জীবনের অমর সংগীত

ভালোবাসাহীন জীবন অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মিক ভালোবাসা, বস্তুগত ভালোবাসা, কিংবা শারীরিক ভালোবাসা—ভালোবাসার এমন ভেদাভেদ ভালোবাসা সম্পর্কে আমাদের বিবেচনাকে বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়। ভালোবাসার কোনো নাম হয় না, ভালোবাসা কোনো বিশেষ শ্রেণীতে পড়ে না, ভালোবাসাকে কোনো সর্বজন অনুমোদিত উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট পৃথিবীর অংশ নয়, ভালোবাসা নিজেই একটা পৃথিবী। হয় আমরা এর মধ্যে বাস করছি, নতুবা এর বাইরে আছি। এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই।

ভালোবাসা যখন হৃদয়কে আলোড়িত করে, আমাদের কথা ও কাজ স্রষ্টার নির্দেশিত পথ ধরে চলে, তখন সকল অহেতুক যুক্তি, জিত আর তর্কের অবসান ঘটে। নীরবতা ও ধৈর্যের মধ্য দিয়ে সেবা ও শান্তির অমর সংগীত রচিত হয়। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় না, ভালোবাসা প্রকাশ পেয়ে যায়ই। ভালোবাসার যে আরাধ্য ধন, তাকে নিজের করে পাবার স্বপ্নে মানুষ জীবনবাজি রেখে হাসিমুখে লড়তে পারে। যার হৃদয়ে ভালোবাসার শক্তি আছে, সে সকল কষ্ট ও পরীক্ষা হাসিমুখে উতরে যেতে পারে।

জীবনের সকল কষ্ট, সকল দুঃখ, সকল যন্ত্রণা, সকল ব্যথা, সকল বেদনার চাইতেও জীবন বড়। জীবনে নৈরাশ্য ও হতাশা আসবেই, তবে তা যেন আমাদের চলার পথকে রুদ্ধ করে না দেয়। যে-স্রষ্টা আমাদের জীবনের এতগুলি বছর আমাদের যত্নে রেখেছেন, ভালো রেখেছেন, তিনি সাময়িক কিছু সময়ের জন্য আমাদের কষ্টে রাখতেই পারেন। তার জন্য আমরা তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারি না, তাঁর প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারি না। বরং ওই কঠিন সময়ে তাঁর ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস আরও দৃঢ় করতে হবে। নিশ্চয়ই আমরা এখন যে-পথে আছি, সে পথ আমাদের জন্য অকল্যাণকর বলেই স্রষ্টা আমাদের সে পথের অসীম কষ্ট বোঝানোর মাধ্যমেই সে পথ থেকে আমাদের সরিয়ে আনতে চাইছেন।

আমাদের যা-কিছু আছে, তার জন্য আমরা স্রষ্টাকে যতটা ধন্যবাদ দিই, আমাদের যা-কিছু দেওয়া হয়নি, তার জন্যও স্রষ্টাকে সমানভাবে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, কারণ নিশ্চয়ই আমাদের চাওয়া বা প্রার্থনার মধ্যে কোনো এক অমঙ্গল লুকিয়ে ছিল। আমাদের সকল দুঃখ আর বিষাদের সর্বোত্তম প্রত্যুত্তর হলো নীরবতা। কঠিন সময় আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি বাড়ায় এবং আমাদের হৃদয়ের ক্ষত সারাতে শেখায়। আমরা আমাদের কল্পনার চাইতেও বেশি দৃঢ়তা নিয়ে বাঁচতে শিখি, আমাদের ব্যক্তিত্বের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়, যা আমাদের সহিষ্ণু করে, সংযমী করে, বিনীত হতে শেখায়। আমরা আমাদের ও আমাদের চারপাশের জগৎটাকে নতুনভাবে চিনতে শিখি।

বাজে অবস্থায় পড়লে মানুষ জীবনকে সবচাইতে কাছ থেকে চিনতে পারে। ভর্তি মানিব্যাগ, সৌভাগ্য কিংবা সুস্বাস্থ্য—এর কোনোটাই জীবনকে চেনাতে পারে না।

জীবনের অর্থ বোঝার প্রথম ধাপ হলো, নিজের ভেতর থেকে ইগোকে বের করে দিতে হবে। এটা করতে পারলে নিজেকে নির্ভার মনে হবে, নিজের অন্তরের আলোয় বিকশিত হয়ে নিজের ভেতরের ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যে একধরনের আশ্চর্য সংযোগ সৃষ্টি হবে। এতে করে আমরা ক্ষমতার নিকটবর্তী হই, আমাদের হৃদয়ের যে-স্থানে স্রষ্টার অবস্থান, আমরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে যাই, বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা যে-সিদ্ধান্তে আমাদের পৌঁছে দিতে চায়, আমরা যদি তাতে বিচলিত না হয়ে আমাদের হৃদয়ের ইশারায় চলি, তবে যা-কিছু আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, তা-ই আমাদের জীবনে আসে। আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন কী ঘটে? আমাদের হৃৎকম্পন, আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, আমাদের সমস্ত অনুভূতি একসাথে মিলেমিশে স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। প্রার্থনার শক্তি মানুষের নিয়তিকেও বদলে দিতে পারে। প্রার্থনা হলো নিজের বিশ্বাস ও আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তোলার জাদু।
Content Protection by DMCA.com