পৃথিবীতে সচরাচর দুই শ্রেণীর লোক দেখা যায়—এক শ্রেণীর লোক অবারিতভাবে দান করছে; আর-এক শ্রেণীর লোক ভিক্ষা করে ফিরছে। যাঁদের ধনসম্পত্তি আছে, তাঁরাই দিচ্ছেন; আর যাদের কল্পিত বা প্রকৃত সম্পত্তির অভাব, তারাই প্রত্যাশী হয়ে সেই দান গ্রহণ করছে। দাতারা দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত; গ্রহীতারা পেয়ে পেয়ে বাসনার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে, আরও…আরও পাবার আশায় মাতছে। দাতারা কী ভাবছেন, গ্রহীতারাই-বা কী করছে, তা একবার ভাবা যাক।
মৌমাছি যেভাবে মধুচক্রকে সারাক্ষণই একাগ্রচিত্তে ঘিরে থাকে, গ্রহীতারা দাতাদেরকে, তেমনি করে, সারাক্ষণই আবেষ্টন করে থাকে। বেপরোয়া ভিখারির ভয়ে, এই পৃথিবীর অনেক ধনী লোক হাতকে চিরকালের জন্য বিশ্রাম দিয়েছেন; দরোজায় অনাহারে লোক মরলেও অনেক ধনী সে-দিকে ভ্রূক্ষেপও করেন না! কেননা, তাঁরা জানেন, যাঁরা একবার হাত বাড়িয়েছেন, এ জীবনে আর তাঁদের হাত গোটানোর সম্ভাবনা নেই; বিষয়সম্পত্তি সমস্ত কিছু নিলামের ঘরে সমর্পণ করেও তাঁরা নিষ্কৃতি পাননি। তাঁরা জানেন, অযথা দানে পুণ্যের পরিবর্তে বৃথাই মানুষকে অলস করা হয়, অথচ ভিখারির পরনির্ভরশীল মনোবাঞ্ছা কখনও পূর্ণ হয় না। এ যেন পরনির্ভরশীলতার এক দুষ্টচক্র!
ধনস্পৃহা কখনও মানুষের কমে না। দশ পেলে শত, শত পেলে হাজার, হাজার পেলে লাখ পেতে মানুষের সাধ হয়। কেবল তা-ই নয়। এক জনকে দশ পেতে দেখলে অপর ভিখারির শত পাবার বাসনা হয়। না পেলে, দাতার চৌদ্দপুরুষের গুষ্টি উদ্ধার করে তবেই সে ক্ষান্ত হয়। এক জনকে তৃপ্ত করো, দশ জন এসে হাজির হবে; দশ জনকে তৃপ্ত করো, শত; শতকে করো, হাজার ভিখারি তোমার দ্বারস্থ হবে। এভাবে এ দেশে কোটি কোটি ভিখারির উদ্ভব হয়েছে। বিনা ক্লেশে দিন কাটানোর জন্য এর চেয়ে সহজ উপায় আর নেই!
তুমি যত বড়ো ধনীই হও না কেন, কতদিন তুমি এমন ভিখারির অভাব দূর করতে পারবে, বলো তো? চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু তার পরিণাম কী? যাকে দশ দিয়েছ, সে বলছে, শত দিলে না কেন? যাকে শত দিয়েছ, সে আক্ষেপ করে রটনা করছে, হাজার দিল না কেন? দিয়ে তো তুমি কেবল অপযশই কিনছ কিংবা দিয়ে দিয়ে কেবল মানুষকে অলস করছ; পৃথিবীর এতে কোনো লাভ নেই। মানুষের শক্তি এভাবে নিঃশেষ করে তুমি মানুষহত্যার পাপে পাপী হচ্ছ।—কৃপণ ধনীরা এ ধরনের কথাবার্তা বলেন। এইসব কথার মধ্যে যে সত্যতা নেই, তা নয়; কিন্তু কোনো কোনো হৃদয়বান ধনী, ভাবোচ্ছাসে, অন্যের অভাব দেখে স্থির থাকতে পারেন না—দেবার প্রবৃত্তিতে ওঁরা যেন মাতোয়ারা! পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দেবার জন্য যেমন উল্লসিত, তাঁরাও অন্যের বাসনার আগুনে ঝাঁপ দিতে তেমনই লালায়িত—এই আগুনে পড়ছেন, কিন্তু চক্ষুলজ্জাবশত আর উঠতে পারছেন না; কার প্রকৃত অভাব, শেষমেশ তা-ও ঠিক করতে পারছেন না; কাজেই অবিচারিতভাবে নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে, অবশেষে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েও যেন নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। দেশের এ বড়ো শোচনীয় অবস্থা!
একজন সদাশয় ধনীর কথা জানি। তিনি যেন দান করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কথাও জানি। যাঁদেরকে জানি, তাঁদের প্রায় সকলেই তাঁর কাছ থেকে কিছু আদায়ের চেষ্টায় আছেন। এতদিন তিনি যাঁদেরকে বন্ধু মনে করতেন, এখন তাঁদের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে বেশ অবাক হয়েছেন। একদিন দুঃখ করে তাই বলছিলেন, "এখন লোক দেখলেই ভয় হয়; মনে হয়, এ-ও বুঝি কিছু চাইতে আসছে। দিনরাত, যে-ব্যক্তিই কাছে আসে, সে-ই কিছু চায়। তারপর? হায়, কৃতজ্ঞতা তো দূরের কথা, একটু নিঃস্বার্থ আন্তরিকতাও কেউ দেয় না—ওদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষতিও করে। দিয়ে দিয়ে এখন ক্লান্ত হয়েছি, আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। কিছু দিনের জন্য দান বরং বন্ধ করি!"
যে-দিন তিনি এমন বললেন, তার পরদিনই শুনলাম, তিনি আবার কাকে কাকে যেন বহু টাকা দিয়েছেন। আমার এই বন্ধুটি যতজনের উপকার করেছেন, যতজনকে সাহায্য করেছেন—তিনি আর-একদিন আক্ষেপ করে বলছিলেন—ওদের অনেকেই তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা এবং তাঁর সম্পর্কে আজেবাজে কথা প্রচার করছে। সত্যি বলতে কী, আমরাও তাঁর প্রশংসা তেমন একটা কারও কাছে শুনিনি। পেয়ে পেয়ে, সকলেই তাঁর কাছ হতে আরও আদায়ের জন্য লোভী হয়ে উঠেছে। আত্মমর্যাদাবোধ ব্যাপারটা এখন এত নিচে নেমে গেছে যে, ভিক্ষা করাটা এক শ্রেণীর লোকের স্বভাবই হয়ে গেছে। বিভিন্ন কৌশলে তাঁর সব কিছু অপহরণ করে তবেই যেন গ্রহীতাদের ব্রত শেষ হবে। দিনদিনই এজন্য লোকের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে, দিনদিনই তাঁর দরোজায় ভিক্ষুকের হাতের সংখ্যা বাড়ছে। চক্ষুলজ্জায় বা ভাবের দায়ে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে অকুল দানসাগরে যেন ভাসছেন!
আমরা এমন একজন গ্রহীতাকেও জানি, যিনি সার্বভৌমিক উদার ধর্মপ্রচারে ব্রতী। তিনি প্রেমিকও বটে! তাঁর ধারণা ও বিশ্বাস—এই জগৎ তাঁকে সাহায্য করতে বাধ্য। ধনী লোকদের ঘরের অতুল ধনরাশি যেন তাঁর ধর্মপ্রচারে সাহায্যের জন্যই। তিনি পেয়েছেনও অনেক, কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান লোক, তাঁকে সোজাসুজি অন্য পথ দেখিয়ে দিয়ে কেবল অনুরোধ-পত্রে, দয়ার ভার অন্যের হাতে দিয়ে, বিদায় করে দিয়েছেন বলে তিনি ইদানীং খুব বিরক্ত হয়েছেন। একদিন আক্ষেপ করে তাই বলছিলেন, "লোকগুলো অধঃপতনে গেছে, হাত গলে কিছুই আর বের হয় না।" এমন গালাগালি করার পরক্ষণেই তাঁকে আবার অন্যের দ্বারস্থ হয়ে কিছু চাইতে দেখেছি।
যে-ব্যক্তি এক সময়ে অন্যকে গালি দেয়, সেই লোকই আবার অন্য সময়ে অন্যের দ্বারস্থ হয়ে ভিক্ষা চায়! সেই আত্মনির্ভরের এতই সম্মান! সে যেন নিজের হাতকে সারাক্ষণই উন্মুক্ত রেখেছে—ভাবখানা এমন যেন, যে চাইছে, তাকেই সব কিছু ঢেলে দিচ্ছে! নিজের হাত গুটিয়ে, অন্যের দ্বারস্থ হওয়া ও অন্যকে সুযোগ পেলেই এভাবে গালি দেওয়া কিংবা মানুষের দয়ার উপর জোর জবরদস্তি করা ধর্মাচরণ কি না জানি না; কিন্তু এটা জানি, এর জন্যই অনেক দাতা কৃপণ হয়েছেন, অনেক ধনী চিরদিনের জন্য সাহায্যের দরোজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
অন্যদিকে, অনেক লোক, অবস্থা অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও, ভিখারির দলে নাম লিখিয়ে অলসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। সব কিছুর সীমা আছে। অবিচারিত দানেরও সীমা থাকা উচিত, অবিচারিত গ্রহণেরও সীমা থাকা উচিত। নিজের শক্তিসামর্থ্য প্রয়োগ করেও যে চলতে পারে না, সে যদি ভিক্ষা করে, তবুও সহ্য হয়; কিন্তু নিজের শক্তি না খাটিয়ে, অন্যের দ্বারস্থ হওয়া যে কতটা নীতি-বিরুদ্ধ কাজ, তা কে না জানে! দান করে রাজা পথের ভিখারি হবেন, এটাও ভালো নয়; ভিক্ষা করে লোকে অলসতার দুগ্ধনিভ শয্যায় শোবে ও চর্চ্য-চোষ্যের সাহায্যে শরীরকে পুষ্ট করবে, এবং দাতার নিন্দা করে জিভ কলুষিত করবে, এটাও ভালো নয়।
বুদ্ধিমান প্রতিভাশালী ব্যক্তিরা, এজন্য, উভয় শ্রেণীর মাঝখানে থাকেন। তাঁরা অন্যকে অনুরোধ-পত্র লিখে দিয়ে দয়ার ভার অন্যের হাতে ন্যস্ত করে নিজে নিশ্চিন্ত থাকেন। তাঁরা মানুষকে স্বাবলম্বনের অতিরিক্ত মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চান না, এবং এটাই করা উচিত। এজন্য, সদাশয় ধনী এবং 'উদার ভিখারি' উভয়ই তাঁদেরকে কৃপা ও ঘৃণার চোখে দেখেন! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কি আদৌ ঘোরতর অন্যায় করেন?
তোমার বাবার শ্রাদ্ধে ঘোরঘটা হয় না, তোমার সন্তানের বিদ্যাশিক্ষা হয় না, তোমার কন্যাদায় উপস্থিত, কিংবা তোমার তীর্থদর্শন বা ধর্মপ্রচার হয় না, অন্য কোনো ভালো কাজ হয় না—তোমার দরিদ্রের সেবা কি দেবসেবা হয় না, সেজন্য ধনীর কী এসে যায়, বলো তো? বিধাতা তোমাকেও হাত-পা দিয়েছেন, তাঁকেও দিয়েছেন; তিনি হাত-পা ব্যবহার করে বুদ্ধি বা পুণ্যবলে তাঁর নিজের যোগ্যতায় বা পিতার অর্জিত কিছু টাকা পেয়েছেন, তুমি তা পাবার জন্য বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার শক্তি খাটিয়ে ওই টাকা আয় করো, ব্যয় করো, পিতৃদায়, কন্যাদায় হতে উদ্ধার হও। তুমি এতদিন চেষ্টা করোনি, সেজন্য অন্যে দায়ী হতে পারে না। তোমার দুর্ভাগ্যের দায় যার নয়, তাকে বিরক্ত করো কোন আক্কেলে?
তুমি একটা ধর্মের মত নিজ জীবনের সার হিসেবে ধরেছ, ভালো কথা। কিন্তু এখন জগতের দরোজায় দরোজায় তোমার সেই মত দিতেই হবে? কে জানতে চেয়েছে বা পেতে চেয়েছে তোমার ওই ধর্মমত? আচ্ছা, ঠিক আছে, কেউ তো বাধা দিচ্ছে না—দাও, প্রচার করো; তাই বলে সেজন্য অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করো কেন? বিধাতা কি তোমাকে অন্য সবার মতো হাত-পা-মাথা দেননি? তুমি পরোপকারব্রত নিয়েছ, ভালো কথা; তুমি অর্থোপার্জন করো, চাকরি বা ব্যাবসা করে কিছু টাকা উপার্জন করো, পরে তা দরিদ্রসেবায় অকাতরে খরচ করো—কে নিষেধ করছে? এর জন্য অন্যের দয়ার উপর জোরজবরদস্তি করো কেন? তুমি কি লোকজনকে ধরে ধরে পুণ্য করিয়ে স্বর্গে নেবার দায়িত্ব পেয়েছ নাকি? লোকপ্রতি কমিশন কত করে পাও? তোমার ধর্মনিষ্ঠা দিয়ে তুমি নিজে স্বর্গে বা যেখানে খুশি যাও না, কেউ তো তোমাকে বিরক্ত করছে না! তুমি নিষ্ঠাবান, তাই এখন এই নিষ্ঠার জন্য আরেকজন অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন?
কেউ অযাচিতভাবে তোমাকে সাহায্য করেন তো ভালোই—তা গ্রহণ করো, কিন্তু আর কেউ সাহায্য করে না বলে বৃথা নিন্দা করো কেন? দয়ার উপর কি জবরদস্তি চলে? কে তোমাকে ওই ব্রত নিতে অনুরোধ করেছে? তোমার ব্রতে কি অন্যে স্বর্গে যাবে, না কি কেউ যেতে চেয়েছে? আমি এমন নারীদের দেখেছি, যাঁরা চাকরি করে অর্থোপার্জন করছেন, এবং সেই অর্থ অকাতরে দরিদ্রের জন্য ঢালছেন। তাঁরা বিয়ে করেন না, তাই তাঁদের স্বামী-সেবা নেই, সন্তান-সেবা নেই, জীবনে কেবল ওই একটাই কাজ। আমরা নরাধম, ওই দৃষ্টান্ত দেখতে পারি, কিন্তু প্রাণে পুরতে পারি না। আমাদের বছর বছর সন্তান উৎপাদন করতে হবে, এবং পরসেবার ভান করে অন্যের দরোজায় ভিক্ষা করে গরিব লোকজনকে প্রতিপালন করতে হবে বাহবা কুড়োনোর জন্য; আর কেউ কিছু না দিলে গালাগালির চোটে আকাশ ফাটাতে হবে!
আহা, দুর্ভাগ্য! যে-দেশের রাস্তায় রাস্তায় কোটি কোটি ভিখারি অন্যের সাহায্যের প্রত্যাশায় অলসভাবে দিন কাটায়, সেই দেশে আবার কত কত কর্মক্ষম, জ্ঞানী, মানী, সুসভ্য ভিখারির অভ্যুদয় হচ্ছে! আমরা বড়ো কঠিন সময়ে জন্মগ্রহণ করেছি। ভিক্ষা করে সংসার চালানো যদি দোষের হয়, তবে ভিক্ষা করে সৎকাজ, পরোপকার করাও দোষের। আমার পুত্র-কন্যার অন্নবস্ত্রের জন্য বিধাতা এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছেন এবং আমাকে কৃষকরূপে পাঠিয়েছেন। আমাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটতে হবে, তবেই তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তোমার রাশি রাশি টাকা আছে, আমার তাতে কী? আমার শাকান্ন আমাকেই পরিশ্রম করে সংগ্রহ করতে হবে। আমার স্ত্রী-সন্তান-পরিজনের জন্য আমারই পরিশ্রম ও স্বোপার্জন যদি প্রয়োজন, তবে অহেতুকী প্রেমের টানে আমার দুঃখী ভাই, আমার দরিদ্র পৃথিবীর ভার যখন আমার মাথায় নেব, তখন তাদের জন্যও আমার ওরকম শ্রম ও উপার্জনই আবশ্যক।
আমি যদি পৃথিবীর দুঃখী-দরিদ্র লোককে আমার পুত্র-কন্যার মতো আপনজ্ঞানে প্রতিপালন করতে না পারি, তবে তাদের ভার আমার গ্রহণ করা উচিত নয়; কেননা কেবল দয়াতে পরের উপকার হয় না, প্রাণের টানে হয়। তারা যখন আমার নিজের মানুষ হবে, তখনই তাদের জন্য আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে প্রবৃত্তি হবে, এবং তখনই আমি তাদের সেবায় আসব। এটা না হলে আর যে-সকল পরোপকার ব্রতগ্রহণ, তা কেবল ভণ্ডামি মাত্র— কষ্ট ও পরিশ্রমশূন্য সুলভ যশোলাভের পন্থা মাত্র। এমন ব্রতপালনে, এই কঠোর সময়েও, লোকের প্রশংসা পেলেও পাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু প্রকৃত ধর্মের কাছে পুরস্কার বা পুণ্যলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। ধর্মের কাছ থেকে পুরস্কার তখনই পাওয়া যায়, যখন লোকে নিষ্কাম হয়ে, আপন সন্তানের মতো, জগতের নরনারীর সেবা করতে পারে। তা-ই পৃথিবীর স্বাবলম্বনের প্রথম সোপান—তা-ই বৈকুণ্ঠের মুক্তির পবিত্র সিঁড়ি।
পিতা-পুত্র সম্বন্ধটি এ পৃথিবীর বড়োই মধুর ও পবিত্র সম্বন্ধ। পিতা দিচ্ছেন, পুত্র নিচ্ছেন। পিতার মনেও ক্লান্তির বা শ্রান্তির ভাব নেই, পুত্রের মনেও কামনা, আশা বা নিরাশা নেই। পিতা যা দেন, পুত্রের তা-ই শিরোধার্য, পুত্র তাতেই কৃতার্থ। পিতা দিচ্ছেন, তাঁর কোনো প্রত্যাশা নেই, দেবার জন্য কেউ তাঁকে অনুরোধও করছেন না। এখানে কোনোরূপ অনুরোধ-উপরোধ নেই। না দিলেও পুত্র পিতার নিন্দা করেন না কিংবা অনেক দিয়েও পিতা মনে করেন না যে, খুব বেশি দিয়েছি। এখানে দান ও গ্রহণ আছে, কিন্তু উভয়ই মানুষকে স্বাবলম্বন-পথে নিয়ে যাচ্ছে। পিতা নিষ্কামভাবে দান করেন, পুত্র নিষ্কামভাবে গ্রহণ করেন। পিতা অসহায় শিশুকে মানুষ করার জন্য বিধাতার আদেশে খাটছেন, পুত্র অসহায় অবস্থা হতে নিজ শক্তির উপর ভর করে দাঁড়াবার জন্য বিধাতার ইচ্ছেয় পিতার সাহায্য নিচ্ছেন। এখানে দান ও গ্রহণ আছে, কিন্তু স্বাবলম্বনও অছে।
এ ধরনের দান ও গ্রহণই আদর্শ। এর মূলে স্বর্গের প্রেম। ভাবোচ্ছাসে নয়, কিন্তু এই স্বর্গের প্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি মানুষ অযাচিতভাবে নিষ্কাম দান করে, তবে তা সার্থক হয়; আর এই প্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে বিনা প্রার্থনায় কিছু পাওয়া গেলে যদি কেউ তা গ্রহণ করে, তবে স্বাবলম্বনে ব্যাঘাত ঘটে না। এমন নিষ্কাম প্রেমের অভাবেই, ধনী ভাবোচ্ছাসে দান করে, আর দিনশেষে আক্ষেপ করেন, এবং ভিখারি বা প্রার্থী, দান পেয়েও, আশা-নিবৃত্তি না হওয়ায়, দাতার নিন্দা করে নিজের রসনাকে (জিভকে) কলুষিত করে।
আর-একটা চিত্র আছে—মানুষের লক্ষ্য এই পৃথিবী নয়, এ পৃথিবীর ধনঐশ্বর্য কিছুই নয়। মানুষের লক্ষ্য কেবলই ঈশ্বর। ঈশ্বরমুখী প্রাণই নিষ্কাম প্রেমের আস্বাদন বোঝে। এমন প্রাণ পৃথিবীর কিছুই চায় না, সে ধনঐশ্বর্য, টাকাকড়ি, যশ-মান কোনো দিকেই তাকায় না; সে কেবল বিধাতার কৃপার জন্য লালায়িত। সে দান করেও তাঁর ইচ্ছেতে, সে গ্রহণ করেও তাঁরই ইচ্ছেয়—অথবা তাঁরই জিনিস তাঁর কাছে নিয়ে তাঁকেই দেয়। অভাব হলেও সে কারও দরোজায় যায় না, পরমপিতার চরণই ধরে; সে অতুল ঐশ্বর্য পেলেও রাখে না, পরমপিতার সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। পেলেও তাঁর উল্লাস নেই, না পেলেও ক্ষোভ নেই। দিলেও তাঁর বিরক্তি নেই, খুব পেতেও আসক্তি নেই। সে, সকল অবস্থার মধ্যেই নিশ্চিত মনে, এক-য়েরই লীলা দেখে এবং তাতে মজে। সে চায় তো পরমপিতার কাছেই চায়, সে দেয় তো পরমপিতার সন্তানকেই দেয়। ভাবোচ্ছাস তার নেই, তার হৃদয় স্বর্গীয় প্রেমে সঞ্জীবিত।
এখানে ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই; এখানে নিন্দা নেই, গ্লানি নেই। তার লক্ষ্য পৃথিবীর কিছুই নয়—লক্ষ্য নীরবে দাঁড়িয়ে কেবল জগজ্জননীর পূজা, বিশ্বপিতার পূজা করা। লক্ষ্য—নিজের ইন্দ্রিয় ও বৃত্তিসমূহকে তাঁর আনুগত্যে খাটিয়ে তাঁরই চরণে উৎসর্গ করা। লক্ষ্য—চিরকাল তাঁরই চরণে জীবনপ্রাণ ঢেলে দেওয়া। সেই অবলম্বনই স্বাবলম্বন। সেই স্বাবলম্বনই অধীনতা। সেই অধীনতাই মুক্তি। সে, মরে গেলেও, মানুষজ্ঞানে মানুষের কাছে ভিক্ষা চাইবে না, সে অনাহারে মরলেও বলবে—Thy will be done.—তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে। দিতে হয়, তিনিই দেবেন; না দিতে হয়, তিনি দেবেন না—সবসময় এই চিন্তায় বিভোর থেকে যে-ব্যক্তি সংসার-নিরপেক্ষ, বাসনা ও কামনা বিরহিত বা বিযুক্ত হয়েছেন, তিনি দাতাই হোন বা গ্রহীতাই হোন, কিছুতেই তাঁর চিত্তবিকার নেই।
এর অর্থ হলো—দান ও গ্রহণ যখন বিধাতার ইচ্ছে-অনুপ্রাণিত কাজ, তখনই তা পবিত্র ও পরমমঙ্গলের পথ; আর যখন মানুষের ইচ্ছে বা ভাব-প্রসূত, তখনই তা নরক। তাঁর ইচ্ছেতেই দিচ্ছি, এটা যিনি মনে করেন, তিনিই প্রকৃত দাতা; তাঁর ইচ্ছেতেই নিচ্ছি, এমনি করে যিনি ভাবেন, তিনিই প্রকৃত যোগী। অহংজ্ঞানকে অবলম্বন করে যাঁরা চলেন, তাঁরাই পরিণামে দুঃখ পান। বিধাতার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, তাঁর ইচ্ছেতে যখন মানুষ চলে, তখন দানে ক্লান্তি নেই, গ্রহণেও আসক্তি নেই; দানে অহংকার নেই, গ্রহণেও ভিক্ষা বা জোরজবরদস্তি নেই। তখন অবিচারিত দানও থাকে না, অসংযত প্রার্থনা বা গ্রহণও থাকে না। কে দাতা, কেই-বা গ্রহীতা! প্রকৃত ভক্তসাধকের পক্ষে, ঈশ্বরানুগত সাধুব্যক্তির পক্ষে, ভবের সকলেই এক ঈশ্বরের ইচ্ছেচালিত দাস-দাসী।
অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার, তিনি সব ঢেলে দিচ্ছেন। অন্নপূর্ণা নিজেই, রূপ বদলে ফেলে, আবার তা নিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর দিকে চেয়ে, তাঁর ইচ্ছেতে যে দান করে, দানে তার ভাণ্ডার আরও পরিপূর্ণ হয়। তাঁর দিকে চেয়ে তাঁর ইচ্ছেতে যে গ্ৰহণ করে, সে যা পায়, তাতেই তৃপ্ত, অন্ন অবারিতভাবে পাবার সুযোগ থাকলেও আবার চায় না, চোখের সামনে প্রচুর পেলেও প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্রহণ করে না। বাসনার আগুনে সে পোড়ে না, সে দয়ার উপর জোর জবরদস্তি চালাতে চায় না। এই অবস্থায় দুই জনই আত্মবিস্তৃত, কামনারহিত। যশের কুহকে, ভাবের প্ররোচনায় দাতা এখানে দানব্রত গ্রহণ করেননি, গ্রহীতাও কল্পিত ভেক (ছদ্মবেশ) ধরেননি।
যশ বা মানের কুহকে যেখানে দান বা গ্রহণ, সেখানে ক্লান্তি ও শ্রান্তি বোধ হওয়া অনিবার্য। যশ বা মানের কুহকে যেখানে সেবাব্ৰত বা ভেকগ্রহণ হয়েছে, সেখানে বাসনানির্বাণ আকাশকুসুম চিন্তা। সেখানে দানে কলঙ্ক, অহংকারের স্ফুরণ; গ্রহণে অলসতার বৃদ্ধি, স্বাবলম্বন ও আত্মমর্যাদা নির্বাপিত। সেখানে দাতা দান করে অহংকারে মত্ত—মনে করেন, আমার মতো দয়ালু লোক আর নেই; গ্রহীতাও আসক্তি-মত্ত—মনে করে, তাকে লোকে দিতে বাধ্য, তাকে দেবার জন্যই সকলের ধনঐশ্বর্য! দানেও কলঙ্ক, হায়, এখানে গ্রহণেও কলঙ্ক! নিষ্কাম-ব্রত পালন এ সংসারে আজকালকার দিনে বড়োই কঠিন হয়ে উঠেছে। বিধাতার কী ইচ্ছা, কে জানে!