জীবনকে বোঝা

মরুভূমির এক ছোটো আশ্রমে মওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কাজ করছিলেন। ওইসময় ওই পথ দিয়ে কিছু মুসাফির হেঁটে যাচ্ছিল। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তারা হাঁটা থামিয়ে আশ্রমের ভেতরে গিয়ে দেখলেন, আশ্রমপ্রাঙ্গণে শিষ্যরা আর ছাত্ররা বসে আছে, আর মওলানা সাহেব তাদের কথার উত্তর দিচ্ছেন। প্রশ্ন আর উত্তর দুই-ই ছিল অদ্ভুত ধরনের। এটা দেখে মুসাফিররা বিরক্ত হয়ে ওই স্থান ত্যাগ করে নিজেদের পথে চলে গেল।

কয়েক বছর ভ্রমণ শেষে সেই মুসাফিরের দল আবারও ফিরে এল, এবং আগের বারের মতো ওখানটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, ওখানে কী হচ্ছে। এবার তারা দেখল, সেখানে শুধু মওলানা রুমি একা বসে আছেন, তাঁর শিষ্যরা নেই। অবাক হয়ে ওরা ভাবল, কী হলো! ওরা সবাই কোথায়? “কী হয়েছে?” ওরা জিজ্ঞেস করল। মওলানা হেসে বললেন, “এটাই ছিল আমার কাজ। ওদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল, আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এখন তাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। তাই আমি ওদের বলেছি, যাও, আমি যা করেছি, তোমরাও ফিরে গিয়ে অন্যদের সাথে এই কাজটাই করো। যদি এমন কাউকে পাও, যার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছ না, তবে ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।”

আমাদের মনে যত বেশি প্রশ্ন থাকবে, আমাদের মন তত বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকবে, আর সঠিক পথ থেকে আমরা তত বেশি দূরে সরে যাব। যখন সব প্রশ্ন মন থেকে দূর হয়ে যায়, তখন আমাদের মন সেই শৈশবে ফিরে যায়, যে-সময়ে আমরা ছিলাম নিষ্পাপ, আমাদের মনে কোনো কদর্য ভাবনা ছিল না, পৃথিবীর কোনো কিছুতেই মন অশান্ত হতো না। চঞ্চল মনকে সাথে নিয়ে কোনো মহৎ যাত্রা শুরু করা যায় না। নীরবতার শপথ নিয়ে আমরা আমাদের জিভকে স্থির করে ফেলতে পারলে, ভাবনার নিরবধি শান্তধারায় অবগাহন করলে, কোনো কিছু উচ্চারণ না করেই সবচাইতে সুন্দর কথাটিও বলে দেওয়া যায়, সবচাইতে আশ্চর্য প্রচ্ছন্ন সত্যটিও প্রকাশ করে ফেলা যায়। এই নীরবতাই উত্তর। এ উত্তরে কোনো কথা থাকে না, এ উত্তর নির্দিষ্ট কোনো প্রশ্নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও নয়। নীরবতা এমন এক অবস্থায় আমাদের নিয়ে যায়, যখন কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়।

প্রাত্যাহিক জীবনে আমাদের অজস্র ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এসব ঝামেলার অনেকগুলিই এমন, যার শুরু বা শেষ কোনোটাতেই আমাদের কোনো হাত নেই। সেগুলি আমাদের হতবুদ্ধি ও অসহায় করে দেয়। তখন একমাত্র নীরবতাই আমাদের সাহায্য করতে পারে। ঝড় থামার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ অপেক্ষা সহজ নয়, তবে এটা করা ছাড়া তো আর অন্যকিছু করারও থাকে না।

প্রত্যেক ধর্মদর্শনের সারকথাই হলো, জীবনকে বোঝা। এই বোঝার কাজটা কোলাহলে করা যায় না, বিস্রস্ত হৃদয়ে প্রকৃত উপলব্ধি আসে না। আমাদের কথা যদি হয় নদীর মতো খরস্রোতা, তবে আমাদের নীরবতা সমুদ্রের মতোই গভীর। কথা হচ্ছে বন্দুকের গুলির মতো। গুলি বেরিয়ে গেলে বন্দুকের আর কী দাম থাকে? যে গুলি এখনও ছোড়া হয়নি, তার শক্তি ও প্রভাব দুই-ই বেশি। যে-তীরন্দাজ তার তীরটা এখনও ছোঁড়েনি, সাথে রেখে দিয়েছে, সে কি বেশি বিপদজনক নয়? তার শক্তি তার নিজের কাছেই আছে, যা সে যে-কোনো সময়ই ব্যবহার করতে পারে। যে-কথাটি এখনও বলা হয়নি, সে কথা যতটা শক্তি ধারণ করে, তার চাইতে অনেক বেশি অর্থ ও অনর্থ প্রকাশ করে। যার হৃদয়ে এ কথাটি লুকিয়ে আছে, ঠোঁট পর্যন্ত আসেনি, সে ব্যক্তি ওই কথার সম্ভাব্য বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত, এবং লোকে তার এই রহস্যময় নীরবতার বিভিন্ন অর্থ বা অনর্থ নিজেদের মতো করে বের করে, তবে সে অর্থ বা অনর্থে কথার অধীশ্বরের কোনো দায় থাকে না।

কথা বলে ফেলার লোভ সামলানো সত্যিই খুব কঠিন, তবে এ কাজটি যারা করতে পারেন, তারা অপেক্ষাকৃত অধিক ক্ষমতা ও স্বস্তি উপভোগ করেন।
Content Protection by DMCA.com