে এটা শিখিয়ে দিতে আমার হয়তো মাত্র দশ মিনিট খরচ করলেই চলবে। বেশি নয়, মাত্র দশ মিনিট। আপনি খুব সহজেই সেই দশটা মিনিট আমার কাছ থেকে চেয়ে বসলেন। দশ মিনিটই তো! চোখের পলকেই কত দশ মিনিট কেটে যায়! আপনাকে আমি কেন দেবো না মাত্র দশ মিনিট?

মাত্র ওই দশ মিনিটে আমি আপনাকে যা দিতে পারি, তা শিখতে আমার সময় লেগেছে দশ বছর। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, দশ বছর। আমি দশ বছর পরিশ্রম করে যা শিখেছি, তা আমি আপনাকে মাত্র দশ মিনিটেই শিখিয়ে দিতেই পারি। হ্যাঁ, সত্যিই পারি! আপনাকে আমি কেন দেবো সেই দশ মিনিট?

কারণ দেখান। কারণ না থাকলে কারণ বানান।

আমার অনেক শ্রম ও সময় গেছে ওটা শিখতে গিয়ে। ওটা আকাশ থেকে টুপ্‌ করে আমার মাথার উপর পড়েনি।

যে মানুষটা আপনাকে মাত্র দশ মিনিটেই দামি একটা জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারেন, সে মানুষটার ওই দশ মিনিটের একটা দাম আছে। কিছু মানুষের সম্মিলিত দশ সপ্তাহের যা দাম, ওই মানুষটার দশ মিনিটের দাম তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এটাকে কোয়ালিটি টাইম বলে, বস! বুঝতে শিখুন।

এক স্যারের ক্লাসে দুই ঘণ্টা বসেও যা শেখা যায় না, আরেক স্যারের ক্লাসে মাত্র দুই মিনিটেও তার চেয়ে বেশি কিছু শেখা যায়। বেতন তো দুইজনকেই দিয়েছেন, তাই না? কিছু জিনিস টাকা দিয়ে শেখা যায় না। সেগুলির দাম সবচেয়ে বেশি। আপনি আমার কাছ থেকে এমন কিছু পেতে চাইছেন, যা আমার নেই। তো, আপনি সেটা আমার কাছ থেকে পাবেন কীভাবে?

এখনও মনে পড়ে, এক ফাঁকিবাজ স্যার ছিলেন। মাত্র দশ মিনিট ক্লাস নিতেন। তাও প্রতি ক্লাসে আসতেন না। তখন মনে হতো, এই ফাঁকিবাজ মানুষগুলির জন্যই দেশটা এগোচ্ছে না। এরা যে বেতন নেয়, এদের বিবেকে বাধে না? স্যার বেশিদিন আমাদের পড়াননি, স্কলারশিপ দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এরপর বুঝলাম, স্যার দশ মিনিটে আমাদের যা পড়াতেন, আর কারও পক্ষেই তা দশ ঘণ্টায়ও পড়ানো সম্ভব নয়। একজন জিনিয়াসের দশ সেকেন্ডও অমূল্য! জিনিয়াসদের কোনও বেতন হয় না। জিনিয়াসদের প্রাপ্য বেতন দেয়া সম্ভব নয়।

স্যার অ্যাভেইলেবল ছিলেন, আমরা তাঁর দাম দিতে পারিনি।

স্যার যখন আনঅ্যাভেইলেবল হয়ে গেলেন, আমরা তখন তাঁর দামটা বুঝতে পারলাম।

মানুষকে সহজেই সময় দেয়া ঠিক না, কারও কাছ থেকে সহজেই সময় পেয়ে গেলে তাকে মানুষ সস্তা ভাবে।

আমরা এদেশের মানুষ তো, তাই একটা ছাগলও আমাদের সামনে ভাব ধরে বসে থাকলে আমরা সেই ছাগলটাকে দামি মনে করি।

তবে সময় পাওয়া যায় কীকরে? এ দুনিয়ায় সম্পর্কের চাইতে দামি আর কোনও কিছুই নয়। সম্পর্কের দাবিতে মানুষ সবকিছুও দিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকে। সেখানে দশ মিনিট তো খুবই তুচ্ছ জিনিস!

আরেকটা দাবি আছে। ভাললাগার দাবি। আপনি যাঁর কাছ থেকে সময় চাইছেন, আপনাকে কিংবা আপনাকে সময় দেয়ার কারণ ও ধরনটা তাঁর ভাল লাগতে হবে।

ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না, বলদ লাগে। আর কে না জানে, বলদের দাম ছাগলের দামের চাইতে বেশিই!

ভাবনা: ছয়শো সাতষট্টি

………………………………………………………

এক। অতো ভাবিস কেন, বলতো?

টাকা পাস ওসব করে? নাকি বেশি ভাবলে একদিন বেশি বাঁচতে পারবি?

দুই। এ দেশের মেয়েরা যতদিন পর্যন্ত ‘চরিত্র’ বলতে কেবলই প্রজনন-যন্ত্রের একমুখিতাকেই বুঝবে, ততদিন পর্যন্ত এ দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না।………..আমার স্বামীর চরিত্র অনেক উন্নত। এমন দাবি করেন যাঁরা, খোঁজ নিয়ে দেখুন, উনাদের মাথায় কেবলই স্বামীর যৌনতাচর্চার বিশ্বস্ততা আর মদ্যবিমুখিতা ছাড়া আর তেমন কোনও দিক নেই। আসুন, পৃথিবীর দিকে তাকাই। ভাল চরিত্রের মানুষ। এই কথাটি দিয়ে কেবলই সেক্সুয়াল লয়ালটি, আমরা বাদে আর কেউ বোঝায় কি না, ভাববার চেষ্টা করি। ওদের কাছে, কে কার সাথে শোয়, তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় চরিত্রের অন্য দিকগুলি। আর আমরা? ক্যারেক্টারলেস বলতে বুঝি এমন কাউকে, যে ‘আমার অনুমতি ছাড়া’ নিজের কাগজের ব‌উ/জামাই বাদে অন্য কারও সাথে শুয়েছে। তাও কী……..যদি জানাজানি হয়, তবেই! আমাদের মতো কপট, ইতর, হুজুগে জাতি আসলেই কবিরাজের ফুঁয়ের চাইতে ভাল কিছু ডিজার্ভ করে না।

চাকরিসূত্রে দুইএকটি দেশ ঘোরার সুযোগ হয়েছে। সাউথ কোরিয়ায় দেখেছি, অফিসে দেরি করে আসা সম্ভব, এই ব্যাপারটিই ওই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মাথায়ই নেই। একদিন কেউ অফিসে দুই মিনিট দেরি করে আসার অর্থই হল, তাঁর চরিত্রে অধঃপতন হতে শুরু করেছে। এই ব্যাপারটিকেই ওরা মানতে পারে না, বাকি ব্যাপারগুলির কথা না-ইবা বললাম!

মামার মুখে শুনেছি, ছোটবেলায় কেউ আমাকে গান গেয়ে শোনাতে বললে, আমি হাত-পা নেড়ে অভিনয় করে গাইতাম, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে………আর আমার সন্তানকে ওর মামা গান গেয়ে শোনাতে বললে, ও হয়তো হাত-পা নেড়ে অভিনয় করে গাইবে, মেয়ে, তুই অপরাধী রে………কিংবা, ইটস অ্যা হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ লাভ লাভ………যদিও আমি এবং আমার স্ত্রী সবার চোখে ভাল চরিত্রের মানুষ হিসেবেই পরিচিত! একটা শিশু কী গান শুনছে, কী গান পছন্দ করছে, সেটি তার নৈতিক চরিত্র নির্ধারণে অনেক ভূমিকা রাখে। আমার শিশুটি বড়ো হয়েও কিন্তু একপিস ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ’ মালই হবে!

চরিত্র অনেক অনেক বিস্তৃত একটি ধারণা। ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এর মধ্যে চলে আসে। যে লোকটি অফিসে ঘুষ খায় না, কিন্তু নিজের কাজটি ঠিকভাবে না করেই বেতন নেয়, তাকে চরিত্রবান বলার কোনও কারণ দেখি না। আচরণ, কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা, মানসিকতা, সৎ সাহস, আনুগত্য, কথায় ও কাজে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ, এরকম আরও অনেক কিছু চরিত্রের মধ্যে পড়ে। একজন কপট, হুজুগে, ইতর লোক আর যা-ই হোক, চরিত্রবান কিছুতেই নয়। পারস্পরিক সম্মতিতে কেউ কারও সাথে শুলে দেশের জিডিপি কমে যাবে না, তবে কেউ যদি তার কাজটা দায়িত্ব নিয়ে ঠিকভাবে না করে, তবে দেশের জিডিপি কমে যেতেও পারে।

কিছু ‘চরিত্রবান’ লোক দেখেছি, যাঁদের কেবল অবহুগামিতা ছাড়া আর কোনও গুণই নেই। যে দেশে ভাল চরিত্রের সার্টিফিকেট পাওয়া এত সহজ, সে দেশে দুর্নীতি কমবে কীভাবে? মহানায়ক উত্তম কুমারের একটা ডায়লগ কোট করতে ইচ্ছে করছে:

মদ খেয়েখেয়ে পুরুষমানুষের লিভার খারাপ হতে পারে, কিন্তু চরিত্র? কক্খনো খারাপ হয় না।

(বন্ধুরা, বলুনতো, ডায়লগটা কোন মুভির?)

তিন। চার ধরনের মানুষ সাধারণত সৃষ্টিশীল হন না:

যাঁরা সুখী এবং অন্যকে সুখী রাখেন,

যাঁদের জীবনে কোনও অতৃপ্তি নেই,

যৌনতা যাঁদেরকে আকর্ষণ করে না,

আপনি যাঁদের বাংলা বইয়ের মতো গড়গড় করে পড়ে ফেলতে পারেন।

এর মানে এ নয় যে—

নিজে অসুখী হলে, অন্যকে অসুখী রাখলে,

জীবনে অতৃপ্তি পুষে রাখলে,

যৌনতাতাড়িত হয়ে বাঁচলে,

নিজেকে দুর্বোধ্য করে উপস্থাপন করলে—

সৃষ্টিশীল হওয়া যাবে।

গ্যাবন অতো সোজা না, বস! কিছু জিনিয়াস মানুষ স্বভাবে ও আচরণে উদ্ধত টাইপের, তাই বলে উদ্ধত হলেই জিনিয়াস হয়ে যাওয়া যাবে না! এই দুনিয়া কেবল জিনিয়াসদেরই ঔদ্ধত্য মেনে নেয়। বাকিদের ডাকে—বেয়াদব!

সৈয়দ মুজতবা আলী মদ খেতেন। এর মানে এ নয় যে, মদ খেলেই একজন মুজতবা আলী হয়ে যাওয়া যাবে। ওরকম হওয়া গেলে আমি কয়েক গ্যালন মদ খেয়ে মরে যেতেও রাজি। মুজতবা আলী পনেরোটা ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আমি নিজের ভাষাটাই ঠিকমতো জানি না, তবে কয়েক পেগ মদ দিব্যি মেরে দিতে জানি! এরপর খুশিতে নাচতেনাচতে বলি, ওই শালা মুজতবা আলীও তো মদ খেতেন!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সিগারেট ফুঁকলে ভাল গাইতে পারতেন।

ওদিকে আমজনতা সিগারেট ফুঁকলে সকালসকাল ভাল হাগতে পারে।

সিগারেট খেলেই যদি একজন হেমন্তের মতো গাওয়া যেত, তবে আমি তো এই মুহূর্তেই, দরকার হলে, গাঁজাই ধরতাম! আর গাঁজাগাছে বাগান ভরে ফেলতাম!

বাই দ্য ওয়ে, জীবনে সুখী হতে চাইলে একেবারেই সাধারণ কাউকে বিয়ে করুন। সৃষ্টিশীল কাউকে বিয়ে করে জীবনে সুখী হওয়া অনেকটাই অসম্ভব!

চার। দুই ধরনের মানুষকে কখনওই আপনার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে দেবেন না। সম্ভব হলে ওদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলুন। যদি তা করতে নাও পারেন, তবু তাদের, আপনি মলত্যাগ করার সময় কমোডে ফ্লাশ করার আগে যে মল আটকে থাকে, সেটির চাইতেও কম গুনুন।

আপনার বিপদের সময় যাঁদের পাশে পাননি, সামনেও কখনও বিপদে পড়লে পাবেন বলে মনে হয় না। সামনে পাবেন কি পাবেন না, কীকরে বুঝবেন? বোঝা যায়। নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখুন, তাঁদের আচরণ ও কাজ একটু বিশ্লেষণ করে দেখুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের কাজ হল, আপনি বিপদে পড়ার পর আপনার সে বিপদে পড়াটা উচিত কি উচিত না, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে বসা। আমি তাঁদেরকেও এই দলে রাখছি। আপনার বিপদের সময় যাঁরা আপনার পাশে না দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে বসেন, তাঁরা আর যা-ই হোক, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কিছুতেই নন।

আপনার কর্মসূত্রে যাঁদের কথা শুনতে আপনি বাধ্য, তাঁদের বলতে দিন। আপনার কলিগ, আপনার বস, আপনার স্টেকহোল্ডার, আপনার ক্লায়েন্ট। এবং এরকম আরও যাঁরা আছেন। কিছু লোক বাজে মন্তব্য করে মজা পায়। মজা পেতে দিন। বেচারাদের যে মজা নেয়ার ক্ষেত্র খুব সীমিত! পারলে আপনি নিজেও নিজের সম্পর্কে দুইএকটা বাজে কথা বলে ওদের সহযোগিতা করুন। আমার এক সিনিয়র সহকর্মীর একটা কথা আমার খুব মনে থাকে। উনি বলেছিলেন, আরে মিয়া, আমি যদি এখন চাকরি ছাইড়া দিই কিংবা তুমি যদি এখন চাকরি ছাইড়া দাও, তাইলে আমারে তোমার স্যার বলার দরকারটাই-বা কী? তখন তো আমারে তুমি ভাই ডাকবা! নাম ধইরা তুইতোকারি করলেও আমার কিছুই করার নাই। তবে এর আগ পর্যন্ত আই উড লাইক টু এনজয় দ্যাট প্রিভিলেজ!

বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের সাথে একটা জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কথা সেরে নিতে চাই। এটা নিয়ে না ভাবলে পৃথিবীতে প্রলয় শুরু হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। দেখলাম, মিথিলা শাহরুখ খানের সাথে ছবি তুলেছে। খুবই কষ্ট পেলাম। আমি কম কীসে, ভাই? আমার সাথে মিথিলা ছবি তুলে নাই কেন? কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মিথিলা এমন একটা বাজে কাজ করতে পারল? এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর কিনা আমিই জানি না!! কীভাবে সম্ভব? এর জবাব চাই, দিতে হবে! জাতীয় ফইন্নির পুত ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে মিথিলার এমন অবৈধ, অনৈতিক, স্বেচ্ছাচারী, অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি! প্রয়োজন হলে ফেসবুকে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেবো, তবু মিথিলাকে আমি বাদে আর কারও সাথে ছবি তুলতে দেবো না, দেবো না, দেবো না!!!

হায়, জন্মসূত্রে আমরা এতটাই অসহায় যে মানুষের ইতরামি সহ্য করাটা আমাদের দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে!

ভাবনা: ছয়শো আটষট্টি

………………………………………………………

এক। মেধাবী ও জিনিয়াস ধরনের মানুষরা সাধারণত চরিত্রহীন হন। আর যাঁরা এই দুই দলের বাইরে, তাঁরা সবসময়ই হন একেকটা চরিত্রের ডিব্বা।

দুই। যে মানুষটার মৃত্যুর পর তার জন্য কাঁদার কেউ নেই, সৃষ্টিকর্তা তাকে সহজে মরতে দেন না।

তিন। আমি কিছু লেখা লেখার জন্য বেঁচে আছি।

আমি কিছু মুভি দেখার জন্য বেঁচে আছি।

আমি কিছু গান শোনার জন্য বেঁচে আছি।

আমি কিছু বই পড়ার জন্য বেঁচে আছি।

আমি কিছু জায়গা ঘুরে দেখার জন্য বেঁচে আছি।

আমি কেন বেঁচে আছি, তা ভাবলে যে কারণগুলি চোখের সামনে চলে আসে, তার প্রত্যেকটিই ব্যক্তিগত। বেঁচে যে আছি, তা মূলত একটি অভ্যস্ততা। সে অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসা যায় না, এমন নয়। তবে বেরিয়ে আসার কথা ভাবলে ওপরের কয়েকটি বিষয় মাথায় এসে যায়। আমি এটা ভেবে দেখেছি অসংখ্যবার। আমার ওরকমই মনে হয়। হয়তো ওসবের কানাকড়িও দাম নেই, কিন্তু আমার কাছে ওসবই বেঁচেথাকার রসদ, তাই অমূল্য!

একসময় বাঁচতাম পরিবারকে সুখী করার জন্য। কাজটা করতে পারার পর দেখি, বাঁচাটা আগের চাইতে আরও কঠিন হয়ে গেছে! আপনি যাদের সুখী করতে বেঁচে আছেন, তারাই আপনাকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দেবে। তাই, কারও জন্য বেঁচে থাকা যায়, আমি এটাতে এখন আর বিশ্বাস করি না। আমি মরে গেলে সত্যিই কি কারও তেমন কিছু এসে যায়? আমার যা দেয়ার ছিল, তা তো দিয়েই দিয়েছি! এখন আমার আয়ু তো সবার জন্যই অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি! কারও মৃত্যুতে অন্যদের কী এসে যায় কী এসে যায় না, তা নিয়ে নাজিম হিকমতের চাইতে সত্যবদ্ধ উচ্চারণ আর কেউ কখনও করেননি—বিংশ শতাব্দীতে, মানুষের শোকের আয়ু বড়োজোর এক বছর।

আমি মরে গেলে পরিবারের সবাই আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী হয়তো কাঁদবে, মন খারাপ করবে। এরপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। এ পৃথিবীর নিয়ম হল, এখানে সব ঠিক হয়ে যায়। এখানে কান্না আমৃত্যু চলমান কোনও প্রক্রিয়া নয়। এখানে যে যার মতো করে বেঁচে থাকে। আরেকজন কীভাবে বেঁচে আছে, তার কীভাবে বেঁচে থাকতে ভাল লাগে, এসব নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? মানুষ খুব সহজেই ছবি হয়ে যায়। ছবি হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা বোঝা যায় না। বোঝা গেলে মানুষকে নিজের পরিবারেই অতো কষ্ট পেয়ে বাঁচতে হতো না। আমার কাছের এক বন্ধু তার বাবার সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করে ফোনটা রাখার মিনিট সাতেকের মধ্যেই তার বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। বন্ধুটি বাবার কবরে ফুল দিতে যায়। কেন যায়, আমি বুঝতে পারি না।

এই যে এত কষ্ট করে সবকিছু সহ্য করে বেঁচে আছি, শতভাগ সততা নিয়ে বলছি, ওই ব্যক্তিগত লোভগুলি না থাকলে আত্মহত্যা করতে আমারে দুই মিনিটও সময় লাগত না। আমার পরিবার কিংবা আমার সন্তানের জন্য আমি অপরিহার্য নই। মরে গেলে সন্তানের হাসিটা আর দেখতে পাব না, এটা ভেবে অনেক মন খারাপ হয়, কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হয়, সন্তানকে আমি যতোই ভালোবাসি না কেন, সেও একসময় অকৃতজ্ঞ হয়ে উঠতে পারে, মনে দুঃখ দিতে পারে। তাছাড়া আমার মৃত্যুর সাথেই তো আমার সকল অনুভূতিরও মৃত্যু হবে। তার চেয়ে ভাল, আমার যা কিছু সঞ্চয়, সবার জন্য তা কিছু রেখে হাসিমুখে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া! প্রায় ভাবিও এমন করে! আবার সেই পিছুটান! এখন বুঝি, কিছু পিছুটানই আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। পিছুটান ব্যাপারটা না থাকলে প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ রাখলেই আমরা অসংখ্য আত্মহত্যার খবর দেখতে পেতাম।

মানুষ দুঃখ পেয়ে ও দুঃখ দিয়ে বাঁচে। হতে পারে, যে দুঃখটা দিচ্ছে, সে ইচ্ছে করে দিচ্ছে না। কিন্তু দুঃখটা যে পাচ্ছে, সে তো পাচ্ছেই! চুপচাপ কষ্ট গিলে ফেলতে অনেক বেশিই কষ্ট হয়! পরিবারের সবচাইতে নিঃস্বার্থ মানুষটিই পরিবারের কাছ থেকে সবচাইতে বেশি দুঃখ পায়। সে চুপ করে থাকে বলে কেউ কখনও বুঝতেই পারে না, বেঁচে থাকতে তার কতটা কষ্ট হচ্ছে! বইয়েটইয়ে লেখা থাকে, ঘর পৃথিবীর সবচাইতে স্বস্তির জায়গা।…….ভীষণ বাজে কথা ওটা!

ভাবি, সব ছেড়েছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে কেউই আমাকে চেনে না, যেখানে গেলে নতুন করে জীবন শুরু করা যাবে। এটা স্বার্থপরতা নয়, এটা বাঁচতে চাওয়া। যে ঘরে সবাই জিততে চায়, সে ঘরে বাঁচা খুব কঠিন। ঘর কোনোভাবেই ক্ষুধা ও কাম নিবৃত্ত করার অপরিহার্য জায়গা নয়। ঘর হল এমন একটা জায়গা, যেখানে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা একে অপরের জন্য হারতে জানে, ইগোকে দূরে সরিয়ে কাছে টানতে জানে। যেখানে কথা বলার আগে একশোবার ভাবতে হয়, ভয় পেতে হয়, পাপবোধে ভুগতে হয়, সেটা আর যা-ই হোক, ঘর কিছুতেই না।

আমাকে বুঝতে হলে আমার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে থেকো না, বেঁচে থাকতেই আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। আমি মরে গেলে আমার সম্পর্কে অনেক ভালভাল কথা বলেই-বা কী হবে? আমার আর্তনাদ শুনতে পাও না বলে আমি ব্যথা পাচ্ছি না, এমন তো নয়! আমি এখনও মরে যাইনি বলেই আমার মৃত্যুটা দেখতে পাচ্ছ না। বেঁচেথাকার বড়ো ট্রাজেডি হল, যে ঘরে কেউই আমায় বুঝতে পারে না, সে ঘরেও ফিরতে হয়! আমরা বাড়িতে ফেরার সময় ভাবি, ঘরে ফিরছি! আমরা বাড়িকে ঘর ভেবে ভুল করি। আদরের ছোটো শিশুটা আধোআধো বোলে ‘বাবা বাবা’ ডাকে, আর কিছু নয়, কেবলই তা শোনার মোহে ঘরে ফেরে কত মানুষ, সে খোঁজ কে রাখে!

ভয় থেকেই হোক আর বাঁচতে চাওয়ার কারণেই হোক, আমরা মরে যেতে পারছি না বলেই পরিবার আমাদের দুর্বলতার সুযোগটা নেয়। আত্মহত্যা করতে পারছে না যে, তাকে কষ্ট দিয়ে কথাবলা সহজ, তার বেলায়, আর কখনও আঘাত না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভেঙেফেলা সহজ! আছে এমন কিছু গভীর সংবেদনশীল মানুষ, যারা কাঁদতে জানে না, সারাজীবন কেবলই হাসিমুখে কষ্ট পেতে জানে।

কাউকে কষ্ট দিয়ে বাঁচাও এক ধরনের পাপ। প্রকৃতির বিচার বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সে পাপের শাস্তি মৃত্যুর আগে পেতে হবেই হবে!

ভাবনা: ছয়শো উনসত্তর

………………………………………………………

এক। ভালোবাসাহীন অভ্যস্ততা নিয়ে ত্রিশ বছর একই ছাদের ছায়ায় থাকার চেয়ে অভ্যস্ততাহীন ভালোবাসা নিয়ে তিন বছরও একই সুখের ছায়ায় থাকা অনেক ভাল।

সুখ মানে কেবলই শুয়ে থাকা নয়।

সুখ মানে কেবলই খেয়ে বাঁচা নয়।

সুখ মানে কেবলই ঘরে ফেরা নয়।

সুখ মানে কেবলই কিনে ফেলা নয়।

সুখ মানে কেবলই আলো দেখা নয়।

সুখ মানে কেবলই হাসি দেয়া নয়।

সুখ মানে কেবলই মেনে নেয়া নয়।

সুখ মানে কেবলই ঘর বাঁধা নয়।

সুখ মানে কেবলই ঘুরে আসা নয়।

সুখ মানে কেবলই সুখী করা নয়।

এ বিষণ্ণ নগরীতে—

বিত্ত আছে, চিত্ত নেই।

গল্প আছে, প্রাণ নেই।

দায় আছে, ঠাঁই নেই।

গান আছে, সুর নেই।

ফ্রেন্ড আছে, বন্ধু নেই।

প্রেমও আছে, শুধু ভালোবাসাটাই নেই।

হে ঈশ্বর, আয়ু চাই না, বাঁচতে চাই।

দুই। যাঁরা বলেন, বর্তমান জেনারেশনের তালে পড়ে নিজেকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারছেন না, যুগটাই তো মিডিওকারদের, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, এমন এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করেন। যারা চিপ ও শ্যালো, তারা আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ওদের জীবন কাটেই আলস্যে, রাস্তায় ঘুরেফিরে, ফালতু কাজে সময় নষ্ট করে, সস্তা বিনোদনের সাহচর্যে। যারা সময়ের চেয়ে এগিয়ে, অন্যদের চেয়ে শার্প, তারা নিশ্চয়ই বাকিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মানুষ না। এই সিম্পল জিনিসটা তো বুঝতে হবে। জেনারেশন অথর্ব নয়, জেনারেশনের অনেকেই অথর্ব। এদের মধ্য থেকেই জিনিয়াসরা বেরিয়ে আসছে, আগেও এমন হয়েছে। দোষটা জেনারেশনের নয়, আপনার কিংবা আমার। Greatness is something individual, never collective………so is stupidity.

তিন। প্রতিটি মানুষের জীবনেই এমন একজন আসে, যার জন্য সে আর কখনওই অন্য কারও প্রেমে পড়তে পারে না।

চার। প্রতীক্ষাটা শেষ হবে না,

যখন তোকে চাইতে মানা।

আমার রোদে পোড়া ঘর,

তুই একলাই আমার পর।

পাঁচ। মানুষটা এখন আর ভালোবাসে না, দুঃখ নেই।

কিন্তু মানুষটা এখন আর বিশ্বাস করে না, দুঃখ সেখানেই।

আমি এমন কাউকে ভালোবাসি, যে আমায় ভালোবাসে না, এটা মেনে নেয়া যায়।

কিন্তু আমি এমন কাউকে ভালোবাসি, যে আমায় বিশ্বাসই করে না, এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন।

ছয়। ভুল মানুষকে ভালোবাসলে যতটা কষ্ট পেতে হয়, পরিস্থিতির কারণে ঠিক মানুষকে ভালোবাসতে না পারলে তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়।

সাত। আমার একটা বাজে অভ্যেস আছে। যাদের আমি খুব পছন্দ করি, তাদের কাছে কখনও যাই না, দূর থেকে দেখি। ওদের কাছে যেতে আমার কেমন জানি লাগে। এর নাম সংকোচ নয়, লজ্জা নয়, ভয় নয়। এর নাম যে কী, আমি জানি না। দূর থেকে ওদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। একসময় চোখে জল এসে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা সত্যিই অপার্থিব, খুব ভাল লাগে।

আট। ক ভালোবাসে, খ ভালোবাসা পায়।

খ অন্যায় করে, ক ক্ষমা চায়।

নয়। আমরা যতটুকু বুঝি, ততটুকু নিয়েই অভিযোগ করি। আমাদের বিচারে যা কিছু সত্যিই অভিযুক্ত হ‌ওয়ার মতো, তার বেশিরভাগ কিছুই আমাদের বোধশক্তিরও অতীত। মজার ব্যাপার, ওই অংশটুকু যারা বোঝে, সেটুকু নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। সবচাইতে ভয়ংকর শব্দমালা বিদেশি ভাষায় কিংবা মাতৃভাষায় দুর্বোধ্য স্টাইলে লেখা নিরাপদ। সস্তা, নির্বোধ, স্বল্প শিক্ষিত পাঠকদের হাত থেকে যুগেযুগে অনেকেই এ উপায়ে বেঁচে গেছেন।

বাংলাদেশে দাপ্তরিক পর্যায়ে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজির প্রচলন করা হলে জব হ্যাজার্ড অনেক কমে যেত। খেয়াল করে দেখেছি, আদালতের প্যারাওয়াইজ কমেন্টস বা অনুরূপ অনেক কনটেন্ট নিয়ে, ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ যারা, তাদের কারুর‌ই তেমন কোনো বক্তব্য নেই, কেননা ওগুলি আইনের দুর্বোধ্য মারপ্যাঁচে ইংরেজিতে লেখা। সেসব নিয়ে যা কিছু হয়, আইনবিধি মোতাবেক আদালতের ভেতরেই হয়, বাইরে নয়।

নির্বোধদের হাত থেকে আত্মরক্ষার সবচাইতে সহজ উপায় হল, নিজেকে দুর্বোধ্য ও ওদের আয়ত্তের বাইরে রাখা। যার মাত্রাজ্ঞান নেই, তার ব্যাপারে সাবধান! ফ্রেন্ড আর ফ্রেন্ডলি, এই দুইটি শব্দের দূরত্ব যারা বোঝে না, তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়াটা বিপত্তিকর হয়ে উঠতে পারে। নির্বোধরা যে তারিখ থেকে আপনাকে বন্ধু ভাবতে শুরু করবে, সে তারিখ থেকে ওদের মনে বিশ্বাস জন্মাবে: বন্ধুকে দুইএকটা চড়থাপ্পড় তো মারাই যায়!

দশ। মানুষ সত্যিকারের প্রেমে তখনই পড়ে, যখন তার কাছে ভালোবাসার মানুষটির সুখ তার নিজের সুখের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এগারো। এ পৃথিবীর বড়ো ট্র্যাজেডি:

যার উপর নির্ভর করা যায়, তার ব্যাপারে নির্ভয় হওয়া যায় না।

যার ব্যাপারে নির্ভয় হওয়া যায়, তার উপর নির্ভর করা যায় না।

নির্ভর করো, নির্ভয় হও—এই নীতিতে চলতে পারে যারা, তাদের চেয়ে সুখী মানুষ আর কে আছে?

বারো। প্রেমিকা বাপের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, এটা মেনে নেয়া যতটা কষ্টের, বউ বাপের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, এটা মনে আনাও ততধিক আনন্দের।

তেরো। পৃথিবীর আসল যুদ্ধটি তো হয় একাকিত্বের বিরুদ্ধে!

চৌদ্দ। আসুন, সাঁতার শিখি……..আমরা তো প্রায়শই স্বপ্নে ডুবে যাই!

ভাবনা: ছয়শো সত্তর

………………………………………………………

এক। আপনি কেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে সবাই হঠাৎ করেই ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গেছেন? আপনার এমন সারল্য আত্মঘাতী প্রমাণিত হতে পারে।

মানুষ ততক্ষণ পর্যন্তই ভিন্নমতকে মেনে নিতে তৈরি থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই ভিন্নমতটি এমন কারো কাছ থেকে আসছে না যাকে সে অপছন্দ করে। এখানে মতের চেয়ে মতধারী বেশি আমলযোগ্য। তবে সেই ভিন্নমত যদি তার স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তখন‌ কিন্তু সে আর চুপ করে বসে থাকবে না।

আরো মজার ব্যাপার আছে। যদি কোনোভাবে কায়দা করে কারো ব্রেইনওয়াশ করিয়ে দেয়া হয় যে ভিন্নমতটি কিছুতেই সহ্য করার মতো নয়, অত‌এব, তা প্রতিহত করতে হবে, তখন আর তার মধ্যে সহনশীলতা দেখবেন না। এমন-কী, নানাভাবে চাপ প্রয়োগেও ভিন্নমতের প্রতি বেপরোয়াভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে বাধ্য করা হয়। প্রায়ই এমন অসহিষ্ণু আচরণ হয়ে থাকে দলগত। আফসোস, এক্ষেত্রে মত নয়, বরং ব্যক্তিই আহত হন। নির্বোধরা মতকে খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়ে মতধারীকে আক্রমণ করে বসে, কেননা ওটাই সহজ। মগজের দৌড় যেখানে শেষ, সেখান থেকেই পেশির দৌড় শুরু হয়।

ভিন্ন যে মতটি, সেটির বিরোধিতা করাই যদি হয় হালের ফ্যাশন, তখন‌ও মত ও মতধারীর প্রতি চরম বৈরিতা দেখা গেছে। মানুষ কারো প্রতি ঈর্ষাতাড়িত হয়েও তার যেকোনো মতকে ঘৃণার্হ ভিন্নমত হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করে ফেলতে পারে। ফলে সে লোকটিকে ঘৃণ্য হিসেবে প্রচার করা সহজ হয়, তাকে সকল প্রকারের আঘাত করাটা নাগরিক অধিকারের পর্যায়ে চলে যায়। কাউকে ভালোবাসার চাইতে ঘৃণা করা অনেক সোজা, এমন-কী নিরাপদ‌ও, কারণ ভালোবাসলে সবাই সন্দেহের চোখে দেখে, ঘৃণা করলে সবাই সহজেই মেনে নেয়।

নিষ্ঠুরতাই যে সময়ের রীতি, সে সময়ে দয়ালু লোকদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হয়! যে মতের বিরুদ্ধে বিশাল একটা গোষ্ঠী অবস্থান নিয়েছে এবং সুকৌশলে সেটিকে ভ্রান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, সে মতটাকে সবাই ভুল বলেই ধরে নেয়, কেননা স্রোতের অনুকূলে চলাই নিরাপদ ও জনপ্রিয়।

ব্রান্ডিং খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, ছেঁড়া শার্টপ্যান্টও ব্রান্ডিংয়ের বদৌলতে লোকের আদরকদর পায়। যদিও দিনের শেষে, ছেঁড়া ছেঁড়াই, তবুও সারাদিন ধরে ছেঁড়ার দৌরাত্ম্যই সহ্য করতে হয়। গাধাদের রাজ্যে সিংহকে হত্যা করাটা গাধারা জায়েজ করে নেয়।

এটাও দেখছি, মত যা-ই হোক না কেন, মতধারী ব্যক্তির ক্ষমতা ও অবস্থান মতের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়, এতে করে অগ্রহণীয় মতামতও লোকে ভয়ে কিংবা নেহায়েতই পেটের দায়ে চুপচাপ গ্রহণ করে ফেলে।

আরেকটা শ্রেণী ইদানিং পয়দা হয়েছে, যে শ্রেণীর নাম দেয়া যায় ‘সহমত, ভাই’ শ্রেণী। তারা যেকোনো মতকেই সমর্থন করে ফেলতে পারে অবলীলায়, এবং ওই মতের বিরুদ্ধমতের বেলায়‌ও সেই শ্রেণী অনিবার্যভাবেই—সহমত! এদের আপন ভাবাটা বোকামি, কেননা এরা সবার‌ই আপনজন। যে মানুষ সবার‌ই, সে মানুষ আসলে একমাত্র তার নিজের, আর কারুর‌ই নয়।

কী বলা হল, সেটা বিবেচ্য নয়, বরং কথাটাকে অবিকৃত কিংবা বিকৃত উপায়ে কতটা ফলাও করে সবার সামনে নিয়ে আসা হল, সেটাই বিবেচ্য। এখানে ঘটনার চাইতে ঘটনার প্রচার অধিক মনোযোগ পায়। ফলে, কেউ খুন করেও পার পেয়ে যায়, আর খুন করার ইচ্ছে পোষণ করার অনুমানেও কাউকে ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ ফাঁসি দেয়া হয়। এমন বৈধ নির্মমতা যেখানে রেওয়াজ এবং আপনি আমি সে রেওয়াজের‌ই প্রশ্রয় ও মদদ-দাতা, সেখানে ন্যায়বিচার আশা করাটা নিঃসন্দেহে স্ববিরোধিতা।

অভিজ্ঞতা এও বলে, ঝামেলা এড়াতে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে, দীর্ঘকাল ধরে কোনো অবিচল বিশ্বাস বা ধারণা লালন করে, মতের ও ব্যক্তির বাহ্যিক প্রদর্শনে প্রভাবিত হয়ে, কখনোবা আর কিছু নয়—কোনো যুক্তিতর্কের ধারেকাছেও না গিয়ে স্রেফ মন চাইছে বলেই মানুষ কোনো মতকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে পারে।

যারা মুখে ফটফট করে বলে, নাথিং ইজ পার্সোনাল, তাদের কাছেই, এভ্রিথিং ইজ পার্সোনাল, সবচাইতে বেশি। তাদের টার্গেট বক্তব্য নয়, বক্তা। সময় এলেই ওদের মুখোশ সরে গিয়ে মুখটা বেরিয়ে পড়ে। দ্বিচারিতা বা কপটতা আমাদের রক্তের মধ্যেই মিশে গেছে।

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আপনি আমি এমন একটা সমাজে বাস করছি, যেখানে মানুষের চেহারা চোখের পলক পড়ার আগেই বদলে যায়, যেখানে শয়তানরা অবিশ্বাস্য রকমের ভাল সেজে আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, যেখানে লোকে মুখোশের আদলে মুখ তৈরি করে নেয়।

এখানে—

মূর্খদের বিভ্রান্ত করা সহজ, কেননা মূর্খরা বিশ্লেষণ করতে পারে না।

অমূর্খদের বিভ্রান্ত করা আরো সহজ, কেননা অমূর্খরা বিশ্লেষণ করতে চায় না।

আর বাকিদের‌ তো বিভ্রান্ত করতেই হয় না, কেননা প্রথম দুই শ্রেণীর মানুষকে বিভ্রান্ত হতে দেখে ওরা নিজ দায়িত্বেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

…………..আর কে না জানে, বিভ্রান্ত মানুষমাত্রই অন্ধের মতো হুজুগে, কল্পনার বাইরে কৃতঘ্ন, পশুর চাইতে হিংস্র!

এ দুর্ভাগা দেশে মানুষকে বিশ্বাস করার চাইতে বড়ো পাপ আর কেউ করে না।

দুই। আগে ভাবতাম, অন্যদের সাথে তেমন ব্যবহার করা উচিত, যেমন ব্যবহার আমরা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। এখন বুঝি, অন্যদের সাথে তেমন ব্যবহারই করা উচিত, তারা যেমন ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য। কেন? কারণ, সবাইই ভাল ব্যবহার ডিজার্ভ করে না। অনেকেই আছেন, ভাল ব্যবহার যাঁদের সহ্য‌ই হয় না, বদহজম হয়ে যায়। বলতে পারেন, অতো ভেবে কী হবে? নেয়ার চাইতে দেয়াই তো ভাল! আমার তো মনে হয়, দেয়ানেয়াই সবচাইতে ভাল। এতে উভয়েরই মন ভাল থাকে, সম্মান বজায় থাকে।

তিন। লোকটার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল, সে একটা হলেও ভাল কবিতা লিখবে। চেষ্টাও করেছে। হয়নি। লোকটা কবিতা লিখত, নিজেই পড়ত, আর ছিঁড়ত। কিছু জিনিস চেষ্টাতে হয় না, ভেতর থেকে বেরোতে হয়। লোকটার চেষ্টায় কোনো ফাঁকি ছিল না, তবু হয়নি। সে ক্ষুব্ধ হল, ক্রুদ্ধ হল। কবির ক্রোধ কবিকে কবি করে, অকবির ক্রোধ অকবিকে করে খুনি। অগত্যা সে কবিকে খুন করে তার স্বপ্নটা পূরণ করে ফেলল। খুনটা করবার সময় সে প্রথমেই কবির আঙুলগুলো কেটে ফেলেছিল, যেন আঙুল থেকেই কবিতা আসত! ঈশ্বর সেই মুহূর্তে হেসে বলেছিলেন, হে নির্বোধ, ওই পাঁচটি আঙুল তো আমি তোমাকেও দিয়েছিলাম! বিশ্বাস করুন, লোকটা খুন করতে চায়নি, সে শুধুই কবি হতে চেয়েছিল। কবিত্ব পায়নি বলেই সে খুন করার অধিকার পেয়েছে। আহা, যদি কবিকে খুন করলেই কবি হ‌ওয়া যেত, তবে পৃথিবীর সব কবিই হতেন খুনির হাতে নিহত! খুনিরা খুনিই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত, কখনোই কবি হয়ে ওঠে না। এইটুকু বুঝতে পারলে একজন খুনিও হতে পারত কবি।

কবি চলে গেলেও কবিতা থেকে যায়। কবিদের কখনো খুন করা যায় না। লোকটা চোখের সামনে কবিকে সহ্য করতে পারেনি। এখন তাকে কবির পাঠকদের সহ্য করতে হচ্ছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কবি মরে গেলে কবিতার পাঠক বেড়ে যায়। লোকটা কবি হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, আফসোস, সে এখন পাঠক হয়েও বাঁচতে পারছে না! কবিতা হারিয়ে লোকটা বুঝতে পেরেছে, সে আসলে কবিকে ঘৃণা করত না, সে শুধুই কবিতা ভালোবাসত। সে ভালোবেসে খুন করেছে। সবাইকেই কবি হয়েই বাঁচতে হবে কেন? কিছু মানুষ কবিতা ভালোবেসেও তো বেঁচে থাকে!—সে ভাবে, হায়, এমন করে আগে যদি ভাবতাম!

ভাবনা: ছয়শো একাত্তর

………………………………………………………

এক। আজ—

অবসরপ্রাপ্ত খুনিরাও খুনের বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত নির্যাতকরাও নির্যাতনের বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত চোররাও চুরির বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত ডাকাতরাও ডাকাতির বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত ধর্ষকরাও ধর্ষণের বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত ভণ্ডরাও ভণ্ডামির বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত মাতালরাও মাতলামির বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত গুণ্ডারাও গুণ্ডামির বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত ঘুমন্তরাও ঘুমের বিচার চায়।

অবসরপ্রাপ্ত র্যাগাররাও র্যাগিং-এর বিচার চায়।‍

এমন বিচার ততক্ষণই ভাল জিনিস—যতক্ষণ তা নিজের বেলায় হচ্ছে না।

সত্যিই চায়? চায় হয়তো! চাওয়াটা পূরণ না হলে? আরও ভাল। নতুন ইস্যুতে সরব হওয়া যাবে। চেতনাচাষিদেরই তো জয়জয়কার! হায়, অচেতনেরই চেতনা বেশি!

শ্রদ্ধেয় প্রতুল মুখোপাধ্যায় আজকের দিনে গাইলে হয়তো গাইতেন:

“আমি চেতনায় গান গাই, আমি চেতনার গান গাই,

আমি আমার আমিকে চিরদিন এই চেতনায় খুঁজে পাই।

আমি চেতনায় দেখি স্বপ্ন, আমি চেতনায় বাঁধি সুর,

আমি এই চেতনার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর।

চেতনা আমার জীবনানন্দ, চেতনা প্রাণের সুখ,

আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি চেতনার মুখ॥

আমি চেতনায় কথা কই, আমি চেতনার কথা কই,

আমি চেতনায় ভাসি, চেতনায় হাসি, চেতনায় জেগে রই।

আমি চেতনায় মাতি উল্লাসে, করি চেতনায় হাহাকার,

আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে করি চেতনায় চিৎকার।

চেতনা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীরধনুক,

আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি চেতনার মুখ॥

আমি চেতনায় ভালোবাসি, আমি চেতনাকে ভালোবাসি,

আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি।

আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়,

মিশে তেরো নদী, সাতসাগরের জল গঙ্গায়-পদ্মায়।

চেতনা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক,

আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি চেতনার মুখ॥”

আজ, কাল, পরশু—

ঢালাওভাবে ডাক্তারদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে ব্রতী ছেলেটিকেও একসময় বলতে হয়,

স্যার, বাড়ি আছেন? মা খুব অসুস্থ, আমার সাথে একটু…….

ঢালাওভাবে পুলিশদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে ব্রতী ছেলেটিকেও একসময় বলতে হয়,

স্যার, এইবারের মতো আমাকে বাঁচিয়ে দিন। আর কখনো……..

ঢালাওভাবে উকিলদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে ব্রতী ছেলেটিকেও একসময় বলতে হয়,

স্যার, মামলাটাতে আমাকে জিততেই হবে। টাকা নাহয়……….

ঢালাওভাবে পুঁজিবাদীদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে ব্রতী ছেলেটিকেও একসময় বলতে হয়,

স্যার, আমাকে আমেরিকার ভিসাটা দিন। অনেকদিনের স্বপ্ন………

ঢালাওভাবে বিসিএস-এর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারে ব্রতী ছেলেটিকেও একসময় বলতে হয়,

স্যার, চাকরিটা আমার খুব প্রয়োজন। ক্যাডার হওয়াই এ জীবনের………

ইতর! কপট! অথর্ব! দ্বিচারী! নিষ্ঠুর!

“আমাদের বাঙ্গালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবেনা, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন,সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙ্গালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয়না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।”

― শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী

আমার সবচাইতে প্রিয় কথাগুলির একটি। বাঙালিদের নিয়ে এর চাইতে ভাল বিশ্লেষণ আমি আর কোথাও পাইনি।

দুই। আমিও সত্যিসত্যিই বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম যে বাংলাদেশের কোনো ভার্সিটিতেই র্যাগিং হয় না। আসলেই কি হয় র্যাগিং? আপনাদের কী মনে হয়? কেন মনে হয়? আপনাদের কী মনে হয়েছিল? কেন মনে হয়েছিল? আপনাদের কী মনে হবে? কেন মনে হবে?

যা-ই হোক, আসুন, আমরা ভুলকে ভুল এবং ঠিককে ঠিক বলতে শিখি। যাকে পছন্দ করি না, সে ভুল করলেও ভুল, ঠিক করলেও ভুল; যাকে পছন্দ করি, সে ঠিক করলেও ঠিক, ভুল করলেও ঠিক—এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসি। দশজন মিলে একটা ভুলকে ঠিক বললেই সেটা ঠিক হয়ে যায় না। আবার দশজন মিলে একটা ঠিককে ভুল বললেই সেটা ভুল হয়ে যায় না। এটা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্বতা প্রয়োজন। এইটুকু বুঝতে না পারলে আমরা কীসের মানুষ? মানবিক হোন, দয়ালু হোন। দেখবেন, বাঁচতে আগের চাইতে ভাল লাগছে। আমাদের এ পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে পাঠানো হয়েছে নিষ্ঠুর হয়ে জীবন নষ্ট করার জন্য নয়।

আরেকটা কথা। সেলিব্রিটিদের কথায় নাচবেন না। নিজের ব্রেইন ইউজ করা প্র্যাকটিস করুন। দুঃখজনক হলেও সত্য, উনাদের অনেকেই ধান্দাবাজ, ইতর, ভণ্ড প্রকৃতির। কেউকেউ আছেন পেইড ব্লগার। তাঁরা সত্যটা বলবেন কিংবা নিজেই যা বিশ্বাস করেন না, তা বলবেন না, এমনটা আশা করেন কেন? উনাদের ফেসবুকে দেখলে বুঝবেন না, কাছ থেকে দেখলে বুঝবেন। অনেকের আসল চেহারা দেখে ফেলেছি তো, তাই উনাদের দেখলে ঘেন্না লাগে! শুধু দুই রকমের নয়, হাজারো রকমের মুখের মানুষ আছেন।

ফেসবুকে কে কী লিখল, কে কী লিখল না, দুটোকেই সহজভাবে নিতে শিখুন, অনেক দিকেই লাভ হবে। কেউ নিজের ওয়ালে কিংবা আপনার ওয়ালে কিছু লিখলেই প্রলয় শুরু হয়ে যায় না। বিশ্বাস করুন, পৃথিবী অতো সহজ জিনিস নয় যে একটা ঠুনকো ফেসবুক স্ট্যাটাসেই রসাতলে চলে যাবে! আসুন, আমরা সহনশীল হতে শিখি। আক্রমণ করতেই হলে কথাকে আক্রমণ করি, বক্তাকে নয়। কথার জবাব কথা দিয়ে দিই, বাহু দিয়ে নয়। অভিজ্ঞতা শিক্ষা দেয়: যার ঘিলু যতো কম, তার হাত চলে ততো বেশি।

সাবধানে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। মাথায় রাখবেন, আপনার বিপদ কেবলই আপনার এবং আপনার পরিবারের বিপদ। এতে আর কারুরই কিচ্ছু এসে যায় না। কারো উস্কানিতেই প্রভাবিত হবেন না, আপনি বিপদে পড়লে ওদের কেউ আপনাকে বিন্দুমাত্রও সাহায্য করতে পারবেন না কিংবা পারলেও করবেন না। আপনি কী করবেন, কী করবেন না, সেটা নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করুন। আশেপাশে যাঁদের দেখছেন, তাঁদের বেশিরভাগই আপনার বিপদকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার লোক। বিপদে পড়ার আগ পর্যন্ত এটা বুঝবেন না। আমার খুব প্রিয় সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানটার প্রথম দুই লাইন শেয়ার করছি, একটি শব্দ বদলে দিয়ে…………

অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোন দাবিদাওয়া,

এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু বাঁচতেই চাওয়া।

ভাবনা: ছয়শো বাহাত্তর

………………………………………………………

অন্যায় হতে দেখলে আপনি কী করেন?

কী আবার! ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, স্ট্যাটাস পড়ি।

আর যদি সে অন্যায়টা আপনার প্রতি হয়, তাহলে?

ওইতো………..ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, স্ট্যাটাস পড়ি।

এইটুকুই………..ব্যস্‌?

আপনি কী বলতে চাইছেন? অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। অন্যায় দেখেও যারা স্ট্যাটাস দেয় না, আমি ওদের মুখে থুতু দিই!

শুধুই প্রতিবাদ? এরপর……..?

এরপরেরটা আমার কাজ না। আমি কাজে বিশ্বাসী, অকাজে না।

না, মানে কেবল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেই আপনার দায়িত্ব শেষ?

তা হবে কেন? প্রয়োজন হলে প্রতিবাদী ইভেন্ট খুলি, সবাইকে সোচ্চার করি। ফেসবুকে মানববন্ধন করি, ফেসবুকে আলোচনাসভা হয়। আরও স্ট্যাটাস দিই, স্ট্যাটাস শেয়ার করি, কমেন্ট করি। আমি ভাই চুপ করে বসেথাকার মানুষ না, আমি কাজের মানুষ।

আপনার মাথায় এমন আজব দায়িত্ববোধ তৈরি হল কীভাবে?

মানে? কী বলতে চান আপনি? আমি পোস্ট করলে কতজন পড়ে, জানেন? কতজন আমার স্ট্যাটাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ট্যাটাস দেয়, জানেন? আপনার কোনো ধারণা আছে ফেসবুকে আমার ফলোয়ার কত?

নেই, ভাই। ফলোয়ার দিয়ে কী হয়? পয়সা পান?

সবাই আমার প্রতিবাদী পোস্ট দেখে, লাইক দেয়, কমেন্ট করে, শেয়ার করে। সবাই সচেতন, জাগ্রত। ফেসবুকে কেউ তো আর বসে নেই, ভাই! দুনিয়ায় পয়সাই কি সবকিছু? আত্মতৃপ্তির কোনো দাম নেই?

বাহ্‌, বেশ ভাল! তো জনাব, সব ইস্যু নিয়েই প্রতিবাদ করেন?

করি, তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। মানে, ডিপেন্ডস……..আরকি!

কীরকম?

দেখুন, অন্যায়টা যার সাথে হচ্ছে, সে যদি আমার পছন্দের তালিকায় না থাকে, তবে সেটা কোনো অন্যায়ই নয়। সে তার কৃতকর্মের শাস্তি পাচ্ছে। তখন তা নিয়ে প্রতিবাদ করার তো কিছু নেই। আমি চাই, সে আরও গর্তে পড়ে যাক। আবার ধরুন, যদি এমন কিছু ঘটে, যেটা নিয়ে লিখলে পাবলিক খাবে না, উল্টো আমার ফলোয়ার কমে যেতে পারে, তবে সেটা নিয়ে লেখার তো কোনো মানে নেই, তাই না?

যদি সেটা কখনো আপনার সাথেই হয়, তখন?

আমি প্রতিবাদ করবো, আমাকে যারা পছন্দ করেন, তাঁরাও প্রতিবাদ করবেন। আমিও স্ট্যাটাস দেবো, তাঁরাও স্ট্যাটাস দেবেন। কেউ চুপ করে বসে থাকবে না। আজকাল কেউ চুপ করে বসে থাকে না।

সবকিছু ফেসবুকেই?

তো? আর কোথায়? খেপেছেন, ভাই?

ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখে আদৌ কিছু হয়? ফেসবুকের বাইরেই তো সমস্যার প্রকৃত সমাধান। সেখানে কে যাবে?

অবশ্যই হয়। মুখবুজে বসেথাকার মানেই অন্যায়কে সমর্থন করা। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় না, আমি তাদের ঘৃণা করি! আর ফেসবুকের বাইরে কেন যাবো? সেখানে কতজনই-বা মানুষ? সবাই তো ফেসবুকেই! আসল কথা, ফেসবুকের বাইরে আমাদের রাস্তার কুত্তাও তো গোনে না! (কিছু মনে করবেন না, আপনি পড়ার পর এই অংশটা আমি ডিলিট করে দেবো।)

হাহাহা……ইটস ওকে। তার মানে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যাঁরা স্ট্যাটাস দেন না, তাঁরা সবাইই অন্যায়কারী কিংবা অন্যায়কে প্রশ্রয়দানকারী?

নিশ্চয়ই! অন্যায় হলে কারুরই চুপ করে বসে থাকা উচিত নয়, অন্তত একটা স্ট্যাটাস দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আজ যেটা অন্যের সাথে হচ্ছে, কাল তো সেটা আপনার সাথেও হতে পারে। তখন যদি কেউ অন্তত একটাও স্ট্যাটাস না দেয়, আপনার কেমন লাগবে, একবার ভাবুনতো?

অন্তত একটা……….মানে?

একাধিক হলে আরও ভাল। যতো প্রতিবাদ হয়, ততোই ভাল। সবাই দেখুক, ফেসবুকে কেউ বসে নেই। ফেসবুক বসেথাকার জায়গা নয়।

কয়টা স্ট্যাটাস দিলে প্রতিবাদ পূর্ণতা পায় বলে আপনি মনে করেন? কয়টা স্ট্যাটাস দিলে বিপদগ্রস্ত মানুষটার একটু সাহায্য হয়? কয়টা স্ট্যাটাস দিলে দুঃখী মানুষের দুঃখ কমে?

সেটা নির্ভর করে ইস্যুটা কতদিন পর্যন্ত মানুষের মনে থাকে, তার উপর। নতুন কোনো ইস্যু এলে পুরনোটা বাদ দিয়ে নতুনটাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সবাইকে খুশি করে চলতে হবে। আর বিপদগ্রস্ত মানুষটার সাহায্য করার কাজ তো আপনার আমার না, ভাই! সেটার জন্য সৃষ্টিকর্তা আছেন; তবে হ্যাঁ, আমরা উনার জন্য ফেসবুকে প্রার্থনা করতে পারি। দুঃখী মানুষের দুঃখ আপনাআপনিই কমে যাবে, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।

ও আচ্ছা! তা আপনার এই ঝাঁপাঝাঁপিতে আদতে কোনো লাভ হয় কিংবা হয়েছে কখনো?

হয় না মানে? আপনি জানেন, আমাকে কতজন ফলো করে? ওদের প্রতি, এ সমাজের প্রতি আমার তো একটা দায়িত্ব আছে, তাই না?

ভাই, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি কখনো ভয়ানক বিপদে পড়েছেন?

হ্যাঁ, পড়েছি। কেন?

তখন কী হয়েছিল?

সবাই স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এমন-কী কেউকেউ একাধিক স্ট্যাটাসও দিয়েছে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন স্ট্যাটাস দিয়েছে। স্ট্যাটাস অসংখ্যবার শেয়ার হয়েছে, লাইক-কমেন্ট পড়েছে। এরকম। আমি নীরবে সবার স্ট্যাটাস পড়েছিলাম। অনেকেই ফেসবুকে দোয়া করেছে।

স্ট্যাটাসে বিপদ কেটেছে?

বোকার মতো প্রশ্ন করবেন না। স্ট্যাটাসে বিপদ কাটে নাকি? তবে যারা স্ট্যাটাস দিয়েছে, আমার পক্ষে বা বিপক্ষে, ওদের ফলোয়ার বেড়েছে, গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কেউ বসে ছিল না, ফেসবুক অকর্মণ্যদের জায়গা নয়।

তার মানে, ওরা যা করেছে, চেতনা আর দায়িত্ববোধ থেকেই করেছে, ওতে আপনার তেমন কোনো লাভ হয়নি।

দেখুন, আমার বিপদ মানে কেবলই আমার এবং আমার পরিবারের বিপদ, আর কারুরই কিছুই না। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হয় নিজেকেই। এটাই তো স্বাভাবিক।

তখন পাশে কাউকে পেয়েছিলেন?

নিশ্চয়ই পেয়েছিলাম। অনেক মানুষ পাশে ছিলেন। সবাই আমার জন্য স্ট্যাটাস দিয়েছেন, দোয়া করেছেন। অন্যের বিপদ দেখলে স্ট্যাটাস না দিয়ে চুপ করে থাকে একমাত্র কাপুরুষরা।

না, আসলে আমি জিজ্ঞেস করছি, ফেসবুকে না, বাস্তবে আপনার পাশে কাউকেই পাননি?

পাবো না কেন? দুই-চারজন পাশে ছিল। তবে ওদের কেউই আমার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়নি। ওরা আসলে ফেসবুকে তেমন একটা অ্যাক্টিভ না।

ও আচ্ছা……তার মানে, আপনার লক্ষলক্ষ ফলোয়ারদের মধ্যে কাউকেই আপনার পাশে আক্ষরিক অর্থে পাননি?

আবার বাজে কথা বলছেন! বললামই তো, সবাই স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তুমুল প্রতিবাদ করেছেন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে! আরেকটা প্রশ্ন করি। এই যে অন্যের বিপদ দেখলে স্ট্যাটাস না দিয়ে চুপ করে থাকে যারা, তাদের দুম্‌ করে কাপুরুষ বলে দিলেন, ওরা যদি কিছু বলতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়, তখন?

আপনার কী মনে হয় আমাকে? আমি কাপুরুষ? আমি ভয় পাই কাউকে? আমার মধ্যে চেতনা নেই? কোনো অন্যায় দেখলে স্ট্যাটাস না দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ আমি? প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ যদি বিপদে পড়ে যায়, তবে তার জন্যও আমি স্ট্যাটাস দেবো, সবাইকে স্ট্যাটাস দিতে বলবো। এদেশে কোনো বিপন্ন মানুষই একা নয়, ফেসবুকে তার পাশে হাজারহাজার মানুষ আছে। অনলাইনের জামানা, ভাই। বি স্মার্ট!

আপনার বীরত্ব দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। আচ্ছা, ফেসবুকের বাইরে এসে কখনো কিছু করার চেষ্টা করেছেন?

অতো সময় কোথায়, ভাই? নতুন ইস্যু এসে যায়, আমি চুপ করে থাকতে পারি না, আমার চেতনা আমাকে চুপ করে থাকতে দেয় না। সমাজের মানুষ হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, সবাই লাইক দেয়, কমেন্ট করে, শেয়ার করে, ফলোয়ার বাড়ে, আমার ভাল লাগে। এক মিনিট…….আপনি মেবি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করছেন। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? জানেন, আমার ফলোয়ার কত? আমি একটা স্ট্যাটাস দিলে ওরা সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার জন্য! আমি চাইলে আপনার আইডিটাই খেয়ে দিতে পারি!

সরি, আমি আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারিনি। এখন পারছি। ভুল হয়ে গেছে, ভাই। কখনো সময় করে মাফ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দেবো।

যাক, এতক্ষণে লাইনে এসেছেন। দেখুন, আমার বিপদের সময় যা হয়েছিল, অন্যের বিপদের সময়ও তা-ই হবে। এটাই নিয়ম, এটাই কালচার। আমাদের সবারই দায়িত্ব একটাই—ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া। সবার মধ্যে চেতনার আগুন লাগিয়ে দিতে হবে, যাতে সবাইই স্ট্যাটাস দেয়।

আপনার কথাই ঠিক। আমাদের সবাইকে বেশিবেশি স্ট্যাটাস দিতে হবে। ভেতরের চেতনাকে ফেসবুকে নিয়ে আসতে হবে। সবার চেতনাকে এক করে পরবর্তী ইস্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। স্ট্যাটাসের জয় হোক, মানবতার জয় হোক। আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি চাইলে আমাদের এই কথোপকথনের স্ক্রিনশটটার নির্বাচিত কিছু অংশ আপনাকে ট্যাগ করে আমার ওয়াল থেকে শেয়ার করতে পারি। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, আমি আমার কিছু ফলোয়ার আপনাকে উপহার দিতে চাই।

ওয়াও! ভালই হবে। ফ্রিতে কিছু ফলোয়ার পেয়ে যাবো! ফলোয়ার না থাকলে এ জীবনের কী-ইবা দাম আছে? আপনি আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। আমাদের সবারই উচিত ফেসবুকে চেতনা ছড়িয়ে দেয়া।

সেটাই, ভাই! চেতনা ছাড়া মানুষ কীকরে বাঁচে? বাই দ্য ওয়ে, ইচ্ছে করলে আমাকে ট্যাগ করে কিছু লিখতে পারেন। আমি সেখানে খুব দামি কিছু কথা লিখে কমেন্ট করবো। পাবলিক খাবে। দেখবেন, আমার কমেন্টেও কত লাইক পড়ে!

আপনি না বললেও লিখতাম, ভাই। আজ থেকে চেতনা খেয়ে ও চেতনা বেচে বাঁচবো। এটাই সোজা, এটাই মজা! অসহায়, হুজুগে ও ভণ্ড মানুষের ফেসবুকে ভালভাবে বাঁচার এটাই উত্তম পথ।

আপনি কিন্তু আবারো বেলাইনে চলে যাচ্ছেন, মিয়াভাই! হককথা বলা বাদ দেন, পপুলার কথা বলেন, নিরাপদে থাকেন। লাইনে আসেন, নিজে চেতনা সেবন করেন, সবাইকে চেতনা সেবন করান। সবসময়ই নতুন নতুন ইস্যু আসতেই থাকবে। আগের ইস্যু মানুষ ভুলে যাবে, মানুষ ভুলে যায়। গান শোনেন নাই, পুরাতন শেষ হয়ে নতুন জন্ম নেবে, এ-ই তো জগতের রীতি………আপনি আমি কেউই তো আর জগতের রীতির বাইরে না, তাই না?

সহমত, ভাই। ভাল থাইকেন।

আপনিও, ভাই।