ক্রিয়া কোয়েরভো (১৯৭৬)

একটা স্প্যানিশ প্রবাদ আছে: Cría cuervos y te sacarán los ojos, তর্জমা করলে দাঁড়ায়: একটা দাঁড়কাকের ছানাকে আদর করে বড়ো করো, তবু দেখবে, বড়ো হয়ে সে ঠিকই ঠুকরেঠুকরে তোমারই চোখ উপড়ে ফেলবে।

আপনি একজন ভাল মানুষ, আপনি লোকের উপকার করেন, কারো কোনো ক্ষতি করেন না। এর মানে কী? আপনি কখনো বিপদে পড়বেন না? এরকম কিছু? না, ভুল হল। আপনিই বিপদে পড়বেন। সবার আগে। আপনাকে বিপদে ফেলার পেছনে সবচাইতে বড়ো ভূমিকা রাখবে সেই ব্যক্তিটি, আপনি যার উপকার করেছেন। আরও মজার ব্যাপার শুনবেন? আপনার ক্ষতি করার সময় সে সেই বুদ্ধিটাই কাজে লাগাবে, যার উল্টো বুদ্ধিটা আপনিই তাকে দিয়েছিলেন, যাতে সে কখনো বিপদে না পড়ে। বাবা-মা সন্তানকে কত যত্ন করে, আদর করে বড়ো করে। আর সেই সন্তানই যখন বাবা-মা’র ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তখন? এমন-কী যদি খুনই করে ফেলে কিংবা করার চেষ্টা করে? এই লেখার প্রথম লাইনের প্রবাদের প্রথম দুটো শব্দ দিয়ে একটা মুভি আছে: ক্রিয়া কোয়েরভো, বানিয়েছেন স্প্যানিশ নির্মাতা কার্লোস সাউরা, ১৯৭৬ সালে। ভাল কথা, ছবির নামের ইংরেজি অর্থ: রেইজ র‍্যাভেনস (দাঁড়কাককে বড়ো করো)।

আনা, বয়স ৮। নির্বিকার ও শান্ত স্বভাবের। মাঝরাতে ঘুমভেঙে তার বাবার রুমের সামনে গেলো। বাবা কোনো এক মেয়েকে নিবিড় আবেগে ভালোবাসার কথা বলছে। একটু পর রুম থেকে দ্রুতপায়ে বাবার প্রণয়িনী বেরিয়ে এলো, বিস্রস্ত এবং অর্ধনগ্ন। স্ক্যান্ডাল এড়াতে সে সেখান থেকে অনেকটা পালিয়ে বাঁচল। আনা বাবার রুমে গিয়ে দেখল, বাবা মৃত। তার চোখমুখ অবিচলিত, স্বাভাবিক। বিছানার পাশ থেকে খালি গ্লাসটা নিলো, রান্নাঘরে গিয়ে সেটা ধুয়ে রাখল। সেক্স অ্যান্ড ডেথ! সেক্স, ঠিক আছে। কিন্তু ডেথ কেন?

আনার বাবা সেনাবাহিনীতে কাজ করতো। তারই এক কলিগের স্ত্রী আগের রাতে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। মৃতদেহের প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে স্বামীর সাথে সেও এসেছে। অন্যান্য কলিগরাও আছে। আনার দুইবোন ওদের খালা পলিনার কথামতো মৃত বাবার কপালে চুমু খেলো। এটা একটা সামাজিক রীতি। আনা খেলো না। কিছুতেই ওকে চুমু খেতে রাজি করানো গেলো না। সে দাদীর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মৃত বাবার কপালে চুমু খেতে আনার কী সমস্যা?

আনা বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ব। তার চারপাশে কী ঘটছে, কেন ঘটছে, তার অনেককিছুই সে বুঝতে পারে। কিন্তু মুখে সে কিছুই বলে না। চুপচাপ দেখে যায়। তার দৃষ্টি শীতল, নিঃস্পৃহ। তার মা তাকে একটা কৌটা দেখিয়ে বলেছিল, সে কৌটায় পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ংকর বিষ রাখা আছে। সেই কৌটা সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। খুব যত্নে। তিনবোনের মধ্যে সে মেজো। বড়োবোনের নাম আইরিন, ছোটবোন মাইতি। মায়ের সাথে তার প্রায়ই দেখা হয়, আনা যখন ফ্রিজ খুলে তার আদরের খরগোশের জন্য বাঁধাকপি নেয়, যে খরগোশটির মৃত্যুর পর সেটিকে সে অনেক যত্ন করে কবর দেয়, তখনও মা এসে বলে, এতো রাত হয়েছে, এখনো ঘুমাসনি কেন? যদিও মা মারা গেছে অনেকদিন হল। আনা বিশ্বাস করে, মাকে বাবা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। এমনও হতে পারে, অযত্নে, অবহেলায় দীর্ঘদিন ধরে অসুখে আর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেভুগে মা মারা গেছে। তাহলে কীভাবে দেখা হয়?

বাবার মৃত্যুর পর আনা যখন রান্নাঘরে গ্লাস ধুতে গেলো, তখন মা এসেছিলো। আনা বাবার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। সে বিষেই কি বাবা মারা গেছে? যদি তা-ই হবে, তবে তাদের খালা পলিনা যখন এক সেনা কর্মকর্তাকে সোফায় বসে চুমু খাচ্ছিল, তখন সে হঠাৎ পিস্তলহাতে রুমে ঢুকে পড়ে, অবৈধ প্রণয় দেখে ফেলার অপরাধে আনা খালার কাছ থেকে চড় খায়, এরপর একই বিষ খালার দুধের গ্লাসে মেশানোর পরও খালা বেঁচে রইল কীকরে? আনা যেটাকে বিষ বলে বিশ্বাস করতো, ওটা কি আদৌ বিষ ছিল? তবে কি বাবার মৃত্যুর পেছনে সেই বিবাহিতা মহিলার কোনো হাত আছে? নাকি বাবা সত্যিই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে? অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে চুল আঁচড়ানোর সময়ও মা এসেছিলো। মা সবসময় আসে না কেন? মা কি সত্যিই মারা গেছে? আনার অবচেতন মন মাকে কল্পনা করে বলেই আনা মাকে দেখতে পায়? তবে কি যা ঘটছে, তার সবকিছুই আনার মনের মধ্যেই ঘটছে?

আনা বড়ো হল। সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তার অতীত জীবনের গল্প বলছে। আনার মা পরিবারের জন্য অনেক করেছে। বিয়ের আগে মা অসাধারণ পিয়ানো বাজাতো, চর্চা চালিয়ে গেলে হয়তো বিখ্যাত পিয়ানোবাদক হতে পারত, অথচ মেয়েদের জন্য সবকিছু ছেড়ে সংসারেই মন দিয়েছে। এর বিনিময়ে আনার বাবা মাকে কষ্ট ছাড়া আর কী দিয়েছে? আনা দেখতে অবিকল তার মায়ের মতো। মায়ের মতোই তার জীবনেও অনেক দুঃখ। মায়ের সব দুঃখ সে যেন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। বাবার কাছ থেকে সে পেয়েছে একটা পিস্তল। ওটা দিয়ে মানুষ খুন করা যায়। জীবনে সে আর কিছু পায়নি।

আনা এবং তার দুইবোন খালার বাসায় থাকে। সে বাসায় ওদের শৈশব কাটে। একাকীত্ব আর বিষাদ তাদের সবসময়ের সঙ্গী। তবু সেখানেও কিছু আনন্দ আছে। তিনবোন মিলে অনেক মজা করে, খালার ড্রেসিংটেবিল থেকে নিয়ে ইচ্ছেমত কসমেটিক্স মাখে, পরচুলা পরে। আইরিন বাবা সাজে, আনা মা সাজে, মাইতি ওদের মেয়ে সাজে। ওদের খেলায় বাবা পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত। এটা নিয়ে মা সন্দেহ করে। ওদের মধ্যে খুব কথা কাটাকাটি হয়। মেয়েটা কিছু না বলে চুপচাপ বাবা-মায়ের শোনে। এরকমই কিছু ওরা ছোটবেলা থেকে দেখেদেখে বড়ো হয়েছে। ওরা লুকোচুরি খেলে। যে ধরা পড়ে যাবে, তাকে মিথ্যামিথ্যা মরে যেতে হবে। এটাই খেলা। ওরা তিনজন মিলে সেসময়ের খুব জনপ্রিয় একটা গান ছেড়ে নাচতে থাকে। সকালে বিছানা ছেড়ে স্কুলে যেতে বললে দুইবোন চাদরের মধ্যে ঢুকে পড়ে মজা করে। আনা ওদের দাদিমাকে অনেক সময় দেয়। দাদিমা হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, একটা হুইলচেয়ারে সারাদিন বসে থাকে আর একটা বোর্ডে আটকানো কিছু কোলাজকরা ফ্যামিলি পিকচার দেখে, গান শুনে পুরনো স্মৃতি মনে করে হাসে। আনা দাদিমাকে নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট চালায়। সে একজন বৃদ্ধার মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করে। ওদের অনেক আনন্দ। কিন্তু সে আনন্দ বিষাদে ঘেরা। কীসের বিষাদ?

সিনেমায় আনা কখনো হাসে না। তার চোখ স্থির, মুখ ভাবলেশহীন। এক ধরনের চাপা ক্রোধ তাকে সবসময়ই ছেয়ে আছে। তাকে দেখতে অদ্ভুত রকমের ধীর মনে হয়। সে খুব ঠাণ্ডা মাথায় মানুষখুনও করে ফেলতে পারে। তার চরিত্রে রহস্য আছে, তার ব্যক্তিত্বে গভীরতা আছে। সে রহস্য আর গভীরতা ভেদ করা দুঃসাধ্য! সে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে, তার চোখজোড়া কখনো পড়া যায় না। তাকে দেখে কেউই বুঝবে না, সে কি ওই মুহূর্তে কোনো খুনের প্ল্যান করছে, নাকি তার সন্তানতুল্য আদরের পুতুলের কথা ভাবছে। সে কিছুটা সহজভাবে কথা বলে কেবল একজনের সাথে। তার নাম রোসা। সে ওই বাসায় কাজ করে। ওদের খালা সকালে বেরিয়ে পড়লে, রোসাই ওদের দেখাশোনা করে। রোসা আন্তরিক, চমৎকার। আনার শৈশব আর দশটা মেয়ের শৈশবের মতো নয়। তাকে জীবনের অনেক কদর্য রূপ দেখেদেখে বড়ো হতে হয়েছে। সেখানে তার কোনো হাত ছিল না। তার মধ্যে কোনো ধরনের দয়া, মায়া, মমতা কাজ করে না। সে তাদের মাকে বাবার স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের কারণে অসীম মানসিক যন্ত্রণাভোগ করতে দেখেছে। স্ত্রীর এমন কষ্টের জন্য আনার বাবার মনে কোনো অনুতাপ ছিল না।

শেষ দৃশ্যে তিনবোন মিলে স্কুলে যাচ্ছে। ওরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডটা পেরিয়ে ওরা স্কুলের দিকে হাঁটছে। নতুন বছর, নতুন স্কুল, নতুন স্বপ্ন। সকল বেদনা আর মৃত্যু ভুলে ওরা নতুন করে জীবন শুরু করছে। “সবই মিথ্যা! আমার জীবনে সুন্দর কিছুই নেই। একেবারে কিছুই নেই! ওরা আমাকে মিথ্যে বলেছে।”—আনার স্বগতোক্তি, প্রকারান্তরে তিনবোনেরই। ওরা মিথ্যের পৃথিবী ছেড়ে সত্যের পৃথিবীর দিকে হাঁটছে। সিনেমার নাম ‘ক্রিয়া কোয়েরভো’ কেন? আনা নিজের মধ্যেই একটা অচেনা পৃথিবীতে বাস করে, সেই পৃথিবীর কী এক ইশারায় সে বাবাকে খুন করতে চায়, মায়ের দেয়া রহস্যময় ‘বিষের কৌটা’ যেন তাকে নিজের ভয়ংকর সব ইচ্ছে পূরণ করার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে, সেই ‘বিষ’ খাইয়ে যে খালা ওদের দেখাশোনা করছে, ওকে এতো আদর করে, তাকেও সে খুন করতে চায়। একটা শিশুর নিষ্পাপ মনে এমন নিষ্ঠুরতার ছক আসার কথা নয়, অথচ সিনেমায় তা-ই হয়েছে। একটা ভয়াবহ অসুস্থ শৈশব ওদের যে নষ্ট নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে, শেষ দৃশ্য নিয়ে ভাবলে মনে হয়, সেখান থেকে ওরা বেরিয়ে আসতে চায়।