একটি অস্থিরতার গল্প

 
প্রিয় বাবুই,


হয়তো তুমি ভাবছ, ভীষণ ভীষণ রেগে আছি আমি। তুমি দুই দিন হলো আমাকে ফোন করছ না, এজন্যই রেগে গাল ফুলিয়ে বসে আছি। বলা যায় না, যেকোনও সময় ফেটে পড়তে পারি।


আসলে হ্যাঁ, আমি রেগেই আছি। আমি তোমার কণ্ঠ না শুনে, তোমার সাথে কথা না বলে এখন আর থাকতে পারি না। খুব খুব কষ্ট হয় আমার। কেমন যেন ছটফট করতে থাকি, আর মোবাইলস্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি, বারে বারে মোবাইল চেক করি তুমি ফোন করেছ কি না দেখার জন্য। আমি জানি, কোনও ফোন আসেনি, তবু এটা করি, কেননা এটা আমার অভ্যাস। আমি তোমার ওপর রাগান্বিত হই, অভিমান করি, আমার অনেক অভিযোগ জমে যায় তোমার প্রতি, কিন্তু তবুও আমি তোমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারি না, তোমার ওপর রাগটা দেখাতে পারি না।


এটা আসলে এজন্য নয় যে, রাগ দেখালে, ঝগড়া করলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি জানি, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। এটা আমার বিশ্বাস। এটা আমার, অসংখ্য দীর্ঘরাত যে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম কিংবা এখনও আছি, সেইসব মুহূর্তের বিশ্বাস। এটা একদিনে তৈরি হয়নি, আর এই বিশ্বাস ভাঙতে গেলেও আমাদের দুজনকেই অনেক অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমাদের দুজনের কারওই সেই সময়টুকু নেই। সেই বিশ্বাস থেকে জানি, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।


আমি তোমার উপর রাগ, অভিযোগ এগুলো এখন আর দেখাব না, তার কারণ, আমি এসব করলে তুমি কষ্ট পাও, তোমার কষ্ট হয়। আমি রেগে আছি, আমি কষ্ট পাচ্ছি, এসব বুঝলে তুমি কষ্ট পাও। তোমার এই কষ্টপাওয়া আমি এখন আর মেনে নিতে পারি না। আমার যদি এটা হজম করতে কষ্টও হয়, আমি তা-ও হজম করে ফেলব, আমি ওষুধের মত গিলে ফেলব, তবুও আমি তোমাকে কখনও আর কোনও দিন বুঝতে দেবো না যে আমি তোমার কোনও আচরণে কষ্ট পাচ্ছি।


তোমার কষ্ট আমি এখন অনুভব করতে চাই। আমি জানি না পৃথিবীতে কোনও মানুষ আজ পর্যন্ত কেউ কারও কষ্ট পুরোপুরি অনুভব করতে পেরেছে কি না, কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তোমার কষ্ট অনুভব করতে চাই। আমার শরীরের একটা অঙ্গ আঘাত পেলে সারাশরীর যেভাবে সেটা টের পায়, নিজের কাছে কিছুই যেভাবে অজানা থাকে না তখন, আমি তোমাকে সেভাবে অনুভব করব। এতে হয়তো তোমার কষ্ট আমি কমাতে পারব না, কিন্তু আমি তা ভাগ করে নিতে পারব।


আমি এখন বুঝতে চেষ্টা করি যে, তুমি আসলেই এমন। তুমি কোনও কাজে পুরোপুরি ডুবে গেলে তোমার মন অন্য কোনও দিকে চলে যাক, এটা তুমি অপছন্দ কর। মস্তিষ্ক বারে বারে অন্য দিকে গেলে মনোসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এজন্যই তুমি এমন। আমার এটা নিজের সাথে মানিয়ে নিতে একটু হয়তো কষ্ট হবে, একটু হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু আমি পারব। এখন আমি অনেক কিছু পারি, আমি অনেক কিছু শিখে নিয়েছি। আর এখন যেহেতু আমি তোমার অংশ মনে করি নিজেকে, সেহেতু পারতে আমাকে হবেই!


আমি এ-ও জানি, আমি অনেক ছেলেমানুষি করি, যেটা হয়তো আমার বয়সের সাথে যায় না কোনওভাবেই। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো, আমি আর কারও সাথে এমন করি না। আর কাউকে কখনও জ্বালাই না। জানো পাখি, আমি এই দুই দিন তোমাকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা খুব কম বলেছি, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি তোমার প্রতি ভালোবাসাটুকু অনুভব করেছি। হয়তো তুমি এর সবই বোঝো। তীব্র ভালোবাসা কখনও কোনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না পাখি, কেবল অনুভব করেই বোঝা যায়।


আমি বলতে না পেরে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু বলতে গেলে অনুভব করেছি, আমি যে তোমাকে এর চেয়েও লক্ষগুণ বেশি ভালোবাসি, তা হলে বলে আর কী হবে! কিন্তু জানপাখি, গত কয়েকটি বছর আমি যে ভালোবাসা তোমার প্রতি অনুভব করে এসেছি, সেটা যদি তোমাকে বলে না বোঝাতাম, তা হলে আজ তুমি এভাবে পারতে বুঝতে? সব সময় নীরবতা ভাষা বোঝায় না, লক্ষ্মী। কখনও বলে বোঝাতে হয়, কখনও করে বোঝাতে হয়, কখনও দেখিয়ে বোঝাতে হয়, আবার কখনও সম্পূর্ণ চুপ করে থেকেই বোঝাতে হয়। মানুষ সাধারণত যখন আর কিছুই খুঁজে পায় না, কোনও তীর খুঁজে পায় না, তখনই কেবল চুপ হয়ে যায়। এটাও হয়, যখন চুপ করে থাকে, তখনই সবচেয়ে বেশি বলে, তখনই সবচেয়ে বেশি অনুভবে জড়ায়।


আমি জানি, তুমি আমার কাছে নেই, আমার কাজ, আমার চোখের ভাষা এগুলোর কোনওটা দিয়েই আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেজন্য সেই চেষ্টাও যেমন করি না, তেমন তোমাকে দোষও দিই না। আমি যতটা বলি, জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না, আমি তা মেনে নিতে ঠিক ততটাই যে কষ্ট পাই। কিন্তু আমাদের সবাইকে না চাইতেও তো অনেক কিছু মেনে নিতে হচ্ছে, তা হলে যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্থান দখল করে আছে, তাকে কেন তার মতো করে মেনে নিতে পারি না? এইসব হলো কিছু মানসিক দ্বন্দ্ব। দেহে প্রাণ যতদিন আছে, এমন কিছু অন্তর্দহনও ততদিন আছে।


সত্যি বলতে কী, আমি তোমার ভালোবাসা পেতে পেতে আরও লোভী হয়ে উঠছি। এই অপূর্ণতা, এই লোভ হয়তো আমাকে শেষ করে ছাড়বে। আগে ভাবতাম, আমি অনেক কিছু বুঝি, আমি অনেক কিছু জানি। কিন্তু অনেক দিন হলো, প্রায় দেড়-দুই বছর হলো, আমার মনে হয়, আমি কিছুই জানি না, আমি কিছুই বুঝি না। আমি এতটা দিন তা হলে কী শিখেছি, তা-ও বলতে পারব না। কিন্তু আমি প্রতিদিন আরও জানছি, প্রতিদিন আমি এমন কিছু কিছু জিনিস জানি, যা আগে কখনও জানতাম না।


পথ ফুরায় না, তেষ্টাও পায় ভীষণ, তবুও আমি হাঁটতে থাকি। একটা ভিক্ষুক আর আমার মাঝে কোনও পার্থক্য কি আছে! আমি ভীষণ শূন্য অনুভব করি তোমাকে ছাড়া। আহা, এই জীবনে এমন একটা সৌভাগ্য নিয়ে যদি আসতাম, যার বিনিময়ে আমি তোমাকে পেতাম! তুমি আমাকে স্বাধীন করে না দিলে, আমাকে আমার কথা বলার স্বাধীনতা না দিলে হয়তো এতকিছু কখনও বলা হতো না। কখনও এই দিনটাও পেতাম না। আমি তোমার রাগ, তোমার অস্বস্তি, তোমার কষ্ট, সব কিছু মেনেও কেবল তোমাকে পেলেই পুরো জীবনসমান বোঝা অনায়াসেই গিলে ফেলতে পারি, আজ আমার তা-ই মনে হয়।


তুমি যা খুশি, তা-ই করো, লক্ষ্মী। তুমি তো আমার পাখি, আমার কলিজার টুকরা। একটা মাত্র পাখি তুমি আমার, তোমাকেই কেবল এসবে মানায়।


ইতি, তোমার চড়ুই