কোথা থেকে যেন নাদুসনুদুস তুলতুলে খুব আদুরে ছোট্ট একটা ছাগলছানা নিয়ে হাসতে হাসতে মা আমার দিকে এল। আমি খুশিতে একলাফ দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলাম। পরিবারের নতুন সদস্যটা তখন তিড়িংবিড়িং করে নাচছিল। আহা, কী যে আদর লাগছিল ওকে দেখে! এদিকে ভীষণ দুষ্টু আমি নতুন সঙ্গী পেয়ে খুশিতে আত্মহারা! পাশের পাড়া থেকে মা এই বাচ্চাটিকে কিনে এনেছে পালবে বলে। আমাদের জীবনে নতুন একটি অনুষঙ্গ যোগ হলো। আমি ওর নাম দিলাম মিন্টু। বাড়িতে যখন মিন্টুকে আনা হলো, তখন ওর বয়স মাত্র তিন কি চার মাস। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাদের মিন্টু পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই বেশ মিশে গেল আমাদের সাথে। মিশমিশে কালো ওর সারাগায়ের রং। কপালের ঠিক মাঝ বরাবর লম্বাটে সাদা ফুটকির মতো দাগ। সেই সাদা জায়গায় কখনও কখনও আমি টিপ পরিয়ে দিতাম মিন্টুকে। তা দেখে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ত। মিন্টু আমাদের সাথেই বড়ো হতে লাগল। বেড়াল সাইজের মিন্টুর শরীরটা ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিল। দিনের বেলায় ওকে পাশের বিলে চড়িয়ে আসতাম, আর সন্ধে নামলেই মিন্টু ঘরের বারান্দায় দুষ্টুমি করত। দিন যত যাচ্ছিল, মিন্টুর দুষ্টুমিও তত বাড়ছিল। বাড়ছিল একধরনের তীব্র মায়াও। মিন্টু এখন আর রাতের বেলায় একা ঘুমাতে চায় না। আমাদের সাথে ঘুমানোর মৌনী আবদারটা জুড়ে দেয়। মশারি টাঙালে সে লাফিয়ে লাফিয়ে মশারির উপর উঠে যায়, কখনওবা কাঁথার ভেতর শুয়ে-থাকা কারও কাঁথার ভেতরে টুক করে ঢুকে পড়ে বুঝদার মানুষের মতো মাথাটাকে তার বুকের মধ্যে গুটিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত। আমরা ভাত খেতে গেলে মিন্টুও পাশে বসে থাকত বাধ্য শিশুটির মতো। অন্যদের মতো তার জন্যও পাতে ভাত বাড়া হতো। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো তার পাতেও থাকা লাগত ভাতের সাথে তরকারির আইটেম। প্লেট থেকে ভাত-খাওয়া শেষ হবার পরও সে অন্যদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাটিতে বসেই থাকত। তার মধ্যে এরকম কিছু সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। খাওয়া শেষে মিন্টু আর আমি পুকুরপাড়ে চলে যেতাম খেলতে। সে ঘাস বা কাঁঠালপাতা খাবার জন্য এদিক ওদিক গেলেও আমার আশেপাশেই থাকত। আবার মিন্টুর যেন কষ্ট না হয়, তার জন্য যেখানেই খেলতে যেতাম, সেখানেই মিন্টুর জন্য একডাল কাঁঠালপাতা হাতে বা কাঁধে নিয়ে নিয়েই ঘুরতাম। এটা নিয়ে পাড়ার বন্ধুমহলে আমাকে নিয়ে বেশ হাসিতামাশা চলত। আমি ওসব তেমন পাত্তা দিতাম না। বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলা খেলতে গেলে আমি খুব সহজেই ধরা পড়ে যেতাম। কারণ আমি যেখানেই লুকোতে যেতাম, মিন্টু আমার পিছু পিছু সেখানেই চলে যেত। মিন্টুকে দেখে সবাই ঠিকই বুঝে যেত যে আমি মিন্টুর খুব আশেপাশেই আছি। বন্ধুদের কারও সাথে আমার ঝগড়া হলে আমাকে আঘাত করার প্রধান অস্ত্র ছিল মিন্টু। আমার সাথে পেরে উঠতে না পারলে আমার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য ওরা মিন্টুকে চড়থাপ্পড় মেরে দৌড়ে পালাত। কেউ আমাকে মেরে তক্তা বানালেও আমি তেমন একটা তার গায়ে হাত তুলতাম না, কিন্তু যখনই মিন্টুকে কেউ চড়থাপ্পড় মারত, তখনই আমি ওর পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে যেখানেই পেতাম, সেখানেই ওকে মেরে তক্তা বানিয়ে তবেই শান্ত হতাম। আর আমি ওকে ধরতে যতক্ষণই দৌড়াতাম, ততক্ষণ মিন্টুও আমার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকত। রাত নামলে মিন্টু আমাদের সাথেই ঘুমাত। কখনও খাটে, কখনওবা মাটিতে বিছানো পাটিতে। তবে মিন্টু বড়ো হয়ে যাবার পর শুধু আমার সাথেই ঘুমাত। ওকে বুকের ভেতর চেপে ধরে আমি টুক করে ঘুমিয়ে পড়তাম। তবে মিন্টু কখনওই বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করত না। সে উঠোনে গিয়েই বাধ্য ছেলের মতো মলমূত্র ত্যাগ করে আসত। চা-খোর পরিবারে থাকতে থাকতে মিন্টুও হয়ে উঠেছিল বেশ চা-খোর। সকালে উঠেই আমাদের সাথে একসাথে বসে চা খেত। ওর জন্য আলাদা তরকারির বাটিতে চা দেয়া হতো, আর মিন্টু কীরকম জানি সুরুৎ সুরুৎ শব্দ করে করে চা খেত। মিন্টুকে আমরা কখনও গলায় রশি পরাইনি। দরকারই পড়েনি কখনও। সে যেখানেই যেত, বাড়িতে ঠিকই চলে আসত। কখনওই ওকে খুঁজতে বেরোতে হয়নি। এভাবে চলতে চলতে মিন্টুর বয়স সাত বছর হয়ে গেল। একদিন ভাইয়ার হঠাৎ প্রচণ্ড অসুখ। এমনিতেই অনেক অভাবের সংসার আমাদের। তার উপর ভাইয়ার এমন বড়ো অসুখ। ডাক্তার-দেখানো, ওষুধপত্র-কেনা সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। ওদিকে তিন দিন পরেই কুরবানির ইদ। হঠাৎ করেই মা সিদ্ধান্ত নিল, এই ইদে মিন্টুকে বিক্রি করে দেবে। পাড়ার একজনের সাথে মা পাঁচ হাজার টাকায় দরদামও ঠিক করে ফেলেছে। সেদিন সকালবেলা। আমি ঘুম ভেঙেই দেখি, পাশে মিন্টু নেই। সারাঘরের কোথাও মিন্টু নেই। আমি পাগলের মতো দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। দেখি, পুকুরপাড়ে মা মিন্টুকে এক লোকের কাছে দিয়ে দিচ্ছে। মিন্টুর গলায় রশি। এই প্রথম মিন্টুর গলায় রশি দেখলাম। মা রশিটা ধরে মিন্টুকে লোকটার হাতে দিয়ে দিল। তার বদলে লোকটা পকেট থেকে গুনে গুনে দশটা পাঁচশো টাকার নোট মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল। দেখলাম, হাতে টাকাগুলো ধরে মা মিন্টুর দিকে ঠায় চেয়ে আছে। ঠোঁট দুটো দাঁতে কামড়ে ধরে মা কান্না গিলতে চাইছে কোনওমতে, কিন্তু পারছে না। মা তখন হয়তো ভাবছিল, এক সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচাতে আরেক সন্তানকে তুলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে। মায়ের চোখ বেয়ে দরদর করে জল ঝরছে। মা এবার নিচু হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে মিন্টুর গলা জড়িয়ে ধরে ছোটোবাচ্চার মতো হাউমাউ করে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। মিন্টু আসল ঘটনার কিছুই আঁচ করতে পারছে না। আমি স্পষ্ট দেখেছি, মায়ের হু হু কান্নার শব্দে বিচলিত হয়ে মাকে শান্ত করতে মিন্টু মায়ের বুকে আরও চেপে ছিল। মায়ের কষ্ট কোন সন্তানটা সহ্য করতে পারে! মা উঠে দাঁড়াল। ওদিকে লোকটা রশি ধরে মিন্টুকে টানছে, আর মিন্টু মায়ের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে চেয়ে ম্যা ম্যা করে জোরে চিৎকার করছেই তো করছে। দেখলাম, সে রশির বিপরীতে ছুটে আসতে চাইছে প্রাণপণে। আমি এসব দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে মিন্টুকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লোকটার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। মিন্টুও আমাকে দেখে তার চিৎকার আরও বাড়িয়ে দিয়ে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল, কিন্তু লোকটার রশির টানের কারণে আমার মিন্টু ঠিক পেরে উঠল না। এদিকে আমি পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছি, আর শক্তির সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মিন্টুকে ছাড়াতে চাইছি। আমার এমন পাগলামো দেখে মা আর আমাদের এক চাচা, দুজন আমার দুহাত ধরে আমাকে মিন্টুর কাছ থেকে টানতে টানতে ছাড়িয়ে নিল। আর আমি আমার দুইটা পা যত জোরে আছড়ানো যায়, তত জোরে আছড়িয়ে মিন্টুর দিকে এগুতে চাইছি, ওদিকে মিন্টুও রশির বিরুদ্ধে তার সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসতে চাইছে। একদিকে আমার হাত-পা ধরে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে চাইছে চার-পাঁচজন, অন্যদিকে মিন্টুকে রশি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে দুজন। আমরা দুজনই দুজনের কাছে ফিরতে চাইছি প্রাণপণে, কিন্তু পৃথিবী আমাদের দুজনকেই বিপরীত দুইটি দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে একসময় মিন্টু অদৃশ্য হয়ে গেল। এ যেন পুরো একজন্মের বাঁধনছেঁড়ার অসীম কষ্ট! তার পিঠে টপটপ করে ঝরেপড়া আমার চোখের জল সূর্যের আলোয় হয়তো চিকচিক করছে এখনও। যেতে যেতে মিন্টুর চোখ বেয়ে টুপটুপ করে ঝরে-পড়া জলের কয়েক ফোঁটা পুকুরপাড়টার ওই মেঠো পথে শুকিয়ে গেল, কান্নার সে দাগ আর কেউই দেখতে পায়নি। সেবার কুরবানির দিন। জানলায় মাথা রেখে উদাস হয়ে আমি শুধুই মিন্টুর কথা ভাবছি। কত স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে! বাড়িতে মিন্টু নেই, এটা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছি না। খানিক বাদে কারা যেন আমাদের বাড়িতে মাংস দিয়ে গেছে। মা মাংসগুলো হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমি উঠে মায়ের কাছে গেলাম। দেখলাম, মায়ের ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখ দুটো জলে টলটল করছে। আমি মাংসের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, ও মা, ওরা কি তবে আমার মিন্টুকে…?’ না, আমি আর কথা বলতে পারলাম না। আমার গলায় দলা দলা কান্না পাকিয়ে জমে আসছিল। আমি ওখান থেকে দৌড়ে মিন্টুর বিছানায় গিয়ে ধপাস করে পড়ে উপুড় হয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় হাউমাউ করে অবিরল ধারায় কাঁদছি, আর মিন্টু মিন্টু ডেকে বিলাপ করছি। মা আঁচলে মুখ লুকাতে লুকাতে রান্নাঘরের নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখল। মিন্টুকে বিক্রি করার পর থেকে আমি ঘর থেকে আর তেমন একটা বের হই না। বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে লাগলাম। যেখানেই যাই, যেদিকেই তাকাই, সবদিকে শুধু মিন্টুকেই দেখতে পাই, ওর ডাকটা যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। দীর্ঘ সাত বছরের অভ্যস্ততা। আমার সাত বছরের নিবিড় ভালোবাসা মিন্টু। আমার শৈশবের প্রতি পাতায় পাতায় মিন্টুর স্পষ্ট জলছাপ আঁকা। ভুলে-যাওয়া এত সহজ নাকি? সবার কাছে মিন্টু একটা পশু হলেও আমার কাছে সে আমার অস্তিত্বেরই একটা টুকরো, স্নেহ আর মমতার একচ্ছত্র বাঁধন, আমার সাত সাতটি বছরের জমাটবাঁধা শৈশব। মিন্টু যে বিছানায় আমার সাথে ঘুমাত, সে বিছানায় আমি সারা দিন-রাত শুয়ে থাকতাম। রাত হলেই মনে হতো, এই বুঝি মিন্টু আমার বুকের ভেতর মাথা গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে টুক করে চলে আসবে। যখনই উঠোনে বের হতাম, তখনই আমি পুকুরপাড়ে বিচলিত দৃষ্টিতে ঠায় তাকিয়ে থাকতাম মিন্টুর চলে যাবার পথের দিকে। বার বারই মনে হতো, এই বুঝি মিন্টু তিড়িংবিড়িং করে দৌড়ে এসে আমার কোলে মাথা রেখে গা এলিয়ে দেবে। চা খেতে গেলে মিন্টুর চায়ের বাটিটার দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি। মনে হতো, এই বুঝি মিন্টুও মুখ লাগিয়ে সুরুত সুরুত শব্দে চা খাবে। এই বুঝি আমার মিন্টু আমি যেখানেই যাই, সেখানেই নাচতে নাচতে আমার পিছু পিছু চলে যাবে। এই বুঝি মিন্টু বলে ডাকতেই মিন্টু মুখ তুলে আগের মতোই আমার ঘাড়ে, গালে, কপালে সবখানে চুমু খাবে। আমি এদিক ওদিক, এখানে ওখানে, দৃশ্যে কিবা অদৃশ্যে সবখানে মিন্টুকে হাতড়ে বেড়াই। না, মিন্টু আর ফেরেনি। আমার সন্তানসম মিন্টু আর কোনও দিনই ফিরে আসেনি। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। মাকে আর কখনও ছাগল পালন করতে দেখিনি। আমিও অত মমতা দিয়ে কাউকে আর কখনও ভালোবাসিনি। কোথাও ছাগল দেখলেই মা ধীরে ধীরে কাছে ঘেঁষে ওর মুখে পিঠে হাত বোলায়, চুমু খায়। হয়তো মা এখনও মিন্টুর ছায়া খুঁজে বেড়ায়। কুরবানি দেবার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তবু মনে হয়, সবচেয়ে বড়ো কুরবানিটা তো তারাই দেয়, যারা আমার মতো সন্তানস্নেহে পেলেপুষে বড়ো-করা বড়ো আদরের ধনটাকে অন্যের হাতে তুলে দেয় স্রেফ টাকার অভাবে। মিন্টু চলে যাবার পর আমি টানা তিন-চার দিন উঠোনে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছিলাম। সময় সময়ের নিয়মেই গড়িয়ে যায়। মিন্টুকে আজও ভুলতে পারি না, কুরবানির দিনে সারাদিনই বিষণ্ণতা ভর করে থাকে শরীরে মনে। কালকে বাসার পাশে কারা জানি তিন-চারটা ছাগল এনেছিল। সারাসন্ধ্যা ওরা চিৎকার করে করে কেঁদেছে। ওই ছাগলগুলো দেখে আমি প্রায় তিন ঘণ্টা কেঁদেছি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আহারে মায়া! তবে এটা ঠিক, আবেগটা আগের মতো আর নেই, অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। যা-কিছু হারিয়ে যাবে নিশ্চিতভাবেই, তা হারানোর আগের আবেগটা, হারিয়ে ফেলবার পরের আবেগের চাইতে শতগুণ প্রখর হয়।