দুর্গাপূজা থেকে দুর্গোৎসব (শেষ পর্ব)

 এখন দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শারদীয়া বা পূজা সংখ্যা। একেবারে শুরুর দিকে কোনও একটি পত্রিকার সাধারণ সংখ্যার সঙ্গে শরৎকালে বিশেষ সাল্পিমেন্ট হিসাবেই ছাপা হতে থাকে পুজো সংখ্যা। সম্ভবত, কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভার সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে ‘ছুটির সুলভ’ নামে। এক পয়সার সেই বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। তারপর থেকে ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকা পুজো সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। তখনকার দিনের নামী লেখকেরা যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এতে লিখতেন। প্রথম শারদ উপন্যাস ছাপা হয় শারদীয় বসুমতীতে। ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রথম শারদীয় সংখ্যা বের করে আনন্দবাজার পত্রিকা। তার বেশ কিছু বছর পর তাতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বড় গল্প ‘রবিবার’ প্রকাশিত হয় এখানেই, পরের বছরেই ‘ল্যাবরেটরি’। দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রথম প্রকাশ পায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে আর সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ ছিল দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস, যা বেরিয়েছিল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে। এরপর ইংরেজি ষাটের দশক থেকে আমরা দেখতে পাই, একএকটি পুজোয় একাধিক পুজোর সংখ্যা বের হয়, এমনকি ছয়-সাতটি করে উপন্যাস ছাপা হয়। সমকালের বিখ্যাত লেখকেরা সেগুলি লিখতেন। যেমন পুরনো দেশ পত্রিকার সংখ্যা খুললেই দেখা যাবে প্রথমেই অবশ্যউপস্থিতিটি রবীন্দ্রনাথের, তাঁর অপ্রকাশিত লেখা বা চিঠিপত্রের সম্ভার। তারপরেই থাকত বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, সতীনাথদের যুগের পর তাঁদের ব্যাটন ধরেন সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার-রা। সত্যজিতের হাত ধরে ফেলুদার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় পুজো সংখ্যায়ই।
পূজার সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ ব্যাপার ছিল। নানা সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁদের পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত। যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হলো প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন:
“তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভাল লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়ই দুঃসাধ্য কাজ, অন্যদিকে তত বড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য, সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি—অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার, ভাবিবার, বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধূলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে—ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড ‘পার্বণী’তে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ, বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদলাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভলোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই।
ইতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।”
১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পূজা সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশ টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯শে আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ পত্রিকাদ্বয়ের সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন:
“এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় ‘দেশ’ ও ‘আনন্দবাজার’-এর দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্য একশ টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেজন্য ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।……”
শারদীয়া সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাওয়ার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে পূজার লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না, তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনোকখনো উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পূজাতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পত্রিকা পূর্বাশা’য় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন, “নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে—তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপূজা সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্রস্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোনো ছোট-বড়র হিসাব কিংবা অভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে/যাবে না ফিরে……’। এখানে সবারই আমন্ত্রণ রয়েছে।
আগে পূজায় তেমন জাঁকজমক হতো না, তাই ছুটিরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুর্গাপূজায় প্রথম ছুটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৮৭ সালে। কলকাতার পূজার বাজারকে গ্রামের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯২৭ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে (ই. বি. রেলওয়ে) কর্তৃপক্ষ পূজার আগে ‘পূজাবাজার স্পেশাল’ নামে তিন কামরার একটি ট্রেন প্রায় মাসখানেক ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চালিয়েছিল। গ্রামের মানুষদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে মোট ১৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ওই ট্রেনে পসরা সাজিয়ে যোগ দিয়েছিল।
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
অর্থাৎ, ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা”, অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সবসময় দুর্গা নামে পরিচিত।
শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, যে দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ (সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি), তিনিই দুর্গা।
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, “দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।……বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো। শরৎ ঋতুর আরম্ভেও হতো। এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হয়ে দুর্গাপূজা হয়েছে।” বৈদিক যুগের শারদোৎসব বা রুদ্রযজ্ঞ, সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তি প্রভৃতি দুর্গাপূজার প্রাচীনত্বের পরিচায়ক। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদ, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, মুণ্ডক উপনিষদ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ, দেবীভাগবত, কালিবিলাসতন্ত্র প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণতন্ত্রাদি গ্রন্থে কোথাওকোথাও কিছুটা রূপকাশ্রিত হলেও প্রায় ধারাবাহিকভাবে দুর্গাপূজার কথা জানা যায়। তবে দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হল: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে – আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। দুর্গার বাহন সিংহ। বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী, তাঁর ডানপাশে উপরে লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ, বামপাশে উপরে সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়।
অনেকের মতে, বাংলার প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজার পরিবারে মা দুর্গা মৃন্ময়ীদেবী রূপে পুজিত হন। মল্লরাজ জগৎ মল্ল ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে সারাবছর ধরেই মৃন্ময়ী দেবীর পুজো হয়। কিন্তু পুজোর দিনগুলিতে চণ্ডীপাঠ থেকে শুরু করে পুজোর সব রীতিনীতি রাজবাড়ির দুর্গাপুজোকে এক অন্যমাত্রা দেয়। মল্লরাজ জগৎ মল্লর আমলে এখানে কামান দাগার পর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে পুজো শুরু হত। এখনও মহাষ্টমীর দিন কামান দেগে শুরু হয় সন্ধিপুজো। যা দেখতে ভক্ত ও পর্যটকদের ঢল নামে বিষ্ণুপুরে। শোনা যায়, একসময় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব এই মন্দিরে এসে পুজো করেছিলেন। সেই সময় নাকি তিনি মৃন্ময়ীদেবীকে সিংহবাহিনী রূপে দেখেছিলেন। নীলকণ্ঠ পাখিরা এখন বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাজার বছরের পুরনো রীতি বজায় রেখেছে রাজবাড়ি। এখনও বিজয়ার দিন সকালে নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যায় রাজবাড়ি থেকে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, মল্লরাজ জগৎমল্ল তৎকালীন রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে শিকার করতে গিয়ে গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে দেবী দুর্গার দর্শনলাভ করেছিলেন। যে জায়গায় তিনি দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন, সেখানেই দেবী মৃন্ময়ীর মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে। এই অঞ্চলেরই নাম বন বিষ্ণুপুর। পরে এই মন্দির সংলগ্ন এলাকাতেই তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। প্রচলিত সাবেক মূর্তির চেয়ে আলাদা এই প্রতিমা। দেবীর পাশে, উপরে থাকে কার্তিক ও গণেশ। নীচে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কাঠামোর উপরে থাকেন মহাদেব। তার পাশে নন্দী, ভৃঙ্গী এবং ভূত-প্রেত। তার ঠিক নীচে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যার দশটি রূপ। এই পুজোর কিছু ব্যতিক্রমী আচার অনুষ্ঠান রয়েছে।
মৃন্ময়ী দেবীর পুজো ছাড়াও দুর্গোৎসবে পূজিত হয় একাধিক দুর্গাপট। যেমন বড় ঠাকরুণ, মেজ ঠাকরুণ, ছোট ঠাকরুণ এবং অন্যান্য ধাতু নির্মিত দুর্গাপট। জীতাষ্টমীর সন্ধ্যায় হয় বড় ঠাকুরানির বিল্ববরণ অনুষ্ঠান। পরের দিন নবমী তিথিতে গোপালসায়রের ঘাটে বড় ঠাকুরানির পট, রাজবাড়ির রৌপ্য পট এবং নবপত্রিকার বিশেষ পুজোর পরে মৃণ্ময়ী মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। সেই দিন থেকেই ১৯ দিনের দুর্গোৎসবের সূচনা। এর পরে চতুর্থী তিথিতে গোপালসায়র থেকে জল ভর্তি করে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি ঘট। এ দিন মেজঠাকুরানি পটের পুজো করা হয়। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় ছোট ঠাকুরানির পট বেলতলায় রেখে পুজো করা হয়। বড় ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানির দুর্গাপট বংশানুক্রমে আঁকেন শাঁখারিপাড়ার ফৌজদার পরিবারের শিল্পীরা। সপ্তমীর দিন সকালে রাজবাড়ি থেকে মন্দিরে আনা হয় একটি সোনার পাতে আঁকা দুর্গা পট। তার প্রচলিত নাম ‘পটেশ্বরী’। শুরু হয় বিশেষ স্নানপর্ব ও সপ্তমী পুজো। অষ্টমীর পুজো বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ। এখানে সন্ধিপুজো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে দিন রাজবাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডার বিগ্রহ। প্রথা অনুসারে আসেন রাজপরিবারের সদস্যেরা। পুষ্পাঞ্জলির পরে হয় তোপধ্বনি। নবমীর মধ্য রাতে মহামারীর দেবী খচ্চরবাহিনী-র বিশেষ পুজো হয়। পুরোহিত ঘটের দিকে পিছন ফিরে বসে এই পুজো করে থাকেন। এই সময় মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। জনশ্রুতি, এক সময় মৃন্ময়ীদেবীর সামনে নরবলি হত। তবে মল্লরাজ বীর হাম্বির বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পরে নরবলি তথা সর্ব প্রকার বলিদান নিষিদ্ধ হয় এখানে। মৃন্ময়ীদেবীর বিসর্জন হয় না। দশমীর দিন প্রথা অনুসারে নবপত্রিকা এবং অন্যান্য আঁকা পট বিসর্জন দেওয়া হয়। এই পূজাও কংসনারায়ণ প্রবর্তিত পূজার অনেক আগে প্রচলন লাভ করে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন। সেও কংসনারায়ণের বহু আগের ইতিহাস। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোত্‍সবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। দেবী দুর্গার অনেকগুলি হাত। তাঁর অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভূজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়।
সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাত্‍ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাত্‍ দশমী অবধি পাঁচদিনব্যাপী দুর্গোত্‍সব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিনে---এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিনে অর্থাত্‍ পূর্ণিমায়---এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাত্‍সরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসেবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উত্‍সবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও পরিবারে অবশ্য পনেরো দিন ধরে দুর্গোত্‍সব পালনের প্রথা আছে। এক্ষেত্রে উত্‍সব মহালয়ার পূর্বপক্ষ অর্থাত্‍ পিতৃপক্ষের নবম দিন অর্থাত্‍ কৃষ্ণানবমীতে শুরু হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবাড়িতে আজও এই প্রথা বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় মহাসপ্তমী থেকে বিজয়াদশমী অবধি জাতীয় ছুটি ঘোষিত থাকে; এই ছুটি বাংলাদেশে কেবলমাত্র বিজয়াদশমীর দিনই পাওয়া যায়, তবে সাধারণত হিন্দুরা আবেদনসাপেক্ষে পূজায় আরও তিনদিন ছুটি ভোগ করতে পারে। পূর্ব ভারতের কলকাতা, হুগলী, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং ভারতের অন্যান্য অবাঙালি অঞ্চল যেমন, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করে এই উত্‍সব পালন করা হয়। কাশ্মীর ও দাক্ষিণাত্যে অম্বা ও অম্বিকা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, কান্যকুব্জ (কুব্জা রমণীগণের নগরী)-এ কল্যাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা অন্তরীপ অঞ্চলে কন্যাকুমারী নামে দুর্গোৎসব পালিত হয়। জাপানে চুণ্ডিদেবী, চীনে চানসান দেবী, তিব্বতে তার দেবী, নেপালে মঞ্জুশ্রী দেবী, মিসরে আইসিস হ্যাথর সিংহমুখী দেবী, বেলুচিস্তানের মরুদ্বীপে হিংলাজমাত দেবী, জার্মানি, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে বিবিধ প্রতিমূর্তিরূপে মহাশক্তিধর দেবী স্থানীয় রীতিনীতি অনুসারে দুর্গা পূজিত ও বন্দিত হন। বিদেশে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েত, মালয়েশিয়া-সহ বিশ্বের বহু দেশে অভিবাসী হিন্দুদের বা বাঙালি হিন্দুদের নানা সংগঠন এই উত্‍সব পালন করে থাকে। ২০০৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনে রাজধানী লন্ডন শহরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে ‘ভয়েসেস অফ বেঙ্গল’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীতে স্থানীয় প্রবাসী বাঙালিরা আর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মিলে বিশাল এক দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। বাংলায় এই পূজাকে শারদীয় পূজা, শারদোত্‍সব, মহাপূজা, মায়ের পূজা, ভগবতী পূজা এবং বসন্তকালে বাসন্তীপূজা হিসেবে উদযাপন করা হয়। বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ---এসব স্থানে এ পূজাকে দুর্গাপূজা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচলপ্রদেশ, মহীশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ---এসব স্থানে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়।
দুর্গাপূজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ কুমারীপূজার কথকতা দিয়ে লেখাটির ইতি টানছি। দেবীপুরাণে কুমারীপূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্রে সাধারণত ১ বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজা করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজা করার বিধান রয়েছে। দুর্গাপূজায় কুমারীপূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলংকারে তাকে সাজানো হয়। পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল। কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার। সঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। চারদিক থেকে শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মায়ের স্তব-স্তুতিতে পূজাঙ্গন মুখরিত হয়ে থাকে। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে দেবী বেশি প্রকাশ পায়। কুমারীপূজার মাধ্যমে নারীজাতির মানসমূর্তি হয়ে ওঠে পূতপবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন, শ্রদ্ধাশীলা। প্রতিমায় দেবীর পূজাতে আংশিক ফল হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায়। এ পূজা কুমারীর পূজা নয়, এ পূজা কুমারীতে পূজা। কুমারীতে ভগবতীর রূপ ও গুণ অধিষ্ঠান করে পূজা। এটি একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানববন্দনা আর নারীর মর্যাদা। নারীর সম্মান, মানুষের জয়গান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারীপূজায় অন্তর্নিহিত।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এক ভোর। হালকা কুয়াশায় ঢাকা নির্জন ঝিলাম নদীর ঘাটে একখানি নৌকা দেখা যায়। সে নৌকায় কালোরঙের চাদরে মুড়ি দিয়ে বসে আছে একজন মাঝবয়েসি মাঝি। স্পষ্টই বোঝা যায় যে মাঝিটি যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছে। মাঝির মুখ ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় একটি সাদারঙের উলের টুপি। মাঝির কোলে একটি সাত/আট বছর মেয়ে চুপ করে বসে আছে। মেয়েটির ছোট্ট শরীরে একখানি ধূসর রঙের ময়লা চাদর জড়ানো। মাথায় বেগুনি রঙের উলের টুপি।
নদীপাড়ের কুয়াশার ভিতর যেন পাশাপাশি দুটি আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যায়। মাঝিটি সেদিকে তাকাল। হাতে বৈঠা তুলে নেয়। একটু পরেই দুজন তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখা যায়। তাঁরা ঘাটে নেমে নৌকার গলুইয়ের খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। সন্ন্যাসীদের পরনে হলুদরঙের গেরুয়া বসন, মাথায় হলুদ পাগড়ি।………মাঝির জানার কথা নয়---এ দুজন তরুণ সন্ন্যাসী বাঙালি। এঁদের একজন স্বামী বিবেকানন্দ, তখন বয়স ৩৫; অন্যজন স্বামী অক্ষদানন্দ। বয়েসে ইনি স্বামী বিবেকানন্দের চেয়ে বছরখানেক ছোটই হবেন। এঁরা দুজনই ভারতবর্ষ ভ্রমণ করছেন। বেদান্তদর্শন অধ্যয়নের পাশাপাশি মানবীয় অভিজ্ঞতার ঝুলিটি তাঁরা পূর্ণ করে নিচ্ছেন। এঁদের দুজনের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের মুখখানি ভাবগম্ভীর এবং দৃষ্টি অর্ধমুদিত, সে কারণে তাঁকে কিছুটা অর্ন্তমুখীই মনে হয়, সেই তুলনায় স্বামী অক্ষদানন্দ যেন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত আর জড়তামুক্ত………বাঙালি সন্ন্যাসী দুজন বেশ কিছুকাল হল কাশ্মীরে অবস্থান করছেন। তাঁরা মেধাবী বলেই এরই মধ্যে স্থানীয় ভাষাটি মোটামুটি রপ্তও করে ফেলেছেন।
স্বামী অক্ষদানন্দ মৃদু হেসে সুমধুর কণ্ঠে স্থানীয় ভাষায় মাঝিকে বললেন, আমাদের পার করে দাও গো মাঝি। “নৌকায় উঠে আসুন, হজুর।” মাঝিটি হেসে বলল। ভিনদেশির মুখে মায়ের ভাষা শুনে কার না ভাল লাগে! গরীব মাঝি সে, তার উপর তার মাতৃভূমিটি দীর্ঘদিন হল ইংরেজরা দখল করে রেখেছে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রায়শ উদ্বিগ্ন থাকে সে। এই ভোরে দুজন তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে মাঝির মনের উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।………সন্ন্যাসী দুজন ধীর প্রসন্ন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এলেন। মুহূর্তেই নৌকায় যেন রজনীগন্ধার মৃদু সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল। গভীর শ্বাস ফেলে নৌকার দড়ি খুলে নদীর শীতল জলে বৈঠা নামায় মাঝি। মাঝির কোলে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটি যাত্রী দুজনের দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে।
স্বামী অক্ষদানন্দ মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাম হে তোমার?
“আমার নাম ইব্রাহীম, হজুর।” বৈঠা বাইতেবাইতে মাঝি বলল। মৃদু ছলাত শব্দ শোনা যায়। সেকালে ঝিলাম নদীর গন্ধ আজকের দিনের মতো আঁশটে হয়ে ওঠেনি সম্ভবত।
“আর এইটে বুঝি তোমার মেয়ে?”
ইব্রাহীম মাঝি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হজুর। ও আমার মেয়ে। ওর তো মা নেই, তাই হজুর সারাদিন ও আমার সঙ্গেই থাকে।
অলক্ষ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্বামী বিবেকানন্দ। আহ্, এই অনাথ বালিকাটি তার মাকে দেখতে পায় না। সেই দেখতে না পাওয়ার গভীর শূন্যতা অনুভব করলেন তিনি। জগতে জীবের এই কষ্ট……ভাবতেই সমগ্র জগতের জীবের কষ্ট যেন তৎক্ষণাৎ অনুভব করলেন ওই তরুণ যোগী। তারপর মুহূর্তেই সচেতন হয়ে উঠলেন। ইব্রাহীম মাঝির দিকে তাকিয়ে জলদ মধুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম ওর?
এতক্ষণে তরুণ মুসাফিরের ভরাট কন্ঠস্বর শুনে ইব্রাহীম মাঝি মুগ্ধ হয়ে গেল। মুসাফিরের ভরাট মুখটি কেমন নূরানি। সে নূরানি মুখে বড়বড় দুটি স্পষ্ট আয়ত চোখ। তরুণ মুসাফির যে সামান্য লোক নয়, মস্ত বড় কামেল দরবেশ, সেটি ইব্রাহীম মাঝি তার নির্মল হৃদয়ের বিচারবিবেচনায় ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে। সেই তরুণ দরবেশটি শীতে মোটেও কাহিল নয় দেখেও বিস্মিত হল সে। ইব্রাহীম মাঝি ভক্তিভরে বলল, ওর নাম সাবিহা, হজুর।
সাবিহা? বাহ্‌, বেশ সুন্দর নাম তো। বলেই গভীর অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন আয়ত চোখে সাবিহার মুখখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন স্বামী বিবেকানন্দ। সাবিহার ফরসা মুখটি ঈষৎ লম্বাটে। গালে হালকা লালের ছোঁয়া। বেগুনিরঙের উলের টুপি ছাপিয়ে সোনালিরঙের কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ দুটি বড়বড়, ভারি নিষ্পাপ আর নীলাভ। মুখটি যেন এর আগে কোথাও দেখেছি……হাজার বছর আগে যেন……যখন বিগত জন্মে বেঁচে ছিলাম সুপ্রাচীন শ্রাবস্তী নগরে…….তার রোদজলের ভিতর……তার বৃষ্টির ভিতর……তার অন্ধকারের ভিতর…….রূপশালী অন্নের ভিতর…….অশ্বক্ষুর-ধ্বনির ভিতর……গোধূমের গন্ধের ভিতর……দেবালয়েরর আবছায়ার ভিতর……ধূপের গন্ধের ভিতর……সন্ধ্যালগ্নে……তখন……তখন এই কুমারী বালিকাটি কি আমায় স্নেহময়ী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি? আশ্বিনের ভোরে আমাকে কি নদীপাড়ের উদ্যান থেকে একখানি জবা ফুল ছিঁড়ে দেয়নি পূজার উদ্দেশ্যে?
সহসা তরুণ সন্ন্যাসীর কেমন এক ঘোর লাগে। তিনি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। তাঁর ভরাট গম্ভীর মুখে ফুঠে উঠতে থাকে প্রবল ভক্তির চিহ্ন। তিনি হাত জোড় করে সাবিহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। যেন কোনও মাতৃসমা মহাদেবীকে প্রণাম করছেন এক নতজানু ভক্ত। ওই দিব্যদৃশ্যটি দেখে স্বামী অক্ষদানন্দ প্রগাঢ় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এতকাল একসঙ্গে রয়েছি, কই, এর আগে এ রকম তো কিছু চোখে পড়েনি। স্বামী অক্ষদানন্দ মনেমনে ভাবলেন। ইব্রাহীম মাঝিও কম বিস্মিত হয়নি। তরুণ দরবেশ তাঁর কন্যা সাবিহাকে প্রণাম করছে বলে তার হৃদয়ে সে গভীর এক আনন্দের অনুভূতি টের পায়। এই মা-মরা মেয়েটিই ইব্রাহীম মাঝির সব। আল্লাহ যেন মেয়েটির উপর অশেষ রহমত বর্ষণ করেন---নামাজ আদায় করে এই দোয়াই সে করে। ইব্রাহীম মাঝির চোখের কোণটি জলে ভিজে উঠে।
কুমারী সাবিহার প্রতি প্রণামের ভঙ্গিতে আচ্ছন্ন ও স্থির হয়ে রইলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সম্পূর্ন আত্মবিস্মৃত হয়ে কুমারী সাবিহাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতে থাকেন। সহসা তরুণ যোগীর কন্ঠ থেকে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হয়, সুসংকশা মাতৃমৃষ্ট্রেব যোষাবিস্তম্বং কৃণুষে দৃশে কম……
স্বামী অক্ষদানন্দ জানেন, শ্লোকটি ঋগ্বেদের ১/১২৩/১১ নং সূক্ত, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়:
……যেন মায়ের নিজের হাতে সাজিয়ে দেওয়া সুরূপী কন্যাটি মানুষের দৃষ্টির সামনে নিজের তনু প্রকাশ করছে।
নৌকার বাতাসে রজনীগন্ধার সৌরভ ঘন হয়ে উঠতে থাকে। আর সময় যেন থমকে গেছে---এরকমই বোধ হয় স্বামী অক্ষদানন্দের। তাঁর চোখের কোণে চিকচিক করছে দুফোঁটা আনন্দের অশ্রু। জাতপাতের ভেদাভেদ সম্বন্ধে আজ তাঁর এক পরম অভিজ্ঞান হল, যা তাঁর ভবিষ্যতের দীর্ঘ মানবিক ও কল্যাণকর যাত্রাপথে দান করবে গভীর প্রত্যয়। এই শীতশেষের ভোরে ঝিলাম নদীর জল নিস্তরঙ্গ হয়ে রয়েছে। সেই তরঙ্গশূন্য জলে মনের আনন্দে বৈঠা বায় ইব্রাহীম মাঝি। নৌকায় একজন নিষ্পাপ কাশ্মিরী কুমারী বালিকার উদ্দেশ্যে মাতৃজ্ঞানে অর্চনারত এক বাঙালি যোগী গভীর ধ্যানে নিমগ্ন……যখন নদী ও নদীপাড়ের হালকা কুয়াশা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছিল সূর্যের অনাবিল আলো……
মাতৃপূজার প্রচলন পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে দেখা গেলেও ভারতবর্ষের মতো শক্তির সাধনা আর কোথাও দেখা যায় না। এখানে বহুরূপে শতনামে শক্তির আরাধনা হয়। দুর্গাপূজার সময় কিছুকিছু পূজামণ্ডপে দেবীর কুমারী রূপের পূজার আয়োজন করা হয়। মহাশক্তির বরেণ্য সাধক-সন্তান শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরীজী তাঁর শ্রীশ্রী দশমহাবিদ্যা গ্রন্থে নানাভাবে দর্শন করেছেন নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের প্রসূতী ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী আদ্যাশক্তি মা’কে। তাঁর দৃষ্টিতে এই মা ব্রহ্মশক্তি ব্রহ্মময়ী, নির্গুণ ব্রহ্মের অচিন্ত্যগুণ প্রকাশিনী আদ্যাশক্তি সনাতনী, সমগ্র জীব-জগতের আশ্রয় স্বরূপ। নিষ্কলা হয়েও পরমাকলা-পরম ঐশ্বর্য্যময়ী। তাঁর বাণী-আকাশে আকাশবরণী নিত্য প্রকাশ ইনি যে দুহিতর্দিবঃ।। মাগো তুমি যে আকাশেরই মেয়ে! তুমি আকাশক্রোড়ে আকাশরাণী। ওদিকে মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবী মাহাত্ম্যম্‌ ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’র নারায়ণীস্ততির পঞ্চদশ শ্লোকে রয়েছে: কুমারী রূপ সংস্থানে নারায়ণী নমহস্তুতে। কুমারী কে? অপাপবিদ্ধা নিত্যশুদ্ধা সৃজনকারিণী ব্রহ্মশক্তি। কুমারী ব্রহ্মরূপিণী স্ত্রীশক্তি। দেবীভগবতে কুমারীর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এক বছরের কন্যা পূজার যোগ্য নয়। দু’বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত কুমারীর পূজা হবে। কুমারী প্রসন্ন‍া হলে সাধকদের অভীষ্ট প্রদান করেন। ভিন্ন বয়সের কুমারীপূজার ফলও পৃথক পৃথক।
দুবছরের কুমারীর পূজা দ্বারা দুঃখদারিদ্র ও শত্রুনাশ এবং আয়ুবৃদ্ধি হয়। ধনসম্পদ, ধান্যাগম, ও বংশবৃদ্ধি হয়। কল্যাণীর পূজা সাধককে বিদ্বান, সুখী এবং বিজয়ী করে। রোহিণীর পূজায় ধনেশ্বর্য লাভ। ষষ্ঠ বর্ষীয়া শঙ্করী, দুর্গা বা কালিকার অর্চনায় শত্রুরা মোহিত হয়, দারিদ্র্য ও শত্রু বিনষ্ট হয়। অভীষ্টসিদ্ধির জন্য সুভদ্রার পূজা বিধেয়। তন্ত্রে যে কোনো বর্ণ ও জাতির কুমারীকে দেবীজ্ঞানে পূজার কথা বলা হয়েছে। জগৎজননীর অনন্য প্রকাশ এই কুমারীর মধ্যে। মাতৃশক্তি ছাড়া এই জগতে কোনো প্রাণের সৃষ্টি কি সম্ভব!! কুমারীপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজার এক বর্ণাঢ্য পর্ব। দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন কুমারীপূজা উদযাপন করা হয়। কুমারীপূজা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বেশ কৌতূহল দেখা যায়। বালিকা প্রতিমায় মহামায়ার পূজা ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনার ফলিতরূপ বলা যায়। নারী জগদ্ধাত্রীর অংশবিশেষ। সমগ্র বিশ্বে তিনি মহামায়া রূপে প্রকাশিতা। প্রত্যেক নারীকে মাতৃভাবে ভাবনা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা এবং নারী মর্যাদার সর্বোচ্চ বিধান।
কুমারী হলো দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি। সব নারীর মধ্যেই আছে দেবী দুর্গার শক্তি। তাই নারী পূজনীয়---এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কুমারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে কুমারীপূজা করা হয়। এ যেন কুমারীরূপে বিশ্বের নারীশক্তি, বিশ্ব মাতৃশক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজা ছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা ও অন্নপূর্ণাপূজা উপলক্ষে এ পুজো হয়। কামাখ্যাসহ বিভিন্ন শক্তিক্ষেত্রেও কুমারীপূজার প্রচলন রয়েছে। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “দিব্যচক্ষু চাই। মন শুদ্ধ হলেই সেই চক্ষু হয়। দেখ না কুমারীপূজা! হাগা-মোতা-মেয়ে, তাকে ঠিক দেখলুম সাক্ষাৎ ভগবতী।” তিনি আরও বলেছেন, “সারদা মা-কে কুমারীর ভিতর দেখতে পাই বলে কুমারীপূজা করি।” কুমারী হল শুদ্ধ আধার। কুমারীপূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। প্রতিবছর দুর্গোৎসবের মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশে কুমারীপূজার প্রচলন যে বহু আগে থেকেই ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘কুমারীপূজাপ্রয়োগ’ নামক গ্রন্থের পুথি থেকে (লিপিকাল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)। যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্ত্রসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারীপূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনানুসারে, কুমারীপূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমন-কী বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। অবশ্যই অব্রাহ্মণ কন্যায়ও অতি উত্তম কুমারীপূজা হবে। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। কুমারী মানেই সর্ববিদ্যাস্বরূপা। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়:
১) এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
২) দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
৩) তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
৪) চার বছরের কন্যা — কালিকা
৫) পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
৬) ছয় বছরের কন্যা — উমা।
৭) সাত বছরের কন্যা — মালিনী
৮) আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
৯) নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
১০) দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
১১) এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
১২) বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
১৩) তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
১৪) চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনায়িকা
১৫) পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
১৬) ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা
বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবীপুরাণে এ বিষয়টির বিস্তারিত উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে। একসময় শক্তিপীঠসমূহে কুমারীপূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নামটা অনেক পুরনো। দেবীর কুমারী নাম যেমনি পুরনো, তার আরাধনা ও পূজার রীতিনীতিও তেমনি প্রাচীন এবং ব্যাপক।
যোগিনীতন্ত্রে কুমারীপূজা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ব্রহ্মার শাপবশে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপসঞ্চার হলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হতে বিষ্ণু হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন। দেবীর সন্তোষে বিষ্ণুর পদ্মনাভি হতে সহসা ‘কোলা’ নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাজিত করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে নেয়। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। বিষ্ণু ও আদি দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী বলেন, “হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবান্ধবে হত্যা করিব।” অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বধ করলে সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেব-দেবীগণ সকলে সমবেত হয়ে কুসুমচন্দনভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন। পুরাণে আছে, ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে শ্রীরামচন্দ্র দেবীপূজার আয়োজন করলেন। ধ্যানমানসে উদ্ভাসিত হলেন দেবী এবং ব্রহ্মা জানতে পারলেন যে, দেবী তখন কুমারীরূপে শায়িত আছেন বিল্বশাখায়। ব্রহ্মার নির্দেশ অনু্যায়ী শ্রীরামচন্দ্র শুক্লা ষষ্ঠীর সকালে কল্পারম্ভ এবং সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষমূলে শুরু করলেন দেবীর বোধন। ষষ্ঠীতে বোধিত হলেন দেবী। সপ্তমীতে ষোড়শোপচারে দেবীকে পূজা করলেন শ্রীরামচন্দ্র, কিন্তু তখন পর্যন্ত দেবীর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন অষ্টমী তিথিতে সকল যোগিনীদের ডেকে আবার সমস্ত পূজা-অর্চনা করে আরাধনা করা হল দেবীকে। দেবী তখনও কোনো সাড়া দিলেন না। আগত যোগিনীদের হৈচৈয়ে দেবী তখন কেবল একটু নড়েচড়ে পাশফিরে শয়ন করলেন। কিন্তু জাগ্রত হলেন না। তখন অষ্টমীর শেষ এবং নবমীর শুরুতে মহাসন্ধিক্ষণে রামচন্দ্র করলেন দেবীর বিশেষ পূজা, যা পরিচিতি পেয়েছে সন্ধিপূজা নামে। দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিন হয় এই বিশেষ পূজা , এই পূজার সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালীন পূজা। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এইসময় দেবী দুর্গাকে চামুণ্ডারূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়, হয় পশুবলি। সেই বলিকৃত পশুর স্মাংস-রুধি (মাংস ও রক্ত) এবং কারণ (মদ) প্রদান করা হয় দেবীর উদ্দেশ্যে। এককভাবে চামুণ্ডা, চণ্ডী বা কালী-পূজায় পশুবলি দেখা গেলেও বাংলাদেশের কোথাও দুর্গাপূজায় পশুবলি হয় না। শ্রীরামচন্দ্র সন্ধিপূজায় চামুণ্ডা দেবীকে আবাহন করে বললেন, যেভাবেই হোক, দেবী দুর্গাকে জাগাতে হবে। চামুণ্ডার সহযোগিতায় দেবী তখন জেগে উঠলেন নবমী তিথিতে। শ্রীরামচন্দ্র যোগিনীরাসহ দেবীকে পূজা করলেন। এবং, দেবীকে দর্শন করলেন কুমারীরূপে। সেই থেকে কুমারীরূপী দেবীপূজা শুরু। শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে একসঙ্গে একশ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দিলেন এবং দেবী নবমীর দিন কুমারীরূপে পূজিতা হলেন। মহাভারতে বর্নিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে দ্বারকা নগরীতে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডব পক্ষের অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন কুমারীরূপে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন। শ্বেতাশ্বর উপনিষদেও কুমারীপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থ থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমেও কুমারীপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।
আগেই উল্লেখ করেছি, স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারীপূজা করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্ৰমণকালে। শাস্ত্ররীতিতে ব্রাহ্মণ কন্যাকেই কুমারীপূজার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি সমস্ত রীতির উর্ধ্বে গিয়ে পূজা করেছেন মুসলমান কন্যাকে। তিনি জাতপাতের উর্ধ্বে দেবীদর্শন করেন। দেবীত্ব কেবল ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা দেবীত্ব ও মাতৃ্ত্ব কারুর একচেটিয়া সম্পদ নয়। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজির ধ্যানে ও দর্শনে তা স্বীকৃত। তাই তিনি মুসলমান কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন। কালের অতলে দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা হারিয়ে গেলেও ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কুমারীপূজা পুনরায় শুরু করেন। এর পেছনে স্বামীজির মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। তখনকার সমাজ নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিত না। যার কারণে সমাজে নারীর অবস্থান ছিল খুব দুর্বল। হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, চিরবিধবা-সহ নানা অবিচারে নারীরা ছিল নিপীড়িত। স্বামীজি অনুভব করেছিলেন, দেশ তথা জাতির উন্নতিকল্পে নারী-পুরুষ উভয়েরই অংশগ্রহণ করা একান্ত জরুরি। আর সেই কারণে নারী যাতে তার যথাযথ মর্যাদা পায়, তার জন্যই নারীকে পূজা করা। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরা সাধনপথের বাধা হিসেবে বিবেচনা করে নারীজাতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে নারীজাতির কথা চিন্তা করেছেন, কারণ যদি নারী এবং পুরুষ উভয়েই জীবনে সমানভাবে এগিয়ে না যায়, তবে দেশ বা জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুমারীপূজা একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া হলেও এটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বেলুড় মঠের প্রথম কুমারীপূজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয়জন কুমারীকে পূজা করেন। এখন বেলুড়মঠে একজনকেই পূজা করা হয়ে থাকে। এটাই শাস্ত্রীয় রীতি। স্বামীজির দিব্যদৃষ্টিতে সকল কুমারীই দেবীর একএকটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিরকুমার বিবেকানন্দ নারীকে দেবীর আসনে সম্মানিত করার জন্যেই হয়তো পুনঃপ্রচলন করেন। তবে এর আগেও কোথাও কোথাও কুমারীপূজা হত। ১৯০১ সালের পর থেকে প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণসাধনই কুমারীপূজার মূল লক্ষ্য। জগতের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও অশুভের ভেদাভেদ ভুলে মায়ের কৃপা ও তুষ্টি-লাভই মানব জীবনের মোক্ষ উদ্দেশ্য। স্বামীজি প্রতিটি কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। গড় হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে। এই নয়জন কন্যার মধ্যে একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা। তাঁর কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে বলেছিলেন, “আঃ! দেবীর বোধহয় তৃ্তীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।” তাঁর দৃষ্টি ঠিকই ছিল। আমাদের দুটো চোখ থাকলেও, তৃ্তীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃ্তীয় নয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি যেমন সেদিন ‘দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’, পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজির স্নেহধন্যা ছিলেন এই কন্যা। স্বামীজির কুমারীপূজায় যেন সত্যিসত্যিই তিনি দুর্গামারূপে পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেদিনের ‘দুর্গামা’ পরবর্তীকালে অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজির অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এই নয়জন কুমারীর মধ্যে দুর্গামা যেমন ছিলেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলাল দাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানীও ছিলেন। স্বামীজি এই পূজার মধ্য দিয়ে যেন একটা নূতন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সমস্ত নীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নূতন নীতি। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। ইদানীং যে দুর্গাপূজার সময় জীবন্ত কন্যাকে কুমারীরূপে পূজা করার প্রচলন, তা স্বামীজিরই আবিষ্কার এবং তিনিই এর প্রচারক। তবে অনেকে মনে করেন, দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে।
অন্য একটি ঘটনার মধ্যে আমরা তাঁকে পাই দিব্যভাবের পূজক হিসেবে। তিনি তখন উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে (সময়টা খুব সম্ভবত ১৯০০ সাল)। সেখানে তিনি এক প্রবাসী বাঙালির কুমারী মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল মণিকা। পরবর্তীকালে এই মণিকাদেবী হয়ে উঠেছিলেন যশস্বিনী সন্ন্যাসিনী। এ যেন স্বামীজির ঐ দিব্যবীজের বপন, যেন অনাঘ্রাত কুসুমকে দেবসেবায় উৎসর্গ করা। যথার্থই তাঁর দেবীদর্শন। কুমারীপূজায় উৎসর্গীকৃ্তা মণিকা যেন দেবীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা। এই মণিকাদেবী শেষজীবনে সন্ন্যাসিনী হয়ে যশোদামাঈ নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। এও স্বামীজির এক অনন্য আবিষ্কার। কুমারীপূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তি (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব)-র বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হয়ে চলেছে, সেই ত্রিশক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারীজাতির প্রতীক ও জগতের আদি বা বীজাবস্থা। তাই কুমারী নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপধারণ করে; পুজোর মূল থিম হচ্ছে: নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। এ ভাবনায় ভাবিত হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
তথ্যঋণ:
ইতিহাসের আলোকে রামায়ণ---সুধাময় দাস
ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ---অমলেশ ত্রিপাঠী
কালিকাপুরাণম্, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত
কুমারীপূজা---তারাপদ আচার্য
কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও বাংলার লোকঐতিহ্য---তনিমা চক্রবর্তী
দুর্গা রূপে রূপান্তরে---পূর্বা সেনগুপ্ত
দুর্গাপূজা ও কিছু কথা---সনজিৎ ঘোষ
পূজা-বিজ্ঞান---স্বামী প্রমেয়ানন্দ
পৌরাণিকা : বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম---অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
বঙ্গে শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা---শিবশংকর ঘোষ
বাংলায় পটের দুর্গা---দীপঙ্কর ঘোষ
বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব---বিনয় ঘোষ
বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা---বিনয় ঘোষ
বাল্মীকি রামায়ণ---রাজশেখর বসু অনূদিত
বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ---নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
বাল্মীকী রামায়ণ---ড. কানাইলাল রায়
মা দুর্গার কাঠামো---মহানামব্রত ব্রহ্মচারী
যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ---অলোককুমার সেন
রামায়ণ: কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
শ্রীশ্রীচণ্ডী, অনুবাদ ও সম্পাদনা: স্বামী জগদীশ্বরানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ নতুন তথ্য নতুন আলো---শঙ্করীপ্রসাদ বসু
এবং, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত নানান উৎস