পঁচাশি। আমাদের নিজেকেই এখন থেকে পুনরায় সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে, নিজের মনকে ভেঙেচুরে নিজের সাথেই কথা বলার জন্য রাজি করাতে হবে, তা না হলে আমরা আমাদের প্রকৃত শেকড়ে কখনওই পৌঁছুতে পারব না। এমনকি যদি আমরা পৃথিবীর সকল ধর্মালয়েও যাই, তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের স্রষ্টাকে কখনও খুঁজে পাবো না। যদি আমরা পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থের কথাকেও অনুসরণ করি, প্রার্থনা, পূজার্চনা করতে থাকি, কিংবা অন্য কোনও কিছুর পেছনে আমরা যতই শ্রম দিই না কেন, সব কিছুর পরও আমরা স্রষ্টার কাছে পৌঁছুতে পারব না। কেবল আমাদের ভালোবাসার প্রার্থনাই আমাদেরকে আমাদের স্রষ্টার কাছে পৌঁছে দিতে পারে। যদি আমাদের মাঝে কেবল ভালোবাসাই থাকে, তবে আমাদেরকে প্রার্থনা করারও প্রয়োজন নেই, ওটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে। আমরা যদি কিছুই না বলি, তা সত্ত্বেও স্রষ্টা আমাদের সব কথা বোঝেন, শোনেন। একজন ভালোবাসাসমৃদ্ধ মানুষ যদি খুব বেশি শিক্ষিত না-ও হয়ে থাকেন, তা-ও তিনি জীবনের যথাযথ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হন। প্রকৃত ভালোবাসা মানুষকে নত হতে শেখায়। আমরা যদি কেবল নিজেদেরকে ভালোবাসার কাছে নত করতে শিখি, তবে ভালোবাসা স্বেচ্ছায় এসে আমাদের কাছে ধরা দেয়। কেননা এটিই সত্য যে ভালোবাসা কোথাও চাষ করা হয় না, ভালোবাসাকে বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, ভালোবাসাকে কেবল ভালোবাসা দিয়েই অর্জন করে নিতে হয়। ভালোবাসার রাজ্যে ধনী-দরিদ্র, রাজা-উজিরের কোনও ভেদাভেদ নেই। ভালোবাসার রাজ্যে একজন ধনী এবং একজন ভিক্ষুক সব সময়ই একই সারিতে থাকেন। ভালোবাসার একটিই মাত্র নিয়ম, যদি আমরা ভালোবাসা চাই, তবে আমাদেরকে মাথাটা নত করতে হবে। ভালোবাসাকে পাবার জন্য একটা মানুষকে তার নিজেকে হারাতে হতে পারে, ভালোবাসার জন্য তার নিজেকে ত্যাগ করতে হতে পারে, নিজের অহম সত্তা, তার পরিবার, তার মুখোশ, তার আমিত্ব সব কিছু হারাতে হতে পারে। ভালোবাসার কাছে নত হওয়া বলতে মূলত এটিকেই বোঝায়। এই ত্যাগকে যদি আরও গভীরে বিশ্লেষণ করা যায়, তবে এর দুইটি মাত্রা দেখতে পাবো। একটি হচ্ছে আমাদেরকে আমাদের ইগো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটি আমাদের মস্তিষ্কের সাথে জড়িত, এটি আমাদের ভেতরে এক আমিত্বের সৃষ্টি করে। এজন্য আমরা আমাদের চারপাশের মানুষের কাছে সব সময় মাথা নত করে চলব। এটি কেন করতে হবে? কেন কেবল আমাদের মাথাকেই অন্যদের কাছে নত করতে হবে? কেন অন্য কোনও অঙ্গ নয়? কেননা কেবল আমাদের মস্তিষ্কই সমস্ত আমিত্ব, ইগোকে ধারণা করে। এমনি করেই যখন আমরা আমাদের সামনের কাউকে আঘাত করে, অপমান করে কথা বলি, তখন আসলে আমরা তার ইগোকেই আঘাত করি। যদি আমরা আমাদের ইগোকে ঝেড়ে ফেলি, তবে আর আমাদের মাঝে ধনী-গরিব, সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এরকম কোনও ভেদাভেদ থাকে না। তখন আমরা সকলে এক শ্রেণির এক বন্ধনে আবদ্ধ হই, এক ভালোবাসার ছায়ায় সকলে একসাথে আশ্রয় নিই। যদি ভালোবাসাকে বাজারে কিনতে পাওয়া যেত, তবে অবশ্যই তা ধনী-গরিবের মাঝে বিশাল দূরত্ব তৈরি করে দিত, কেননা তাতে ধনীরা তাদের বিপুল অর্থের সাহায্যে সহজেই ভালোবাসাকে কিনে ফেলত, আর দরিদ্রেরা সব সময় এই দিক থেকেও গরিবই থেকে যেত। ভালোবাসার কোনও শর্ত হয় না, এটি অমূল্য। কেবল আমাদের মস্তিষ্ক ছাড়া, আমাদের আমিত্বের বোধ ছাড়া ভালোবাসাকে হারাবার আর কোনও পথ নেই। একজন প্রকৃত ভালোবাসাসমৃদ্ধ মানুষ অন্যের জন্য, অন্যকে বাঁচাবার জন্য নিজের সর্বস্ব বিলীন করে দেয়। অনেক সময় আমাদের এই আমিত্ববোধ আমাদের ইগোকে ঝেড়ে ফেলতে দেয় না। অনেক সময় যখন আমরা আমাদের ইগোকে ঝেড়ে অন্যের সামনে নিজেকে নত করতে যাই, তখন আমাদের আমিত্ব ভেতর থেকে বলে, এমনকি পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমরা আমাদের আমিত্ব থেকে সরে আসব না, তাই মাথা নত করার তো প্রশ্নই আসে না। এই ধরনের মানসিকতাই আমাদেরকে ভালোবাসার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। আমাদের স্বাতন্ত্র্য থেকে দূরে সরিয়ে আনে। ছিয়াশি। আমরা যখন বলি, আমরা আমাদের সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীকে ভালোবাসি, আমরা তখন তাকে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা, তার ভালোলাগা-মন্দলাগা থেকে বের করে এনে ভালোবাসার অজুহাতে আমাদের নিজেদের মতো করে বাঁচতে, আমাদের নিজেদের ধ্যান-ধারণায় চলতে বাধ্য করি। আমরা তাদের সব কাজে সব সময় ছায়ার মতো লেগে থাকি এমনভাবে, যেন তারা কোনও ভুল করছে; আমরা রাগ করি, কেননা তারা আমাদের মনমতো চলছে না! যখন তাদের কোনও কিছু আমাদের অপছন্দ হয়, তখন আমরা তাদের পুরো জাতসুদ্ধ টেনে তাকে কথা শোনাই, ঠিক তেমন করে, যেমনি সমগ্র স্ত্রীজাতি অথবা সমগ্র পুরুষজাতির নাম করে আমরা যখন বলি, আসলে তোমরা পুরুষ জাতটাই এমন, অথবা তোমরা নারী জাতটাই অমন। অতঃপর ওই পুরুষ অথবা ওই নারী তার ভালোবাসার মানুষটিকে খুশি করার জন্য তার নিজের সকল স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, চিন্তাভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে তার ভালোবাসার মানুষের পছন্দ, ইচ্ছা, ধ্যানধারণা অনুসরণ করে চলতে শুরু করে। সাধারণত বিবাহিতজীবনে নারী-পুরুষের মাঝে যে পরিমাণ ঝগড়া লেগে থাকে, পৃথিবীর আর কোনও সম্পর্কেই এর পরিমাণ এতটা ভয়াবহ নয়। স্ত্রীরা স্বামীর মনমতো হতে গিয়ে ভয়ানক হয়ে ওঠে, ওদিকে স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ভয়ানক হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে, আবার শেষও হয়ে যায়, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া আজীবন একই গতিতে একই নিয়মে চলতেই থাকে। এমনটি কেন হয়? কারণ এরা দুজনেই কোনও না কোনওভাবে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তারা সন্তান ধারণ করে এবং তাদের সন্তানের উপরেও একইভাবে প্রভাব খাটাতে চায়, আর এভাবেই একের নিয়ন্ত্রণ অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাবা-মায়েরা ভাবেন, তাঁরা যা বলেন, সব সত্যি। সুতরাং তাঁদের সন্তানেরা সেটি মানতে বাধ্য এবং যদি ওরা অবাধ্য হয়, তবে ওদের জোর করে হলেও সেটি মানতে বাধ্য করা হবে। অথচ তারা নিজেরাই জানেন না, তাঁরা যে পথে যেতে চাইছেন, সে পথটা সঠিক কি না। তাঁরা তাঁদের নিজেদের জীবন অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে চালাতে বাধ্য হয়েছেন, এখন তাঁরা তাঁদের সন্তানদেরও একইভাবে চালাতে গিয়ে ওদের জীবনটাকে নষ্ট করে দিতে চলেছেন! আমরা বাবা-মায়েরা সাধারণত আমাদের সন্তানদের বলে থাকি, আমি তোমার বাবা কিংবা আমি তোমার মা, সুতরাং আমি যা বলব, সেটাই সত্যি এবং সেটা তোমার মানতে হবে। যদি তুমি আমার কথা না মানো, তবে তোমার ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে। কখনও কখনও আমরা আমাদের সন্তানদের এই বলে ভয় দেখাই, যদি তুমি আমার কথা না মানো, তবে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে, তোমার খরচ বন্ধ করে দেওয়া হবে, অথবা সন্তান যদি অনেক ছোটো হয়, তবে তাদের বেতের ভয় দেখাই, তাদেরকে ঘরবন্দি করে রাখি। এককথায়, তাদেরকে আমাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো চালাতে হলে যা যা করা প্রয়োজন, আমরা সেই সব কিছুই করি। এভাবে করে আমরা তাদেরকে মানুষ নয়, বরং একটি বস্তুতে পরিণত করি। আমরা তাদের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা, তাদের আত্মসম্মানবোধ সব কিছুকে এভাবেই মেরে ফেলি। ফলে এটা হয়ে থাকে যে, যেসব বাচ্চা নির্জীব, নিষ্প্রাণ, ঘরকুনো, অলস, তারা তাদের আনুগত্যের জন্য তাদের বাবা-মায়ের কাছে প্রশংসিত হয়। আর যেসব বাচ্চারা প্রাণবন্ত, সদাপ্রফুল্ল, সতেজ, উদ্যোগী, সক্রিয়, যারা কোনও সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়তে কখনও ভয় পায় না, যারা সব সময় এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়ায়, তারা সাধারণত তাদের বাবা-মায়ের নানান ধরনের অভিযোগের শিকার হয়। তারপর একটি অবাককরা কাণ্ড ঘটে। অনুগত বাচ্চারা বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, আর দুষ্টু ও অকর্মা বাচ্চারাই উজ্জ্বল কিছু করে দেখায়। এ সকল বাচ্চাই দীপ্তিমান, কেননা তাদের ভেতরে শক্তি আছে, এক বিপুল জীবনীশক্তি রয়েছে তাদের ভেতরে। আমাদের এত শত চালাকি সত্ত্বেও, এত শত নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও তারাই আমাদের শিক্ষক হয়ে বসে থাকে। ভালোবাসার শিল্প হচ্ছে, নিজের ভেতর থেকে ইগোকে অদৃশ্য করে দেওয়া। যদি আমরা আমাদের সন্তানদের সত্যিই ভালোবেসে থাকি, তবে আমাদের তাদের সামনে নত হতে হবে। তবেই আমরা অহমসত্তাপূর্ণ বাবা-মা হয়ে ওঠার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারব। আমরা যদি আমাদের সন্তানের কাছে নত হতে পারি, তবেই আমরা দেখব, কী করে সে এর প্রতিদান দেয়। যখন আমরা আমাদের ইগোকে তাদের ব্যাপারে ঝেড়ে ফেলব, তখন আমাদের সন্তানেরাও তাদের ইগোকে আমাদের ব্যাপারে ঝেড়ে ফেলতে শিখে যাবে। তাহলেই আমরা একে অপরের কাছে আসতে পারব, একে অপরের চিন্তাভাবনাগুলো অবাধে, নিঃশঙ্কভাবে বিনিময় করতে পারব। কিন্তু আমরা যদি তাদের কাছে নত না হই, তবে আমাদের সন্তানেরা সব সময় কেমন একটা সমস্যা অনুভব করতে থাকবে, তারা সব সময় মনমরা হয়ে থাকবে, আর এর থেকে পালিয়ে বের হবার সুযোগ খুঁজতে থাকবে। তারা মনে মনে তাদের নিজেদের সাথে এই আলাপ করতে থাকবে যে,---একটা সময় আমাদের বাবা-মা দুর্বল হবে, কিন্তু আমরা তখন সবল থাকব, সুতরাং আমরা সেদিন তাদের এসব কাজের প্রতিশোধ নেবো। একটা সময় তারা সত্যি সত্যিই আমাদের উপর তার আজকের সমস্ত ক্ষোভ ঝাড়বে, কেননা এতদিন আমরাই তাকে প্রতিনিয়ত আমাদের কথা মানতে বাধ্য করেছি। তাদের থেকে তাদের জীবন, তাদের সকল স্বাধীনতা, তাদের জন্মগত অধিকার সবই কেড়ে নিয়েছি। আমাদের তখন মনে হবে, আমাদের সন্তানেরা বিপথপগামী হয়েছে, তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। আমরা আসলে সেটাই পাচ্ছি, যা আমরা এক সময় তাকে শিখিয়েছি। ছোটোবেলায় সে যখন দুর্বল ছিল, আমাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, আমরা তাকে এভাবেই নিগ্রহ করেছিলাম এবং সময়ের ব্যবধানে এখন আমরা দুর্বল হলে সে আমাদের মতোই একইভাবে আমাদের নিগ্রহ করবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? এটিই আমাদের কাজের অপরিবর্তনীয় নীতি, যা আমরা করেছি, আমরা তার ফলই পাচ্ছি অথবা পাবো। যখন আমরা আমাদের সন্তানের কাছে আমাদের সব ইগো ঝেড়ে ফেলব, তখন সে একাই প্রকৃতির নিয়মে আমাদের কাছেও আমাদের দুর্বল মুহূর্তে তার ইগোকে ঝেড়ে ফেলে দেবে। আমরা ভালোবাসার নাম করে কী সুন্দর সহজ উপায়ে অন্যের জীবনকে ধ্বংস করি, নষ্ট করি। আমরা নিয়মশৃঙ্খলার, আনুগত্যের নামে কী সহজভাবেই না অন্যকে মেরে ফেলি! যত বার আমরা ভালোবাসার নাম করে অন্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাই, তত বারই আমরা আমাদের ইগোকে আরও প্রশ্রয় দিই কাজটি বারে বারে করার ব্যাপারে। সাতাশি। জীবনের চিরজীবী নিয়ম হচ্ছে, ভালোবাসা ছাড়া কোনও আনন্দলাভ অসম্ভব। সেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে জীবন নির্জীব। আর যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে ইগো সমর্পিত হয়। এমনকি আমাদের ভালোবাসার মানুষটি যদি বয়সে বা অবস্থানে আমাদের থেকে ছোটোও হয়, তারপরও আমাদের ভেতরে কোনও ইগো কাজ করে না, কেননা তখন আমাদের ইগো আমাদের ভালোবাসার কাছে সমর্পিত হয়। যদি সে আমাদের স্ত্রী হয়, তবে আমরা তার সামনে মাথা নত করি, আমরা তার ওপর প্রভুত্ব খাটাই না, কেননা সেখানে তখন কোনও ইগো নয়, বরং একটি ভালোবাসা সমর্পিত হয়। এমনকি স্বামী-স্ত্রী কেউ কারও উপরে থাকে না, তারা উভয়েই স্রষ্টার ভালোবাসার কাছে নত হয়। তখন কেউ কারও ওপরে তীর ছোড়ে না, কেউ কাউকে নিচ বা নিজের অধীনে দেখে না, বরং উভয়ই একে অপরের কাছে সমর্পিত হয়। সর্বপ্রথম আমাদের মস্তিষ্কই ইগোর জন্ম দেয়, তারপর আসে চিন্তা। আমাদের মস্তিষ্ক প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক সকল চিন্তারই রাজ্য। আমাদের মনটা আসলে অসীম এক চিন্তার বাজার ছাড়া কিছুই না। আমাদের মনের রাজ্যটি সব সময় নানা রকমের চিন্তার মাধ্যমে সক্রিয় থাকে। এমনকি আমরা ঘুমিয়ে থাকলেও এটি তখনও পূর্ণ সচেতন এবং নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর আমরা আমাদের এইসব চিন্তার পেছনে এত সময় এবং শক্তি ব্যয় করি যে আমাদের কাছে ভালোবাসার আর কোনও সময়ই থাকে না। আমাদের এসব চিন্তার উপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, এটি যে-কোনও সময় যে-কোনও দিকে মোড় নিতে পারে। এটি ভালো মন্দ দুইই হতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক আসলে একটি শোষণকারী সত্তা। এটি সকল প্রকার চিন্তাকে শোষণ করে থাকে। আমাদের মন এ সকল চিন্তার মাধ্যমে আমাদের শক্তিকে এমনভাবে নষ্ট করে যে, সেটি আর আমাদের হৃদয় পর্যন্ত আর পৌঁছুতেই পারে না। আমাদের এসব চিন্তার প্রায় নিরানব্বই ভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। আমরা যদি আমাদের এই অপ্রয়োজনীয় চিন্তাগুলিকে ঝেড়ে ফেলতে পারতাম, তবে আমরা অনেক ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যেতাম। আমরা কি কখনও শান্ত হয়ে বসে সচেতনভাবে ভেবে দেখেছি যে, এই যে আমরা সারাদিন হাজারো চিন্তা করি অথবা যেসব চিন্তা সারাদিন আমাদের মাথায় ঘুরতে থাকে, তার কোনওটিরই কোনও প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না? যেসব চিন্তা আমাদের জীবনের জন্য ক্ষতিকর এবং অপ্রয়োজনীয়, আমরা সাধারণত সেসকল চিন্তাই বেশি করি। বিজ্ঞানীরা এটি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে সারাদিন একটি জমিতে খনন করতে আমরা যে শক্তি ব্যয় করি, আমাদের চিন্তার মাধ্যমে সারাদিন তার থেকেও চারগুণ বেশি পরিমাণ শক্তি ব্যয়িত হয়। অর্থাৎ, আমাদের কাজ আমাদের যত শক্তি ক্ষয় না করে, তার থেকেও চারগুণ বেশি শক্তি আমাদের চিন্তার মাধ্যমে ক্ষয় হয়ে যায়। যাদের চিন্তার পরিধি যত সীমিত অর্থাৎ মানসিক শ্রম যত অল্প হয়, তারা তত বেশি গায়ে গতরে খাটতে পারে অর্থাৎ শারীরিক শ্রম দিতে পারে। আমাদের এই চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। এই চিন্তাগুলো একটি চক্রাকারে দিন-রাত আমাদের মস্তিষ্কে ঘুরতেই থাকে। আমাদের শরীরের বিশ্রাম থাকলেও মস্তিষ্কের কোনও বিশ্রাম নেই। আমাদের মস্তিষ্ক এই কাজটি খুব সূক্ষ্মভাবে করে থাকে। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের শক্তিকে অন্য কোথাও যেতে দেয় না। এটি আমাদের শরীরের সব শক্তিকেই শোষণ করে নেয়। অন্যদিকে আমাদের হৃদয় কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মতো এমন আক্রমণাত্মক নয়। আমাদের হৃদয় ভালোবাসাকে এমনভাবে নিজের ভেতরে রোপণ করে যে, একে যখনই জল দেওয়া হয়, এটি তখনই চারিদিকে তার কার্যকারিতা ছড়িয়ে দিতে থাকে। আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ সব সময় সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আমাদের ইগো, চিন্তাভাবনা আমাদের হৃদয়কে জল দেওয়ার কাজটি বন্ধ করে দেয়, যার ফলে আমরা ভালোবাসার শক্তি হারিয়ে ফেলি। যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের নানা রকম চিন্তাভাবনা, আমাদের ইগোকে ঝেড়ে ফেলতে না পারি, তাহলে আমাদের ভালোবাসার পথটি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা কেবল তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বই পড়ে। এসব মানুষ আজীবন বই পড়ে যায়, কিন্তু কিছুই জ্ঞানলাভ করতে পারে না। কেননা তথ্যের সাথে প্রজ্ঞার সত্যিই কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা একবিন্দুও প্রজ্ঞাবান না হয়েও একসাথে লক্ষকোটি তথ্য মস্তিষ্কে জড়ো করতে পারি। মানুষের মস্তিষ্কে তথ্যের জন্য বিপুল জায়গা আছে, যার ফলে আমরা অনেক বই পড়ি, নানান তথ্য আত্মস্থ করি। আমরা অনেক তথ্য জানি, কিন্তু বস্তুত তথ্য আমাদের জীবনের প্রকৃত শিক্ষাই দেয় না। প্রচুর বই পড়েছেন, কিন্তু নিজের হৃদয়কে জাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। বই থেকে তথ্য নিয়ে মাথা বোঝাই করে ফেলেছেন যাঁরা, তাঁরা তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ হতে পারেন, তবে জ্ঞানী না-ও হতে পারেন। যে সমাজে তোতাপাখি ও জ্ঞানীকে একই চোখে দেখা হয়, সে সমাজ প্রগতির পথে এগোতে পারে না। হায়, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে কেবল কিছু তথ্য আত্মস্থ করতে পারলেই লোকে আমাদের প্রজ্ঞাবান বলে। মাঝে মাঝে এত তথ্য মনে রাখতে গিয়ে আমাদের রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যেতে হয়। তথ্যের ভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একজন মানুষকে ভালোবাসা কী, সেটি পর্যন্ত পড়ে পড়ে জানতে হয়। অথচ ভালোবাসার দুটি শব্দ আত্মস্থ করে কখনও ভালোবাসা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায় না। কেবল জীবনে ভালোবাসার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, ভালোবাসায় বাঁচার মাধ্যমেই ভালোবাসা সম্পর্কে জানা সম্ভব। যে মানুষ ভালোবাসতে জানে, তাকে বই পড়ে ভালোবাসার জ্ঞান অর্জন না করলেও চলে। কিন্তু যে ব্যক্তির ভালোবাসার প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তার পক্ষে পৃথিবীর হাজার বই পড়েও ভালোবাসা সম্পর্কে একটিও বাস্তবসম্মত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা কোনও বিষয় না যে, আমরা আমাদের চারপাশে কতটা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছি, আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে কত বেশি পরিমাণে ভালোবাসছি, অথবা আমরা যতই নিজেদের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে ভালোবাসি না কেন, তারপরও আমাদের কাছে কখনও সেই ভালোবাসাকে পর্যাপ্ত মনে হবে না। আমাদের সব সময়ই মনে হতে থাকবে, কোথাও যেন কম পড়ে গেছে। আমরা আমাদের মানসিক প্রশান্তির জন্যে যতই চেষ্টা করি না কেন আমাদের ভালোবাসার মানুষকে আরও কিছুটা বেশি ভালোবাসতে, তারপরও আমাদের কাছে কোথাও কী যেন অপর্যাপ্ত মনে হতেই থাকবে। এমন কেন হয়? কারণ ভালোবাসা অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম, এর শুরু আছে, কিন্তু এর কোনও শেষ নেই। ভালোবাসা আমাদের স্রষ্টার মতো। ঠিক যেমনি আমাদের স্রষ্টার শক্তির কোনও সীমা নেই, ঠিক তেমনি ভালোবাসাও অসীম। আর যা-কিছু অসীম, তার কোনও ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই। পৃথিবীতে যা-কিছুই সসীম, তার প্রত্যেকটির মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু ভালোবাসা সীমাহীন, এর কোনও শুরু অথবা শেষ নেই। পৃথিবীতে কেউই বলতে পারবে না, ঠিক কবে থেকে ভালোবাসার শুরু, কেননা এটি সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই যেমন ছিল, আজও ঠিক সেই নিয়মে তেমন করেই চলছে। সুতরাং আমরাও আমাদের চারপাশে, আমাদের ভালোবাসার মানুষকে যতই ভালোবাসি না কেন, এটি কখনওই আমাদের আত্মতৃপ্তি এনে দেবে না। আমরা কি কখনও কাউকে এটা বলতে শুনেছি যে, আমি তাকে এতটা ভালোবাসতে পেরে তৃপ্ত? কখনওই না। যেহেতু ভালোবাসা কখনও ফুরিয়ে যায় না, সেহেতু এর মৃত্যুও নেই। এজন্যই আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন আমাদের মনে হয় যেন আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে অর্ধেক হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছি। আরও একটু যদি ভালোবাসতে পারতাম, আহা! এজন্য ভালোবাসা সব সময়ই অসম্পূর্ণ। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, এটিকে কোনওভাবেই পূর্ণ করা সম্ভব নয়, কেননা এটিই ভালোবাসার প্রকৃতি, এটিই ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য। আটাশি। প্রত্যেক বার আমরা যখন আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসতে যাই, আমরা যখন আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তাকে ভালোবাসি, প্রতি বারেই আমরা তার আগের বারের তুলনায় আরও অধিক ভালোবাসি, তারপরও আমাদের অসন্তুষ্টির পরিমাণটাও যেন ক্রমাগত গাণিতিক হারে বাড়তেই থাকে। এভাবে প্রতিটি অসন্তুষ্টি আমাদেরকে পরবর্তী অসন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। প্রতি বার আমরা যখন আমাদের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি, প্রতি বার আমরা প্রার্থনা করি যেন এর পরের বার আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে আরও বেশি ভালোবাসতে পারি। ভালোবাসা এমন কোনও পানীয় নয়, যেটি আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। বরং ভালোবাসা এমন এক পানীয়, যা প্রতিবার পান করার পর আমাদের তৃষ্ণা আগের তুলনায় আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। যখন একজন মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসে, তখন তার তৃষ্ণা যেমন আগের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়, তেমনি তখন তার আনন্দের পরিমাণও তার চাইতে বহুগুণে বেড়ে যায়। ভালোবাসার জয় এমন একটি জয়, যেখানে আনন্দের কোনও সীমা নেই। ভালোবাসার আনন্দ ভালোবাসার মতই সীমাহীন। একজন কামুক ব্যক্তি সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু একজন প্রেমী ব্যক্তি কখনও সন্তুষ্ট হয় না। কেননা যৌনাকাঙ্ক্ষার একটি সীমা আছে, কিন্তু ভালোবাসা অসীম। ভালোবাসার কোনও দেয়াল হয় না। যা-কিছু করতে আমরা ভালোবাসি, তা কখনও আমাদের তৃপ্তি এনে দেয় না। আমাদের কেবলই ইচ্ছে করে, আরও করি আরও করি! স্রষ্টার যেরূপ অসীম, স্রষ্টার শক্তি যেমন সীমাহীন, স্রষ্টার যেমন শুরু অথবা শেষ নেই, ভালোবাসা স্রষ্টারই সেই রূপটি। ভালোবাসা মানবের মাঝে অতিমানবীয় শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটায়। ভালোবাসা বিশ্বস্রষ্টারই প্রতিকৃতি আর ভালোবাসার প্রকৃতিই হচ্ছে স্রষ্টার প্রকৃতি। ভালোবাসা অসীম, কেননা স্রষ্টা অসীম। যদি আমাদের স্রষ্টার শক্তি সসীম হতো, তবে আমাদের প্রকৃতি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সব কিছু এতদিনে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু স্রষ্টার ক্ষমতা সীমাহীন বিধায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সীমানাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি আমরা আমাদের শক্তিকে স্রষ্টার সাথে যুক্ত করি অথবা যদি আমরা আমাদের শক্তিকে স্রষ্টার থেকে আলাদা করে দেখি, তা সত্ত্বেও স্রষ্টার শক্তি কোনও অংশে কিছু পরিমাণেও পরিবর্তিত হবে না। আমরা যদি স্রষ্টাকে না-ও মানি, অথবা যদি আমরা স্রষ্টার শক্তি নিয়ে সন্দেহ করি, তা সত্ত্বেও স্রষ্টা, স্রষ্টাই থেকে যাবেন। সৃষ্টির শুরু থেকে স্রষ্টা যেমন ছিলেন, সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্তও স্রষ্টা তেমনই থেকে যাবেন। স্রষ্টা যা, স্রষ্টা তা-ই। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই। ভালোবাসা সৃষ্টির শুরুতেও যেমন ছিল, সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্তও তেমনই থেকে যাবে। আমরা ভালোবাসাকে গ্রহণ করি অথবা না করি, এটি সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্তও আমাদের হৃদয়ে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যাবেই। যদি আমরা একে হাজারো বারও ব্যবহার করি, তা সত্ত্বেও এর কোনও ক্ষয় নেই, কমতি নেই। আমাদের হৃয়ের সাথে সংযুক্ত কোনও কিছুরই কোনও পরিসমাপ্তি নেই। আমাদের শরীর, মস্তিষ্ক এসবের মৃত্যু আছে, কিন্তু হৃদয়ের কোনও মৃত্যু নেই। যে ভালোবাসায় ধীরে ধীরে ক্লান্তি এসে যায়, সেটি প্রকৃত ভালোবাসা নয়, সেটি কেবল শারীরিক চাহিদা। আর শারীরিক চাহিদা কেবল শরীরের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছামাত্রই শেষ হয়ে যায়। যে পথে বিশ্রাম আছে, সে পথের শেষও আছে। ভালোবাসার পথের কোনও বিশ্রাম নেই, এটি অসীমের পথে এক গন্তব্যহীন নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা। দাতা এবং গ্রহীতার মাঝে ভালোবাসা একটি অদৃশ্য সেতু, যা বাইরে থেকে দেখা যায় না, কিন্তু ভেতরে ঠিকই যাতায়াত চলতে থাকে। ভালোবাসার শুরুতে দুজন মানুষের মাঝে ভালোবাসা আদান-প্রদান হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি ওই দুজন মানুষকে ছাপিয়ে শুধু ভালোবাসায় পরিণত হয়। তখন দাতা মনে করেন যে তিনি রিক্ত-শূন্য হয়ে গেছেন, আবার গ্রহীতারও মনে হয় তিনি রিক্ত-শূন্য, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, তাদের মাঝে আর দাতা, গ্রহীতা বলেই কিছু থাকে না! সেখানে কেবল ভালোবাসা থেকে যায়। ভালোবাসা আসলে নিজেই দুজন মানুষকে ভালোবাসায় পরিণত করে। ফলে, সেখানে ভালোবাসা নিজে, দাতা, গ্রহীতা---এই তিন মিলে এক সত্তায় পরিণত হয়, যার নাম ভালোবাসা-সত্তা, আর কিছুই নয়। এই তিনকে আলাদা করা সম্ভব নয়, কেননা এদের মধ্য থেকে একটি সরে গেলে তিনটিই একই সাথে বিনষ্ট হয়ে যায়। ঠিক তেমনি করেই আমরা যখন গভীর ভালোবাসায় স্রষ্টার কাছে নত হই, তখন স্রষ্টা আর তাঁর সৃষ্টির মাঝে কেবলই ভালোবাসা থেকে যায়। প্রতিফোঁটা জলবিন্দু, যেটি সাগরের সাথে মিশে যায়, তা সত্ত্বেও বিন্দু নিজে বিন্দু হিসেবেই থাকে, সে কখনও সাগর হয় না, ঠিক তেমনি সাগরও কখনও একটি বিন্দুতে পরিণত হয় না, সবশেষেও এটি সাগরই থেকে যায়। এই বিন্দু আর সাগরের মাঝের দূরত্বটিই হচ্ছে ভালোবাসা। এই জলবিন্দু আর সাগরের মাঝে ভালোবাসাই এদেরকে একে অপরের কাছে টেনে আনে। যখন এই দুটির মাঝে মিল হয়, তখন না এটি জলবিন্দু, না সাগর। তখন এটি এক সীমাহীন ভালোবাসা, যা সাগরের সাথে জলবিন্দুকে সব সময় এক করেই রাখে। যখন এক বিন্দু জল সাগরের সাথে মিশে যায়, তখন কি আর সেই বিন্দুটিকে আলাদা করা যায়? অথবা সেই বিন্দুর থেকে সাগরকে? যখন দুজন মানুষ ভালোবাসায় এক হয়ে যায় তখন তাদের কাউকেই আর আলাদা করা যায় না। তাদের মাঝে কোনও পার্থক্য থাকে না। উননব্বই। স্রষ্টা আর সৃষ্টিও এরূপ। যখন আমরা ভালোবাসি, তখন আমরা কিছুই কি হারাই? আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে যেমন করে পাই, ঠিক তেমনি করে নিজেকেও পাই এবং সেই সাথে ভালোবাসাকে পাই। এ এক আশ্চর্য আবিষ্কার! এ এক আশ্চর্য যাত্রা! ভালোবাসলে একসাথে দুটি বিষয় ঘটে---এক, আমরা সব হারিয়ে শূন্য হয়ে যাই; দুই, আমরা সব পেয়ে শূন্য হই। ভালোবাসায় মাঝামাঝি কিছু হয় না। এটি আমাদেরকে সব সময় সর্বোচ্চ দেওয়ার অথবা সর্বোচ্চ হারাবার অনুভূতিটি এনে দেয়। অথচ সবশেষে ভালোবাসার প্রাপ্তি কখনওই শূন্য হয় না, এর সবটাই আমাদের মাঝে থেকে যায়। এ এক আশ্চর্য জাদু! ভালোবাসায় সর্বোচ্চ দানেও অলৌকিকভাবে নিজের ঝুলিটি আগের চাইতে আরও অধিক পূর্ণ হয়ে থাকে, যাতে আমরা পুনরায় নিজেদের শূন্য করে নিতে পারি। যে ভালোবাসার সূচনাই আমাদের হৃদয়ে, সে ভালোবাসাকে কী করে আমরা নিজের হৃদয়কে দূরে সরিয়ে রেখে কিংবা কখনওই নিজের হৃদয়কে না জগিয়ে অন্ধের মতো ধর্মগ্রন্থে বা ধর্মালয়ে খুঁজে ফিরি? আমাদের হৃদয় আমাদের সবচাইতে বড়ো ধর্মালয়, আমাদের হৃদয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ, যদি আমরা একে সঠিকভাবে পড়তে জানি। একজন পবিত্র ও শুদ্ধ হৃদয়ের মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তি। আমরা যদি নিজেরা নিজেদের ভেতরে ঢুকতে না জানি, তাহলে এমনকি আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পক্ষেও আমাদের নিজেদেরকে চেনানো সম্ভব হবে না। আমাদের নিজেদের ভালোবাসার দরজা নিজ চেষ্টায় নিজেদেরকেই খুলতে হবে। কেননা আমরা দীর্ঘসময় ধরে এটিকে বন্ধ রেখেছি, যার ফলে এর উপরে আবর্জনার পুরু প্রলেপ জমে গেছে। আমাদেরকে ধীরে ধীরে ধৈর্যের সাথে সেই ময়লাগুলো পরিষ্কার করে যেতে হবে। তারপর এমন একদিন আসবে, যেদিন আমাদের হৃদয়ের সকল ময়লা পরিষ্কার হয়ে ভালোবাসার দরজা খুলে যাবে। ঠিক সেই দিন আমরা আমাদের প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ পাবো। মনের সে গভীর এক ঘরের সন্ধান পাবো, যা আমাদের মাঝে এতকাল ধরে বিশাল এক শূন্যতার অনুভূতি দিয়ে এসেছে। যত দিন পর্যন্ত না আমরা নিজেরা নিজেদের হৃদয়ের দরজা খুলতে পারছি, তত দিন পর্যন্ত আমরা জানতেই পারব না, ভালোবাসা আসলে কী। ভালোবাসাকে পেতে হলে, ভালোবাসাকে জানতে হলে আগে নিজের ভেতরের সেই ভালোবাসাকে খুঁজে বার করতে হবে। এই কাজটি যে করতে পারে না, তার কোনও প্রার্থনাই কাজে লাগবে না। ইবাদতের প্রথম শর্তই হচ্ছে, নিজের হৃদয়কে জাগ্রত করা। আমাদের শিক্ষক কেবল আমাদের মাঝে ভালোবাসাকে খুঁজে পাবার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেবার কাজটি করতে পারেন, নয়তো কেবলই ঠেলে ঠেলে আমাদেরকে আমাদের ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করতে পারেন, কিন্তু আমরা নিজেরা যদি চেষ্টা না করি অথবা আমারা নিজেরা যদি নিজেদের ভেতরের দিকে মনোযোগ না দিই, তবে কোনও দিনই আমরা এর খোঁজ পাবো না। নিজেদের মাঝে ভালোবাসাকে খুঁজে পাবার একটি প্রধান মাধ্যম হচ্ছে, নিজের স্বরূপ নিজের হৃদয়ের সামনে তুলে ধরা, নিজের বিবেকের কাছে সম্পূর্ণরূপে সৎ হওয়া। যতক্ষণ না আমরা নিজেদের কাছেই নিজেকে মেলে ধরছি, নিজেকে পুরোপুরি চিনতে না পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ভালোবাসাকে জানা সম্ভব নয়, কেননা নিজেকে নিজের কাছে খোলাসা করার অর্থই হচ্ছে, নিজ হৃদয়ের দরজা খুলে যাওয়া। যদি আমরা আমাদের হৃদয়ের দরজাটাই না খুলতে পারি, তবে কী করে এর ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব? আমরা সব সময় পাগলের মতো এদিক সেদিক স্রষ্টাকে খুঁজে ফিরি, এমনকি আমরা এ-ও বলি, আদৌ স্রষ্টা আছে তো? আমরা সব সময় স্রষ্টার অস্বিত্বের প্রমাণ খুঁজি। যখন আমরা এমন করি অথবা যখন আমাদের মাঝে এমন ভাবনার উদয় হয়, তখন আমরা নিজেরাই জানি না যে আসলে আমরা কী যে আবোলতাবোল বলছি! কেননা স্রষ্টাকে খুঁজে পাবার কেবল একটি মাত্র পথই রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে, নিজেকে হারিয়ে ফেলা। নিজেকে হারিয়ে ফেলে একেবারে শূন্য থেকে ধাপে ধাপে নিজের হৃদয়কে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে। ঠিক যেমন করে আমরা আমাদের ভালোবাসাকে পেতে নিজেকে হারাই, সম্পূর্ণরূপে শূন্য হয়ে যাই, তেমনি স্রষ্টাকে পেতে গেলেও আমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত হতে হবে, স্রষ্টার সামনে ভালোবাসায় নত হতে হবে। আমরা যদি নিজেকে অপরিবর্তিত রেখে স্রষ্টাকে খুঁজতে যাই, তবে আমরা কখনওই স্রষ্টার দেখা পাবো না। স্রষ্টার অস্বিত্বের খোঁজ পেতে চাইলে আমাদের আগে নিজেদের সমস্ত পরিচিতিকে হারাতে দিতে হবে। আমরা স্রষ্টার খোঁজ করছি, এর মানেই হলো, এই মুহূর্তে স্রষ্টার খোঁজ আমাদের কাছে নেই। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, এই মুহূর্তে আমরা যেমন আছি, তেমন একটি সত্তায় থেকে গেলে স্রষ্টা আমাদের কাছ থেকে দূরেই থেকে যাবেন। ফলে ভিন্ন একটি প্রয়োজনীয় সত্তায় নিজেদের রূপান্তরিত করতে চাইলে বর্তমান সত্তাকে ভেঙে ফেলতে হবে পুরোপুরিই। এক্ষেত্রে নিজের সমস্ত গোঁয়ার্তুমি, যুক্তি, অভিজ্ঞতা, ইগো ইত্যাদির বাইরে এসে কাজটা করতে হবে। যখন আমরা সম্পূর্ণ ভাবে নিজের কাছে অচেনা হয়ে যাবো, যখন আমাদের নিজের বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না, তখনই স্বয়ং স্রষ্টা আমাদের মাঝে প্রকট হয়ে দেখা দেবেন। কোনও বর্ণমালাই আমাদেরকে স্রষ্টার খোঁজ দিতে পারবে না, যদি না আমরা নিজেরা স্রষ্টা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করি। কোনও বই আমাদেরকে স্রষ্টার অনুভূতি দিতে পারবে না, যদি না আমরা নিজেদের হৃদয়কে সেই অনুভূতির জন্য তৈরি না করি। গাছের বৃদ্ধির জন্য যেমন জল, আলো বাতাস অপরিহার্য, তেমনি স্রষ্টাকে পেতে চাইলে আমাদের অতীত হৃদয় বা আমাদের অস্তিত্বের সমাধি প্রয়োজন। ভালোবাসা কয়েক খণ্ড মেঘ হয়ে আমাদের মাথার উপরে ঝুলে আছে, আর যখনই আমাদের হৃদয়ের দরজা খুলে যাবে, তখনই ভালোবাসা বৃষ্টির মতো আমাদের মাঝে বর্ষিত হবে। উত্তাপ যেমন আগুনের প্রকৃতি, সৌন্দর্য যেমন ফুলের প্রকৃতি, তেমনি ভালোবাসার আমাদের হৃদয়ের প্রকৃতি, স্রষ্টা আমাদের সমগ্র অস্তিত্বের প্রকৃতি। এটিকে কোনওভাবেই নিজের থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। ভালোবাসাকে দেখতে হলে, একে উপলব্ধি করতে হলে একে আমাদের হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে হবে, কিন্তু আমরা আমাদের হৃদয়ের চোখ অন্য দিকে সরিয়ে রেখেছি, যার ফলে আমরা ভালোবাসাকে দেখতে পাই না। এর আর-একটি বড়ো কারণ, আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের চৈতন্যকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। ভালোবাসা সব সময় আমাদের চারপাশেই থাকে, কিন্তু আমরা একে দেখি না। আর যখন ভালোবাসা আমাদের মনের দরজায় কড়া নাড়ে, আমরা তখন ঘুমিয়ে থাকি; আমরা ভাবি, বোধহয় আমরা স্বপ্ন দেখছি; ভালোবাসা আমাদের বারে বারে ডাক দিয়ে যায়, অথচ আমরা সাড়াই দিই না…একটা সময় এটি নিজেই চলে যায়। আমরা ঘুম থেকে জেগে দেখি, সত্যিই ভালোবাসা আমাদের দরজায় কড়া নেড়ে গেছে, আমরা টেরই পেলাম না। তখন ঘুমকে মনে হয় মৃত্যুর সমান। নব্বই। ভালোবাসা আমাদের দরজায় তার পদচিহ্ন রেখে যায়, আর আমরা যখন টের পাই যে ভালোবাসা এসেছিল, তখন খুব দেরি হয়ে যায়, কেননা ততক্ষণে ভালোবাসা আমাদের থেকে চলে গেছে। এর সবই ঘটে আমাদের ভগ্নবিশ্বাসের ফলে। আমরা ভাবি, ভালোবাসা বলে কিছু নেই, আর যখন এটি এসেও চলে যায়, তখন আমরা হায় হায় করতে থাকি। স্রষ্টা যেমন আমাদের চারপাশে, আমাদের হৃদয়ে সর্বত্র বিদ্যমান, তেমনি ভালোবাসাও আমাদের সর্বত্র বিদ্যমান। আমরা যেন কখনও ভালোবাসায় বিশ্বাস না হারাই, আমরা যেন কখনও স্রষ্টায় বিশ্বাস না হারাই, আমরা যেন পরম ভালোবাসায় ধৈর্যের সাথে স্রষ্টার জন্যে, ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করি, কেননা যখন সময় হবে, তখন স্বয়ং স্রষ্টা আমাদের দ্বারে আসবেন, স্বয়ং ভালোবাসা আমাদের কাছে আসবে, তখন আমরা যেন ঘুমিয়ে না থাকি, আমরা যেন ভালোবাসা আমাদের দ্বারে আসামাত্রই তাকে গ্রহণ করতে পারি। এ এক অদ্ভুত তরঙ্গের মতো, যা ঠিক সময়ে, ঠিক উপায়ে, ঠিক হৃদয়ে গ্রহণ করতে না পারলে অন্য কারও কাছে চলে যায়, যে এটিকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। ভালোবাসা একফালি মেঘ হয়ে সব সময় আমাদের মাথার উপরে ঘুরতে থাকে এবং যখন সেই মেঘকণা জমতে জমতে ঘনীভূত হয় যখনই, তখন তা একপশলা বৃষ্টি হয়ে আমাদের হৃদয়কে ভিজিয়ে শান্ত করে দিয়ে যায়, যেন আমরা যুগ যুগ ধরে তৃষ্ণার্ত ছিলাম, কখনও আমাদের তৃষ্ণা মেটেনি। আমাদের হৃদয়টা নিজের একটা সম্পূর্ণ প্রকৃতির অনুরূপ। এটি বর্বর, আগাছায় পূর্ণ। এটি অসভ্য, এটি একটি জঙ্গলের মতোই আদিম। আমরা আমাদের সমাজের সাথে আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ঘষামাজা করে নিলেও এই হৃদয়টিকে কখনও ঘষামাজা করা যায় না। আমাদের কারও পক্ষেই এই হৃদয়টিকে ঘষামাজা করা সম্ভব নয়, কোনও মানুষের পক্ষেই এটি সম্ভব নয়। আমাদের হৃদয়ে কেবল স্রষ্টার বসবাস, আর কেবল স্রষ্টাই পারেন এটিকে সঠিক পন্থায় রূপান্তর করতে। আমরা যত বেশি নিজেদের থেকে দূরে সরে যাই, ততই আমাদের মনের এই জঙ্গলটি নিষ্প্রাণ আর শুকনো হতে থাকে। কিন্তু আমরা যদি এতে নিয়মিত ভালোবাসার চাষ করি, তবে আমাদের হৃদয়ের বনভূমি ক্রমেই সবুজ সতেজ আর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা যদি আমাদের শেষবিদায়ের দিনটিকে আজই কল্পনা করতে পারি, তবে আমরা দেখব, আমরা আমাদের জীবনকে কতটা অযথা কাজে অপচয় করেছি, প্রতিনিয়তই একটা ভ্রমের মধ্যে কাটিয়ে গিয়েছি কেবল। আমাদের প্রার্থনায়, আমাদের ভালোবাসায় স্রষ্টা বাস করেন। আমরা যত বেশি স্রষ্টার নাম করি, তথা যত বেশি স্রষ্টার কাছে সমর্পিত হই, ভালোবাসা ততই আমাদেরকে চারপাশ থেকে জড়িয়ে রাখে। একটা শান্ত সমাহিত আবহ সর্বদাই আমাদের মাঝে বিরাজ করে। যখন আমরা নতশিরে থাকি, কেবল তখনই স্রষ্টাকে আমাদের চারপাশে দেখতে পাই। আমরা প্রায় কেউই আমাদের শেষদিনটিকে দেখতে ভা ভাবতে চাই না। আমাদের মনে হতে থাকে, আরও অনেক দেরি, আমাদের মনে হয়, আমরা অনেক সময় নিয়ে থেকে যেতে পৃথিবীতে এসেছি। তারপর হঠাৎ একদিন মৃত্যু আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে, আর আমরা সেদিন দেখতে পাই, অনেক দেরি হয়ে গেছে! আমরা হৃদয়ের দরজা খুলে পেছন ফিরে দেখি, স্রষ্টা কত শত বার আমাদের দরজায় এসেছেন, আমরা আমাদের দরজায় স্রষ্টার পদচিহ্ন দেখতে পাই, কিন্তু হায়, ততদিনে যে খুব দেরি হয়ে গেছে, সেইদিন আর আমাদের পেছনে ফিরে যাবার সময় কই! সেদিন মৃত্যুকে হঠাৎ আমাদের দ্বারে দেখে আমরা ভাবি, ইস্, আর-একটু সময় যদি পেতাম, তবে জীবনের যে সময়গুলো অযথা অপচয় করে কাটিয়ে এসেছি, সে সময়টুকু কাজে লাগাতে পারতাম। জীবন আমাদের অনেক সুযোগ দেয় কিন্তু আমরা হেলায় সব সুযোগ হাত থেকে চলে যেতে দিই। আসলে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই না। এর কারণ কী? এর কারণ এটাই যে মৃত্যু কী, তা আমরা জানি না, অথবা আজ পর্যন্ত সে সকল মানুষ মরে গেছে, তারা কেউই আর ফিরে আসেনি। ফলে আমরা জানতেও পারিনি মৃত্যুর পর বলে কিছু আছে কি না, মৃত্যুর অনুভূতি কেমন হয়, কিংবা মৃত্যুর দিকে যাত্রাটা আসলেই কী! মানুষ যে বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ, তা যতই মধুর অথবা ভয়ানকই হোক না কেন, তা নিয়ে মানুষ ভয় পায় না। যখন মৃত্যু আমাদের মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়, ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা জানতে পারি মৃত্যু কী, কিন্তু সেই মুহূর্তে জেনেও-বা কী হবে, আমরা কি আর ফিরে আসার সুযোগ পাবো সেদিন? আবার আমরা স্রষ্টাকে উপলব্ধি করার সুযোগ কি পাবো? সেদিন আমরা জানতে পারব, ঠিক কতটা অসফল জীবন আমরা এতকাল কাটিয়ে এসেছি। স্রষ্টা, ধার্মিকতা, জীবনের পরমসত্য, ভালোবাসা এইসব কিছুকে যারা নিজেদের জীবনে মেনে নিয়েছিল এতদিন, কেবল তারাই মৃত্যুকে খুশির সাথে আলিঙ্গন করে। কোথায় আমাদের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে, কোথায় কোন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আমাদের মন স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে, আমাদের সব সময় সে পথের খোঁজ করে যেতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকার সময়টুকু কোনওভাবেই যেন অহেতুক অনর্থক কাজের পিছে অপচয় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা মৃত্যু সব সময় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, আর যখনই এটি আমাদের ছুঁয়ে ফেলবে, তখন আর আমাদের সময় থাকবে না পেছনে ফিরে যাবার। মৃত্যু কাউকে সময় দেয় না, মৃত্যু হঠাৎ এক বিদ্যুৎ-ঝলকানির মতো আসে, আর আমাদের দেহ থেকে প্রাণকে আলাদা করে নিয়ে চলে যায়। আমাদেরকে সব সময় হৃদয়ের স্পন্দন খুঁজে যেতে হবে। যতক্ষণ না আমরা এক পুরোপুরি আমাদের আয়ত্বে আনতে না পারি, ততক্ষণই আমাদের সে খোঁজটা করেই যেতে হবে। আমরা যখন ভালোবাসায় স্রষ্টার প্রতি নত হই, তাঁর নামের মাঝে এক প্রশান্তি খুঁজে পাই, তখনই আমরা বুঝতে পারব, আমরা সঠিক পথে এগুচ্ছি, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমাদেরকে তোতাপাখির মতো সারাদিন স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করে যেতে হবে। আমরা যখন প্রকৃতই স্রষ্টাকে ভালোবাসব, স্রষ্টার ভালোবাসাকে নিজেদের মাঝে উপলব্ধি করতে পারব, তখন স্রষ্টার নামের মাঝে এক প্রশান্তি খুঁজে পাবো, যা আমাদের ভালোবাসায় আরও উন্নত করে তুলবে। স্রষ্টার নামের মাঝে ভালোবাসায় সিক্ত হলে সে অনুভূতি আমাদের হৃদয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে, ঠিক যেমন করে বৃষ্টি এসে প্রকৃতিকে ধুয়ে দিয়ে যায়, তেমনি স্রষ্টার নাম আমাদের হৃদয়কে প্রকৃতির মতো আরও পরিষ্কার, সজীব এবং সতেজ করে তোলে। যদি আমরা আমাদের মনে আমাদের হৃদয়ে স্রষ্টাকে ধারণ করে না পারি, যদি ভালোবাসার সেই পরম অনুভূতি আমাদের হৃদয়কে স্পন্দিত না করে, তবে স্রষ্টার নাম যদি আমরা সারাক্ষণ মুখে কেবল উচ্চারণই করে যাই, অথবা যদি আমরা আমাদের ঘরের প্রতিটি দেয়ালেও স্রষ্টার নাম লিখে রাখি, এমনকি সারাক্ষণই অন্যদের শুনিয়ে স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করে যেতে থাকি, তা সত্ত্বেও সেই ভালোবাসার পরম অনুভূতি আমাদের হৃদয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটাবে না। স্রষ্টাকে যে যত বেশি অনুভব করতে পারে, সে তত বেশি নীরব হয়ে থাকে। স্রষ্টা যার মুখে যত বেশি, স্রষ্টা তার হৃদয়ে তত কম। স্রষ্টাকে কিংবা তাঁর প্রতি ভালোবাসাকে প্রথমে হৃদয়ে উপলব্ধি করতে হয়, তারপর যখন এটি বাইরে আসে তখন এর এক আলো আমাদের চারপাশে ছড়াতে থাকে, যা সেই অনুভূতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যা লোকে আপনাআপনিই বুঝতে পারে, মুখে বলে বেড়াতে হয় না। ভালোবাসা আমাদের হৃদয়কে পরিষ্কার করে, স্রষ্টার অনুভূতি আমাদের হৃদয় থেকে শুরু হয়ে আমাদের চারপাশে ছড়াতে থাকে, এর বাইরে এই মহান অনুভবকে কখনও, কোনওভাবেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আর যে হৃদয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সে হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই স্রষ্টার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। একানব্বই। আমরা অনেকেই উচ্চস্বরে স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করে করে অন্যদেরকে, স্রষ্টার প্রতি আমাদের ভালোবাসার পরিমাণ কতটা, সেটি দেখাতে চাই। আবার এরূপ ভালোবাসা প্রচারকারীকে আমরা অনেকে আবার বাহবাও জানাই, তাকে আরও বেশি করে কাজটি করে যেতে প্রলুব্ধ করে যেতে থাকি এমনভাবে, যেন স্রষ্টা এত সস্তা কিছু, যার নাম একশতবার উচ্চারণে আমরা হাজার পয়সা, হাজার পুণ্য বেশি পাবো! কিন্তু এটি কখনও সঠিক পথ নয়। অন্যদের দেখিয়ে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার জাহির-করা হয়তো অন্যদের চোখে আমাদের কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি করতে সহায়তা করতে পারে কিংবা খুব বেশি হলে আমরা কিছুটা করুণা, নয়তো অন্যের কাছে আমি একজন ভালো অথবা সৎমানুষ, এটুকুই প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু অন্যের আমাদের প্রতি এমন ধারণায় আদৌ কি স্রষ্টার কিছু এসে যায়? আমরা আমাদের হৃদয়ে কী ধারণ করি, তা সে কেবল আমরাই জানি। আমাদের হৃদয় বা আমাদের স্রষ্টাই জানেন, আমরা কতটা সত্যি সত্যিই তাঁর ভালোবাসায়, ভালোবাসার প্রকৃত আলোয় সমুজ্জ্বল হতে পেরেছি। আমরা যদি ভালোবাসায় সিক্ত হই, স্রষ্টার কাছে সমর্পিত হই, তখন আমরা যদি আমাদের আশেপাশের কাউকে সেটি না-ও বুঝতে দিই, অথবা লুকিয়েও রাখার চেষ্টা করে যাই, তা সত্ত্বেও আমরা সে আলোকে ঢেকে রাখতে পারব না, আমাদের চলার প্রতিটি পদক্ষেপে এটি আমাদের আশেপাশে সর্বত্র আলো ছড়িয়ে যাবে। আমরা তখনই আমাদের চারপাশের সবাইকে, সব কিছুকে ভালোবাসতে পারব, যখন স্রষ্টার অফুরন্ত ভালোবাসা আমাদের ভেতরে আন্দোলিত হবে, আমাদের হৃদয়ে সে ভালোবাসা উপচে পড়বে। নিজেকে উজাড় করে দুহাত ভরে দেওয়া তার পক্ষেই দেওয়া সম্ভব, যার নিজের কাছেই অঢেল আছে। ভালোবাসায় যে মানুষের হৃদয় উপচে পড়েছে, তার পক্ষে কখনও সেটি চারপাশে না বিলিয়ে শান্ত থাকা সম্ভব নয়, তাকে তার নিজের প্রয়োজনেই পুনরায় শূন্য হয়ে যেতে হয়, আর সেই শূন্যতা থেকে আরও অধিক প্রাপ্তি ঘটে। একজন ভালোবাসাশূন্য, স্রষ্টাশূন্য মানুষ ভালোবাসাকে বিলোতে পারে না। ভালোবাসাকে ছড়াতে চাইলে প্রথমে নিজের মাঝে তার নিজের প্রয়োজনের অধিক থাকতে হয়। আর আমরা নিজেরাই যদি শূন্য হয়ে থাকি, তবে আমরা কী করে অন্যদের বিলোব? আমরা নিজেরাই চরম শূন্যতায় পর্যবসিত ফলে আমরা আর কাউকে ভালোবাসা বিলোবার কথা কল্পনাতেও আনতে পারি না। আমরা ভিক্ষুকের মতো ভালোবাসা খুঁজে ফিরি, আমাদের রুক্ষ হৃদয় ভালোবাসার তৃষ্ণায় মৃতপ্রায়। আমরা সারাক্ষণই একচিলতে ভালোবাসার খোঁজে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরি। যখন আমাদের কেউ একচিলতে ভালোবাসা ভিক্ষা দেয়, যখন আমাদের দিকে কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়, তখন আমরা ভাবি আমার ঘরে আজ চাঁদের আলো, আমার উঠোনে একচিলতে রোদ, আমার ঘরে আনন্দের ফোয়ারা বইছে যেন! আর যখন সেই একচিলতে ভালোবাসার রেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার শেষ হয়ে যায়, আমরা আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসি, আমরা আবার আমাদের ভিক্ষার থলি নিয়ে একটু ভালোবাসার খোঁজে অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াই। কখনওবা, আমরা অর্থের বিনিময়ে একটুকরো হাসি কিনতে চাই, সেই একটুকরো হাসিই তখন আমাদের জীবন হয়ে ওঠে। কিন্তু এই হাসিও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এভাবেই আমরা একে অপরের কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা করেই বেঁচে আছি। কিন্তু আদৌ কি আমরা কাউকে ভালোবাসা দেবার যোগ্যতা রাখি? না, রাখি না। কেননা আমাদের আসলে কিছুই দেবার ক্ষমতা নেই। আমরা কেবলই একে অন্যকে আশাই বিলিয়ে আসছি, এর বেশি আমাদের আর কিছুই করার নেই। আমরা সকলেই ভিক্ষুক, আমরা সকলেই একে অন্যের দ্বারে ভালোবাসার ভিক্ষা করে ফিরি। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসা দিই, তখন আমরা মনে মনে নিজেকে রাজা মনে করি, অথচ নিজের রাজত্ব চালাবার দায়েও আমরা সেই অন্য কারও দ্বারে ভিক্ষাই করে ফিরি! আমরা স্বীকার করি অথবা না করি, এটিই বাস্তব। কেবল স্রষ্টার পক্ষেই ভালোবাসা দেওয়া সম্ভব, ভালোবাসাপ্রাপ্তি মানেই স্রষ্টাকে প্রাপ্তি। আমরা কাউকে ভালোবাসি, কেননা তার কাছ থেকে না হলে, অন্যত্র থেকে হলেও আমরা মনে মনে সেই ভালোবাসার আশা করে বসে থাকি। আমরা তার দ্বিগুণ পাবার লোভে, অন্যের চাইতে আরও কিছুটা ভালো থাকবার লোভ থেকেই নিজেদেরকে বিলিয়ে শূন্য করতে চাই। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে ভেবে দেখি, তবে আমরা দেখতে পাবো যে আমরা সকলেই আসলে একে অন্যের দুয়ারে কেবল হাত পেতে যাচ্ছি, আমরা সকলেই আসলে ভিক্ষুক। আমরা আমাদের কাছের মানুষ, আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর দিকে তাকাই আর ভাবি, সে হয়তো ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। কিন্তু যখনই আমরা একে অন্যের থলির দিকে তাকাই, তার থলিটি তার কাছ থেকে কেড়ে নেবার ফন্দি করতে থাকি, তখনই আমরা দেখি, সেও আমার মতোই শূন্যহাতে বসে আছে, যে থলিটি আমি বা আমরা এতদিন পূর্ণ ভেবেছিলাম, সেটিও আসলে আমাদেরটির মতোই শূন্য। আমরা একে অপরকে ভালোবাসা দেবার কথা দিই, আমরা একে অপরের দুঃখ মুছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা একে অপরের থেকে ভালোবাসাই ভিক্ষা করি, কেননা আমরা উভয়েই শূন্য। না আমাদের ভালোবাসা দেবার ক্ষমতা আছে, না আমাদেরকে অন্যের ভালোবাসা দেবার ক্ষমতা আছে, আমরা সকলেই তো শূন্যহাতে ওই উপরের দিকেই চেয়ে আছি, আমরা সকলেই আসলে ভিক্ষুক। অনেক সময় আমাদের ভালোবাসার মানুষের একচিলতে হাসিই আমাদের ভালো রাখে, আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষকে হাসতে শেখাই, যেন সে আরও বেশি করে হাসতে পারে, কেননা তার ঠোঁটের হাসিই আমাদের জীবনের বেঁচে থাকার আনন্দ এনে দেয়। এক্ষেত্রে তাকে সুখে রাখার পেছনে আমাদের নিজেদেরও একধরনের স্বার্থ জড়িত। কিন্তু কিছুদিন বাদেই সে তার হাসির পেছনের রহস্য বুঝে ফেলে, তারপর সে তার হাসির পরিমাণ কমিয়ে দেয়; এরপর থেকে সে তখনই হাসে, যখন তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে থেকে তার কিছুর প্রয়োজন পরে, কিন্তু সেই হাসিটি তখন আর আগের মতো নির্মল, বিশুদ্ধ হাসি নয়, সেটি তত দিনে এক বিনিময়ের হাসিতে পরিণত হয়ে গেছে। আসলে আমাদের ভালোবাসার মানুষটি তত দিনে হাসির শক্তিকে কাজে লাগাতে শিখে যায়। সে তখন কেবল দেখাবার জন্যেই হাসে। কিন্তু সেই দেখাবার পেছনেও কোনও-না-কোনও উদ্দেশ্য থাকে। হয়তো সে তার ভালোবাসার মানুষটির মুখেও একটুকরো হাসি দেখতে চায়। যদি তার হাসিতে তার ভালোবাসার মানুষটি না হাসত, তবে সে নিজেও আর হাসত না। আমাদের প্রত্যেকেরই যে-কোনও কাজের পেছনে কোনও-না-কোনও একটা উদ্দেশ্য থাকে, কখনও সেটি বস্তুগত সুখের আশায়, কখনওবা মানসিক প্রশান্তির লাভের আশায় করে থাকি, তবে সব কিছুই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে চলে। উদ্দেশ্যই আমাদের দিয়ে সেই কাজটি করিয়ে নেয়। যদি আমাদের কোনও প্রাপ্তিই না থাকে, তবে আমরা সেদিকে আর এগোই না। ভালোবাসা মানুষকে নির্বাক, নিস্তব্ধ করে দেয়। যখন আমরা প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ নিই, তখন আমাদের চোখে মুখে সর্বদা এক তৃপ্তির ছায়া থাকে, যা কখনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ি, তখন আমরা কেবলই ভালোবাসার সেই স্বাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। এটিই আমাদের হৃদয়ের প্রকৃত ভালোবাসা। একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সাধারণত এমনভাবে ভালোবাসার আলোয় আলোকিত হয়ে থাকেন, যাকে দেখলে আপনাআপনি নিজের ভেতরে অদ্ভুত অনির্বচনীয় এক ভালোলাগা কাজ করতে থাকে। আমরা যখন কোনও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সান্নিধ্যে যাই, তখন প্রথমেই আমাদের তাদের বক্তব্য নিয়ে ভয় হতে থাকে, হয়তো তিনি আমাদের কঠিন কিছু বলে ফেলবেন, হয়তো তিনি সহজ কথাই বলেন, কিন্তু আমাদের কাছে সেগুলো কঠিন, অবোধ্য মনে হতে পারে। আমরা যদি গভীরভাবে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, তবে আমরা দেখব, একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যা বলেন, তিনি তার থেকে ভিন্ন কিছু, যা তিনি কাউকে বলেন না এবং তাঁকে দেখেই আমাদের সেই অনুভূতি, সেই বাক্যগুলোকে বুঝে নিতে হবে, যা তিনি অব্যক্ত রেখে দেন, কেননা প্রকৃত ভালোবাসার অনুভূতি, স্রষ্টার অনুভূতি কখনও কোনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এটি কেবল যার যার প্রজ্ঞা, স্বজ্ঞা বা অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করে নিতে হয়। একজন গুরুর পায়ের কাছে বসে থাকা, একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির পায়ের কাছে বসে থাকার অর্থই হচ্ছে সৎসঙ্গে থাকা। আমরা যদি তাঁকে বুঝতে পারি, তাঁর কথার চেয়ে তাঁর অঙ্গভঙ্গির দিকে অধিক দৃষ্টিপাত করি, তাঁর ভাবালুতার সাথে নিজেকে শামিল করে নিতে পারি, তাঁর শ্বাস নেওয়ার ধরন, তাঁর চোখের নড়ন বা চালচলন রপ্ত করতে পারি, তবে আমরাও সেই পরমানুভূতিগুলো অনুভব করতে পারব। তাঁর কথায় অতিরিক্ত কর্ণপাত না-করে আমাদেরকে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, তবেই আমরা ভালোবাসার অনুসন্ধানের সেই আলোকিত হৃদয়পথে আরও খানিকটা এগিয়ে যেতে পারব।