এ সকল ঈশ্বরনির্দিষ্ট সীমা ভাঙার প্রয়োজন হয় না, বরং এ সকল সীমা অবলম্বন করলে আনন্দের পথে সহজে অগ্রসর হওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কালের যে দুটো সীমার কথা বলেছি, তার মধ্যে প্রথমটার ফলে একাগ্রতা, মনোযোগ এবং ঈশ্বরে একনিষ্ঠা প্রভৃতি পাওয়া যায়। ভগবান এমনই নিয়ম করে দিয়েছেন যে, তাঁর নির্ধারিত সীমা ঠিক ঠিক অনুসরণ করলে সেই সীমা ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে এবং আমাদেরকে মুক্তির আস্বাদ দিতে দিতে ক্রমেই তাঁরই মুক্তপথের পথিক করে দেয়। সূর্য যখন নিজের উত্তাপে বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন সেই উত্তাপের ফলে সূর্যের ভেতর থেকে কিছুটা জিনিস বাইরে বেরিয়ে মেঘের সৃষ্টি করে এবং সেই মেঘ থেকে জল পড়ে সূর্যের উপরিভাগ কিছুটা ঠান্ডা করে।
একইভাবে, ক্রমাগত বেশি জ্ঞানলাভের ইচ্ছা প্রভৃতি ঈশ্বরপ্রদত্ত সীমার অনুসরণ করতে করতে যখন সেই সীমা ভেঙে তাঁর কাছে যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে এবং সীমাতে বাধা পেয়ে মানুষ ক্ষণিকের নিরানন্দে মুহ্যমান হতে চায়, তখন আমাদের হৃদয় থেকে একধরনের তেজ বেরিয়ে ঈশ্বরের অসীম ভাবের দিকে ছুটে যায়। ভগবানও তখন নিজের করুণা বর্ষণ করে সেই আগেকার সীমা করুণাস্রাতে ভাসিয়ে দিয়ে আমাদের বিচরণক্ষেত্র বিস্তৃত করে দেন এবং নিরানন্দ দূর করে হৃদয়কে এক অপূর্ব আনন্দসাগরে শীতল করেন।
সংসারে আমরা যে সচরাচর বিভিন্ন ভাবকে দুঃখকষ্ট বা নিরানন্দ বলি, তার কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বা স্বরচিত সীমার সঙ্কীর্ণতা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সীমার একটা উদাহরণ দিই। ধরো, কোনো লোক বাপ-মা'য়ের দোষে পেটুক হয়েছে। আহার বিষয়ে ঈশ্বরনির্দিষ্ট সীমা এই যে, খিদের সময় আহার করলে শরীরে স্বাস্থ্য আসে, মনে ফুর্তি হয় এবং একটা আনন্দের ভাব পাওয়া যায়। কিন্তু পেটুক লোক কেবলই খেতে চায়—সে খিদে অখিদে জানে না, তার কেবল আহার চাই—সে কেবল খাওয়ার সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে বাস করে, তার বাইরে যেতে পারে না। কাজেই খাবার না পেলেই তার বড়োই কষ্ট হয়, নিরানন্দ আসে।
এক মস্ত পালোয়ান ছিল—তার জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না, সকালে বিকেলে কুস্তি করত, আর সমস্ত দিন ধরে খেত। তার সের সের ঘি চাই, সের সের চাল চাই, এই রকম রাশি রাশি খাবার পেলে তার পেট ভরত। অনেক ধনীলোক তার সেই খাবার জোগাতেন, কিন্তু চিরকাল তাকে কেই-বা সেরকম খাবার দিতে থাকবে? এমন একটা সময় এল, তার পেট ভরাবার মতো খাবার আর জুটত না৷ এর ফল হলো এই যে, একদিন সে বড়োবাজারের মিষ্টির দোকান লুট করে খেতে আরম্ভ করল এবং সেই কারণে তাকে শেষমেশ জেলখানায় যেতে হলো।
স্বরচিত সীমাতেও যথেষ্ট নিরানন্দ আসে। সুন্দর জিনিসের সৌন্দর্য দেখে আমাদের ভালো লাগে, এইটুকু হলো ঈশ্বরনির্দিষ্ট সীমা। কিন্তু যদি সেই সৌন্দর্যপ্রিয়তাকে বিকৃত করে কেবল বাইরের সৌন্দর্যের পেছনে পাগল হই এবং সেই কারণে অপরের কোনো সুন্দর জিনিস দেখে আত্মসাৎ করি, তাহলেই আমরা লোভের একটা সীমা রচনা করলাম। সেই লোভের ফলে হয়তো শাস্তি পেতে পারি এবং এর ফলে নিরানন্দ আসতে পারে। শাস্তি না পেলেও চুরি ধরা পড়ার ভয়ই সেই লোভী লোকের যথেষ্ট শাস্তি। অনেক প্রকারের স্বরচিত বা উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সীমাও আমাদেরকে বড়ো কষ্ট দেয়। সেগুলিকে মোটামুটি ছয় শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে, যথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। এই ছয়টি সীমা থেকে আমরা এতটাই কষ্ট পাই যে, এদেরকে সাধারণত আমরা ছয় রিপু বা ছয় শত্রু বলি। অনেকসময় আমরা নিজেকে স্বরচিত সীমার মধ্যে পুরে খাবারের লোভে কলে আটকে-পড়া ইঁদুরের মতো খুব কষ্ট পাই এবং সময়ে সময়ে তার ফলে জীবনের আশাও ছেড়ে দিতে হয়।
চীনের লোকজন বাঁশ প্রভৃতি বড়ো বড়ো গাছকে ঘরে রাখবার মতো করে ছোটো করার জন্য গাছের বাড়ার মুখেই পাত্র দিয়ে চাপা দেয়, তাতে গাছের মুক্ত প্রশস্তভাব একেবারেই চলে যায়। সেরকম আমরাও যতই আমাদের বিচরণ-সীমা সঙ্কীর্ণ করব, ততই জীবনপথের বদলে মৃত্যুপথে নামতে থাকব। আমরা মানুষ---আমরা ইচ্ছে করলেই সঙ্কীর্ণ সীমা নির্মূল করতে পারি। তখন আমরা নিরানন্দ-সাগরে ডুবে কেবল হা-হুতাশ করব কেন? এই সকল বাঁধ ভেঙে বরং অনন্তের পথে এগিয়ে যাও।
উপরে যে-সকল কথা বলে এসেছি, তা থেকে এইটুকু অন্তত বুঝেছ আশা করি, ঈশ্বরকে পেতে গেলে, নিরানন্দকে দূর করতে গেলে, ভগবানের আনন্দস্বরূপ বুঝতে গেলে ছয়টা রিপুরই বাঁধ ভেঙে দিতে হবে; কি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া, কি স্বরচিত, উভয় প্রকারের সীমাই নির্মূল করতে হবে। ঈশ্বরপ্রদত্ত সীমার নিকটে যে-বাধা পাওয়া যায়, সে-বাধা আমাদেরকে অনন্তেরই পথে অগ্রসর করে দেয়। তবে তার জন্য চৈতন্যকে জাগানো চাই।
ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ, একথা আমরা যখন জানতে পেরেছি, তখন আর কেন আমাদের হৃদয়ে কোনো প্রকার দুঃখশোক, নিরানন্দ আসতে দেবো? ঋষিদের সঙ্গে আমরাও একপ্রাণ হয়ে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করব, সেই অভয়দাতা পরমেশ্বরের আনন্দ যিনি জেনেছেন, তিনি কখনও ভয় পান না এবং কেউই তাঁকে ভয় দেখাতে পারে না, নিরানন্দ তাঁর কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যায়। তোমরা সেই অনন্ত আনন্দ পরমেশ্বরকে কখনও ছেড়ো না; তাঁকে প্রাণের একমাত্র আরাম, জীবনের একমাত্র বন্ধু জেনে হৃদয়ে বেঁধে রাখো এবং ঋষিদের সঙ্গে সমস্বরে বেদমন্ত্রে বলো: ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। এই রস হচ্ছে ঈশ্বরের আনন্দ, আত্মার নির্মল আনন্দ।
ঈশ্বর অমৃত। তিনি মৃত্যুর অতীত, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যার জন্ম আছে তারই মৃত্যু আছে; যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই। ঈশ্বর অনন্ত। তাঁর যখন আদি নেই, অন্ত নেই, তখন তাঁর জন্মই-বা কী করে সম্ভব হয়, আর তাঁর মৃত্যুই-বা কী করে হয়? ঈশ্বর নিজের অনন্ত প্রকৃতির ছায়া যে দুইটি জিনিসে বিশেষভাবে রেখে দিয়েছেন, সেই দুইটি জিনিসেই এই সত্যের বিশেষ পরিচয় পাই যে, যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই; সেই দুইটি জিনিস স্থান ও কাল। এই যে অসীম স্থান পড়ে আছে, এই স্থানের আদিই-বা কোথায়, আর অন্তই-বা কোথায়? এই যে অসীম কাল পড়ে আছে, এই কালেরই-বা আদি কিংবা অন্ত কোথায়? এর জন্মই-বা কখন, আর মৃত্যুই-বা কখন?
আমরা কাকে মৃত্যু বলি? যে-প্রাণ আগে ছিল, সেই প্রাণের অভাবকেই তো, তাই না? ধরো, একটা প্রদীপ জ্বাললাম, তা বাতাসে নিভে গেল। তখন আমরা বলব, প্রদীপটা নিভে গেছে, যদিও ধরতে গেলে, প্রদীপের আলোটুকুর মৃত্যুই ঘটল। কিন্তু যদি কোনো প্রাণী—সে-প্রাণী অণুবীক্ষণ-দৃশ্য জীবাণু থেকে শুরু করে মানুষ পৰ্যন্ত যে-কোনো প্রাণীই হোক না কেন—প্রাণত্যাগ করে, তাহলে আমরা বলব, সেই প্রাণী মরে গেছে। একটা পাথরকে ভেঙে ফেললাম, কেউই বলবে না যে, পাথরটা মরে গেছে। কিন্তু একটা গাছ কেটে ফেললাম। যদি সেই কাটা-গাছ থেকে কোনো পাতা-ফুল না বেরোয়, তাহলে বলব, গাছটা মরে গেছে, তার প্রাণের অভাব হয়েছে। আর যদি সেই কাটা-গাছ থেকে ফুল-পাতা বেরোয়, তবে বলব, গাছটা তখনও বেঁচে আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রাণের অভাবকেই আমরা সাধারণত মৃত্যু বলি।
জগতে আমরা যে প্রাণের খেলা দেখতে পাই, মৃত্যু বা অন্য কোনো অবস্থাতে সেই প্রাণের অভাব হয় কি? প্রাণটা আসলে কী? প্রাণ একপ্রকার শক্তি। এই শক্তি দ্বারা প্রাণী মাত্রেই খাবার সংগ্রহ করে, খাবার পরিপাক করে, খেলা করে, ফল-ফুল প্রভৃতি নতুন প্রাণের জন্মদান করে।
এখন বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা একেবারে নিশ্চিতভাবে ঠিক করেছেন, কোনো শক্তিরই বিনাশ নেই, অর্থাৎ কোনো শক্তিই একেবারে মরতে পারে না। শক্তির বিনাশ নেই, শক্তির পরিবর্তন হতে পারে, অর্থাৎ শক্তি নিজের আকার ও স্বভাব ছেড়ে অন্য আকার ও স্বভাব গ্রহণ করতে পারে। ধরো, তুমি দশ ওয়াট বিদ্যুৎশক্তি একটা শিশিতে বন্ধ করে রেখেছ। কয়লা বা অন্য কোনো জিনিস, যে-জিনিসে আগুন দিলে পুড়ে যায়, এমন জিনিসে সেই দশ ওয়াট বিদ্যুৎ ছেড়ে দিলে। তার ফলে সেই জিনিসটা জ্বলে উঠল এবং তা থেকে হয়তো এক-শো ওয়াট উত্তাপ পাওয়া গেল। তাহলে হলো এই যে, দশ ওয়াট বিদ্যুৎ একেবারে মরল না, কিন্তু নিজের আকার ও স্বভাব ছেড়ে দিয়ে এক-শো ওয়াট উত্তাপের আকার ও স্বভাব গ্রহণ করল।
তোমার মাংসপেশির যে-শক্তি আছে, যখন কোনো জিনিস ওঠাও, তখন সেই মাংসপেশির শক্তি জিনিস ওঠাবার শক্তির বিশেষ আকার গ্রহণ করে মাত্র। বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা যে-সকল সূক্ষ্ম গণনার দ্বারা এই সিদ্ধান্ত ঠিক করেছেন, সেই সকল গণনা তোমাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া বড়ো শক্ত, একরকম অসম্ভব। তাঁদের একটা প্রধান কথা এই যে, কোনো শক্তির যদি সম্পূর্ণ বিনাশ সম্ভব হতো, তাহলে তাঁরা কোনো শক্তিরই কাজ সম্বন্ধীয় গণনা করতে পারতেন কি না সন্দেহ।
উপরে আমরা যেসব কথা বলে এলাম, তা থেকে এইটুকু বুঝলাম, প্রাণ একপ্রকার শক্তি এবং প্রাণের সত্যিই বিনাশ বা মৃত্যু নেই৷